অপেক্ষা পর্ব-(২১+২২+২৩)

অপেক্ষা পর্ব-(২১+২২+২৩)
লেখিকা: সামিয়া বিনতে হামিদ

২১।
ইশাদের নতুন বর্ষের ক্লাস শুরু। দিব্য ইশাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে রোহানের সাথে দেখা করতে গেলো। অনেকদিন রোহানের সাথে দেখা হয়নি। রোহান ফোনেও দিব্যের সাথে ভালো করে কথা বলেনি। তাই দিব্য সকালেই অনিককে সাথে নিয়ে রোহানের বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
রোহানের বাসায় দিব্য আগে কখনো যায় নি, কারণ রোহান নিয়ে যায়নি আর আগ্রহও দেখায় নি নিয়ে যাওয়ার। আজ প্রথম যাচ্ছে তবুও চিনতে কষ্ট হয়নি কারণ এড্রেস জানা ছিল।
দারোয়ান দিব্য আর অনিককে দেখেই আটকে দেয়।

দারোয়ান: কারে চাইতাছেন?

দিব্য: রোহানের সাথে দেখা করব।

দারোয়ান: রোহান ভাইয়ের কি হন?

অনিক: আমরা ওর বন্ধু।

দারোয়ান: তার আবার বন্ধু? এতো বছরেও তো দেখি নাই!

দিব্য: আপনি রোহানকে জানান, দিব্য আর অনিক এসেছে।

দারোয়ান: এইখানেই দাঁড়াইয়া থাকেন।

দারোয়ানের প্রচুর ইনভেস্টিগেশন দেখে অনিক বিরক্তবোধ করছে।

অনিক: তোকে কে বলেছে আসতে? যত্তসব কাজ তোর।

দিব্য: ওর কোনো সমস্যা হয়েছে আমার মনে হয়। ওকে একবার না দেখলে অস্থির লাগবে। রোহানের খবর নেওয়া আমাদের দায়িত্ব। তুই জানিস আমরা দুইজন ছাড়া ওর কোনো বন্ধু নেই।

অনিক: বন্ধু নেই তো কি হয়েছে, বাবা তো আছে ওর। আমার না, সত্যিই রোহানকে বিরক্ত লাগে। একটা ছেলের মাঝে এতো অ্যাটিটিউড! বন্ধুদের সাথেও ভাব নিয়ে মানুষ চলাফেরা কিভাবে করে? আমি বুঝি না তুই এতোসব কিভাবে সহ্য করছিস?

দিব্য: চুপ কর অনিক।

অনিক: জয় উদার মনের মানুষ দিব্য রহমানের জয়।
এতো বাঁশ খেয়েও হয় না যার পরাজয়।
সারাদিন সে জনতার জন্য করে মূল্যবান সময়ের ক্ষয়।
আহা, বেঁচে থাকুক তার কর্মকল্যাণ পুরো দেশময়।

দিব্য এতোক্ষণ হাতদুটি পকেটে নিয়ে রোহানের বাসার গেইটে হেলান দিয়ে শুনছে অনিকের দুই লাইনের কবিতা। কবিতা শেষ হলে দিব্য হাত উঁচিয়ে অভিবাদন গ্রহণ করল।

তারপর গলা ঝেড়ে বলল,
দিব্য: ধন্যবাদ মিত্র, আমার জন্য এতোগুলো মূল্যবান বাক্য ব্যয় করেছো। তুমি কী চাও আমার কাছে?

অনিক মনে মনে বলল,
অনিক: মহারাজা আপনার বোনের সাথে যদি আমার সম্বন্ধটা পাকা করার অনুমতি দেন, এতেই আমি খুশি।

এমন সময় রোহান নিচে নামলো।

রোহান: তোরা এইখানে?

দিব্য: রোহান, তুই ঠিকাছিস? তোর কোনো খবর নেই যে! কল দিলে ধরছিস না। ধরলেও কথা ভালো মতো বলছিস না। সমস্যা কি?

রোহান: ইচ্ছে হচ্ছিল না তাই।

অনিক: তোর সাথে কি চার বছরের ডিল করেছি শুধু? চার বছর পর ডিল শেষ, বন্ধুত্বও শেষ?

রোহান: আমার এখন তোদের সাথে বন্ধুত্ব রাখার কোনো ইচ্ছে নেই। এখন তোরা যেতে পারবি।

অনিক দিব্যের কানের কাছে এসে বলল,
অনিক: মান-সম্মান কি বাসায় রেখে এসেছিস? চল এখন।

দিব্য রোহানের কাছে এসে বলল,
দিব্য: কি হয়েছে ভাই, বল? হঠাৎ, তোর এমন পরিবর্তন কিভাবে হলো?

রোহান দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
রোহান: কেউ আসলে আমাকে আর বিরক্ত করবে না ডেকে। চলে যেতে বলবে।

দিব্য আর অনিক রোহানের কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। রোহানের কাছে এমন ব্যবহার তারা মোটেও আশা করে নি।

দিব্য আর অনিক রিক্সায় উঠে। চুপচাপ বসে আছে। দিব্য ভাবছে রোহান কেন এমন করছে? অনিককে কিছু বলতে যাবে, এমন সময় একটা গাড়ি তাদের রিক্সায় খুব জোরে ধাক্কা দেয়। দিব্য রিক্সা থেকে ছিটকে রাস্তায় গিয়ে পড়ে। অনিক সামনে গিয়ে পড়ে। অনিক হাতে পায়ে খুব আঘাত পায়। কিন্তু দিব্য খুব বেশিই আঘাত পায়। আশেপাশের মানুষ তাদের মেডিকেলে নিয়ে যায়।

ইশা ভার্সিটি থেকে এসেই দিব্যকে ফোন দিচ্ছে কিন্তু ফোন বন্ধ বলছে তার। দিব্যতো ফোন বন্ধ রাখে না। রোহানের সাথে দেখা করতে যাবে বলেছিলো সে। এখন তো রোহানের ফোন নম্বরও নেই তার কাছে। ইশার খুব ভয় লাগছিলো। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে দিব্যের ফোন এখনো বন্ধ। হঠাৎ ইশিতা তড়িঘড়ি করে ইশার রুমে ঢুকে।

ইশা ভয় পেয়ে যায় ইশিতার চোখমুখ দেখে। আতংক ভীড় করছে তার মনে।

কাঁপাকাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল,
ইশা: ম..ম..মা.. ক…কি হয়েছে?

ইশিতা: দিব্যের এক্সিডেন্ট হয়েছে।

ইশা আর নিজের মধ্যে নেই। মুহূর্তেই তার পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়। তারা তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যায়। অনিকের অবস্থা এতোটা খারাপ নয়। জ্ঞান ফিরেছে। দিব্যের প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। ছেলের অবস্থা দেখে রাজিয়া আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছেন না।

ইশার চোখগুলো ফুলে লাল হয়ে গেছে। মনে মনে একটাই আওয়াজ আসছে ইশার অন্তর থেকে, দিব্য ফিরে আসো প্লিজ। আল্লাহ তুমি আমার দিব্যকে সুস্থ করে দাও।

কিছুক্ষণ পর ডক্টর এসে বলে যায় দিব্যের রক্তের প্রয়োজন। ব্লাড ব্যাংকে খোঁজ নিয়েও রক্ত পাওয়া যায় নি। অনিক সব বন্ধুদের জানায়। ফেইসবুকে বিভিন্ন গ্রুপেও পোস্ট দেওয়া হয়।

সন্ধ্যায় রোহানের চোখে পড়ে নিউজটা। রোহান আর দিব্যের ব্লাডগ্রুপ একই। নিউজটা দেখেই সে তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হয়ে ফয়সাল আহমেদের কাছে যায়। ফয়সাল আহমেদ মাত্রই বাসায় এসেছিলেন।

রোহান: বাবা, দিব্যের এক্সিডেন্ট হয়েছে।

ফয়সাল: কি বলছিস? কোথায় এখন দিব্য?

রোহান: মেডিকেলে আছে। ওর রক্ত প্রয়োজন, ভার্সিটির গ্রুপে দেখেছি।

ফয়সাল: তাড়াতাড়ি চল।

তারা মেডিকেলে চলে আসে। রাজিয়া ফয়সাল আর রোহানকে দেখে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। রোহান দেরী না করে রক্ত দেওয়ার জন্য কথা বলতে যায়।

ফয়সাল রাজিয়ার কাছে আসেন। তাদের কোনো কথায় যেন বের হচ্ছে না। পাশাপাশি বসে আছেন অসহায় মানুষের মতো। দিয়া ইশার হাত ধরে বসে আছে। সবার মধ্যে আতংক। সবাই নিরব, যেন মুহূর্তেই সব উলটপালট হয়ে যাবে।

রোহান রক্ত দিয়ে বের হলো। ফয়সাল আহমেদের কাছে এসে বসলো।

রোহান: বাবা, দিব্য ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।

ফয়সাল রাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
ফয়সাল: তুমি আমাকে জানাও নি কেন?

রাজিয়া একদৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার বলার কিছুই নেই।

রোহানের এই মুহূর্তে রাজিয়ার কোলে মাথা রেখে বলতে ইচ্ছে করছে,
রোহান: কিছু হবে না মা, দিব্যের। আমার ভাইটা না অনেক ভালো। আমার থেকেও বেশি। দিব্য ছাড়া কেউ আমায় বুঝতে চাই নি কখনো। আর আমি? অনেক খারাপ। আমি কখনো দিব্যের প্রয়োজনে পাশে থাকতে পারি নি। সবসময় দিব্য আমার বিপদে পাশে ছিলো আর আমি স্বার্থপরের মতো তাকে তাড়িয়ে দিয়েছি।

রোহান ইশার দিকে ফিরে তাকালো। ইশার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে তার ভেতরটা আরো মুচড়ে উঠলো। রোহান ইশার পাশে গিয়ে বসল।

ঠাণ্ডাস্বরে বলল,
রোহান: চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে। দিব্য অনেক শক্ত ছেলে, এতো সহজে হেরে যাবে না।

ইশা ফোলা চোখে রোহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
ইশা: আপনার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো। আমি আজকে বলেছিলাম আমার সাথে ভার্সিটি যেতে। আমার নতুন ক্লাস শুরু, দিব্যসহ গেলে কতো ভালো লাগতো আমার! কিছু হতোও না আমার দিব্যের, কিন্তু ওর কাছে আমার চেয়ে আপনি বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। আমারও দোষ আছে, আমি ওকে জোর করলে আমার সাথেই যেতো। কেন জোর করিনি আমি? কেন করিনি?
কথাটি বলতে বলতেই ইশা কেঁদে দেয়।

আর পারছে না নিতে রোহান। মনে মনে নিজেকে দোষ দিচ্ছে সে,
রোহান: কেন যেতে দিয়েছিলাম? বাসায়ও ঢুকতে দেই নি। এতোখারাপ আমি! ছিঃ ছিঃ।

কয়েকঘন্টা কেটে যায় চোখের পলকে কিন্তু কেউ ঠিকমতো চোখের পাতা বন্ধ রাখতে পারছে না ভালো মতো। রাজিয়ার পরিচিত ডক্টর দিব্যের চিকিৎসা করছে, কিন্তু কিছুই জানাচ্ছে না।

অনিকের বিশ্রাম প্রয়োজন। তার বাবা-মাকে জানানো হয়, তারা টিকেট করে ফেলেন দেশে আসার জন্য, রাত দুইটায় তাদের ফ্লাইট। দেশে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল আটটা নয়টা বেজে যাবে।

রাজিয়া শুষ্ক মুখে বসে আছেন। কিছুক্ষণ আগে নামাজ পড়ে এসেছেন। ছেলের সুস্থতার জন্য অনেক কান্নাকাটি করেছেন আল্লাহর কাছে। দিব্যের কিছু হলে তার সবকিছুই শেষ হয়ে যাবে। দিব্য আর দিয়া তাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা দেয়।

পনেরো বছর আগেই তিনি তার ভালোবাসা, স্বপ্ন সব কিছুই ত্যাগ করে দিয়েছিলেন।

পঁচিশ বছর আগে–
ধুমধাম করেই বিয়ে হয়েছে ফয়সাল আর রাজিয়ার। তারা সিনিয়র জুনিয়র ছিলেন দুইবছরের। একই মেডিকেলে পড়াশুনা করেছিলো। সেখানেই প্রথম দেখা আর প্রেম শুরু। তাদের প্রেম নিবেদন হতো চিঠির মাধ্যমে। দুজনে লাইব্রেরিতে বসে বই পড়তো।
ফয়সাল প্রথম দিন তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় চিঠিতে লিখে। বইয়ের ভেতর চিঠিটি রাখতো। রাজিয়া আসার আগেই তার টেবিলে রেখে আসতো বইটি। ফয়সালের প্রেম নিবেদনের ধরণ ভিন্ন রকমের ছিলো। যে বিষয়ে চিঠি লিখতেন ঠিক তেমন বিষয়ের সাথে মিল রাখা বইয়ের ভেতর দিয়ে চিঠিটি দিতেন। যেমন প্রথমদিন তিনি বুদ্ধদেব বসুর ‘হলুদ বসন্ত’ বইয়ের ভেতর চিঠিটি রেখেছিলেন।
ফয়সাল উপন্যাসের বিখ্যাত একটি উব্ধৃতি লিখেছেন প্রথমে,
“ভালোলাগা আর ভালোবাসার পার্থক্য টা কোথায়? ভালো লাগলে মানুষ সেই ভালো লাগাকে তার ইচ্ছাধীন করে রাখতে পারে, কিন্তু ভালবাসলে মানুষ নিজেই সেই ভালোবাসার ইচ্ছাধীন হয়ে থাকে। তার নিজের কোনো নিজস্ব সত্তা থাকে না। ভালোবাসা তাকে যা বলে পোষা পুষ্যির মতো সে তাই করে।”

তারপর লিখেছিলেন নিজের মনের কথা,
রাজিয়া আমিও আমার সত্তা হারাতে চাই তোমার কাছে। তুমি যেভাবে বলবে ঠিক সেভাবেই ভালোবাসতে চাই। রাজিয়া কি রাজি আছে আমার প্রস্তাবে?

রাজিয়াও ফয়সালকে পছন্দ করতো। কিছুদিন পর রাজিয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’ বইয়ের ভেতরে চিঠি রেখে ফয়সালকে পাঠায়।
“ভালোবাসা অর্থ আত্মসমর্পণ করা নহে, ভালোবাসা অর্থ ভাল বাসা, অর্থাৎ অন্যকে ভালো বাসস্থান দেওয়া, অন্যকে মনের সর্ব্বাপেক্ষা ভালো জায়গায় স্থাপন করা।”
ফয়সাল যদি রাজিয়াকে মনের সর্ব্বাপেক্ষা ভালো জায়গায় স্থান দিতে পারে, রাজিয়া রাজি আছে।

তারপর থেকেই শুরু হয় তাদের প্রেম কাহিনী। পরবর্তীতে তাদের ভালোবাসার শুভ পরিণয় হয়।

বিয়ের দুইবছর পর দিব্য আর রোহানের জন্ম হয়। দিব্য-রোহান হওয়ার পর তাদের সংসার আরো সুখের চলছিলো। কিন্তু দিয়া হওয়ার পর রাজিয়া আর ফয়সালের দুরত্ব বাড়তে থাকে। আর এর তিনবছরের মধ্যেই তারা আলাদা হয়ে যায়।

২২।

ঊষা ছোটবেলা থেকেই ফয়সালকে ভালোবাসতো। কিন্তু কখনো বলতে পারে নি। ফয়সাল বাকীসব কাজিনদের থেকে ঊষাকে একটু বেশিই স্নেহ করতো। আর ঊষা মনে মনে এই স্নেহকে অন্যদিকেই নিয়ে যায়। ঊষা ভ্রান্তির মধ্যে ছিলো। সে মনে করতো ফয়সাল তাকে ভালোবাসে। তাই যেদিন ফয়সাল আর রাজিয়ার বিয়ের কার্ড হাতে পায় অনেক কেঁদেছিলো ঊষা। জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হারানোর মতো কষ্ট। শত চেষ্টায়ও আর পাওয়া যাবে না তার প্রিয় মানুষটিকে।

রাজিয়া আর ফয়সাল বিয়ের পর পর দেশের বাইরে চলে যায়। রোহান আর দিব্যের জন্মের আগেই দেশে ফিরে আসে। তারা দেশে আসার পর ঊষা, ফয়সাল আর রাজিয়ার বাসায় থাকতে যায়। ঊষা নিজেকে এই দুইবছরে নিয়ন্ত্রণ করেছিলো অনেকটা। কিন্তু রাজিয়া আর ফয়সালকে একসাথে দেখে পুরোনো ক্ষতে আবার ব্যথা অনুভব করছিলো সে। সহ্য করতে পারছিল না আর। এরপর থেকেই ঊষা ফয়সালের সাথে বেশি সময় কাটাতে চাইতো। দিব্য আর রোহান হওয়ার পর একসাথে দুটো বাচ্চা সামলানোর দায়িত্ব আসে রাজিয়ার উপর। স্বামীর দিকে নজর রাখার দায়িত্ব থেকে কিছুটা দূরে সরে যায় সে। এই সুযোগ ঊষা হাতছাড়া করতে চায় নি। ফয়সালের জন্য রান্নাবান্না করা ছাড়াও ফয়সালের কাপড়চোপড় ধোয়াও বাদ দেয় নি। বেশিরভাগ সময় ফয়সালকে নিজের কথার মাঝেই ব্যস্ত রাখতো সে। যার ফলে ফয়সাল রাজিয়াকে কম সময় দেওয়া শুরু করে। ঘটনা রাজিয়া রহমানের চোখে পড়লে হালকা কথা কাটাকাটি হয় ফয়সালের সাথে। ফয়সাল চান নি রাজিয়ার সাথে কোনো অশান্তি হোক, কারণ তিনি অনেক ভালোবাসতেন রাজিয়াকে। তাই ঊষাকে চলে যেতে বলেন। এরপর আর কোনো সমস্যা হয় নি।

কিন্তু দিয়ার জন্মের পর রাজিয়া সাংসারিক কাজে বেশিই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এরই মধ্যে ঊষার মাও অসুস্থ হয়ে পড়ে। মা ছাড়া ঊষার আর কেউ ছিলো না। তাই ফয়সাল সময় পেলেই খালাকে দেখতে যেতো আর বেশিরভাগ সময় সেখানেই কাটতো তার। নতুনভাবে সুযোগ পায় ঊষা, তার ভালোবাসা ফিরে পাওয়ার। অচেনা নম্বর থেকে ফয়সালকে রাতে ফোন দিয়ে বিরক্ত করতো সে। ধীরে ধীরে রাজিয়ার মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। ছোটোখাটো ঝগড়া পরিণত হয় প্রতিদিনের বড়সড় ঝগড়ায়। ফয়সাল রাজিয়ার এমন সন্দেহ করা মোটেও পছন্দ করতেন না। তিনি রাজিয়াকে কোনো কৈফিয়তও দিতেন না। যার কারণে ভুল বুঝাবুঝি আরো বাড়তে থাকে।

এর মধ্যে ঊষাও রাজিয়াকে একদিন বলে, সে ফয়সালকে একটি মেয়ের সাথে রেস্টুরেন্টে বসে কথা বলতে দেখেছিলো। ছবিও দেখায় প্রমাণ হিসেবে।
আসলে মেয়েটি ছিলো ফয়সালের পুরোনো বান্ধবী আর সেদিন তাদের দেখা হয়ে যায় রাস্তায় তাও অনেকবছর পর। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বললে সুন্দর লাগবে না তাই একসাথে পাশের একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে। ঊষাও তার বান্ধবীর সাথে ওইদিন সেই রেস্টুরেন্টেই ছিলো। ফয়সাল বাসায় আসার পর রাজিয়া তাকে জিজ্ঞেস করলে সে ব্যাপারটি অস্বীকার করে। কারণ এতোদিন তাদের মধ্যে অনেক ঝগড়া হয়েছে। ফয়সাল ভেবেছে বিষয়টি জানালে অশান্তি আরো বাড়বে। ঐদিন রাজিয়া আর কিছু বলে নি। এভাবেই দূরত্ব বাড়তে থাকে তাদের মাঝে। বিভিন্নভাবে সন্দেহের বীজ একদিন বৃক্ষে পরিণত হয়ে যায়।

স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কোনো কথায় আড়াল রাখা উচিত নয়। কারণ আড়ালে রাখা কথা সামনে আসলেই সম্পর্কে একটা দেয়াল তৈরি হয়ে যায়, যা ভাঙতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়।

তাছাড়া ফয়সাল দিন দিন বিরক্ত হয়ে যাচ্ছেন, রাজিয়ার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে। একসময় রাজিয়ার কথার আর কোনো পাত্তা দিচ্ছিলেন না তিনি। প্রশ্ন করলেও কোনো উত্তর দিতেন না। দেরীতে বাসায় আসা, ছুটির দিনও বাসায় না থাকা তো ছিলোই কিন্তু একসময় রাজিয়ার সাথে কথা বলাও বন্ধ করে দেন তিনি।

সংসারে সমস্যা শুরু হলে একজনের অবশ্যই মাথা ঠাণ্ডা রাখা উচিত। কিন্তু ফয়সাল আহমেদের দায়িত্বহীনতার কারণে, শুধু তিনি নিজেই নন, রাজিয়াও খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। বাবা-মার ঝগড়াও নিজ চোখে দেখতো দিব্য আর রোহান। ঝগড়া বোঝার বয়স হয়েছিল দুজনের। রাজিয়াকে কাঁদতে দেখলে দিব্য আর রোহান মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতো।

এভাবে দুটি মানুষ কোনো সমঝোতা ছাড়াই এক ছাদের নিচে বাস করে যাচ্ছিলো।

কিন্তু তাদের সেই একই ছাদের নিচে থাকার শেষ দিনটিও এসে পড়ে, যেদিন রাজিয়াকে একটি অচেনা মেয়ে ফোন দিয়ে বলে সে ফয়সালের বাচ্চার মা হবে। আর প্রমাণ স্বরূপ একটি রিপোর্টের ছবি তুলে দেখায়, যেখানে বাচ্চার বাবা হিসেবে ফয়সালের নাম দেওয়া আছে। রাজিয়া এতো বেশি শূন্যতার মধ্যে ছিলো বিচার করার শক্তি হারিয়ে ফেলেন।
ফয়সাল বাসায় আসলে মারাত্মক পর্যায়ে চলে যায় বিষয়টি। ফয়সাল মানতেই পারছেন না এতো বড়ো অপবাদ আসবে তার উপর। তাও তার ভালোবাসার মানুষটিই এতো বড়ো মিথ্যা অপবাদ দেবে। এর আগেই সম্পর্কের অনেকটা অবনতি হওয়ায় ফয়সালের সব কথাই এখন মূল্যহীন হয়ে পড়ে রাজিয়ার সামনে।

ফয়সাল রাগের মাথায় রাজিয়াকে বলেন,
ফয়সাল: তোমাকে বিয়ে করা আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো।

রাজিয়া: কি বললে, আমি তোমার ভুল?

ফয়সাল: হ্যাঁ।

রাজিয়া: ঠিকাছে, আমি যখন তোমার ভুল, আমি চলে যাবো তোমার জীবন থেকে। আর কখনো ফিরে আসবো না।

রাজিয়া দিয়া,দিব্য আর রোহানকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ফয়সাল বাঁধা দেন।

ফয়সাল: আমার সন্তানদের নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?

রাজিয়া: জন্ম আমি দিয়েছি, আমার সাথেই যাবে। তুমি তোমার নতুন সুখের ঠিকানা পেয়েছো। সেটি নিয়েই থাকো।

ফয়সাল: তুমি এভাবে আমার সন্তানদের আমার থেকে আলাদা করে দিতে পারবে না।

যেহেতু দিয়া ছোট ছিলো তাই রাজিয়ার সাথেই থাকবে, মা ছাড়া বাচ্চা মেয়েটি থাকতে পারবে না। আর দিব্য এবং রোহানের মধ্যে যেকোনো একজনকেই নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। রাজিয়া দিব্যকে নিয়েই চলে আসেন। এরপর থেকেই তারা আলাদা।

আসলে ঊষাই এই চক্রান্ত করেছিলো। যার ফলে এতোগুলো মানুষ আজ একাকী জীবন পার করে যাচ্ছে।

বর্তমানে–
রাজিয়া মেডিকেলের বারান্দায় বসে আছেন। ফয়সাল পাশে এসে বসলেন।

ফয়সাল: তুমি আমাকে কেন জানাও নি? দিব্যের বিয়ে দিয়েছো বলো নি, আজ এক্সিডেন্টের খবরও দাও নি?

রাজিয়া: তোমার কোনো অধিকার নেই জানার। কোন সাহস নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করছো?

ফয়সাল: তুমি আমাকে আগেও ভুল বুঝেছো এখনো ভুল বুঝছো।

রাজিয়া: ভুল বুঝেছি? আমি? ভুল চিনেছিলাম, ভুল বুঝিনি। মানুষ চিনতে ভুল করেছি, তোমার মতো মানুষকে ভালোবেসে ভুল করেছিলাম।

ফয়সাল: রাজিয়া, তুমি হয়তো আমাকে কখনো বিশ্বাস করো নি। আমিও আমাদের মাঝে সমস্যা গুলোর সমাধান করতে চেষ্টা করিনি। দোষ আমারই বেশি, কিন্তু বিশ্বাস করো আমার জীবনে তুমি ছাড়া আগেও কেউ ছিলো না, এখনো কেউ নেই।

রাজিয়া কিছু না বলে চলে গেলেন। রোহান একা একা করিডোরে হাঁটছে, রাজিয়া রোহানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।

রাজিয়া: রোহান।

রোহান রাজিয়ার কন্ঠ শুনে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। আজ তার জন্য দিব্যের এই পরিণতি।

রোহান নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
রোহান: আমার জন্যই দিব্যের এই অবস্থা। আমাকে ক্ষমা করে দিও, মা।

রাজিয়া ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন,
রাজিয়া: দিব্য তোকে খুব ভালোবাসতো। সবসময় তোর কথা বলতো। আমি বুঝতেই পারি নি দিব্য আমার ছেলের কথাই বলছিলো।

রোহান: মা, তুমি দিব্যকে অনেক বেশি ভালোবাসো তাই না?

রাজিয়া: আমি আমার দুই ছেলেকেই সমানভাবেই ভালোবাসি। শুধু পরিস্থিতিই সবকিছু বদলে দিয়েছে। রোহান, আমাকে ক্ষমা করে দিস বাবা। আমি তোর পাশে থাকতে পারি নি। কিন্তু আমার হাতেও কিছু ছিলো না। আমি কখনো চাই নি এমন হোক। আমি তো আমার দুই ছেলেকে সাথে নিয়েই থাকতে চেয়েছি।

রোহান আর কিছুই বলেনি। সে জানতে চায় না রাজিয়া কাকে বেশি ভালোবাসে। রাজিয়া বলেছে তাকেও ভালোবাসে, এটিই গুরুত্বপূর্ণ। একটুখানি ভালোবাসলেও চলবে রোহানের।

সকালেই দিব্যের অবস্থার উন্নতি হয়। পরের দিন জ্ঞান ফিরে। এই দুইদিন ইশা দিব্যের হাত ধরে বসে ছিলো। ভালোমতো খায় নি। ঘুম তো বহুদূর, চোখ বন্ধ করলেই যেন সব হারিয়ে ফেলবে ইশা।
দিব্য চোখ খুলে ইশাকে দেখেই শুষ্ক হাসি দেয়, যেন বহু সংগ্রামের পর জয়ী হয়ে ফিরেছে।

দিব্য ধীর কন্ঠে বলল,
দিব্য: অপ্সরী, আমি… ভালো আছি… এখন। তুমিতো…আমার চেয়েও…. বেশি অসুস্থ।

ইশা: দিব্য, তোমার কিছু হলে আমি কিভাবে থাকতাম? আমার এখনো ভয় লাগছে, জানো আমার কেমন লেগেছিলো? বোঝাতে পারবো না আমি।

দিব্য: আল্লাহর রহমতে আমার ইশার বরটা সুস্থ হয়েছে এখন। এভাবে একা রেখে কিভাবে যাবো তোমাকে? খুব ভয় পেয়েছিলে ইশা? ভয় পেয়ো না আর। আমি আছি তো। তোমার পাশেই আছি।

ইশা: আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। দিব্যের অপ্সরী তার বরকে খুব ভালোবাসে। এখন থেকে তুমি রিক্সায় চড়বে না। রিক্সায় উঠলে আমার সাথে উঠবে।

দিব্য: আচ্ছা। তোমাকে সাথে নিয়েই উঠবো। আর মৃত্যু কি বলে আসে, বলো? আমার মৃত্যু এভাবে ছিলো না ইশা। তাই আজ বেঁচে গিয়েছি। বিপদ আসে মানুষের জীবনে। হয়তো এই বিপদের কারণে এর চেয়ে বড়ো বিপদ আমাদের উপর থেকে কেটে গেছে।

তিনদিন পর দিব্যকে বাসায় আনা হয়। এরপর ইশাও শ্বশুর বাড়ি চলে আসে। দিব্যের সেবা করে তাকে সুস্থ করে তুলে।
এর মধ্যে রোহানের সাথে দিব্যের আর দেখা হয়নি। দিব্য এখনো জানতে পারে নি রোহান তার ভাই। দিব্যের জ্ঞান ফেরার পর রোহান চলে গিয়েছিলো। দিব্যের সামনে আসার সাহস হয়নি তার। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে এখন। কিভাবে মুখ দেখাবে দিব্যকে সে?

দিব্য ছাড়া এখন সবাই জানে রোহান তার ভাই। আর রোহান এখন প্রতিদিন রাজিয়াকে কল দেয়, খোঁজখবর নেয় সবার। রোহানের কষ্ট যেন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে, তার মা আছে এখন।
রোহান মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, তার বাবা-মায়ের মধ্যে কি সমস্যা হয়েছে তা জানার। রোহান অপেক্ষায় আছে কবে তার পরিবার পরিপূর্ণ হবে! সে সব সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।

২৩।

অনিকের বাবা-মা দেশে আসার পর, তারা একটি বাসা ভাড়া নেয়। অনিক চট্টগ্রামেই থাকতে চাইছে তাই ঢাকা আর যাওয়া হয় না তাদের। অনিক এখন অনেকটাই সুস্থ। কিন্তু দিব্য এখনো ঠিক মতো হাঁটতে পারছে না। কারণ পায়ে বেশি ব্যথা পেয়েছিলো সে।

ইশা এই কয়েকদিন দিব্যের বাসায় ছিলো দিব্যের সাথে। আর তাই ভার্সিটিতেও যাওয়া হয় নি তার।

কিন্তু আজ দিব্য সকালেই বলছে,
দিব্য: আমার জন্য তুমি কেন ক্লাস গ্যাপ দিচ্ছো?

ইশা: ক্লাস করার চেয়ে তোমাকে সুস্থ করে তোলা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

দিব্য: আর আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ আমার অপ্সরীর স্বপ্ন। এখন আজকে যাও ক্লাসে। আর মিস দেবে না বললাম। আমি আগের চেয়ে অনেকটা সুস্থ আছি।

ইশা: কিন্তু তুমি বাসায় একা থাকবে?

দিব্য: দিয়া আছে তো।

ইশা: সামনে ওর পরীক্ষা। ও কীভাবে তোমাকে সময় দেবে? ওর এখন পড়াশুনা করা দরকার।

দিয়া পেছন থেকে এসে বলল,
দিয়া: ভাবী, আমি আছি। চিন্তা করো না তো। কিছু লাগলে আমি দেখবো। আর ভাইয়া তোমাকে চলে যেতে বলছে কারণ আজকে অনিক ভাইয়া আসবে। খেলা দেখবে দুজনে বসে। তোমার বর কিন্তু অনেক চালাক। তুমি থাকলে তো ঘুম পাড়িয়ে রাখবে। ইচ্ছেমতো লাফালাফি করতে পারবে না তাই তোমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

ইশা দিব্যের দিকে চোখ ছোটো করে তাকিয়ে বলল,
ইশা: খবরদার, লাফালাফি করলে আমাকে বলবে, দিয়া। চুপচাপ বসে খেলা দেখবে। তোমাদের জন্য আমি রান্না করি দিয়ে যাচ্ছি। বিছানা ছেড়ে উঠবে না বলে দিলাম। কিছু লাগলে দিয়াকে ডাকবে। আর অনিক ভাইয়া তো আছেন।

দিব্য: আহা! এক্সিডেন্ট করে ভালোই হয়েছে। বউটা আমার কতো সেবা করছে!

ইশা: ছিঃ এসব বাজে কথা বললে, আমি লাঠি দিয়ে পা টা আরো ভেঙে দেবো। আর কখনো ওমন খারাপ কথা বলবে না। তোমার কিছু হলে আমার কি হতো? মা আর দিয়ার কথা ভেবে দেখেছো?

দিব্য: আচ্ছা, আচ্ছা, আর কখনো বলবো না। এখন তোমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। বাসটা মিস হয়ে গেলে কিন্তু আমার আর অনিকের খেলা দেখার মাঝে তুমি কাবাবে হাড্ডি হয়ে যাবে। আমি চাই না আমার বউটা কাবাবে হাড্ডি হোক।

ইশা মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেল।

রিধি আজ খুব সুন্দর করেই সেজেছে। চোখে ঘন করে কাজল, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, হাতে বালা দিয়েছে। ফিরোজা রঙের কাতান শাড়ি পড়েছে। চুলগুলো আজকে সকালে কেটে কাঁধ পর্যন্ত করেছিলো। নবনী এখনো দেখেন নি। দেখলে অবশ্যই বকবে কারণ রিধির চুল অনেক লম্বা হয়েছিলো আর চুল ঘনও ছিলো, তাই অনেক সুন্দর লাগতো রিধিকে। কিন্তু রিধির লম্বা চুল পছন্দ না। আর শাড়ি সামলাবে নাকি চুল? তাই সে সকালে চুলগুলো কেটে ছোটো করে ফেলল। আজ ইফতির বার্থডে। গতকাল অনেক রিকোয়েস্ট করেছিলো ইফতি যাতে আজ তার সাথে ঘুরতে যায়। রিধির ইচ্ছে ছিলো না তবুও অনেকদিন পড়াশুনার চাপে মন-মেজাজ খিটখিটে হয়ে গিয়েছিলো। তাই ভেবেছে এই সুযোগে মনের ক্লান্তি দূর হবে। জুনাইয়েত আর নবনীকে বলেছে বান্ধবীর সাথে ঘুরতে যাচ্ছে। কারণ ইফতির সাথে ঘুরতে যাওয়ার পারমিশন সে কখনো পাবে না তাও শাড়ি পড়ে, সেজেগুজে তো কখনোই না। আজ প্রথম সে মিথ্যে কথা বলে বাসা থেকে বের হয়েছে। তবুও কোনো ভয় কাজ করছে না তার। রিধির প্রথম এমন এডভেঞ্চারাস কাজ করতে বেশ মজাই লাগছে।

রক্তিমের দেরীতে ঘুম ভাঙল। কাল সারারাত সে ভালো মতো ঘুমোতে পারে নি। কারণ রিধি কাল রাত জেগে কারো সাথে ফোনে কথা বলেছিলো যা রক্তিম ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো। কিন্তু কিছু বলার ছিলো না আর।
রক্তিমের খুব কষ্ট হচ্ছে এখন, রিধিকে সে অন্য কারো সাথেই সহ্য করতে পারে না। আর পারবেও না কখনো।

সকালে রক্তিম ঘুম থেকে উঠার আগেই রিধি বাসা থেকে বের হয়ে যায়। নবনী বুঝতে না পারার জন্য মাথায় উড়না পেঁচিয়ে বের হয়, কারণ চুল ছোটো দেখলে আজ আর বের হওয়া যাবে না।

রক্তিম ফ্রেশ হয়ে আসলো। রিধিকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে নবনীর কাছে গেলো।

রক্তিম: মা, রিধি কোথায়?

নবনী: বাইরে ঘুরতে গেলো বান্ধবীদের সাথে।

রক্তিম: সামনের ওর পরীক্ষা! আর তুমি ওকে যেতে দিলে?

নবনী: বারণ তো করেছি, কিন্তু এতোবার করে বলল। আজ নাকি বার্থডে, আর এতোদিন অনেক চাপ নিয়েছে, ভাবলাম একটু মন ভালো হবে বাইরে গেলে।

রক্তিমের সন্দেহ হয়, নবনীকে আর কিছু না বলে দিব্যকে ফোন দেয়।

রক্তিম: হ্যালো, দিব্য।

দিব্য: আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।

রক্তিম: ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো এখন?

দিব্য: আগে থেকে ভালোই।

রক্তিম: দিয়া বাসায় আছে?

দিব্য: হ্যাঁ, বাসায় আছে। কিছু বলবেন?

রক্তিম: একটু দেওয়া যাবে?

দিব্য: আচ্ছা, দিচ্ছি।

দিব্য দিয়াকে ডেকে আনল।

দিয়া মনে মনে ভয় পেয়ে যায়। রিধি নতুন কোনো ঝামেলা করে নি তো আবার?

দিয়া: হ্যালো।

রক্তিম: হ্যালো দিয়া, কেমন আছো?

দিয়া: জি ভাইয়া, ভালো।

রক্তিম: আসলে ফোন করার কারণ হচ্ছে, রিধি বাসায় খুব বিরক্তবোধ করছে। তাই ঘুরতে চেয়েছিলো তোমাকে নিয়ে। আর, তোমাদের পড়াশুনার চাপ এখন, তাই বলতে চায় নি তোমাকে কিছু। আর তুমি সাথে গেলে ওর একটু ভালো লাগবে। বাই দা ওয়ে ও জানে না আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি। ভেবেছি ওকে সারপ্রাইজ দেওয়া যাক।

রক্তিম ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল। কারণ রিধির বান্ধবীগুলো দিয়ারও বান্ধবী। আর দিয়া যদি এখন বাইরে যেতে চায় রিধির সাথে, তাহলে বোঝা যাবে রিধি কোনো বান্ধবীর সাথেই বের হয়নি। কারন যাওয়ার থাকলে দিয়া এখন বাসায় থাকতো না। রিধির সাথেই থাকতো। আর রিধি যেখানে যায় সেখানে দিয়া অবশ্যই থাকে।

দিয়া: আমার কোনো সমস্যা নেই ভাইয়া। আমি নিজেও বাসায় বিরক্ত হচ্ছি।

রক্তিম: আচ্ছা, তোমাদের কোনো বান্ধবীর জন্মদিন আছে আজকে? কারণ জন্মদিন উপলক্ষেও বের হতে পারবে বাসা থেকে। এমনি এমনি যদি যেতে না দেয়।

দিয়া: না ভাইয়া, এই মাসে তো কারো জন্মদিন নেই।

রক্তিম: আচ্ছা রাখছি। তাহলে তোমাকে পরে জানানো হবে।

রক্তিমের আর বোঝার বাকী নেই রিধি মিথ্যে বলেছে। আর এদিকে রাত বারোটার পর এই প্ল্যান হয়েছিলো তাই রিধি এতোরাতে দিয়াকে বিষয়টি জানাতে পারে নি। আর সকালে নবনী জুনাইয়েতের কাছ থেকে পারমিশন নেওয়া, তৈরি হওয়ার চাপে ভুলেই গিয়েছে দিয়াকে জানানোর কথা।
রিধি বাইরে থাকলে নবনী কখনো দিয়াকে ফোন দেয়নি, রিধিকেই ফোন দিতো। তাই বিষয়টি তার মাথায়ও আসে নি।

রক্তিমের মাথা খুব গরম হয়ে যায়। সে রিধিকে ফোন দেয়।
রিধি রক্তিমের ফোন দেখে কেঁপে উঠল। মনে মনে ভাবছে, রক্তিম কেন ফোন দিয়েছে? রাক্ষসটা বুঝে যায়নি তো?

রক্তিম দাঁত চেপে জোর গলায় বলল,
রক্তিম: কোথায় তুমি?

রিধি: আমি বান্ধবীদের সাথে।

রক্তিম: আমাকে এড্রেস বলো।

রিধি: আপনাকে কেন বলবো? রাখছি আমি।

রক্তিমকে কিছু বলতে না দিয়ে কল কেটে দেয়।

বিকেলে বাসায় ফিরলে রিধি চোরের মতো মাথায় কাপড় দিয়ে ঢুকল। কিন্তু নিরাপদ স্থানে যাওয়ার আগেই রাক্ষসের সামনে এসে পড়ল রিধি। রক্তিম রিধিকে শাড়ি পড়া প্রথম দেখেছে। হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সে। কিন্তু রিধির মাথায় কাপড় দেখে অবাক হয়ে যায়।

রক্তিম মনে মনে ভাবছে, রিধিকে তো আগে কখনো মাথায় কাপড় দিতে দেখিনি। তবে আজ মাথায় কাপড় কেন?

রক্তিম মাথার দিকে ইশারা করে কিছু বলতে যাবে, রিধি ‘আআআআআআআ’ করে চিৎকার দিয়ে উঠল। রক্তিম বুঝে উঠার আগেই রুমে ঢুকে দরজা ভালো মতো বন্ধ করে দেয় রিধি।

নবনী দরজা খুলে দিয়ে রুমে গিয়েছিলেন মাত্র। রিধির আওয়াজ শুনে ভেবেছেন চোর-ডাকাত ঘরে ঢুকে যায় নি তো। তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হয়ে দেখেন রক্তিম হাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছে।

নবনী: কি হয়েছে?

রক্তিম: জানি না, মাথার স্ক্রু ফেলে এসেছে হয়তো বাইরে।

সন্ধ্যায় রিধির চুল খাটো দেখলে নবনী অনেক বকা দেয়।

রিধির ভাষ্যমতে, চুল সামলাবো নাকি পড়াশুনা? তাই কেটে ফেলেছি।

নবনী: চুল খোঁপা করে পড়াশুনা করা যায় না?

রিধি: বাদ দাও না মা। কেটে ফেলেছি তো।

জুনাইয়েত: আহা, নবনী ভালোই লাগছে। কি শুরু করেছো বলো তো? যা, মা রুমে গিয়ে পড়তে বস।

রিধি মনের আনন্দে রুমে চলে যায়।

রিধির লম্বাচুল রক্তিমের অনেক পছন্দের ছিলো। তাই রক্তিম চুল কেটে ফেলার জন্য আর রিধির সাথে কথা বলে নি।
আর রিধি ইফতির সাথেই ঘুরতে গিয়েছিলো সেটি রক্তিম বুঝে যায়। মনে মনে অনেক কষ্ট পায় রক্তিম। কখনো রিধিকে নিয়ে এক রিক্সায় বসে কোথাও ঘুরতে যেতে পারে নি, আর আজ ইফতি একমাসেই রিধির জীবনে এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়? আর কতো অপেক্ষা করলে রক্তিমের ভালোবাসার শেষ সমাপ্তি হবে!

চলবে—-

আগের পর্বের লিংক:
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/373960287659083/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here