অপেক্ষা পর্ব-৩৪+৩৫: (গল্পের নতুন মোড়)

অপেক্ষা পর্ব-৩৪+৩৫: (গল্পের নতুন মোড়)
লেখিকা: সামিয়া বিনতে হামিদ

৩৪.
রিধি ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরলো বিকেল তিনটায়। বাসায় এসে দেখলো নবনী খুব ব্যস্ত। রান্নার আয়োজন চলছে। অনেক কিছুই বানিয়েছেন ইতোমধ্যে বিকেলের নাস্তার জন্য।

রিধি নবনীকে জিজ্ঞেস করলো,
রিধি: মা, কেউ কি আসবে আজকে?

নবনী হেসে বলল,
নবনী: হ্যাঁ, রে। তোদের নানু আসছে।

রিধি: তাই? আচ্ছা, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তারপর তোমাকে সাহায্য করবো।

নবনী: আচ্ছা, যা।

রিধি রুমে যাওয়ার আগেই রক্তিম রিধির হাত ধরে তাকে রুমে টেনে নিয়ে গেলো। রক্তিমের দুহাত রিধির দুপাশে রেখে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো রিধিকে।

রিধি: তোমার মাথার তার কি ছিঁড়ে গেছে?

রক্তিম: তোমাকে দেখলে মাথা কি ঠিক থাকে?

রিধি: আমি ফ্রেশ হবো। ছাড়ো আমায়।

রক্তিম: নানু আসবে, এরপর তো তোমায় আর পাবো না কাছে।

রিধি: নানু আসলে, কাছে না পাওয়ার কি আছে?

রক্তিম: নানুর কিন্তু চোখে অনেক পাওয়ার। দুইদিনে ধরা খেয়ে যাবো।

রিধি: হুহ, চোরের মতো করলে এমনিতেও ধরা খাবে। আর আমরা চুরি করেছি নাকি? ভালোবেসেছি। ভালোবাসায় কি কোনো অপরাধ আছে?

রক্তিম: তুমি বুঝতে পারছো না রিধি। আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিবে না কেউ। চলো আমরা পালিয়ে যায়।

রিধি: ছিঃ, তুমি আমাকে একদম ভালোবাসো না রক্তিম। তাই এমন পঁচা কথা বলছো।

রক্তিম: আমি আমাদের ভালোর জন্য বলছি।

রিধি: পালিয়ে যাওয়া কোনো সমাধান না। আর আমরা কি চোর? পালিয়ে কেন যাবো বলো তো? বাবা-মা আমাদের অনেক ভালোবাসে। আমাদের খুশি তারা অবশ্যই মেনে নেবে। এখন আমাকে ছাড়ো। আমার ফ্রেশ হতে হবে।

রিধি চলে গেলো। রক্তিমের চোখে-মুখে ভয়ের স্পষ্ট ছাপ দেখা যাচ্ছে। মনের মধ্য চলছে তুফান। রক্তিমের মন বলছে কিছু একটা হবেই। নানু আসলে অবশ্যই রক্তিমের বিয়ের কথা তুলবে। আর রিধিকে কখনো তারা মেনে নেবে না। কেন নেবে না রক্তিমের জানা আছে। সেই তথাকথিত সমাজ আর তাদের পরিবারের পুরোনো সংস্কার। কিন্তু রিধির ভেতরটা একদম পরিষ্কার। সে বুঝতে পারছে না সমাজ আর রক্তিমের পরিবারের সংস্কারগুলো কতোটা কঠোর।

বিকেলেই আসলেন নবনী হোসেইনের মা বেগম আতিকা। জুনাইয়েত হোসেইনের মা, খাদিজা হোসেইন আর বেগম আতিকা ছোটবেলার বান্ধবী ছিলেন। সেই সূত্রে তাদের সন্তানদের মধ্যে বিয়ে দিলেন, বন্ধুত্ব আত্মীয়তায় পরিণত করার জন্য। খাদিজা হোসেইনের মৃত্যুর পর জুনাইয়েত হোসেইন আর তার বড়ো দুইভাইকে মায়ের মতো আদর দিয়েছেন বেগম আতিকা। তাই তিনভাই বেগম আতিকাকে মায়ের মতোই সম্মান করে। আর কোনো সমস্যার সমাধানের জন্য তার কাছেই আসে। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কখনো যায় নি তারা।

বেগম আতিকাকে দেখে রিধি অনেক খুশি হলো।

বেগম আতিকাও রিধিকে দেখে বলল,
আতিকা: মাশাল্লাহ, রিধি তো অনেক বড়ো হয়েছে। এখন তো ভালো পাত্র দেখতে হবে।

রিধি আতিকার কথা শুনে মনে মনে ভয় পেয়ে যায়। রক্তিমের দিকে তাকানোর পর রক্তিম চোখ নামিয়ে ফেলে। রক্তিমের এখন নিজেকে আসামী মনে হচ্ছে, যেন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে সে। আর বেগম আতিকার একটি আদেশে যেন মৃত্যু হবে তার ভালোবাসার।

বেগম আতিকার এক ছেলে এক মেয়ে। নবনী ছোট। স্বামীর মৃত্যু হয় ছয়বছর আগে। এই ছয়বছর তিনি বড়ো ছেলের সাথে খুলনায় ছিলেন। চট্টগ্রামে আসতেন বছরে একবার। আসলেও গ্রামেই থাকতেন। শহরের বাতাস তার ভালো লাগে না। তিনি আসলে নবনী-জুনাইয়েত তাকে দেখতে যেতেন গ্রামে। কিন্তু সংসার ছেড়ে কয়দিন মায়ের কাছে থাকা যায়! তাই তিনি নিজেই এবার মেয়েকে দেখতে এসেছেন। আর কয়দিনই বা বাঁচবেন, কিছু সময় মেয়েটিকেও দিতে চান। এক মাস থাকবেন তিনি। মনে মনে পরিকল্পনা করেছেন এই একমাসে রক্তিমের বিয়ের একটা ব্যবস্থা করে ফেলবেন। নাতবৌ দেখার খুব ইচ্ছে তার।

কয়েকদিন কেটে যায় এভাবেই। রিধি-রক্তিমের প্রেমে এসে পড়েছে বিরাট বাধা। ঠিকমতো কথা বলতেও পারে না তারা। আতিকা রিধিকে চোখের সামনেই বসিয়ে রাখেন সবসময়।

একদিন রাতের ঘটনা।

আতিকা: আমি যা দেখছি, তোর চোখে কি পড়েছে?

নবনী: কিসের কথা বলছো মা?

আতিকা: রক্তিম আর রিধির হাবভাব।

নবনী: বুঝলাম না ঠিক।

আতিকা: দুইজনের মধ্যে কিছু একটা চলছে।

নবনী আগে থেকেই জানতেন রক্তিম রিধিকে পছন্দ করে। কিন্তু রিধির ব্যাপারটি তার চোখে পড়ে নি। আর অদিতির প্রতি রক্তিমের ব্যবহার দেখে তিনি ভেবেছেন রক্তিম হয়তো রিধিকে এখন আর ভালোবাসে না। মেনে নিয়েছে হয়তো বাস্তবতা। কিন্তু মায়ের কথা শুনে একটু নড়েচড়ে বসলো নবনী হোসেইন।

নবনী: এমন কিছু না মা। তোমার মনে হচ্ছে।

আতিকা: এই বয়স পার করে ফেলেছি আমি। এসব বুঝি। মনে রাখিস, রিধি আমাদের বংশের মেয়ে না, আর কি বংশ তার? মা-বাবার কোনো পরিচয় আছে? আশ্রিত সে। আর আমাদের বংশের ছেলে-মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সময় এসব বংশগত পরিচয় দেখে আসছি আমরা। এটি আমাদের পরিবারের রীতি। তোর শ্বাশুড়ীতো কখনোই মানতো না এসব। এখনো বিয়ে না দিয়ে মেয়েটিকে ঘরে বসিয়ে রেখেছিস কেন? তোর ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে। মেয়েটিও বড়ো হয়েছে। লোকে জানতে পারলে বাজে কথা রটিয়ে বেড়াবে। আর রিধি? এমনওতো হতে পারে নিম্ন বংশের মেয়ে সে। রক্তে কোনো দোষ আছে কিনা কে বলতে পারে? আমার বংশের ছেলের বিয়ে আমি ওই আশ্রিত মেয়ের সাথে কখনো মেনে নেবো না।

নবনী: এভাবে বলছো কেন মা? আমি বড়ো করেছি রিধিকে।

আতিকা: বড়ো করেছিস, মাথার উপর ছাদ দিয়েছিস, পড়াশুনা করিয়েছিস, ঢের হয়েছে। এখন ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দে। রক্তিমের কথা ভেবে দেখ। তোর ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করিস না। এদের মধ্যে কিছু নিশ্চয় আছে। এদের বিয়ে যদি হয়, সমাজে আমরা মুখ দেখাতে পারবো না। রক্তিমের শ্বশুর বংশ কি, যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, কি বলবি? আর রিধি? এতোবছর এইখানে আছে। একই ছাদের নিচে রক্তিম আর রিধি। এখন যদি বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় তখন যারা জানে না রিধি পালিত, তারাও জেনে যাবে। তখন আঙ্গুল তুলবে রক্তিমের চরিত্রে। অবশ্যই বলবে, কোনো অনৈতিক সম্পর্ক ছিলো। ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এই বিয়ে। বল, তখন কি করবি?

নবনী চুপ করে আছে।

আতিকা নবনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
আতিকা: মা, আমার। জানি রিধিকে তুই বড়ো ভালোবাসিস। কিন্তু রক্তিমই তো তোর সন্তান। রিধি মেয়েটাও বড়ো লক্ষী, দেখতেও খুব মিষ্টি। ভালো ছেলেই পাবি তার জন্য।

নবনী: রাজিয়া আপার ছেলেটা বড়োই ভদ্র। আমি ভেবে রেখেছিলাম রিধির জন্য।

আতিকা: তুই না বলেছিস বিয়ে হয়েছে তার?

নবনী: দিব্যের বিয়ে হয়েছিলো। আরেকটা ছেলে আছে তো। বাবার সাথে থাকে। রোহান আহমেদ। ভাবছি কি, রাজিয়া আপাকে বলবো।

আতিকা: হ্যাঁ, বরং তাই কর। কিন্তু যা করার তাড়াতাড়ি কর। রক্তিমের জন্যও মেয়ে দেখা শুরু কর। বিয়েটা হয়ে যাক আগেপাছে।

নবনী: ইফতেখার ভাই আছেন না? ওই যে আমেরিকা থাকেন? তার মেয়ে অদিতি, রক্তিমের ক্লাসমেট ছিলো। বড়োই লক্ষী মেয়েটি। রক্তিমকে খুব ভালোবাসে। জুনাইয়েতও পছন্দ করে অদিতিকে। কথা বলে দেখবো?

আতিকা: হ্যাঁ হ্যাঁ বলে দেখ। যাক তাহলে, নিশ্চিত হলাম।

রাতে নবনী হোসেইন জুনাইয়েতের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলো। রিধিকে বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কোনো ইচ্ছেই নেই জুনাইয়েতের। রিধি নিজের পায়ে দাঁড়াবে তারপরই বিয়ে দেবেন। কিন্তু রক্তিমের জন্য বউ আনার ইচ্ছে তার আছে। ছেলের তো যথেষ্ট বয়স হয়েছে।
পরেরদিন সকালে ইফতেখার সাহেবকে ফোন দেন জুনাইয়েত। ছেলের বিয়ের প্রস্তাব দেন। ইফতেখার সাহেব জানিয়ে দেন, তার কোনো আপত্তি নেই। বরং তিনি কয়েকদিনের মধ্যে এই বিষয়ে ফোন করতেন জুনাইয়েতকে। কথা পাকাপাকি হয়ে যায়। আগামী সপ্তাহে অদিতি আর ইফতেখার খান দেশে আসবেন। রক্তিমকে এখনো জানানো হয় নি। বেগম আতিকা চান না বিষয়টা এখন রক্তিম জানুক।

রাতে রিধি ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলো। পেছন থেকে রক্তিম এসে জড়িয়ে ধরলো রিধিকে।

রিধি ভয় পেয়ে যায়। রক্তিম আশ্বস্ত করে বলল,
রক্তিম: আমি ছাড়া আর কে হবে?

রিধি: আমার খুব ভয় লাগছে রক্তিম। মনে হচ্ছে তোমাকে হারিয়ে ফেলবো।

রক্তিম: এতো সহজে হারিয়ে যাবো না আমি। আমি তোমারই থাকবো।

রিধি: নানু ইদানীং কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করছে। আজ কারো বিয়ে নিয়ে কথা বলছিলো। আমাকে দেখেই চুপ হয়ে যায়। কার বিয়ে হবে? আমি না তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না। আর তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করলে আমি এই ছাদ থেকে লাফ দেবো।

রক্তিম রিধিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
রক্তিম: এসব ফালতু কথাবার্তা বললে, মেরে লাল করে দেবো একদম। এতোবছর অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য। ভাষাহীন অপেক্ষা। এখন যদি এই অপেক্ষার সমাপ্তিতে হেরেই যায় তাহলে আমার ভালোবাসার হ্যাপি এন্ডিং তো হবে না। এখন না হয় একটু সংগ্রাম করবো সমাজের সাথে, পরিবারের সাথে। দেখবে, মেনে নেবে সবাই। সমাজ আর পরিবারের রীতিনীতি কখনো সন্তানের সুখের চেয়ে বড়ো হয় না। আর আমার সুখের ঠিকানা একমাত্র রিধির সাথেই। কেউ আলাদা করবে না আমাদের।

এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয় হতে। আজ এক অন্ধকার রাত সাক্ষী তাদের ভালোবাসার। আর এমন কতো রাত পার করলে রিধি-রক্তিমের ভালোবাসার পূর্ণতা পাবে তা হয়তো কেউ বলতে পারবে না।

৩৫.
কলিংবেলের শব্দ শুনে ফয়সাল আহমেদ দরজা খুললেন। দরজা খুলে দেখলেন ঊষার মা, সাহেদা খালা দাঁড়িয়ে আছেন। সাহেদা ভেতরে এসে বসলেন।

ফয়সাল: খালাম্মা, তুমি অসুস্থ শরীর নিয়ে আসলে কেন? আমায় ফোন দিতে আমি চলে আসতাম।

সাহেদা: দাওয়াত দিতে আসে, কেউ নিতে আসে না। আমি আজ দাওয়াত দিতে এসেছি। বড়ো খুশির সংবাদ।

ফয়সাল: আচ্ছা, তাহলে বলো তাড়াতাড়ি।

সাহেদা খালা: ঊষা রাজি হয়েছে। ওর আজিজকে বিয়ে করতে আপত্তি নেই।

ফয়সাল: আলহামদুলিল্লাহ। অনেক বেশি খুশির সংবাদ।

ফয়সাল রোহানকে ডাক দিলো। রোহান এসে সাহেদাকে সালাম করলো।

সাহেদা: দাদুভাই, এখন যে তোমার ঊষা মার বিয়ে ঠিক হয়েছে। খুশি তো তুমি?

রোহান: জি দাদু, অনেক ভালো লাগছে শুনে।

সাহেদা: বাবা ফয়সাল, তেমন আয়োজন করতে দিচ্ছে না ঊষা। মসজিদে আক্দ হবে, ওইখানে যাবি তুই রোহানকে নিয়ে।

ফয়সাল: আচ্ছা, খালাম্মা। আমরা আসবো।।

সাহেদা: আক্দের পরের দিন ওরা চলে যাবে দেশের বাইরে। ঊষা তোকে দেখতে চায় না ফয়সাল। তুই বাসায় আসিস না আপাতত। তুই তো জানিস মেয়েটা তোকে কতো ভালোবাসে। ও তোকে দেখলে দুর্বল হয়ে যায়। এতোদিন তোর অপেক্ষায় ছিলো।

ফয়সাল আহমেদ চুপ করে বসে আছেন। ঊষা বিয়ে করছে শুনে ভালোই লেগেছে তার। মেয়েটার অপেক্ষার মূল্য দিতে পারে নি, তাই বড্ড খারাপ লেগেছিলো। কিন্তু ঊষার ভালোবাসার সমাধান দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তবে আজ ঊষার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হবে জেনে খুশি হয়েছেন তিনি।

সাহেদা: রোহান দাদুভাই, তোর ঊষা মা তোকে যেতে বলেছে এয়ারপোর্টে। শেষবার তোকে দেখতে চায়। অবশ্যই যাবি কিন্তু।

রোহান: হ্যাঁ, দাদু। অবশ্যই যাবো।

তিনদিন পর ঊষার আক্দ হয়ে যায় আজিজের সাথে। পরের দিন তারা চলে যায় দেশের বাইরে। রোহান গিয়েছিলো এয়ারপোর্টে।
ঊষা রোহানকে দেখে কেঁদে দিয়েছিলো।

ঊষা: তোকে মায়ের মতো ভালোবাসতে পারি নি। কিন্তু আমি চেষ্টা করেছিলাম। হয়তো মা হওয়ার অনুভূতি আসে নি, তাই তোর মনে জায়গা পাই নি।

রোহান: এভাবে বলো না, তুমি অনেক ভালো।

ঊষা: রোহু, এই চিঠিটা তোর জন্য। এখানে আমি আমার জীবনের সব কিছুই লিখে দিয়েছি যা হয়তো কেউ জানে না। মুখে বলার ভাষা নেই। হয়তো এই চিঠি পড়ার পর তুই আমাকে ঘৃণা করবি। কিন্তু আমাকে ওয়াদা কর, এই ব্যাপারে কখনো তোর বাবা আর মাকে কিছু বলবি না।

রোহান: আচ্ছা, বলবো না। আমার উপর বিশ্বাস রেখো।

ঊষা: আচ্ছা আমি যায়। আর ফিরে আসবো না তোদের জীবনে। একটাই ইচ্ছে আমার, কখনো যাতে তোর বাবার সাথে দেখা না হয়। আমার অপেক্ষার ফল আজ আমায় এভাবে পেতে হয়েছে! কিন্তু আজিজ অনেক ভালো। তোর বাবা ঠিকই বলেছিলো। সব জেনেও মেনে নিয়েছে আমাকে। ভালো রাখবে ইনশাল্লাহ। ভালো থাকিস তোরা। দিব্য আর দিয়ার সাথে আর দেখা হলো না। তোর বাবার খেয়াল রাখিস। বয়স বেড়েছে কিন্তু দেখায় না। ভেতরে ভেতরে খুব দুর্বল। আর রাজিয়াকে খুব ভালোবাসে। অনেক ভাগ্যবতী তোর মা। এতো বছরের দূরত্বও তাদের ভালোবাসার কোনো পরিবর্তন ঘটায় নি। একেই বলে বিশুদ্ধ ভালোবাসা।

ঊষা চলে গেলো নতুন জীবন শুরু করতে। ঊষার জীবন সুখের হোক, এইটাই একমাত্র চাওয়া। মেয়েটি বহু অপেক্ষা করেছিলো ভালোবাসার জন্য। তবে আজ যাত্রা শুরু করছে নতুন ভালোবাসার হাত ধরে। আজিজকে সে ভালোবাসে না। একদিন ভালোবেসেও ফেলবে হয়তো।

রোহান বাসায় এসে চিঠিটা পড়া শুরু করলো।

প্রিয় রোহু,
প্রথমেই ক্ষমা করিস আমায়। জানিস? আমি ছোটবেলা থেকেই তোর বাবাকে ভালোবাসতাম। কিন্তু কখনো বুঝতে চাই নি, সে আমাকে নিয়ে কি ভাবে? তোর বাবা ভালোবেসেই তোর মাকে বিয়ে করে আনেন। আর আমি বোকার মতো তোর বাবার স্বপ্নে বিভোর ছিলাম। আমার ভালোবাসা এতো অন্ধ হয়ে যায় যে, আমি মনে মনে তাদের দেখে খুব কষ্ট পেতাম। সহ্য করতে পারতাম না। তোরা দুই ভাই হওয়ার পর তোর মা তোদের নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকতো। ওই সুযোগ আমি নিয়েছিলাম। তোর বাবা বড্ড ভালো রে। কখনো খারাপ নজরে দেখে নি আমাকে। সে চাইলে পারতো আমার সাথে সম্পর্কে জড়াতে। কিন্তু কখনো সুযোগ নেয় নি। আমাদের কথার বেশিরভাগ সময় সে তোর মায়ের জন্য কী কিনবে, কী রাঁধবে, তোরা ছোট ছিলি, তোদের জন্য কী করবে এসব ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতো। কিন্তু তোর মা ভেবে নিয়েছে অন্য কিছু। ঝগড়া হয় তাদের মধ্যে। আমি জানতাম তোর বাবা কোনো প্রশ্নের ব্যাখ্যা দেওয়া পছন্দ করে না। কেউ সন্দেহ করলে বা তোর বাবাকে কেউ খারাপ মনে করলেও সে চুপ থাকবে। তবুও কোনো কৈফিয়ত দেবে না। কিন্তু ওইদিন আমাকে বাসা থেকেই বের করে দেয়। অপমান না করলেও বড়ো কঠোর ভাষায় চলে যেতে বলেছিলো। রাজিয়ার রাগটা আমার উপর ঝেড়েছিলো। খুব ক্ষোভ আসে আমার। কয়েকবছর পর পড়াশুনা শেষ করেই চলে আসি চট্টগ্রামে। ততোদিনে দিয়ার জন্ম হয়। আমি সুযোগ খুঁজি। তোর মায়ের সাথে ভালো সম্পর্ক হয় আমার। তোর বাবার নামে উল্টাপাল্টা বুঝানো শুরু করি তারপর। সন্দেহ ঢুকিয়ে দেই মাথায়। ডক্টর হওয়ার কারণে তোর বাবাকে অনেক রোগী ফোন দিতো। মাঝে মাঝে রাতে ডিউটি পড়তো। আমি না ঘুমিয়ে রোগী সেজে মেসেজ করতাম। কখনো কখনো তোর মায়ের চোখে পড়ে যেতো। এভাবে শুরু হয় তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি। রাজিয়া অনেক জেদি মেয়ে ছিলো। কিন্তু তবুও তোর বাবাকে ছেড়ে যায় নি। শেষে, আমার বান্ধবীর মাধ্যমে তোর বাবার নামে মিথ্যে অপবাদ দেই যে, তোর বাবার অবৈধ সম্পর্ক আছে। অবৈধ সন্তানের বাবাও হবে। আমার প্ল্যান কাজ করে। তোর মা ওইদিন রাতেই বাসা ছেড়ে চলে যায়। তোকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু তোর বাবার সাথে অনেক কথা কাটাকাটি হয়। যার কারণে দিব্য আর তোর মধ্যে যেকোনো একজনকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই পুরো ঘটনায় তোর মায়ের কোনো দোষ ছিলো না। দোষ ছিলো তোর বাবার। এতো কিছু জেনেও কখনো যায় নি সব ঠিক করতে। কারণ সে একগুঁয়ে। কৈফিয়ত দেবে না। আর আমি আমার কুকাজে সফল হয়ে যায়। তবুও পেয়েও পায় নি আমার ভালোবাসা। আমি অনেক খারাপ। আমি সব স্বীকার করি। আমি তোর শৈশব ধ্বংস করেছি। আমিই তোর মায়ের কাছ থেকে তোকে আলাদা করেছি। তোর চাপা কষ্টের কারণ আমি। পনেরো বছর ছিনিয়ে নিয়েছি আমি তোদের জীবন থেকে। তবুও ক্ষমা করে, আমাকে মুক্তি দিস। এই কথা তোর বাবা জানলে সব শেষ করে দেবে। আমি চাই না ফয়সাল এসব জানুক। প্লিজ রোহু, মাফ করিস আমাকে। তোর বাবা-মাকে এসব কথা বলিস না।
তোর ঊষা মা।

মনে মনে রোহান একটা কথাই বলছে ঊষার উদ্দেশ্যে,
রোহান: চাইলেও তোমাকে মাফ করতে পারবো না। তুমি আমার জীবনটাই এলোমেলো করে দিয়েছো। আজ তোমার কারণে দিব্য বাবাকে ঘৃণা করে। দিয়া বাবার আদর পায় নি। এতোটা বছর মা কতো বড়ো পাথর জমিয়ে রেখেছিলো। আর বাবা? কিভাবে নিজেকে সামলেছিলে? এতো বড়ো অপবাদ প্রিয় মানুষের মুখ থেকে শুনলে কারোই ভালো লাগে না। ইশাকে ছাড়া এক একটা দিন আমার বহু কষ্টে কাটে। আমি তো শুধুই ভালোবেসেছিলাম। আমার ইশার সাথে কোনো সুন্দর মুহূর্তও ছিলো না। তবুও বড়ো কষ্ট হয় ইশাহীন এই জীবন নিয়ে ভাবতে। আর যারা সুন্দর স্মৃতি নিয়ে আলাদা হয়েছে, তাদের কষ্টগুলো কেমন হতে পারে ভাবতেও পারছি না। দম আটকে যায় প্রিয় মানুষ থেকে আলাদা থাকতে। প্রিয় মানুষের জন্যে অনিশ্চিত অপেক্ষায় থাকা জীবনের একটি কঠিন পরীক্ষা।

ঊষা এখন নিজেই স্বীকার করেছে সে এই ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করিয়েছিলো। ওয়াদা করেছিলো রোহান এই কথা বাবা-মাকে বলবে না। কিন্তু দিব্যকে না জানালে তাদের বাবা-মার এই ভাঙা সম্পর্ক আর কোনোদিন জোড়া লাগবে না। কারণ দিব্য ফয়সাল আহমেদকে অপরাধী ভাবে। আর সে কখনো এই মিল হতে দেবে না। তাই রোহান দিব্যকে এই চিঠি দেখায়। আর সব খুলে বলে। এরপর চিঠিটা জ্বালিয়ে দেয়। এখন দুই ভাই মিলে পরিকল্পনা করছে তাদের মা-বাবার অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটানোর। খুব শীঘ্রই সমাপ্তি ঘটবে পনেরো বছরের অনিশ্চিত অপেক্ষার।

এদিকে কয়েকদিন পর অদিতি আর ইফতেখার খান দেশে আসেন। অদিতি এসেই আবার লেগে পড়ে রক্তিমের পেছনে। রক্তিম যথেষ্ট অবহেলা দেখিয়েছে অদিতির প্রতি। অদিতি মনে মনে অনেক কষ্টও পায়।

ইফতেখার খান আর জুনাইয়েত হোসেইন দেরী না করে সম্পর্কটি এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

রাতে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ইফতেখার খান আসেন মেয়ে অদিতিকে নিয়ে। বেগম আতিকা, নবনী আর জুনাইয়েত হোসেইনের কোনো দ্বিমত নেই। রক্তিমকে ডেকে আনা হয়।

রিধি পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলো।

নবনী: রক্তিম, আমাদের অদিতিকে পছন্দ। তুই কি বলিস?

রক্তিম কি বলবে বুঝতে পারছে না। এমন একটা অবস্থার জন্য সে একদমই প্রস্তুত ছিলো না। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। এভাবে সবার সামনে না জানিয়ে তাকে আগে জানানো উচিত ছিলো। এখন বিব্রতকর একটি পরিস্থিতিতে পড়েছে রক্তিম।

রিধির হাত পা আর চলছে না। সে রক্তিমকে হারিয়ে ফেলেছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রুমে ঢুকে দরজা বেঁধে দিলো।

রক্তিম: আমার অদিতির সাথে কিছু কথা আছে।

আতিকা: কিসের কথা? এখানেই বল।

ইফতেখার: না না বলুক, তাদের বিয়ে হবে তাদের মতামত আগে।

জুনাইয়েত: হ্যাঁ, দুজনে কথা বলেই সিদ্ধান্ত নিক। যা রক্তিম।

তারা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।

অদিতি রক্তিমকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল,
অদিতি: আই লাভ ইউ রক্তিম। আমার এই বিয়েতে অমত নেই। আমি তোমাকে ভালোবাসি স্কুল থেকেই। আমার এখন ভাবতেই ভালো লাগছে আমাদের বিয়ে হবে। আমার অপেক্ষার সমাপ্তি হবে।

রক্তিম: কিন্তু আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। আমি তো এই বিয়ে করতে পারবো না।

অদিতি: পাগল হয়েছো তুমি? কি যা তা বলছো?

রক্তিম: আমাকে কেউ জানায় নি এই ব্যাপারে। আজ জানলাম এসব কথাবার্তা। অদিতি তুমি আমার ভালো ফ্রেন্ড। কিন্তু আমি এর চেয়ে বেশি কখনো ভাবি নি। আমি ভালোবাসি না তোমাকে, সরি।

অদিতি অন্য পাশে ফিরলো। প্রচুর কান্না পাচ্ছে তার।

নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
অদিতি: কে সেই মেয়ে, যে তোমার মনে জায়গা পেয়েছে?

রক্তিম: রিধি।

অদিতি: রিধি? কিভাবে সম্ভব। ও তোমার…..

রক্তিম: রিধিকে দত্তক নেওয়া হয়েছে। ওর সাথে আমার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই, তবে আত্মার সম্পর্ক ঠিকই হয়েছে। অনেক অপেক্ষা করেছি রিধির ভালোবাসার জন্য। আজ আমার ভালোবাসাও আমি পেয়েছি। রিধিও আমাকে ভালোবাসে। এখন শুধু সবাইকে জানানো বাকী।

অদিতি: তোমার নানু, মা, বাবা মেনে নেবে রিধিকে তোমার বউ হিসেবে?

রক্তিম: কোনো সমস্যা আছে রিধির মধ্যে?

অদিতি: তোমার পরিবারে বংশ-জাত এসব নিয়ে খুব কঠোর নিয়ম আছে। রিধির তো কোনো বংশ পরিচয় নেই।

রক্তিম: মানুষ হিসেবে পরিচয়টা সবচেয়ে বড়ো পরিচয়। রিধিকে ভালোবেসেছি আমি। তার বংশকে না। বিয়ে রিধিকেই করবো। আর ভালো বংশে জন্ম নিয়েও মানুষ খারাপ হয়। ভালো-খারাপ চরিত্র আমাদের নিজেকে গঠন করতে হয়। বংশ কখনো চরিত্রের সার্টিফিকেট হতে পারে না। আমি চাই আমার রিধিকে তারা মানুষ হিসেবে মেনে নেবে। চরিত্র দেখে মেনে নেবে। বংশ দেখে না। আমি এর শেষটা দেখতে চাই। যেদিন আর কোনো সুযোগ থাকবে না ওইদিন ভালো মতো খোঁজ নিয়ে সামনে আনবো রিধির বংশের ট্যাগ। এর আগে আমি একটা বার সুযোগ দিতে চাই আমার বাবা-মাকে এই রীতিনীতি পাল্টানোর, মানুষকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দেওয়া, বংশজাত দেখে না।

অদিতি: আমি তোমাকে খুব ভালোবেসেছিলাম। আর রিধিকেও আমার খুব ভালো লাগে। আমি তোমার ভালোবাসায় বাঁধা হবো না রক্তিম। আমি তোমার ভালোবাসা পাবো না তো কী হয়েছে, বন্ধু হয়ে থাকার সুযোগটা হারাতে চাই না।

রক্তিম: ধন্যবাদ অদিতি।

অদিতি: চলো, এখন। সবাই আমাদের অপেক্ষায় আছে।

অদিতি আর রক্তিম জানিয়ে দেয় সম্পর্কটা বাড়ানোর ইচ্ছে নেই তাদের। ইফতেখার আর অদিতি চলে গেলে, নবনী রক্তিমকে জেরা করা শুরু করে।

চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনে রিধি রুম থেকে বের হয়। চোখগুলো কাঁদতে কাঁদতে ফুলিয়ে ফেলেছে একদম। যখন বুঝতে পারে রক্তিম না করে দেয় তখন এই কান্নার মাঝেও সে হেসে ফেলে।

রক্তিম আর রিধি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। রিধির মুখে হাসি দেখে রক্তিমের মুখে হাসি ফুটেছে। কারণ সে ভালোবাসার প্রথম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।

চলবে-

আগের পর্ব :
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/374528140935631/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here