অপেক্ষা
লেখিকা: সামিয়া বিনতে হামিদ
পর্ব-(৩৬+৩৭)
৩৬।
রক্তিমের বাসার পরিবেশ এখন থমথমে। অদিতি ও তার বাবা চলে যাওয়ার পর রক্তিম জুনাইয়েতকে জানিয়ে দেয় সে রিধিকেই ভালোবাসে, আর বিয়ে করলে রিধিকেই করবে। জুনাইয়েত সাহেব কিছু না বলে চলে যান নিজের রুমে। নবনী হোসেইন স্বামীকে অনুসরণ করেন। কিন্তু বেগম আতিকা রিধির উপর খুবই বিরক্ত। যেন সবকিছুর জন্য রিধিই একমাত্র দায়ী। রিধির হাত শক্ত করে ধরে তাকে টেনে নিয়ে যেতে গেলেই রক্তিম বাঁধা দেয়।
রক্তিম: নানু, প্লিজ। তুমি রিধিকে কিছু বলো না।
আতিকা: চুপ কর তুই। আমাদের নাক কাটিয়েছিস, এই মেয়ের সাথে প্রেম করে। কি আছে এই মেয়ের মধ্যে? না আছে বংশ, না আছে নাম। কোথা থেকে কুঁড়িয়ে এনে পড়ালেখা করিয়েছি দেখে আমাদের সামনে এভাবে বেহায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে।
রক্তিম: নানু, তুমি রিধিকে এতোবড়ো কথা বলতে পারবে না। যা বলার আমাকে বলো। ওর কোনো দোষ নেই।
আতিকা: না, কোনো দোষ নেই! দোষ তো সব আমাদের। একে অনাথাশ্রমে রেখে না এসে ঘরে তুলেছি।
আতিকা রিধির সামনে যাচ্ছেতাই বলে রিধিকে অপমান করছে। আর রক্তিম রিধিকে এসব কঠোর ভাষা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে।
সকালে জুনাইয়েত সাহেব না খেয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান। রিধিকে তিনি অনেক ভালোবাসেন। কিন্তু রক্তিম আর রিধির কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে এটি তিনি কল্পনাও করেন নি। তিনি মনে করতেন তাদের মধ্যে যা ছিলো তা ভাই-বোনের সম্পর্কের মতো।
রক্তিম আজ আর অফিসে যায় নি। রিধিকে এই পরিবেশে রেখে যাওয়ার সাহস নেই তার।
সকালে রিধি নবনী হোসেইনের কাছে আসলো।
রিধি কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,
রিধি: আমি তোমাদের কষ্ট দিয়েছি তাই না? সরি। আমি ইচ্ছে করে করি নি। সত্যি!
নবনী রুমের দরজা বেঁধে দিয়ে রিধিকে টেনে কাছে আনলো।
নবনী: ইচ্ছে করে করিস নি? আচ্ছা মানলাম। ভুল তো সন্তানদেরই হয়। মা-বাবা কেন আমরা? ভুলগুলো ক্ষমা করে দেওয়ায় আমাদের দায়িত্ব।
রিধি হালকা হেসে চোখ ভালোমতো মুছে বলল,
রিধি: তুমি আমাদের ক্ষমা করেছো?
নবনী: হ্যাঁ, তবে এক শর্তে।
রিধি: তুমি যা বলবে তাই হবে। আমি তোমার সব কথা মানবো এখন থেকে।
নবনী: যা হয়েছে ভুলে যা। রক্তিমকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। তোর জন্য ভালো ছেলে খুঁজে আনবো। অনেক ধুমধাম করে বিয়ে দেবো। তুই সুখে থাকবি।
রিধি নবনীর কথায় স্তব্ধ হয়ে গেলো। রক্তিমকে সে মাথা থেকে কিভাবে ঝাড়বে? রক্তিমতো তার মন-প্রাণ সব জায়গায় অধিকার জমিয়েছে। সে পারবে না রক্তিমকে ভুলতে।
কাঁপা গলায় নবনীকে বলল,
রিধি: আমি ভা..ভা…ভালোবাসি রক্তিমকে।
নবনী: চুপ। একদম চুপ। এসব কথা বেহায়ার মতো বলছিস কিভাবে তুই? আমার একটা মাত্র ছেলে। আমি তোর সাথে বিয়ে দিয়ে আমার ছেলের জীবনটা ধ্বংস করে দেবো?
রিধি: আমি ওর অনেক খেয়াল রাখবো, সত্যি।
নবনী: তোকে আমরা মেয়ের মতো বড়ো করেছি। কোনো ইচ্ছের অপূর্ণ রাখি নি। যা চেয়েছিস তাই দিয়েছি। আর আমাদের তুই এই প্রতিদান দিচ্ছিস? আজ বুঝতে পারলাম আমি এতোদিন দুধ কলা দিয়ে সাপ পুষেছি।
রিধি নবনীর পায়ের কাছে বসে পড়ল।
রিধি: আই প্রমিজ, তুমি এখন থেকে যা বলবে সব করবো। যতো কঠিন কাজ দেবে সব মেনে নেবো। যতো ইচ্ছে কড়া ভাষায় কথা বলবে, কখনো কিছু বলবো না। কিন্তু রক্তিমকে কেঁড়ে নিও না। আমি ওকে ছাড়া ভালো থাকবো না।
নবনী: তোর ভালো থাকার জন্য কি আমরা সবাই কষ্টে থাকবো? আর তোর বাবা? ওহ বাবা কেন বলছি? তুই কি কখনো আমাদের বাবা-মা ভেবেছিস? আর কিভাবে দাঁড়াবি তার সামনে? রিধি মা, রিধি মা বলে তোকে ডাকতো। বিশ্বাস করতো তোকে। আর তুই তার ছেলের সাথেই ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছিস? এ সম্পর্ক আমরা কখনো মানবো না। আমাদের বংশের ছেলের জন্য উচ্চবংশীয় মেয়ে ঘরে আনে, যারা আমাদের স্ট্যাটাসের হয়। আর আমার তো দুইটা তিনটা না একটি মাত্র ছেলে। ছেলের বিয়ে নিয়ে, তার বউ নিয়ে কতো স্বপ্ন ছিলো আমাদের। এভাবে সব নষ্ট করে দিবি তুই? আমাদের দেখে দয়া হয় না? এতোকিছু করেছি তোর জন্য, তারপরও?
রিধির কান্নার বেগ ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে। নিজেকে নগণ্য আর আবর্জনা মনে হচ্ছে এখন। আজ রিধির মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে তার কিছুই নেই। তার আম্মি-বাপ্পি ছাড়া কেউ তাকে মন থেকে ভালোবাসে নি কখনো। মুখ চেপে কাঁদছে যাতে রক্তিমের কানে এই শব্দ না পৌঁছায়। ভালোবাসার মানুষটির সামনে ছোট হতে চায় না রিধি। রক্তিমের কাছে রিধি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সেই গুরুত্ব কমানোর ইচ্ছে নেই তার।
রিধি তার ঘরে এসে দরজা আটকে এক কোণে বসে পড়লো। ছোটবেলার একটা ড্রয়িং খাতা ছিলো, যেখানে তার বাপ্পি-আম্মি আর অনু ভাইয়ার ছবি এঁকেছিল রিধি। তার কাছে তাদের কোনো ছবি ছিলো না। মস্তিষ্ক থেকেও মুছে যায় তাদের ছবি। তার কাঁচা হাতে আঁকা ছবিগুলোতে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ছবিগুলোকে বের করে নিয়ে আসবে তার কাছে। একটা পেন্সিল নিয়ে রিধি তাদের পাশে একটা ছবি আঁকলো নিজের। নাম লিখলো ছবির নিচে অনাথ অসহায় মেয়ে রিধি।
কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে শুয়ে পড়লো। রিধির মাথায় কাজ করছে না সে কি করবে? রক্তিমকে ছাড়া সে ভালো থাকবে না, আর বাবা-মা কে কষ্ট দিয়েও সে শান্তিতে থাকতে পারবে না।
দুপুরে রক্তিম রিধির রুমের দরজায় কড়া নাড়লো। ধীর কন্ঠে রিধিকে ডাকছে,
রক্তিম: রিধি, কিছু খেয়ে নাও। নয়তো শরীর খারাপ করবে। দেখো, তুমি না খেলে আমিও খাবো না বলে দিলাম। তখন আমি যদি অসুস্থ হয়ে পড়ি? তোমার দোষ হবে কিন্তু। অনশন করছো নাকি? দেখো আমি করবো অনশন, তোমার এসব করতে হবে না। রিধি প্লিজ দরজাটা খোলো। কিছুতো বলো। ঠিক আছো তুমি? দেখো আমি দরজা ভেঙে ফেলবো বলছি কিছু না বললে।
রিধি: রক্তিম, আমার ক্ষিধে নেই। প্লিজ যাও। আমাকে একা থাকতে দাও, প্লিজ।
জুনাইয়েত সন্ধ্যায় বাসায় আসেন। রক্তিম বাবার কাছে যায়। জুনাইয়েত সাহেবের পা ধরে রিধি ও তার সম্পর্কটা মেনে নেওয়ার জন্য ভিক্ষা চায়। আর জুনাইয়েত সাহেবের মনও গলে যায়। তিনি কখনো চান নি রিধি তাদের চোখের আড়াল হোক। রক্তিম আর রিধির বিয়ে হলে রিধি সারাজীবন তাদের সাথেই থাকবে।
সমাজ, পরিবারের রীতিনীতি, বংশজাত এসব নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। সন্তানদের খুশিই তার জন্য সব। কিন্তু নবনী আর বেগম আতিকার এই সম্পর্কে মত নেই। অন্যদিকে বেগম আতিকার বিরুদ্ধে জুনাইয়েত সাহেব কখনো কথা বলেন নি, যেহেতু বেগম আতিকা তার মায়ের মতোই।
রক্তিম আজ শুধু তার বাবা-মা না, বেগম আতিকার কাছেও অনেক অনুরোধ করেছিলো। কিন্তু রক্তিমের চোখের পানি, মনের যন্ত্রণা কেউ বুঝতে পারলো না।
সব বাবা-মা চায় তাদের সন্তান ভালো থাকুক। সুখে থাকুক। তাই রক্তিমের বাবা-মার মতো অনেক বাবা-মারা ভালোবাসার সম্পর্কগুলো অনেক সময় মেনে নেন না। কিন্তু এখানে কেউ অপরাধী নন। সমস্যা শুধুমাত্র দৃষ্টিভঙ্গির। ভালোবাসার মানুষকে একজন প্রেমিক বা প্রেমিকা যে দৃষ্টিতে বিচার করে, বাবা-মা ওই দৃষ্টিতে দেখেন না। আর বাবা-মা যে দৃষ্টিতে দেখে সিদ্ধান্ত নেন, সেই দৃষ্টি বোঝার ক্ষমতা সন্তানদের মাঝে নেই। যদি ভাগ্যক্রমে ওই দৃষ্টিভঙ্গি মিলে যায় তখন হয়তো মেনে নেওয়াটা অনেক সহজ হয়। সম্পর্কগুলোর বাস্তবতা ভাগ্যের হাতে। রক্তিমের ভালোবাসার অপেক্ষা, রিধির রক্তিমকে কাছে পাওয়ার অপেক্ষা যদি বাস্তবতার আড়ালে হারিয়ে যায় এখানে শুধুমাত্র তাদের ভাগ্যের দোষ। অন্যকারো দোষ নেই।
এক মিষ্টি হাওয়ার মতো ভালোবাসার ছোঁয়ায় জেগে উঠেছিলো রিধি-রক্তিম। ভালোবাসা ছিলো তাদের মনে-প্রাণ জুড়ে। আগেপাছে কি হবে এসব ভেবে দেখে নি। প্রেমে পড়লে মানুষ বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যায়। কল্পনার রাজ্যে বিরাজ করে। তখন তার কাছে এই কল্পনায় বাস্তব জগত মনে হয়। কিন্তু যখন তাদের বাস্তবতায় আসতে হয় ছুটে যায় বহুপ্রেমের গল্প। কেউ চোরের মতো পালিয়ে পূর্ণতা দেয়, যা কখনো সমাধান হতে পারে না। আর কেউ কেউ মৃত্যুকে বরণ করে ইতিহাস গড়তে যায়, যা ইতিহাস না হয়ে মানুষের কাছে উপহাস হয়ে পড়ে। আর কিছু মানুষ বাস্তবতা মেনে নিয়ে ছেড়ে দেয় প্রিয় মানুষটির হাত। মনে কষ্ট থাকলেও তারা অন্যের জন্য মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখতে পারে। তবে সৃষ্টিকর্তা যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। অন্যের জন্য কোনো কিছু ত্যাগের ফল কখনো খারাপ হয় না।
নবনী হোসেইন আর বেগম আতিকা কয়েকদিন ধরেই রিধির জন্য রোহানের বাবা-মার সাথে কথা বলার চাপ দিচ্ছে জুনাইয়েতকে। ইচ্ছে না থাকা শর্তেও তিনি নবনীকে সাথে নিয়ে রাজিয়া রহমানের বাসায় যান বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।
রাজিয়া রহমান প্রস্তাব শুনে বললেন,
রাজিয়া: রিধিকে আমার খুব পছন্দ। কিন্তু রোহানের বাবার সাথে কথা বলা উচিত আপনাদের। রোহান তার বাবার সাথেই থাকে।
নবনী আর জুনাইয়েত বাসায় আসলেন শুষ্ক মুখে। বেগম আতিকা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো তাদের। রাজিয়ার উত্তর তাদের পছন্দ হয় নি। জুনাইয়েত তো বলেই দিয়েছেন, এমন ঘরে তিনি মেয়ে বিয়ে দেবেন না, যে ঘরে বাবা-মার মধ্যেই সম্পর্ক ভালো না। বাবা-মা আলাদা থাকে। তার মেয়েটা কি স্বামীর সাথে দৌঁড়াতে থাকবে একবার শ্বশুড়ের কাছে, আরেকবার শ্বাশুড়ীর কাছে? আর রোহান? সে যদি বাবার মতোই হয়? তার মেয়েটিকে যদি ছেড়ে দেয়। কি হবে তখন?
নবনী: ছেলেটা অনেক ভালো। তুমি বুঝতে পারছো না। আর ইশার বাবা-মা দেয় নি তাদের মেয়েকে দিব্যের সাথে বিয়ে?
জুনাইয়েত: ওইটা প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। ওদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক আছে। আর আমরা কি রোহানের বাবাকে চিনি? আর তুমি এসব কি বলছো নবনী? রিধি যদি তোমার পেটের সন্তান হতো তুমি দিতে তাকে রোহানের সাথে বিয়ে? যতো ভালোই হোক ছেলেটা, কিন্তু সে কি শিখেছে বাবার থেকে? বাবারা কি ওভাবে সময় দিতে পারে যেভাবে মা-রা পারেন? এতোবছর তো বাবার সাথেই ছিলো। মাকে তো এখন পেয়েছে। মা ছাড়া বড়ো হয়েছে। কোনো শৃঙ্খলা থাকতে পারে বলে মনে হয় তার মধ্যে? আর সে শিখবেই বা কি তার নিজের পরিবারই তো ঠিক নেই।
তবুও বেগম আতিকার অনেক বলার পর রোহানের বাবার সাথে কথা বলার জন্য রাজী হোন জুনাইয়েত। আতিকা আর নবনী রিধিকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগে আছেন। যদিও রক্তিম আর রিধির কানে এখনো কিছুই যায় নি।
এদিকে রাজিয়া দিব্যকে বললেন, রোহানের জন্য রিধিকে তার পছন্দ। কিন্তু দিব্য কিছুই বলে নি এই ব্যাপারে। কারণ সে জানে রক্তিম রিধিকে অনেক ভালোবাসে।
ইশা: তুমি টেনশন করছো কেন? রোহান ভাইয়ার একদিন তো বিয়ে হবেই। আর রিধি অনেক ভালো। তুমি বরং একবার রোহান ভাইয়ার সাথে কথা বলে দেখো।
দিব্য: রোহানের সাথে কথা বলার মানেই হয় না এই ব্যাপারে। রক্তিম ভাইয়া যেখানে রিধিকে ভালোবাসেন, ওইখানে রোহান কেন আসবে?
ইশা: হয়তো রক্তিম ভাইয়ার ভালোবাসা এক পাক্ষিক ছিলো। রিধি ভালোবাসে না হয়তো। আর ভালোবাসলে কি তারা বিয়ের প্রস্তাব দিতে আসতো?
দিব্য: আমি রোহানকে কিছু বলতে পারবো না। আমার আগে রক্তিম ভাইয়ার সাথে কথা বলতে হবে। কিছু তো ঘাপলা আছে। মাত্র ভার্সিটিতে উঠেছে রিধি। বিয়ে নিয়ে এতো তাড়াহুড়োর কি আছে?
ইশা: দিয়াকে জিজ্ঞেস করে দেখি আমি। দিয়া ভালোই জানবে এ ব্যাপারে।
ইশা দিয়াকে জিজ্ঞেস করেও কিছু জানতে পারে নি। কারণ রিধির সাথে তার কথা হয় নি। রিধির ফোন অফ থাকে বেশিরভাগ সময়। আর ভার্সিটিতেও যায় নি রিধি অনেকদিন। নবনীকে ফোন করে জেনে নিয়েছে রিধি সুস্থ আছে, কিন্তু রিধিকে দেন নি।
দিব্য বুঝতে পেরেছে কোনো সমস্যা নিশ্চয় হয়েছে। রক্তিমকে ফোন দেয় দিব্য। এরপর বিষয়টা পরিষ্কার হয় রিধি আর রক্তিমের সম্পর্কটা তারা মেনে নিচ্ছে না, তাই রিধির বিয়ের কথাবার্তা চলছে। রক্তিম যখন জানতে পারে জুনাইয়েত-নবনী রিধির বিয়ের জন্য রাজিয়া রহমানের বাসায় গিয়েছিলো, রক্তিমের মাথা গরম হয়ে যায়। এ নিয়ে বাসায় অনেক কথা কাটাকাটিও হয়। নবনী এই সব কিছুর জন্য রিধিকে দোষ দিচ্ছেন। তার মতে, রিধির কারণে আজ তার ছেলে তাদের কথার অবাধ্য হচ্ছে, আর তাদের সাথে উচ্চস্বরে কথা বলছে। রিধি নিজেকে এখন আরো বেশি একা ভাবছে। এই কয়েকসপ্তাহের ঝামেলায় রিধি যেন শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এটা এখন তার বাসা না, একটা জেলখানা। আর রিধি হচ্ছে বড়ো আসামী। এই বাসায় তার কোনো অধিকার নেই। রিধি এখন নিজেকে রক্তিমের বাসার আবর্জনা মনে করছে। তাকে দূর করতে পারলেই যেন মুক্ত সবাই। সে আর চায় না বোঝা হয়ে থাকতে। রক্তিমকে ত্যাগ দিয়ে সে মুক্তি দেবে সবাইকে। ভালোবাসা ত্যাগ দিয়ে সে নবনী-জুনাইয়েতের ঋণ শোধ করবে।
৩৭।
রাত দুইটা, কিন্তু রক্তিমের চোখে ঘুম নেই। তবে ঘুম হয় না বহুদিন। এখন রিধি আর রক্তিম একই ছাদের নিচে থেকেও বহুদূর। ভালোমতো কথাও বলতে পারে না দুইজন। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর বেগম আতিকা রিধির সাথেই থাকেন রাতে। তবুও মাঝে মাঝে আতিকা গভীর ঘুমে থাকলে রিধি আর রক্তিম ছাদে চলে যায় কথা বলার জন্য। রক্তিম এই অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে তার প্রেয়সীকে ভালো মতো দেখতে পায় না। তবুও হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে নেয় তার ভালোবাসা।
আজ আকাশ মেঘলা, হয়তো বৃষ্টি নামতে পারে। রক্তিম ছাদে বসে আছে রিধির অপেক্ষায়। এই অপেক্ষাটায় খুব কষ্টের। কারণ রিধি প্রতিদিন তো আর রক্তিমের অপেক্ষার শুভ্র সমাপ্তি দিতে পারে না! আর তাই প্রতিদিনই রক্তিম ভোর অবধি অপেক্ষায় থাকে আর ভাবতে থাকে কবে আসবে তার শুভ্রতার ছোঁয়া!
জানালা খোলা, হালকা হাওয়ায় পর্দাগুলো কাঁপছে। রিধি হঠাৎ কি ভেবে মুচকি হাসলো। বেগম আতিকা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রিধি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। আলমারি খুলে একটা সাদা রঙের শাড়ি বের করে পড়ে নিলো। কপালে একটা লাল টিপ দিলো। অন্ধকারে শাড়িটা ঠিকমতো পড়তে পারে নি রিধি। কোনো ভাবে পেঁচিয়েছে। টিপটাও বাঁকা বসিয়েছে। তার হাত কাঁপছিলো ভয়ে, কারণ যদি বেগম আতিকার ঘুম ভেঙে যায়, সব শেষ। ড্রয়ারে একটা মোমবাতি আর লাইটার ছিলো। ওইগুলো হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে বেরিয়ে পড়লো রুম থেকে। ঘর থেকে বের হয়ে সিঁড়িতে এসে মোমবাতি জ্বালালো রিধি। রক্তিম চোখ বন্ধ করে ছাদের এককোণে বসে আছে।
রিধির কন্ঠ শুনে চোখ বাঁধা অবস্থায় মুচকি হাসলো রক্তিম। এতো প্রশান্তি এনে দেয় রিধির সুর তার জানা ছিলো না।
ভালোবাসার মানুষ কতো গুরুত্বপূর্ণ হয়, তা শুধু দূরত্ব আসলে বুঝা যায়। রক্তিমতো এতোবছর রিধিকেই ভালোবেসে আসছে। কিন্তু রিধির প্রতি কেন এতো টান রক্তিমের তা জানা ছিলো না। আজ বুঝতে পারছে। রিধির দুষ্টুমিগুলো মনে পড়লে তার আর কোনো বিনোদনের প্রয়োজন হয় না, এমনিতেই হাসি চলে আসে। রিধির মায়াভরা কন্ঠের স্বর কানে আসলে মনে হয় কোনো গান শুনছে, যেখানে কোনো বাদ্যযন্ত্রের দরকার হয় না। রিধির হাতে লাগা গ্লাসটিতে করে পানি খেলেও রক্তিমের পেট ভরে যায়। সারাদিন না খেলেও যেন চলবে তার। আর একটু দুচোখ ভরে দেখতে পারলে তো আর কথায় নেই। শান্ত শীতল হাওয়া বয়ে যায় অস্তিত্বের মাঝে।
রিধি ফিসফিসিয়ে বলল,
রিধি: একদম চোখ খুলবে না। তোমার জন্য একটা গিফট আছে।
রক্তিম সোজা হয়ে বসলো। রিধি মোমবাতির আলোটি হাত দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে, যাতে হাওয়া লেগে নিভে না যায়। রক্তিমের সামনে এসে বসলো।
রিধির অস্তিত্বের ঘ্রাণ পাচ্ছে রক্তিম।
রিধি: এখন চোখ খুলো।
রক্তিম চোখ খুলে রিধিকে দেখলো। মোমবাতির আলোয় রিধির ফর্সা মুখটি লালচে আভায় পরিণত হয়েছে। আজ রিধি শাড়ি পড়েছে, শুধুই তার জন্য। অনেক ভালো লাগছে রক্তিমের। রিধির কপালের বাঁকা টিপটা সোজা করে দিলো রক্তিম। কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেলো রক্তিমের পরিবেশ। রক্তিমের মনের কোনো ভাষায় যেন ধ্বনি খুঁজে পাচ্ছে না শব্দ বের করার। হঠাৎ বাতাসের বেগ জোরে আসায় বাতি নিভে গেলো। সাথে সাথে যেন নিভে গেলো রক্তিমের চোখের আলো। রিধিকে কাছে টেনে নিলো রক্তিম। অনেকক্ষণ এভাবেই নির্বাক বসে ছিলো দুইটি অস্তিত্ব।
রিধি নিরবতা ভেঙে বলল,
রিধি: তুমি চেয়েছিলে, তোমার রিধি যাতে তোমার জন্য সাজে। আজ আমি তোমার জন্যই সেজেছি।
আড়ম্বরহীন সাজ,
বাঁকা টিপ,
এলোমেলো শাড়ীর কুচি,
রক্তিম তোমায় আমি
বড়ো ভালোবাসি।
.
চুলগুলো খোলা,
হাওয়ায় উড়ছে ভীষণ,
হচ্ছে না চুলে খোঁপা,
তাই উড়ছে ভূষণ।
.
তোমার মনে জ্বলছে কিরণ,
আমার চুলে আভা,
ভালোবাসায় বাঁধা হিরণ,
রিধির অপেক্ষার আশা।
রক্তিম শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রিধিকে।
রক্তিম: বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। তোমাকে আমি কোথাও যেতে দেবো না। তোমার হিরণ তোমার থাকবে। তোমার অপেক্ষার আশা একদিন পূর্ণ হবে।
রিধি মনে মনে বলছে,
রিধি: আমাদের অপেক্ষার সমাপ্তি হবে রক্তিম। তোমাকে ত্যাগ করে এই সমাপ্তি ঘটবে। আমাদের ভালোবাসা এই সমাজ মানবে না। বিশ্বাস করো রক্তিম, আমি জানতাম না সমাজ আর তোমার পরিবারের চোখে আমি মূল্যহীন। এমন জানলে কখনো ভালোবাসতাম না তোমায়। কে চায় কাঁদতে? কার ইচ্ছে হয় যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে? তুমি এখন আমার যন্ত্রণা। তবে এখন এই যন্ত্রণা সাথে রাখতেই ভালো লাগবে। তুমি সবসময় আমার সাথে থাকবে। এক ছাদের নিচে না থাকলেও এক আকাশের নিচে আমাদের আশ্রয় হয়েছে। একই হাওয়ায় শ্বাস নেবো, দূর থেকেও অনেক ভালোবাসবো।
রক্তিম আজ সকালে অফিসে গেলো। অনেক দিন যায় নি। জুনাইয়েত সাহেব তাই আজ বাসায় ছিলেন।
রক্তিম যাওয়ার পর রিধি, নবনী ও জুনাইয়েতের কাছে আসলো।
নবনী: কিছু বলবি?
রিধি: হ্যাঁ।
নবনী: যা বলার বলে চলে যা। ভালো লাগছে না কোনোকিছু। আমার সংসারে কার নজর লেগেছে আল্লাহ ভালো জানেন।
জুনাইয়েত সাহেবের ভালো লাগছে না এসব কথা। তবুও ঝগড়া লেগে যাবে কথা বাড়ালে, তাই চুপচাপ সহ্য করছেন।
রিধি মাথা নিচু করে বলল,
রিধি: আমার বিয়েতে আপত্তি নেই। তোমরা যার সাথেই বিয়ে দেবে আমি মেনে নেবো।
নবনী রিধির কথা শুনে খুব খুশি হলেন।
নবনী: বাঁচালি মা আমাদের।
জুনাইয়েতের দিকে তাকিয়ে বলল,
নবনী: রোহানের বাবার সাথে কথা বলে দেখো। তাড়াতাড়ি পাকা করে ফেলি কথা। দেরী করা কি উচিত হবে?
জুনাইয়েত শান্ত স্বরে রিধিকে বলল,
জুনাইয়েত: মা, তুই তোর ঘরে যা।
রিধি রুমে আসলো, দেখলো বেগম আতিকা বসে আছেন। শান্তিতে কাঁদবে সেই উপায়ও নেই। ওয়াসরুমে চলে গেলো। পানির কল ছেড়ে দিয়ে ইচ্ছেমতো কাঁদলো। এখন এই যন্ত্রণায় যে তার সঙ্গী!
এদিকে আজ রোহান দিব্যকে নিয়ে আসলো তাদের বাসায়। ফয়সাল আহমেদ পত্রিকা পড়ছিলেন। চোখ তুলে দিব্যকে দেখেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
আজ দুটি অস্তিত্ব তাদের পরিচয় ফিরে পেয়েছে। দিব্য তার বাবাকে কাছে পেয়েছে, ফয়সাল আহমেদ তার ছেলেকে। তাদের উষ্ণ আলিঙ্গন যেন পরিবেশটায় আবেগপ্রবণ করে দিচ্ছে। অশ্রুগুলো আজ সুখের ঠিকানা পেয়েছে।
দিব্য: আমি কি তোমাকে বাবা বলে ডাকতে পারবো?
ফয়সাল: হ্যাঁ। হ্যাঁ। অবশ্যই।
দিব্য: বাবা, তোমাকে খুব মিস করেছিলাম, দিয়া, আমি আর মা। তুমি আমাদের একবারো দেখতে আসো নি কেন?
ফয়সাল আহমেদের কাছে এর উত্তর নেই।
দিব্য: আমাদের ছাড়া ভালো ছিলে, তাই না?
ফয়সাল: কেউ কি প্রিয়জন ছাড়া ভালো থাকতে পারে?
দিব্য: তাহলে একবারো আসো নি কেন? আমার কথা আর মায়ের কথা না হয় বাদই দিলাম। দিয়াকে তো দেখতে আসতে পারতে?
ফয়সাল হালকা হেসে বলল,
ফয়সাল: মেয়েটাকে রোজ দেখতে যেতাম ওর কলেজে। একদম তোর মায়ের মতো হয়েছে দেখতে। খুব গোছালো আর ভদ্র।
দিব্য: আমাকে দেখতে আসো নি?
ফয়সাল: রোহান তো রোজ তোর কথায় বলতো। সারাদিন দিব্য আর দিব্য। তুই তো আমার চোখের সামনেই ছিলি।
দিব্য: বাসায় চলো। মা তোমাকে খুব মিস করে।
ফয়সাল: কই একবারো তো ফোন দেয় নি?
দিব্য: তুমিও তো দিতে পারতে?
ফয়সাল: মাফ করে দিস। আমার কারণে আমার পরিবারটাই এলোমেলো হয়ে গেছে। আমি বড়ো অপরাধী। রোহানকে তার মা থেকে দূরে রেখেছি। তোদেরকে বাবার ভালোবাসা দিতে পারি নি। আমি তোর মায়ের যোগ্য না রে!
দিব্য: এভাবে বলো না প্লিজ। এখনো সময় আছে। বাকী জীবনটা আমরা না হয় একসাথেই কাটায়। সুযোগ তো আছে।
ফয়সাল: রাজিয়া আমাকে তখনো বুঝে নি, এখনো বুঝবে না।
রোহান: তুমি একবার মায়ের সাথে দেখা করো বাবা। কিছু তো ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আর কতো? আমার ভালো লাগে না এই বদ্ধ ঘরে, যেখানে কোনো সুখ নেই। শুধু নিয়তির অপেক্ষায় থাকতে হয়। ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ আছে এখনো, একটাবার সুযোগ দাও।
ফয়সাল আহমেদ আর কিছুই বলেন নি। তার নিজেরও ইচ্ছে হয় রাজিয়াকে ভালোমতো দেখার। কিন্তু ভালোবাসার মানুষটির চোখে ঘৃণা সহ্য করতে পারবেন না। রাজিয়ার চোখে ফয়সালের জন্য ঘৃণায় দেখা যায়। একসাথে বুড়ো হওয়ার স্বপ্ন বেঁধেছিলো তারা।
আর আজ পনেরো বছরে তাদের যৌবনকাল শেষ। বুড়ো বয়সে এসে শেষ একবার তিনি আবার সেই ঘৃণার চোখ দুটি দেখতে চান। তিনি দেখা করবেন রাজিয়ার সাথে। কথা বলবেন, শুনবেন সব অভিযোগ। সমাধান না হলেও চেষ্টা তো করেছেন, এই আশায় শান্তিতে মরতে পারবেন।
পরের দিন দিব্য আর রোহানের পরিকল্পনায় রাজিয়া আর ফয়সালের দেখা হয়। তাদের একসাথে বসিয়ে দিব্য আর রোহান সরে পড়ে।
অনেকক্ষণ পর রাজিয়া নিজেই বললেন,
রাজিয়া: আমি যাচ্ছি। তোমার একা বসার ইচ্ছে থাকলে বসো।
ফয়সাল আহমেদ রাজিয়ার হাত ধরে ফেললেন। খুব ইতস্ততবোধ করছেন এখন দুজন। এতোবছরের দূরত্ব ছিলো, মনের দূরত্বতো আসবেই।
ফয়সাল আহমেদ সাথে সাথে হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন,
ফয়সাল: কথা আছে। বসো।
আবার কিছুক্ষণ নিরব থেকে ফয়সাল আহমেদ বললেন,
ফয়সাল: আমার ভুলগুলো কি এতোই বেশি ছিলো, যার জন্য পনেরো বছরের শাস্তি পেয়েছি আমি?
রাজিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন।
রাজিয়া: এতোবছর পর তিনি আসছেন ভুল কি বেশি ছিলো নাকি কম ছিলো তা জানার জন্যে।
ফয়সাল: তোমার কথাগুলো ভালো লাগে নি রাজিয়া। এতোবড়ো অপবাদ কিভাবে দিয়েছিলে আমার উপর? একটুও কি বিশ্বাস হয় নি? এতোই দুর্বল ছিলো আমাদের ভালোবাসা?
রাজিয়া: রাত জেগে ফোনে কথা বলা, দেরীতে বাসায় আসা, কথায় কথায় রাগ দেখানো, মিথ্যে কথা বলা এসব কি ভালোবাসার প্রকাশ ছিলো?
ফয়সাল: আমি জানি না তুমি কি বুঝেছো। কিন্তু বাসায় দেরীতে আসার কারণ ছিলো, আমি চাই না আমাদের সন্তানরা বাবা-মার ঝগড়া দেখুক। একটা মানুষ বাইরে থেকে আসলেই অভিযোগের ভীড় জমতো। কার রাগ নিয়ন্ত্রণ থাকবে, বলো? মিথ্যে কথা বলি নি, যদিও কখনো বলে থাকি হয়তো শান্তির জন্য। মানুষের তো ভুল হয়। কিন্তু বিশ্বাস করো রাজিয়া, তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নারী নেই আমার জীবনে। ছিলো না কখনো, আর আসতেও দেবো না। আমায় ঘৃণা করো না রাজিয়া। তোমার চোখে আমার জন্য এই ঘৃণা আমি সহ্য করতে পারি না। এই কারণে তোমার সামনে আসার সাহসও হয় নি।
রাজিয়া: সাহস তো যে অপরাধ করে তার মধ্যে থাকে না। তুমি তো অপরাধী ছিলে না, তাই না? তাহলে লুকিয়ে ছিলে কেন?
ফয়সাল: জানি না। হয়তো আমার মধ্যে মাথা নত করার ইচ্ছে ছিলো না। আমি হেরে গিয়েছিলাম মনে মনে। কিন্তু তোমার সামনে হারতে চাই নি। ভুল করে ফেলেছি, তাই না?
রাজিয়া: যে মেয়েটি আমাকে ফোন দিয়ে বলেছিলো তুমি তার সন্তানের বাবা হবে। ওইদিনই আমার সবকিছুই শেষ হয়ে গিয়েছিলো।
কথাগুলো বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে গেলো রাজিয়া রহমানের।
ফয়সাল: মিথ্যে। আমার চেয়ে বেশি বাইরের মানুষকে কিভাবে বিশ্বাস করলে তুমি? আমি এতোটা নিচু চরিত্রের ছিলাম না রাজিয়া। এইটুকু বিশ্বাস রাখলেও হতো।
এরপর ফয়সাল আহমেদ একটা প্যাকেট থেকে বই বের করলেন। সেই বইটি রাজিয়ার হাতে দিয়ে চলে গেলেন। রাজিয়া রহমানের সিক্ত চোখের আড়াল হয়ে গেলো ফয়সাল আহমেদ। চোখ মুছে বইটির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’।
বইটি তিনি পড়েছিলেন অনেক আগে। বইয়ের প্রথম পাতায় লেখা ছিলো
‘পনেরো বছর তুমিহীনা কাটিয়েছি, মনে ছিলো শুধু তোমার নাম।
দেয়ালের ফাঁকে ফাঁকে এখনো তোমায় দেখি,
তুমি হীনা আমার জীবন ম্লান।’
বাসায় যাওয়ার পর ভালোমতো বইয়ের পাতা উল্টিয়ে দেখলেন। ১৫তম পৃষ্ঠায় পেয়েছেন ফয়সালের চিঠি। লেখা ছিল,
‘আমি মহেন্দ্রের মতো আমার আশাকে ভালোবেসেছি, কিন্তু বিশ্বাস করো আমার আশার কোনো চোখের বালি ছিলো না। মহেন্দ্রের মতো আমার জীবনে কোনো বিনোদিনী নেই। কোনো বিনোদিনী পারবে না এই মহেন্দ্রকে আশার ভালোবাসা হতে ছিনিয়ে আনতে। চোখের বালির মহেন্দ্র আর আশার ভালোবাসার সমাপ্তি হয়েছিলো, বিনোদিনীর ছায়া আসার পরও। কিন্তু আমাদের মধ্যে তো কোনো বিনোদিনী আসে নি, তবে কেন আমার আশা এখনো তার মহেন্দ্রবাবুকে অপেক্ষায় রেখেছে? আমার বিনোদিনীও তুমি, আশালতাও তুমি। এখনো তোমায় বড়ো ভালোবাসি। বুড়ো হয়ে গিয়েছি আমি। কিন্তু মনটা এখনো ওই মেডিকেল ক্যাম্পাসের লাইব্রেরির মাঝেই আটকে আছে। সময় তো আর ফিরে আসে না। তবুও তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকবো, আগামীকাল সেই লাইব্রেরীতেই।’
রাজিয়া কলম হাতে নিলেন, লিখতে বসলেন তার অব্যক্ত কথা। অশ্রু যেন ভিজিয়ে দিচ্ছে লেখার সাদা পাতা। তবুও হাসছেন তিনি। প্রশান্তচিত্তে লিখছেন তার বুড়ো প্রেমিককে নতুন প্রেমের পত্র।
চলবে—
আগের পর্ব:
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/374584724263306/