অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের-১১
প্রচণ্ড রাগ হলে ঈশা খেতে পারেনা। জোর করে খাবার মুখে দিলেই বমি আসে। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। ইভানের উপরে রাগ করে দুপুরের খাবারটা খেলই না আর। শুধু যে খেলোই না তা নয়। নিজেকে ঘর বন্দি করে ফেললো। এটা নতুন কিছু নয়। জেদ আর রাগ হলে ঈশা বরাবর এরকম করে। আজও তাই করেছে। তাই বাড়ির বাকি সদস্যদের মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা গেলো না। ইলহাম সেই খেয়ে শুয়েছে তারপর আর ওঠে নি। ৬ ঘণ্টার আগে ওঠার কথাও না। ইরা খাওয়া শেষ করে সোফায় বসে টিভি দেখছে। ইভান এতক্ষন চুপ করেই বসে ছিল। ভেবেছিলো ঈশার রাগ কমে গেলে সে ঘর থেকে বের হলেই জোর করে খাইয়ে দেবে। তাই নিজেও না খেয়ে বসে থাকলো। কিন্তু ঈশা ঘর থেকে বের হল না। ইভান নিজের ধৈর্য হারিয়ে ফেললো। উঠে দরজায় গিয়ে অনেকবার ধাক্কা দিলো। কিন্তু ভেতর থেকে কোন আওয়াজ আসলো না। ইরা অনেক্ষন ধরেই এসব দেখছিল কিন্তু কোন কথা বলল না। এসব নাটক তার একদম ভালো লাগে না। ঈশার উপরে সে খুব বিরক্ত। ইভানের কথাটা অন্তত তার শোনা উচিৎ ছিল। ঈশা খুব ভালোভাবেই জানে ইভান বিশেষ কারণ ছাড়া কোন কাজ করে না। তাহলে ইভান কেন এমন করেছে সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য তাকে একটা সুযোগ দেয়াই উচিৎ ছিল। কিন্তু ঈশা সেরকম কিছু না করে উল্টা নিজেকে ঘর বন্দি করে রেখেছে। ইভান আবারো ডাকল। এবারো ঈশার কোন সাড়া এলো না। ইরা বিরক্ত হয়ে টিভি বন্ধ করে দিয়ে উঠে ঘরে চলে গেলো। ইভান সেদিকে একবার তাকাল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
–আমি জানি তুই আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস। আমি তোকে আর বিরক্ত করবো না। শুধু একটা রিকুয়েস্ট করবো না খেয়ে থাকিস না। তুই অসুস্থ। না খেয়ে থাকলে আরও অসুস্থ হয়ে যাবি। একটা বার আমার কথা শোন।
দরজা খুলে গেলো। ঈশা ঘর থেকে বের হয়ে ইভানের মুখোমুখি দাঁড়ালো। কঠিন গলায় বলল
–কি শুনবো? আরও কি শোনানোর বাকি আছে তোমার? সবই তো শুনলাম। বুঝলামও। কিন্তু ভাবতে পারছি না। তুমি আমার সাথে এমন কিভাবে করতে পারো? প্রতি রাতে আমার অজান্তেই আমাকে ঘুমের ঔষধ খাওয়াচ্ছ। আমি মরার মতো পড়ে ঘুমাচ্ছি। বুঝতেও পারছি না কি হচ্ছে আমার সাথে। আমার ঘরে কে আসছে কে যাচ্ছে কিছুই জানতে পারছি না।
ঈশা থেমে যেতেই ইভান অসহায়ের মতো বলল
–সব কি নিজেই বলে যাবি? আমাকেও বলার সুযোগ দেয়া উচিৎ।
ঈশা তাচ্ছিল্য হাসল। বলল
–আমার কিছু শোনার ইচ্ছা নেই। তুমি নিজের সাফাই ছাড়া আর কিছুই বলবে না তো। এই মুহূর্তে আমি তোমার কোন সাফাই শুনতে চাইনা। আমার তো এখন মনে হচ্ছে তুমি সুযোগ নেয়ার জন্যই এমনটা করেছো।
শেষের কথাটা শুনেই ইভানের চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেলো। ঈশার কথাটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হল তার। সে কখনো ভাবেনি ঈশা এমনভাবে তাকে বলবে। কারণ অনেক বেশী ভালোবাসার পরেও ইভান ঈশাকে নিয়ে কখনো এমন ভাবেনি। অথচ এমন কথা বলতে ঈশার একবারও বুক কাঁপল না। তীব্র অভিমানে বুক ভারী হয়ে উঠলো। ঈশা আরও কিছু বলতে নিলেই ইভান থামিয়ে দিলো। মৃদু আওয়াজে বলল
–ব্যাস ঈশা। অনেক হয়েছে। আমার ধৈর্যের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে তোর কথা। আর সম্ভব না।
সে চলে গেলো একদম বাইরে। বাসায় থাকলেই ঈশার চেহারা দেখতে হবে। আর ঈশাকে যতই দেখবে ততই তার মেজাজ খারাপ হবে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়ার মুহূর্তে ঈশা আর ইভানের বাবা মায়েরা ফিরে এলো বাসায়। ইরা দ্রুত শরবত বানিয়ে তাদের সামনে দিলো। ভীষণ ক্লান্ত তারা। ঈশার মা শরবতের গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে সচেতন দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকিয়ে বললেন
–আর সবাই কোথায়? কাউকে দেখছি না যে? বাসায় নেই নাকি?
ইরা দুপুরের বিষয়টা সম্পূর্ণ চেপে গেলো। এটা এমন কোন গুরুতর বিষয় নয় যে সবাইকে জানাতে হবে। তাছাড়া ঈশার রাগ এমনিতেই কমে যাবে আর উপর থেকে শুধু ইভান সবার কাছে খারাপ হবে। তাই স্বাভাবিকভাবে বলল
–আপু আর ইলহাম ভাইয়া ঘরে ঘুমাচ্ছে। আর ইভান ভাইয়া বাইরে গেছে।
ঈশার মা ভ্রু কুচকে তাকালেন ইরার দিকে। বললেন
–এই সন্ধ্যা বেলা কিসের ঘুম। ডাক ওদেরকে।
ইরা একটু ভেবে বলল
–ইলহাম ভাইয়ার মাথা ব্যাথা করছে তাই ডাকতে নিষেধ করেছে। একটু ঘুমাক মা। আপুকে আমি ডেকে দিচ্ছি।
ইরা আর কথা না বাড়িয়ে ঈশার রুমের দিকে গেলো। দরজায় কয়েকবার আওয়াজ করে যখন ভেতর থেকে কোন সাড়া এলো না তখন গলা ছেড়ে ডাকল।
–আপু দরজা খোলো। সবাই তোমাকে ডাকছে।
কয়েক সেকেন্ড পরেই দরজা খুলে গেলো। ঈশা ঘর থেকে বের হয়েই কোনদিকে না তাকিয়েই ইরাকে কঠিন ভাবে বলল
–কেন বিরক্ত করছিস আমাকে? সেই দুপুর থেকে তোরা কি শুরু করেছিস? বলেছিলাম আমাকে বিরক্ত করিস না। আমার যখন ইচ্ছা হবে তখন এমনিতেই বের হয়ে আসবো। তবুও বিরক্ত করেই যাচ্ছিস।
ইরা এমনিতেই ঈশার উপরে বিরক্ত। তার উপর এমন করে কথা বলায় আরও রেগে গেলো। ঈশার বরাবরের অভ্যাস কোন কথা না শুনেই এমন আচরন করা। রেগে গিয়ে বলল
–আমি তোমাকে বিরক্ত করিনি। মা ডাকতে বলল তাই ডাকলাম। আর হ্যা সবাইকে একই রকম মনে করবে না। তোমার এইসব আচরন একজন সহ্য করে বলে সবাই সহ্য করবে সেটা কখনই ভাববে না।
ইরার এমন কঠিন আচরন ঈশার জেদ বাড়িয়ে দিলো। এভাবে তার সাথে কেউ কথা বলে না। তাই রাগে ফুসে উঠে সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো ইরার গালে। কয়েক মুহূর্ত থমকে গেলো সবাই। ঈশার এমন আচরণের কারণটা কারো কাছেই বোধগম্য নয়। তবে ধারনা করে নিলো ইভানের সাথে কিছু হয়েছে। ইভানের মা এগিয়ে এসে ইরাকে জড়িয়ে ধরলেন। ঈশার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন
–একদম ঠিক করলিনা ঈশা। তোর ব্যাবহার দিনদিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামলাতে শেখ।
বড় মার মুখে এমন কথা শুনে ঈশা হা করে তাকাল। যেই বড় মা এতদিনে মায়ের এমন কথা থেকে তাকে আড়াল করে এসেছে সেই বড় মা আজ তাকে সেরকম কথাই বলছে। এইসব কিছুর জন্য ইভান কে দায়ী মনে হল তার। সমস্ত রাগ ক্ষোভ জমে যেতেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। তীব্র জেদ নিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো
–তোমরা সবাই শুধু আমার দোষ দেখতে পাও। আর বাকি সবাই তো খুব ভালো। আমার আচরন দেখা যায় বলেই তোমরা আমাকে কথা শোনাও। তোমার ছেলে আড়ালে কি করে সেসব তো জানতে পারো না। তাই তাকে কিছু বলতেও পারো না।
এবার ইভানের মা গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন
–কি করেছে ইভান?
–প্রতিদিন আমাকে ঘুমের ঔষধ খাওয়ায় পানিতে মিশিয়ে।
সবাই ভ্রু কুচকে তাকাল। ইভান অযথা কেন ঘুমের ঔষধ খাওয়াবে ঈশাকে। ইভানের বাবা কঠিন গলায় বলল
–ইভান কোথায়?
কেউ কোন উত্তর দিলো না। তিনি আরও বেশী রেগে গেলেন। ঈশার বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন
–ছেলেটা দিনদিন লাগাম ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। যা ইচ্ছা তাই করছে। এসব কি শুরু করেছে? ওকে জবাবদিহি করতেই হবে। আমার সহ্যের সীমা পার হয়ে যাচ্ছে।
ঈশার বাবা বুঝলেন তার ভাই খুব রাগ করেছে। তাই নরম গলায় বললেন
–ইভান কেন এমন করতে যাবে? হয়তো কোন কারণ আছে। ওর…
কথা শেষ করার আগে ইভানের বাবা হুঙ্কার ছেড়ে বললেন
–এতোটা অন্ধ হওয়া ভালো না। নিজের চোখেই ছেলেটার সমস্ত কারসাজি দেখতে পাচ্ছিস তবুও বাচ্চাদের মতো আচরন করছিস। যে ছেলের নিজের জীবনের প্রতি মায়া নেই সে আরেকজনের কথা কিভাবে ভাবতে পারে? কিভাবে আরেকজনের খেয়াল রাখবে সে? যা মাথায় আসে তাই করে। ঠিক ভুল কিছুই ভাবে না। ঈশাকে মানসিক ভাবে অত্যাচার করে সে। কিছুই কি তোর চোখে পড়ে না? যেটা ভুল সেটাকে ভুল হিসেবেই দেখতে হবে। হোক না সেটা আমার ছেলে।
ইরা এতক্ষন নিঃশব্দে চোখের পানি ফেললেও এখন আর চুপ করে থাকতে পারলো না। কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল ঈশার দিকে। গলা তুলে বলল
–ভাইয়া তোমাকে ঘুমের ঔষধ খাওয়ায় সেটা বুঝে গেছো। আর কেন খাওয়ায় সেটা বঝনি? মাইগ্রেনের ব্যাথায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলে। ইনজেকশনে তোমার ফোবিয়া। ঔষধ গিলতে পারো না। তাই তোমাকে পানির সাথে মিশিয়ে কড়া ডোজের ঘুমের ঔষধ খাওয়ান হতো যাতে তুমি ঘুমাতে পারো। আর স্ট্রেস কমে গিয়ে তোমার ব্যাথা ঠিক হয়ে যায়।
থেমে গিয়ে উল্টা ঘুরে বলল
–আর বড় বাবা তোমার ছেলে নিজের ইচ্ছা মতো কিছুই করেনি। ডাক্তারের কাছ থেকে ভালো করে সব শুনে নিয়ে তারপর এসব করেছে। তোমার ছেলে কখনো ভুল করে না। তোমরা তার কাজ গুলোকে জোর করে ভুল বানিয়ে দাও। আর তুমি বললে না যে যার নিজের জীবনের প্রতি মায়া নেই। কিভাবে থাকবে? সে তো আরেকজনকে নিয়েই ব্যস্ত। আপুর ভুল গুলা তোমাদের চোখে পড়ে না। কারণ ভাইয়া কখনো তার ভুলগুলা তোমাদের সামনে আসতে দেয় না। কিন্তু নিজে কখনো তোমাদের কাছে ভালো থাকতে পারে না। শুধু মাত্র আপুর জন্য।
ইরার কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেলো। ঈশা স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে ইরার দিকে। ইরা ঈশার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল
–তোমার জন্য ভাইয়া ৫ বছর বাইরে থেকেছে। সেদিন ছোট একটা বিষয়ে যদি তুমি এতো সিন ক্রিয়েট না করতে তাহলে এমন কিছুই হতো না। তোমার বন্ধুদের সামনে শাসন করে তোমার আত্মসম্মানে আঘাত করেছে ঠিকই কিন্তু সেটার কারণ কি ছিল সেটা বোঝার মতো ক্ষমতা তোমার নাই। তুমি যেখানে গিয়েছিলে সেখানে কোন ভালো বাড়ির মেয়েরা যায়না আপু। তুমি রাতে সেখানে থাকলে পরের দিন তোমার চরিত্র নিয়ে মানুষ কথা বলতো। ভাইয়া সেটা হতে দেয়নি জন্যই সে অপরাধ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। তুমি অনেক স্বার্থপর। তোমার উপরে আমার করুনা হয়। এতো কিছুর পরেও তুমি ভাইয়াকে কষ্ট দাও। আর শুধু ভাইয়া বলেই এসব সহ্য করে। এটা তোমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এখন তুমি সবাইকেই তোমার এসব আচরন সহ্য করাতে চাও। মনে রাখবে সবাই কিন্তু ভাইয়া না।
ঈশা ইরার কথা শুনে বুঝতে পারলো সে ভুল করেছে। এভাবে আগে কখনো ভাবেনি। তবুও নিজের স্বভাব বশত জেদ করে বলল
–তার প্রতিটা কাজের পেছনে কারণ যেটাই থাকুক। আমাকে জানানো উচিৎ ছিল। যখন যেটা করছে সেটার কারণটা আমাকে জানালেই এতো কিছু হয়না। কিন্তু সে তো মহান সাজতে চায়।
ইরা চিৎকার করে বলে উঠলো
–তোমার লজ্জা থাকলে আবারো এসব কথা বলতে না। ভাইয়াকে কথা বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি কখনো? আজকের ঘটনার পর ভাইয়া কতবার তোমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। তুমি কি শুনেছ তার কথা? অপমান করে বের করে দিয়েছ। বড় বাবা বলেছে ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নাকি ভুল ছিল। এতে তোমার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। আমিও একই কথাই বলছি সত্যিই বাবার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। কিন্তু তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে ভাইয়ার জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সে অনেক কষ্টে আছে।
চলবে…