অপেক্ষা পর্ব (০৭+০৮)

অপেক্ষা পর্ব (০৭+০৮)
লেখিকা: সামিয়া বিনতে হামিদ

০৭।
সকালে ঘুম থেকে উঠতে ইশার দেরী হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলো ভার্সিটির জন্যে। আজকে ভার্সিটির প্রোগ্রামের জন্য অনেক কাজ করতে হবে তাকে। নাস্তা না খেয়েই বেরিয়ে পড়ল সে। এখন সমস্যা হচ্ছে সে কি আদৌ বাস পাবে? অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও সে বাসের দেখা পেল না।এখন লোকালে করে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু ইশার লোকালে চড়ার অভ্যাস নেই। তাও ভার্সিটিতে কাজ আছে বিধায় সে উঠে পড়ল লোকাল বাসে। তার বাসা থেকে ভার্সিটি যেতে দেড় ঘন্টা লাগে। ইশা বাসে উঠে দেখল পেছনে একটি মাত্র সিট খালি ছিল। সে ওই সিটে গিয়ে বসলো। পাশের লোকটিকে তার সুবিধার মনে হচ্ছে না। তাও সে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। লোকটি মনে হয় ইচ্ছে করেই আরো কাছে ঘেঁষে বসছে।

এদিকে রোহানেরও আজকে বাস মিস হয়ে গিয়েছিলো। সেও লোকালে উঠে পড়ে। ভাগ্যক্রমে সেই বাসেই উঠে যে বাসে ইশা উঠেছিলো।
রোহান বাসে উঠে ইশাকে দেখতে পায়। সে পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়, ইশার সিটের পাশে। ইশার পাশে বসা লোকটিকে দেখে রোহান বুঝে যায় লোকটির মতলব ভালো না। ইশা জানালার পাশে বসেছিল। ইশার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। সে মনে মনে ভাবছে নেমে যাবে কিনা। কিন্তু সে রোহানকে খেয়াল করেনি।
কিছুক্ষণ পর লোকটি তার একটি পা ইশার পায়ের উপর রাখে, তখনই ইশা ভয়ে কেঁপে উঠে। ইশার ভীত চেহারা দেখে রোহানের রাগ চরমে উঠে যায়। নিজের রাগ সে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। কারণ সে চাচ্ছে না কোনো গণ্ডগোল হোক। রোহান শান্ত দৃষ্টিতে ইশার উপর নজর রাখছে।
হঠাৎ লোকটি ইশার আরো কাছে ঘেঁষে তার হাত স্পর্শ করলে, রোহান নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে লোকটির কলার ধরে তাকে সিট থেকে উঠিয়ে দেয়।

ইশা রোহানকে দেখে যেন দেহে প্রাণ ফিরে পায়।

রোহান লোকটিকে উদ্দেশ্য করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
রোহান: কি করছিলি তুই? সাহস কি করে হয়, হ্যাঁ? অনেকক্ষন করে দেখছি তোকে।

বাস কন্ডাকটর এগিয়ে এসে বলল,
কন্ডাকটর : কি হইলো ভাই আপনে কি করতাছেন? লোকটার কলার এভাবে ধইরা আছেন কেন?

রোহান: চুপ থাকেন আপনি। বাস থামাতে বলেন। নামান এই অসভ্য লোকটিকে। এসব কোন ধরণের নিয়ম? মেয়েদের সিটে পুরুষদের বসতে কিভাবে দেন আপনারা?

আশেপাশের যাত্রীরা বুঝে গিয়েছে এতোক্ষনে ব্যাপারটি। লোকটিকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেয় সবাই। রোহান দুই চারটা চড়ও মেরেছিল।
রোহানকে বাস কন্ডাকটর শান্ত হয়ে বসতে বলল। বাস আবার চলা শুরু।

রোহান ইশার পাশের সিটেই বসলো কিছুটা দূরত্ব রেখে।

ইশা বলল,
ইশা: ধন্যবাদ।

রোহানের মেজাজ অতিরিক্ত খারাপ ছিল। রোহান খুব কড়া ভাষায় বলল,
রোহান: তোমার মধ্যে কি আক্কেল জ্ঞান নেই? লোকটি তোমাকে বিরক্ত করছিল আর তুমি চুপচাপ বসে ছিলে?

ইশা চুপ করে রইল।

রোহান: অসহ্য যত্তসব। বেশি ভালো লাগছিল মনে হয়?

ইশা অনেক ভয় পেয়েছিল তাই কিছু বলার সাহস পায় নি।
রোহানের কথাটি শুনে ইশার হাত পা অবশ হয়ে গিয়েছে। এসব কথা শুনলে ইশার খুন হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। কেন ভালো লাগবে তার পরপুরুষের স্পর্শ?

মুহিবও একবার ইশাকে বলেছিল এমন কথা, যখন তাকে একটি ছেলে মেসেজ দিয়েছিল, তাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজে। সব কিছুতেই মুহিব সন্দেহ করতো ইশাকে। সন্দেহ এমন পর্যায়ে চলে যায়, সে ইশার চরিত্র নিয়েও কথা বলে।

ইশার এখন ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। প্রতিটি মেয়ের জন্য তার চরিত্র অনেক মূল্যবান সম্পদ। সেই চরিত্রে দাগ না লাগানোর জন্য তারা কতোভাবে নিজেকে গুটিয়ে চলে। কিন্তু কিছু মানুষরূপী পশুরা চিন্তাও করে না কোনো মেয়ের ক্ষতি করার আগে। এর পরিণাম যে মেয়েটির জীবনে কি বয়ে আনতে পারে তা ভাবার সময় যে তাদের নেই!

রোহানের রাগের মাথায় বলা কথাগুলো ইশার বুকে তীরের মতো বিঁধেছে। চুপ করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরে, ছলছল করছে চোখদুটি। গোলা হয়ে আসছে সবকিছু।চোখজোড়া বন্ধ করতেই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েকবিন্দু জল।
কষ্ট পাওয়ার জন্য বিশাল ক্ষতের দরকার হয় না। একটি বাক্যই যথেষ্ট। রোহানের এই একটি বাক্য যেন ইশার পুরোনো ক্ষত আবার তাজা করে দিয়েছে।

অনেকক্ষণ রোহান চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ আগে ঘটা ঘটনাগুলো মনে করছিল। তার বুকে কেমন চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। ইশাকে এভাবে কথাটি বলা উচিত ছিল? মেয়েটি হয়তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলো?
না, তার এভাবে বলা উচিত হয় নি। চোখ খুলে ইশার দিকে তাকিয়ে দেখল মেয়েটি চোখ বন্ধ করে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। চোখজোড়া ভেজা মনে হচ্ছে। মেয়েটি কি কেঁদেছে তাহলে? তার কথায় মেয়েটি আঘাত পেয়েছিল?
সে তো রেগে গেলে যা মুখে আসে বলে ফেলে। সে তার রাগটিকে নিয়ন্ত্রণ করতেই পারেনি। আর কেউ তার প্রিয় মানুষটিকে খারাপ নজরে দেখবে এটি সে চায় না।

রোহান কিছু বলতে যাবে তার আগেই বাস ভার্সিটির সামনে চলে আসে। তারা বাস থেকে নেমে পড়ে। রোহান ইশার সাথে কথা বলতে যাবে তার আগেই ইশা দ্রুত পায়ে চলে যায়।

এদিকে সকাল এগারোটা বেজে গেল, আর রিধি এখনো ঘুমের রাজ্যে আছে।
কাল সারারাত পড়াশুনা করেছে মেয়েটি, তাই তাকে আর ডাকলো না মিসেস নবনী হোসেইন।

আগামীকাল রক্তিম আসবে তাই তিনি বড়োই খুশি। ছেলেটিকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছেন স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে।

রক্তিম দুই বছর আগে যে কারনে গিয়েছিল, এতোদিনে হয়তো সব ঠিক হয়ে গিয়েছে, এটিই ভেবে নেন নবনী।

দুপুর দুইটায় ঘুম ভাঙে রিধির। ঘড়ি দেখে সে লাফিয়ে উঠল। কলেজ টাইম শেষ? ইশ! আজকেও কলেজ মিস গেল।

নবনী হোসেইনের কাছে এসে রিধি বলল,
রিধি: ডেকে দিলে না কেন মা? আজকেও কলেজে যেতে পারলাম না।

নবনী: তুই যাস কবে কলেজে? আর আমাকে বলেছিস যে তোর কলেজ যাওয়া লাগবে? তোকে ডেকে দিলে বলিস, কলেজে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস নেই।

রিধি: আজকে ছিল। আচ্ছা থাক, দিয়া তো যাবেই ওর থেকে তুলে নেবো।

রিধি ফ্রেশ হয়ে দিয়ার বাসায় যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলো। সাদা রঙের একটি জামা পড়েছে কালো সুতার কাজের। সেলোয়ার আর উড়না কালোরঙের। কপালে কালো টিপ দিয়েছে, ঘন করে কাজল লাগিয়েছে, সাথে ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিকও। চুলগুলো খোলা রেখেছে।
দেখতে এমনিতেই সুন্দর, আজকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে।

নবনী রিধিকে সেজে গুজে বাইরে যেতে দেখে বলল,
নবনী: আমার মেয়েটি পরী সেজে কোথায় যাচ্ছে?

রিধি: দিয়ার বাসায় যাচ্ছি।

নবনী: দিয়ার বাসায় এতো সেজে?

রিধি: দিয়ার সাথে ঘুরতে বের হচ্ছি। ওই আমাদের স্কুল ফ্রেন্ড আছে না ঐশী ওর জন্মদিন আজকে। তাই সবাই মিলে আজকে পতেঙ্গা যাবো ভেবেছিলাম। ওর জন্মদিনে ঘুরাও হবে।

নবনী: আচ্ছা মা, সন্ধ্যার আগে চলে এসো।

রিধি: আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ। টা, টা।

রিধি দিয়ার বাসার সামনে এসে দিয়াকে ফোন দেয়।

রিধি: কিরে এতো দেরী কেন করছিস? তাড়াতাড়ি নাম।

দিয়া: বাসায় আয়।

রিধি: না থাক। এতো সময় নেই। তাড়াতাড়ি কর তুই।

এদিকে ইশার ভাই ইফতি, কলেজ থেকে বাসায় ফিরছিল। রিধিকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। রিধিকে সে অনেকবার দেখেছিল দিয়ার সাথে। ভালোই লাগে মেয়েটিকে। খুব সুন্দর মেয়েটি। কিন্তু কথা বলে নি কখনো।

রিধি ইফতিকে দেখে মুখ ভেংচি দিয়ে দিলো। রিধির দিকে কোনো ছেলে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সে এমন ভেংচি মেরে দেয়। ইফতি ভেংচি খেয়ে লজ্জা পেয়ে যায়, আর বাসায় ঢুকে পড়ে।
দিয়া নামলে তারা বেরিয়ে পড়ে।

আগামীকাল আসার কথা ছিল রক্তিম আর জুনাইয়েত সাহেবের কিন্তু তারা আজকেই চলে আসে। বাবা-ছেলে মিলে সারপ্রাইজ দিবে ভেবেছে নবনী হোসেইনকে।

রক্তিম কালো ব্লেজার পড়েছে ভেতরে সাদা শার্ট। চোখে সানগ্লাস দিয়েছে তাই তার চোখদুটি দেখা যাচ্ছে না। তবে রক্তিম এর চোখদুটি সবসময় শান্ত থাকে। মুখে চাপ দাঁড়ি, আর কালো ঘন চুলগুলো খাড়া। দেখতে খুবই সুন্দর ছিল এখন আরো বেশি স্মার্ট লাগছে। রক্তিম অনেক চঞ্চল স্বভাবের ছিল, কিন্তু এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি গম্ভীর হয়ে গিয়েছে।

এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি ভাড়া করে তারা বাসায় পৌঁছাল।
নবনী হোসেইন স্বামী-সন্তানকে দেখে যেন আকাশের চাঁদ পেয়েছেন। দুইবছর পর দেখছেন রক্তিমকে। ভিডিও কলে তো কথা হতো। কিন্তু সন্তানকে ছুঁয়ে দেখা, নিজ হাতে খাইয়ে দেওয়া থেকে তিনি এতো দিন বঞ্চিত হয়ে ছিলেন। আজ তার সব ইচ্ছেই যেন পূর্ণ হলো।

রক্তিমের চোখদুটি রিধিকে খুঁজছে।

জুনাইয়েত সাহেব বললেন,
জুনাইয়েত: আমার রিধি মা কোথায়? দেখছি না কেন? বাবা এসেছে তার।

নবনী: তুমি আসবে তাই তোমার পছন্দের খাবার রান্না শিখেছে। তুমি আসলে তোমাকে রান্না করে খাওয়াবে নাকি। এখন ওই একটু ঘুরতে গেল, তার বান্ধবীদের সাথে। এসে যাবে সন্ধ্যার আগে।

জুনাইয়েত: গিয়েছে কোথায়?

নবনী: পতেঙ্গা।

জুনাইয়েত: তুমি এতোদূর যেতে দিলে মেয়েটিকে? দেশের পরিস্থিতি কতো খারাপ জানো?

নবনী: তুমি চিন্তা করো না। দিয়া আছে তো।

জুনাইয়েত: দিয়া পারবে তোমার মেয়েকে বিপদ থেকে বাঁচাতে??

নবনী: আচ্ছা চলে আসবে। তুমি চিন্তা করো না।

সন্ধ্যা হয়ে গেল। জুনাইয়েত সাহেবের চিন্তা আরো বেড়েছে।

রক্তিম: মা, তোমার রিধিকে যেতে দেওয়া উচিত ছিল না। এখন যদি কিছু হয়ে যায়? কল দিয়ে দেখো, কোথায়।

নবনী: আচ্ছা, দেখছি।

রিধির ফোন বাজছে কিন্তু তার খেয়াল নেই। তারা পতেঙ্গা থেকে চলে এসেছে অনেকক্ষণ হলো। তারা কেক কাটছে এখন একটি রেস্টুরেন্টে। বাসায় ফিরতে বেজে গেল রাত আটটা।

বাসায় বেল দেওয়ার সাথে সাথে নবনী দরজা খুলে দিল।

রিধিকে দেখে বলল,
নবনী: রিধি, কয় ছিলি এতোক্ষন? ফোন দিচ্ছি ধরছিলি না। পরে আবার বন্ধ পায় কেন?

রিধি: সাইলেন্ট ছিল, অনেক ছবি তুলেছিলাম তাই চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছে। সরি, মা।

নবনী: আচ্ছা,হআচ্ছা। কে এসেছে দেখ!

ভেতরে ঢুকে জুনাইয়েত সাহেবকে দেখে।
রিধি: বাবা, তুমি?

জুনাইয়েত: কয় ছিলি মা? কতোক্ষন বাবাকে অপেক্ষা করিয়েছিস!

রিধি: বাবা তুমি না কালকে আসবে, আজকে আসবে জানলে আমি কখনো বের হতাম না।

জুনাইয়েত: আচ্ছা, এখন কেমন আছে আমার মা টা?

রিধি: ভালো ছিল, তোমাকে দেখে আরো বেশি ভালো হয়ে গিয়েছে।

রক্তিম রিধির কন্ঠ শুনে ঘর থেকে বের হলো। রক্তিমকে দেখে রিধি কয়েক মিনিটের জন্য শকড। আর রিধিকে দেখে রক্তিম মনে মনে অনেক খুশি।

রক্তিম ভাবছে,
ছোট মেয়েটি কতো বড়ো হয়েছে, দেখতে আরো সুন্দর লাগছে।
পুরনো প্রেম যেন জেগে উঠেছে রক্তিমের রিধির প্রতি। হ্যাঁ, সে অনেক ভালোবাসে রিধিকে। অনেক বেশিই বাসে। রিধির মায়াবী চেহারা, দুষ্টামিগুলো কবে যে রক্তিমের মনে জায়গা করে নেয় সে নিজেও জানে না। রক্তিম রিধিকে ভালোবাসে এটি শুধু রক্তিমের এক বন্ধু জানতো। তাদের কথা শুনে ফেলে নবনী। নবনী জানিয়ে দেয় এই সম্পর্ক কখনো সম্ভব না। সমাজের চোখে তারা ভাই-বোন। আর রিধি রক্তিমের বয়সে অনেক ব্যবধান। নবনী জানিয়ে দেয় রক্তিম যাতে তাকে বোন হিসেবে মেনে নেয়।
এরপর থেকে রক্তিমের মহা ক্ষোভ। কেন রিধি তার বোন হবে? রিধি তো তার আপন বোন না। আর রিধিকে সে কখনো বোনের চোখে দেখে নি। তাই রিধির সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করে রিধিকে বুঝিয়ে দেয় যে, সে এই ঘরের সন্তান না। রক্তিমের অনেক খারাপ লাগলেও সে রিধিকে অনেক কষ্ট দিয়েছিল। এই দুইবছর যেন বুকে পাথর নিয়ে ছিল, আজ রিধিকে দেখে যেন সব পাথর গলে গিয়েছে।

রক্তিমকে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নবনী বললেন,
নবনী: ছোট বোনটিকে দেখে কি ভাবছিস? বড়ো হয়ে গিয়েছে অনেক তাই না? এখন তো বিয়ের বয়স হয়েছে। তোর বিয়ে দেওয়ার পর রিধির জন্য একটি বর খুঁজে আনতে হবে।

রক্তিম মায়ের কথার অর্থ বুঝে যায়।

রিধি নবনীর কথা শুনে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
রিধি: আমার বিয়ের বয়স হয়নি।আমি এখন বিয়ে করছি না। দেখো বাবা, ছেলেকে পেয়ে আমাকে বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে।

জুনাইয়েত: কে বলেছে আমার রিধি মার জন্য বর খুঁজবে? রিধি মা তার বাবাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না।

নবনী: মেয়েকে তো একদিন শ্বশুর বাড়ি যেতেই হয়।

নবনীর কথা শুনে রিধি মন খারাপ করে চলে যায়।
রিধি তার ঘরে গিয়ে মনে মনে রক্তিমকে গালি দেয়, তার ধারণা রক্তিম কিছু বুঝিয়েছে।

রিধি: বেটা রাক্ষস, আজকে এসেই মাকে আমার বিরুদ্ধে করে ফেলেছে। দাঁড়া তোকে রিধি শান্তিতে থাকতে দেবে না।

০৮ –

বাসায় আসার পর থেকে রোহানের বলা কথাগুলো মাথায় ঘুরছে ইশার। সে কি এতোটাই খারাপ যে তার চরিত্রে সবাই আঙ্গুল তোলার সাহস পায়?

ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম হবে এক সপ্তাহ পর কিন্তু আয়োজন এখন থেকে শুরু। ইশা যেহেতু ক্লাসের মনিটর তাই তার উপর অনেক দায়িত্বও পড়েছে। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের নাম সহ সব তথ্য সে সংগ্রহ করছে। তাই এই একসপ্তাহ সে ভার্সিটিতে যাবে। আজকে সকালের ঘটনার পর সে ভাবছে কিভাবে সে রোহানের সামনে যাবে। কারণ রোহান প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে। আর প্রতি ক্লাসের মনিটররা রোহানকে সাহায্য করবে, এটিই নিয়ম।

এদিকে বান্ধবীরা মিলে মহামায়া যাবে আগামীকাল। কালকে যেহেতু ভার্সিটিও বন্ধ, তাই সে মুহিবকে ফোন দেয়।

ইশা: কেমন আছো?

মুহিব: ভালো। তোমার কি অবস্থা?

ইশা: ভালোই। আমরা আগামীকাল মহামায়া যাচ্ছি। তোমাকে তো আগেও বলেছি। কালকে যাচ্ছো তো?

মুহিব: না, আমি যাচ্ছি না।

ইশা: কেন?

মুহিব: ইচ্ছে নেই।

ইশা : ওকে, ফাইন। রাখছি আমি।

মুহিব: ইশা, শোনো।

ইশা: হ্যাঁ, কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো।

মুহিব: অনেক পরিবর্তন হয়েছে তোমার। আগের মতো ভালোবাসো না আর।

ইশা: আর কিছু?

মুহিব: আগের মতো হয়ে যাও। আমি সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আর করবো না আমি কিছু। কষ্টও দেবো না।

ইশা একটু তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
ইশা: এখন বলবে ইশা তুমি মহামায়া যেও না, তোমার ফেইসবুকের পাসওয়ার্ড দাও, এভাবে চলো, ওভাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। শোনো মুহিব, অনেক কন্ট্রোল করার সুযোগ দিয়েছিলাম। তোমার কথায় অনেক নাচিয়েছিলে আমাকে। এখন আর না। আমার নিজের কি কোনো স্বকীয়তা নেই? তোমার কথা মতো আবার যাতে চলি তাই এসব ভালোবাসা দেখাচ্ছো? কিছুদিন পর পর তুমি পরিবর্তন হও, আমি না। আমি এখন নিজেকে যেভাবে পরিবর্তন করেছি সেভাবেই থাকবো। আমার মাঝে পুরোনো ইশাকে আর ফিরে পাবে না। যে মানুষ মূল্য দিতে জানে না, তার কাছে নিজেকে অমূল্য করার ইচ্ছেও নেই।

মুহিব: আচ্ছা, কারা কারা যাচ্ছে মহামায়া?

ইশা: কেন?

মুহিব: এমনি। বলো না। এইটুকু অধিকার তো আছে জানার। তোমাকে যেতে মানা তো করছি না।

ইশা: আমি, মারিয়া, নিশু, তিথি, সাদিয়া, সাথে যাচ্ছে নিশুর বয়ফ্রেন্ড মিহির ভাইয়া, আর তিথির বয়ফ্রেন্ড রাতুল।

মুহিব: ছেলেও যাচ্ছে! ভালো।

ইশা: তোমাকে তাই যেতে বলেছি। যেতে চাচ্ছো না যখন যেও না।

মুহিব: জানো, আজকে আমার তানিশার সাথে কথা হয়েছে।

ইশা: ভালো হয়েছে। আমাকে কেন বলছো?

মুহিব: এমনি।

মুহিব কিছু হলেই কোনো না কোনো মেয়ের কথা তুলে ইশাকে জেলাস করাতে চায়। কারণ সে জানে আর কিছু না হোক মুহিব কোনো মেয়ের সাথে কথা বললেই ইশা একটু দুর্বল হয়ে পড়বে। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ইশা মনে মনে কষ্ট পেয়েছে, কিন্তু সে মুহিবকে বুঝতে দেয় নি। কারণ নিজের দুর্বলতা কারো সামনে প্রকাশ না করাই ভালো। মানুষ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কষ্ট দিতে ভুল করে না।

ভোরে মহামায়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা দেয় তারা।
ভোর সাড়ে ছয়টায় বাসা থেকে বের হয় ইশা। ইশা আর নিশু একসাথে একে খান পৌঁছায়। বাকীরা সবাই ওইখানে একত্র হয়। একসাথে ঢাকা-চট্টগ্রাম বাসে উঠে। বাস তাদের মিরসরাই নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে অটোতে করে পৌঁছে যায় মহামায়া।
মহামায়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম হৃদ। পাহাড়ি লেকের পানি দিয়ে এই এলাকা গঠিত। এখানে অসাধারণ পাহাড়ি গুহা, রাবার ড্যাম আর ঝর্ণা রয়েছে।

নিস্তব্ধ নির্জন পরিবেশ, পক্ষীকুলও যেন শান্ত হয়ে আছে। হালকা বাতাস, মৃদু রোদ, ভালো লাগা দোলা দিচ্ছিল ইশার মনে। এতোদিন পর ইশা যেন জীবন্ত হচ্ছে। মহামায়া লেকের সামনে এলো তারা। রোদ মাথার উপর, তবুও ভালো লাগছে ইশার। রোদের তীব্রতা থেকে প্রকৃতির মুগ্ধতা তাকে বেশি আনন্দ দিচ্ছে।
বামপাশে পাহাড়। তারা উঠল পাহাড় বেয়ে। ক্লান্ত লাগছে তবুও মন যেন উড়তে চাইছে পাখিদের মতো। পাহাড় থেকে সবকিছু ছোট ছোট দেখাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করছে মহামায়া লেকটি। পাহাড় থেকে লেকটিকে দ্বীপের মতো লাগছে।আশেপাশে জঙ্গল আর জঙ্গল। একধরণের গন্ধ লাগছে নাকে, এটি বুনোলতার গন্ধ। এই গন্ধ শুধু পাহাড়ের বুক থেকে উৎপন্ন হয়।

পাহাড়ে উঠার সময় ফোন আসলো ইশার। মুহিব কল দিয়েছে।

কল ধরে,
ইশা: তুমি না মিস করলে। জানো কতো সুন্দর চারপাশের দৃশ্য। পাহাড়ে উঠেছি এখন।

মুহিব: ভালো। তোমাকে একটি কথা বলার ছিল।

ইশা: বলো।

মুহিব: তোমার সাথে হয়তো আমি আর থাকতে পারবো না।

ইশা: মানে?

মুহিব: আমার আজকাল তানিশাকে ভালো লাগছে। ও আমাকে খুব পছন্দ করে। ও আমাকে বলছে যাতে আমি ওর হয়ে যায়।

ইশা: কি বলছো যা তা? ও তোমাকে বলবে আর তুমি মানবে? তুমি কি পাগল? আর আমরা একে অপরকে ভালোবাসি।

মুহিব: হ্যাঁ। কিন্তু এখন ভাবছি তোমার সাথে আমি ভালো থাকবো না। কারণ তুমি আমার কথা মতোও চলো না।। নিজের ইচ্ছেমতো চলছো। আচ্ছা রাখছি, তানিশা আসছে। আমি ওর সাথে আছি এখন।

ইশা: কি?

মুহিব ফোন কেটে দেয়।
ইশার মন খারাপ হয়ে যায় সাথে সাথে।
আজকে একটু ঘুরবে তা না আজকেও মুহিবের মানসিক অত্যাচার।

মারিয়া ইশাকে মন খারাপ করে থাকতে দেখে বলল,
মারিয়া: কি সমস্যা? মুহিবজনিত রোগ আবার?

ইশা: হ্যাঁ। ও নাকি তানিশা নামের মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়াবে। আমি নাকি ওর কথামতো চলি না তাই।

মারিয়া: ভালোবাসা কখনো নিয়ন্ত্রণের উপর চলে না। ভালোবাসা মানে স্বাধীনতা। যে ভালোবাসা শিকল পড়িয়ে রাখে সেটিকে ভালোবাসা না, শোষণ বলে।

ইশা: এখন কি করবো আমি?

মারিয়া: ওকে ধরে রাখার থেকে ছেড়ে দে। আর যাই হোক মানসিক ভাবে তোর চাপ থাকবে না। আমার আর সানির মধ্যে কতো প্রেম ছিল, একজন আরেকজনকে একদিন না দেখে থাকতে পারতাম না। আর আজ আমরা কতো দিন কথাও বলি না একে অপরের সাথে।

ইশা: তোদের সবকিছু কতো ভালো ছিল। তোরা এভাবে আলাদা না হলেও পারতি।

মারিয়া: জানিস ইশা, সমবয়সী সম্পর্কগুলো এমনই। ভালোবাসা আর অপেক্ষা থাকে এসব সম্পর্কে। কিন্তু পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আমার অপেক্ষার ফল সানি আমাকে দিতে পারবে না হয়তো। আমরা একে অপরকে ভালোবেসে আজ দূরে। এই না পাওয়ার মাঝেও আনন্দ আছে। সব ভালোবাসাতো আর ঠিকানা খুঁজে পায় না। হয়তো আমার আর সানির ভালোবাসার গল্প এখানেই সমাপ্ত। অন্যের হয়ে পুরনো স্মৃতি চিরতরে ভুলিয়ে দেওয়ার অপেক্ষায় এখন।

ইশা আর মারিয়াকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাদিয়া এসে বলল,
সাদিয়া: ভাই তোদের ভালোবাসার স্মৃতিগুলো বাসায় রেখে আসতে পারলি না? আজকের দিনটি শুধুই আমাদের জন্য। সো, নো বয়ফ্রেন্ড রিলেটেড টপিকস আর এলাউড টু’ডে। অনলি বেষ্ট ফ্রেন্ডস আর রিয়েল।

তারা পাহাড় থেকে নেমে লেকের সামনে এলো। এরপর নৌকায় উঠলো তারা, যাবে মহামায়া ঝর্না।
লেকের পানি স্থির, কোনো স্রোত নেই। হালকা হাওয়া অবাধ্য করছে সব বাঁধার সীমারেখাকে। পাখিদের ব্যস্ততা, ধীরে ধীরে নৌকার এগিয়ে চলা সবকিছু যেন ইশাকে পুলকিত করছে। আলাদা বৈঠা ছিল, তাই মাঝিকে সাহায্যের জন্য ইশা আর মারিয়া দুজনে বৈঠা চালাচ্ছে। ইশার জীবনে নতুন অভিজ্ঞতা।
তারা ঝর্নার কাছে চলে এলো, পাহাড়ের গা ঘেঁষে পড়ছে শীতল পানির ধারা।

ইশা এখন ভুলেই গিয়েছে মুহিবের সব কথা। প্রকৃতিকেই যেন ভালোবাসা উত্তম। আর নি:স্বার্থ ভাবে তারা ভালোবাসা বিলিয়েও যায়।

মহামায়ার যাত্রা শেষ করে এতোদিনের পরিকল্পনা সফল করে তারা।
বাস পেতে তাদের একটু কষ্ট হয়, ঢাকা-চট্টগ্রামগামী রোড, তাই আশেপাশে কোনো গাড়িও পাওয়া যায় না। ঢাকা থেকে আসা একটি বাসে উঠে তারা। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে যেতে হয় তাদের। যাত্রী নামার পর সিট খালি হয়। বাসের পিছনেই সিট পায় তারা।

ইশার ফোনে আবার মুহিবের কল আসে। মুহিব তানিশার সাথেই ভালো থাকবে এসব কথা ইশাকে শুনিয়ে তার মন খারাপ করে দেয় আবার।

মিহির ইশার মন খারাপ দেখে নিশুকে কারণ জিজ্ঞেস করলে, নিশু সম্পূর্ণ ব্যাপারটি খুলে বলে।

মিহির ইশাকে বোঝায়, ভালোবাসা এমন ভাবে হয় না। ইশা যাতে ভেবে-চিন্তে ভালো সিদ্ধান্ত নেয়।

ইশা বাসায় এসে অনেক চিন্তা করার পর মুহিবকে ফোন দিয়ে বলে,
ইশা: আমি ভেবে দেখেছি আমাদের মধ্যে সবকিছু আজকে এবং এখনই শেষ। তোমাকে ভালোবাসা আমার প্রথম ভুল আর দ্বিতীয়বার সুযোগ দেওয়া আমার শেষ ভুল। আমার ভুলগুলো শুধরে আমি জীবনে প্রথম কোনো উত্তম সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ।

মুহিব: আমি তো তোমার সাথে দুষ্টুমি করেছিলাম। দেখছিলাম তুমি কি করো।

ইশা: ধন্যবাদ, তোমার আজকের দুষ্টুমি আমাকে সাহায্য করেছে এই সিদ্ধান্ত নিতে।।

মুহিব: আচ্ছা বাদ দাও, আজকে কেমন ঘুরলে।

ইশা: মানসিক চাপ দিয়েছো আজকে আর বলছো কেমন ঘুরলাম? রাখছি আমি।

মুহিবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে কল কেটে দেয়, সাথে নম্বরটিও ব্ল্যাকলিস্টে দিয়ে দেয়।

তিন চারদিন হয়ে যাচ্ছে মুহিব ইশার বাসার সামনে আসছে আর যাচ্ছে। ইশার কোনো খবর নেই। কান্না আসছে এখন মুহিবের, মনটিকে যেন কেউ ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে। শেষে ইশা ফোন রিসিভ করার পর অনেক কান্নাকাটি করে মাফ চায় সে। কিন্তু হয়তো ইশার ধৈর্য সীমার বাইরে চলে যায় মুহিবের কাজকর্ম। ইশাকে আর ফেরানো যাবে না।

এখন থেকে চলতেই থাকবে মুহিবের অপেক্ষা। কিন্তু ইশা নিজেকে শক্ত করে ফেলেছে মন থেকে। এখন আর মুহিবের অপেক্ষার সাড়া আসবে না হয়তো ইশার পক্ষ থেকে।

চলবে–

আগের পর্বের লিংক:
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/373035014418277/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here