অমিশা ভিলা | পর্ব :৪

0
3158

গল্প : অমিশা ভিলা | পর্ব : চার

২০১১ খ্রি.
সকাল থেকেই আকাশ কালো হয়ে আছে। বৃষ্টি নামবে নামবে ভাব তবে নামছে না। মাঝে মাঝে গুড়ুগুড়ু আওয়াজ হচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রবল বেগে হাওয়া। ধুলো উড়ছে, পাতা উড়ছে, উড়ছে ফেলনা কাগজ। মনে হচ্ছে এই বুঝি ঝপ করে বৃষ্টি নামবে। কিন্তু না। নামছে না। আমি বসে বসে সেই দৃশ্যই দেখছিলাম। মা এসে বললেন, “এই আরজু, আবার এমপি-ফাইভ হাতে নিয়েছিস! সারাদিন গান শুনে আর গেম খেলে কী মজা পাস বল তো?” বলেই তিনি আমার হাতের এমপি-ফাইভ ডিভাইসটা একরকম টেনে নিয়ে গেলেন। আদতে আমি গানও শুনছিলাম না আর গেমও খেলছিলাম না। আমি কেবল আকাশের কালো কালো মেঘ দেখছিলাম। আর ভাবছিলাম, আকাশটা আজ এত রেগে আছে কেন? তাকে কি কেউ বকেছে?

মা আমার একগোছা চুল মুষ্টিবদ্ধ করে বললেন, “আমার সামনে ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাং তুলে বসে আছিস! বাঁদর! বেয়াদব!”

“উঃ!” বলে দাঁড়িয়ে বললাম, “তোমার ছেলে তোমার মতোই হবে।” বলে চোখ টিপে দিলাম দৌড়। মা এক ঝাপটায় আমার হাত ধরে ফেললেন। কড়া গলায় বললেন, “এখন ছাদে যাবি না। আকাশের অবস্থা দেখেছিস? কখন না ঝড় এসে তোকে উড়িয়ে নিয়ে যায়।”

আমি মুখ ভার করে বললাম, “তুমি সব সময় আমাকে নিয়ে উপহাস করো। আমি কি ইচ্ছে করে পাতলু আছি নাকি! আমি তো ঠিকই খাই। তোমার থেকেও বেশি খাই। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না। এখানে আমার দোষটা কোথায়?”

মা আমার মাথায় চাটি মেরে বললেন, “কচু খাস তুই। এর চেয়ে দু’বছরের বাচ্ছারা আরো বেশি খায়।”

মা আর আমার খুনসুটি প্রায় জমে উঠেছিল। তখন নিচতলার বারান্দায় আমরা দাঁড়িয়ে। জায়গাটা বেশ ফাঁকা। বারান্দা পেরিয়ে সরু আঁকাবাঁকা রাস্তা গেট পর্যন্ত চলে গেছে। রাস্তার দু’পাশে গাদাগাদি ফুল গাছ। বড়ো গাছগুলো মা লাগিয়েছিলেন। আর ছোটো চারাগাছগুলো ক’দিন আগে আমি লাগিয়েছি। সেগুলোর কয়েকটা গাছ মরে গেছে। কয়েকটা জীবিত আছে। তবে কতক্ষণ জীবিত আছে তার ঠিক নেই। আর একটি গাছ আছে। সেটা কী ফুলের গাছ তা তো জানি না। তবে সেই গাছে দু’টো ফুল ফুটেছে। দেখতে বেশ লাগে।

গেট পেরিয়ে কে যেন এগিয়ে আসতে দেখা গেল। মা দেখলেন প্রথম। হেসে বললেন, “আরে! মোতালেব সাহেব! কী খবর?”

এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। মুখে বিনীত হাসি। তার পাশাপাশি হেঁটে হেঁটে এল এক মেয়ে। বয়স পনেরো কি ষোলো হবে। ফ্রক পরেছে বলে একদম বাচ্চাদের মতো লাগছে। মেয়েটার মুখ ভার। বগলে ছাতা ভাঁজ করে রাখা। আমি এর আগে কোনোদিন তাদেরকে দেখিনি। তবে দু’দিন পর মা বলেছিলেন ওই ছোট্ট মেয়েটা আমার খালাতো বোন। আর ওই ভদ্রলোক আমার খালু। খালা মারা গেছেন প্রায় আট বছর আগে। আমাদের সব সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়ার পর আমাদের শেষ সম্বল মানে এই বাড়িটা মা এই পুঁচকে মেয়েটার নামে লিখে দিয়ে যাচ্ছেন। তবে মা’র কাবিনের জায়গাটুকু কাউকে দিচ্ছেন না। ওটা যেভাবে আছে সেভাবেই পড়ে থাকবে। আমি কৌতূহলবোধ করেছিলাম। আমার খালাতো বোন অথচ এর আগে কখনো তার কথা শুনিনি! মা আলতো হেসে জবাব দিলেন, আপন খালা নয় রে! দূরসম্পর্কের খালা। মেয়েটার মা মরার পর সে খুব অসহায় হয়ে পড়েছে। খুব গরিব। ওঁর বাবা এসেছিল আমার কাছে যেন ক্যানাডা চলে যাবার আগে তার মেয়ের পড়াশোনার খবর বাবদ কিছু টাকা সাহায্য করি। আমি আমাদের বাড়িটাই লিখে দিয়েছি। এতে ওঁরাও থাকতে পারবে আর বাকিটুকু ভাড়া দিয়ে যা পাবে তা দিয়ে আরামসে মেয়েটার পড়াশোনা চলে যাবে। এবার বল, ঠিক করিনি আমি? কী রে খোকা? বল? আমি হেসে বলেছিলাম, তুমি সব সময় ঠিকটাই করো মা।

ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, “আপনাদেরকে দেখতে এলাম। কালকেই তো ক্যানাডায় চলে যাবেন। আর কখনো দেখা হবে কি না…”

মা মৃদু হেসে বললেন, “এসে ভালোই করেছেন। আমরা একা একা বোর হচ্ছিলাম। এই বৃষ্টি বাদলের দিনে চায়ের সাথে আড্ডা বেশ জমবে।”

আড্ডা হলো অনেক্ষণ। ভদ্রলোক আর মা কথা বলছিলেন। আমি বসে বসে শুনছিলাম। আর ওই ফ্রক পরা মেয়েটা মুখ কালো করে ছাতা বগলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শেষে আমিই ওর কাছে গেলাম। মেয়েটাকে বাগে পেয়েছি। একটু ভয় দেখানো যাক! যেই ভাবা সেই কাজ। মেয়েটার কাছে গিয়ে বললাম, “এই, কী নাম তোমার?”

সে কথা বলে না। সাড়া দেয় না। শুনতে পায়নি এমন ভান করে দাঁড়িয়ে থাকে। ব্যাপারটা অপমানজনক। শেষে আমি তার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করতেই চেঁচিয়ে বলল, “অমিশা।”

সহসা বুকটা ধড়াক করে উঠল। বাবাগো বাবা! কী জোরে চিৎকার দিয়েছে! আমি তো ভেবেছিলাম এই মেয়ে কথাই বলতে পারে না! এবার আমি বললাম, “আমাদের বাসার ছাদে যাবে? ওখানে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখাব।”

কৌতূহলে মেয়েটার ভ্রু কুঁচকে গেল। আমি মুখ টিপে হাসলাম। এইতো কাজ হচ্ছে! এবার ভুলিয়ে ভালিয়ে ছাদে নিয়ে গিয়ে এমন ভয় দেখাব যে…

“কী হলো, যাবে?”

মেয়েটা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। আমি আরো একটু কৌতূহল জাগাতে বললাম, “সত্যি যাবে? ভয় পাবে না তো আবার?”

মেয়েটা ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়াল। আনন্দে আমার ভেতর লাফিয়ে লাফিয়ে উঠল। ক্যানাডায় যাব বলে স্কুল ছেড়েছি বহুদিন। এতদিন সমবয়েসী কাউকে পাইনি। খেলাধুলা, হৈচৈ সব বন্ধ। মা বলেছেন বাকি দুষ্টুমি ক্যানাডায় গিয়ে হবে। কিন্তু তাই কি হয়? দুষ্টুমি না করলে পেটের ভাত হজম হবে আমার?

যাহোক, মেয়েটাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে উঠতে পেছন ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলাম আর মেয়েটাকে ভয় দেখাচ্ছিলাম এই বলে যে, “এই, সত্যি ছাদে যাচ্ছে তো! ভয় পাবে না তুমি? দ্যাখো, ভয় পেলে কিন্তু আমাকে কিছু বলতে পারবে না।”

মেয়েটার মুখ তখনও গম্ভীর। সে এদিক ওদিক না তাকিয়ে এক মনে সিঁড়ি ভাঙছে। একটুও ভয় নেই, সঙ্কোচ নেই, হাসি, আহ্লাদ এমনকি বিস্ময় পর্যন্ত নেই। আমি ভেবেছিলাম বিস্ময়ে তার ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে। এবার বুঝতে পারলাম, বিস্ময়ে নয় বরঞ্চ প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে সে ভ্রু কুঁচকাচ্ছে। এ-কেমন মেয়েরে বাবা! একে নিয়ে কী যে করি!
ভয় দেখানোর সিদ্ধান্ত এখানেই পাল্টে ফেললাম। তবে ছাদে যাওয়ার প্ল্যান অটুট রইল। ভয় দেখিয়ে কাজ হবে না। মেয়েটাকে বরং চমকে দেওয়া যাক!

ছাদে টবে কয়েকটা ফুলগাছ ছিল। ফুলটার নাম আপাতত মনে পড়ছে না। তবে দেখতে বেশ সুন্দর। আমি করলাম কী, গাছ থেকে একটা ফুল নিয়ে মেয়টার সামনে বসে পড়লাম। ফুলটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “ভালোবাসি!”

কিন্তু একি! গম্ভীর মেয়েটা গম্ভীর রয়ে গেল। ধীরে ধীরে আকাশের মেঘ কেটে গেল ঠিকই কিন্তু মেয়েটার গোমড়া মুখ গোমড়াই রয়ে গেল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটার চুলে এক টান মেরে বললাম, “শয়তান মেয়ে! এত এমন কেন রে তুই? তোর ভিতরে কি ইমুশন টিমুশন নেই নাকি, অ্যাঁ?”

মেয়েটা খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, “আপনি আমাকে তুই করে বলছেন কেন?”

“উরিম্মা! তুই করে বলব না তো কী করে বলব? আপনি করে? তুই আমার ক’বছরের ছোটো হবি জানিস?”

“কী যে দেখাবেন বললেন?”

“দেখাব তোর মাথা, মুন্ডু। দেখবি? বল? দেখবি?”

এরপর ডাক পড়ল। মা আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। সেই সঙ্গে মেয়েটাকেও। এরপর ওরা চলে গেল। আমি আর মা আবারও একা হয়ে গেলাম। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “তারপর বল, কাল তো ক্যানাডা চলে যাচ্ছি। কেমন লাগছে তোর?”

আমি নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইলাম৷ দৃষ্টি তখনও সেই আঁকাবাঁকা পথে। যে পথ ধরে মেয়েটা অর্থাৎ অমিশা আর তার বাবা হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছেন।

ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসতেই মেয়েটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। ভূতেরা কি তবে জাদু জানে! মেয়েটা কেবল আমার মাথার উপর হাত রেখেছিল। আর এতেই আমি গত দশ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা আবারো চোখের সামনে দেখতে পেলাম। সারা রাত ঘুমাইনি। ঘুমে চোখ লেগে আসছে। ফজরের নামাজ পড়ে শুয়ে পড়তে হবে। এরপর আবার অপেক্ষা। সেই ছোট্ট অমিশা যাকে দশ বছর আগে দেখেছিলাম সে আবার আসবে। আসতেই হবে তাকে। না এলে যে জটিল রহস্য রয়ে গেছে তার সমাধান কখনোই পাওয়া হবে না।

চলবে
মো. ইয়াছিন

[উপস! দেড়ি হয়ে গেল। এই কান ধরলাম। আর কখনো এমন হবে না। পাঠকদের জন্য শুভকামনা রইল। হ্যাপি রিডিং।]

গত পর্বের লিংক :
https://www.facebook.com/107969461087579/posts/344098660807990/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here