গল্প : অমিশা ভিলা | পর্ব : আট
দরজায় টিংটং শব্দ বেজেই চলেছে। কে যেন একনাগাড়ে ডোরবেল বাজাচ্ছে। ঘুমে বুঁদ ছিলাম আমি। ভোরের ঝলমলে আলো কাচের জানালা ভেদ করে বিছানায় আছড়ে পড়েছে। পড়েছে আমার চোখে-মুখে। শেষে ডোরবেলের শব্দ থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য বালিশের নিচে মাথা রেখে কান দু’টো চেপে ধরেছিলাম। কিন্তু এতেও বিশেষ লাভ হলো না। অগত্যা প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে চোখ খুললাম। দেয়াল ঘড়িটা জানান দিচ্ছে নয়টা বেজে চার মিনিট। লম্বা হাই তুলে বিছানা ছেড়ে স্যান্ডেল পরে নিলাম। ডোরবেল তখনও একনাগাড়ে বাজছে, টিংটং-টিংটং-টিংটং।
দরজার ওপাশে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা বেশ লম্বা। প্রায় ছ’ফুট হবে। শরীরের ফরসা পুরু চামড়ার উপর দিয়ে ফোলা ফোলা শিরা ভাসছে। নাকের নিচে ভারী গোঁফ। চোখদু’টো ফোলা ফোলা এবং লাল। হাতে একগুচ্ছ বাহারী ফুল। আমি দরজা খুলে দিতেই লোকটা সামনের দিকে ঝুঁকে ফুলগুলো এগিয়ে দিয়ে বলল, “ভাই আপনার জন্য বিদায়বার্তা পাঠিয়েছেন। হ্যাপি জার্নি।”
বলেই লোকটা চলে যাচ্ছিল। আমি বললাম, “কিন্তু আমি তো কোথাও যাচ্ছি না।”
সঙ্গে সঙ্গে লোকটা ফিরে তাকাল। ভারী গলায় বলল, “আমি এক কথা দু’বার বলতে পছন্দ করি না। আর আমার মুখের উপর কেউ কথা বলুক সেটাও পছন্দ করি না। ভাই ভালো মানুষ তাই ভালোয় ভালোয় বলছে। আমি আবার মুখে কথা বলি না। আমার কথা হয় বুলেট দিয়ে। বুঝলেন তো? আসি। আপনার যাত্রা শুভ হোক।”
বলে চলে যেতে লাগল লোকটা। আমি আর কিছু বলিনি। কী-ইবা বলার আছে! এখন সময়টাই এমন, জোর যার মুল্লুক তার! এই লোকটা কিংবা তাকে যে পাঠিয়েছে অর্থাৎ সেই রিটায়ার অফিসার তাদের সবার গায়ের জোর আছে৷ অস্ত্রের জোর আছে। পাওয়ার আছে। এদিকে আমি ক’দিনের জন্য আসা মেহমান মাত্র! ক’দিনের জন্য এসেছিলাম। আবার সেই ক্যানাডায় ফিরে যেতে হবে। কাল রাত মনে হয়েছিল যে করেই হোক অমিশার খুনি এবং ধর্ষকদের শাস্তির ব্যবস্থা করে তবেই ক্যানাডায় ফিরব। কিন্তু এখন এই লোকটার ধমক শুনে সব ইচ্ছে ধুলোর সাথে মিশে গেছে। আমি তো আর মেয়েটার কেউ নই! তবে কেন শুধু শুধু নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে অন্যের জন্য লড়ব? তা ছাড়া যদি লড়াই করি, ক’জনের জন্য লড়ব? দেশে কি শুধু এই একটা ধর্ষণের ঘটনাই ঘটেছে? না, কখনোই না। প্রতিদিনই এমন ঘটনা ঘটছে। পত্রিকা খুললে ওই একই খবর। ক’জন অমিশার পাশে দাঁড়াব আমি?
যাকগে, লোকে বলে, চাচা, আপন পরাণ বাঁচা! আমারও এখন সেই গতি। নিজের জীবন নিয়ে পালিয়ে বাঁচতে পারলেই হয়। এইসব ভাবতে ভাবতে ব্যাগ গুছাচ্ছিলাম৷ যদিও ব্যাগ গুছানোর প্রায় সিংহভাগ গতকাল সন্ধ্যোবেলাই করে ফেলেছিলাম। এখন বাকিটুকু সারছিলাম। তখন আরো একবার ডোরবেল বাজল। না, আগের মতো একনাগাড়ে নয়, এখন কেবল একবারই বেজেছে। কিন্তু এই অবেলায় আবার কে আসবে! মনের ভুল নয়তো!
আবারো ব্যাগ গুছানোয় মনোযোগ দিয়েছি ঠিক তখন আরো একবার ডোরবেল বাজল। আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়লাম। এরপর পা থেকে স্যান্ডেলগুলো খুলে রেখে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে দরজার সামনে উপস্থিত হলাম৷ দরজা খুলতেই আমার চোখদু’টো ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার উপর আটকে গেল। বিস্ময়ে সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠল। বুকের ধুকপুক শব্দটা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেল মুহূর্তেই। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “ত-তুমি!”
দিজা টিপ্পনী কেটে বলল, “কেন? অন্য কোনো মেয়ে আসার কথা ছিল নাকি?” বলে একরকম আমাকে ঠেলে ঘরের ভেতর ঢুলে গেল। আমি তার পেছন পেছন যেতে লাগলাম। সে হঠাৎ আমার দিকে ঘুরে বাঁকা চোখে চেয়ে বলল, “এতদিন হয়ে গেল একটা ফোন পর্যন্ত দাওনি। এখানে এসে কোনো মেয়ে-টেয়ের পাল্লায় পড়োনি তো আবার?”
আমি তখনও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যার ফলে না চাইতেও বারবার দিজার মুখের দিকে দৃষ্টি চলে যাচ্ছিল। বারবার দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছিলাম। দিজা আমার গালে আলতো হাত রেখে তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “আমার দিকে তাকাও তো! কী হয়েছে তোমার? এমন থম মেরে আছো কেন?”
“তুমি কখন এলে?”
“কাল এসেছি। আসার পর বহু কষ্টে তোমার অ্যাড্রেস বের করেছি। চাইলেই তোমাকে ফোন দিয়ে অ্যাড্রেস জেনে নিতে পারতাম তবে তখন আর থ্রিলিং যে ব্যাপারটা সেটা থাকত না।”
“এর মাঝেও থ্রিল?” আমি প্রশ্ন করলাম।
দিজা তাচ্ছিল্য করে বলল, “অভিয়েজলি! এই যে দ্যাখো, আমাকে হঠাৎ দেখে তোমার মুখটা কেমন চুপসে গেছে। ব্যাপারটা কেমন হলো বলো তো?”
দিজা এমন কান্ড প্রায়ই করে। আমরা বিয়ে করেছি দু’বছরেরও বেশি। অথচ আজও মেয়েটাকে বুঝতে পারি না। তবে তাকে আমার বেশ পছন্দ। তার বাচ্চামো, সারাক্ষণ আমার পেছন পেছন ঘুরঘুর করা কিংবা হঠাৎ এমন কোনো কান্ড করা যা আমি ভাবতেও পারিনি এই সবকিছুই আমার ভালো লাগে। মোটকথা মেয়েটাকে আমি মন থেকে ভালোবাসি। আর বাসি বলেই সে এখন অমিশা ভিলায় পা রাখায় অজানা এক ভয় ঘিরে ফেলেছে আমাকে। আমি এতদিন এখানে ছিলাম। কতকিছু ঘটেছে আমার সঙ্গে। তবুও এতটা ভয় হয়নি যতটা দিজাকে এখানে আসতে দেখে হচ্ছে।
“ব্যাপার কী বলো তো, আমি যখন তোমার অ্যাড্রেস জানতে চাইছিলাম তখন যার কাছেই যাচ্ছিলাম সে-ই দূরে সরে যাচ্ছিল। আর কেমনভাবে যেন তাকাচ্ছিল। কেউ অ্যাড্রেস বলে দেয়নি। শেষে এক দোকানদার বলেছে এ-বাড়িতে নাকি এক পাগল থাকে। পাগলটা ক্যানাডা থেকে এসেছে। তখন আমি কনফার্ম হলাম যেহেতু ক্যানাডা থেকে এসেছে তার মানে এই পাগলটা আমার পাগলই। কিন্তু ব্যাপার কী বলো তো? কাহিনীটা কী?”
আমি প্রশ্ন এড়িয়ে বললাম, “কাহিনী কিছুই না৷ এখানকার মানুষই এরকম৷ আমি আজই এখান থেকে চলে যাচ্ছিলাম৷ ভাগ্য ভালো এখনই এসেছো। আরো পরে এলে আমাকে পেতে না।”
“যাবে মানে? বাড়িটা তো বেশ দেখতে। আমার তো ভালোই লেগেছে।”
“ভালোটালো কিছুই না দিজা। চলো এখান থেকে যাই। আমার ব্যাগ অলমোস্ট গুছানো শেষ। বাকিটুকু সেরে এখনি বেরোব আমরা।”
দিজা সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠল, “মানে কী! আমি আসতেই তাড়াহুড়ো শুরু করেছো যে! ব্যাপার কী?”
“ব্যাপার কিছুই না দিজা। আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি এটাই শেষ কথা। আপাতত ভালো একটা বাসায় গিয়ে উঠব। সেখানে যতদিন খুশি থেক।”
দিজা দুম করে বিছানায় বসে পড়ল। গাল ফুলিয়ে বলল, “আমি এখান থেকে এক পা-ও নড়ছি না।”
“বাচ্চামো করো না দিজা! চলো!”
দিয়া অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। অবস্থা বেগতিক দেখে দিজার কাছে গিয়ে বসলাম। তার মাথা আমার কাঁধে আলতো চেপে ধরে বললাম, “শুনো, বাচ্চামো করো না। এদেশে তো ভাড়া বাসার অভাব নেই। আমরা ভালো একটা বাসায় উঠব। তোমার পছন্দের বাসায়ই উঠব। গোঁ ধরে বসে থেক না প্লিজ।”
দিজা আমার চোখের দিকে তাকাল। তাকিয়েই থাকল। একসময় জেদি গলায় বলল, “তুমি আমাকে জোর করে নিয়ে যাবে?”
আমি থতমত খেয়ে বললাম, “না না! জোর করব কেন? আমি তোমাকে অনুরোধ করছি। প্লিজ এখান থেকে চলো।”
দিজা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “ওকে ফাইন, আমরা চলে যাব। তবে আজ নয়। আজকের দিনটা আমি এ-বাড়িতেই থাকব। দেখি কী হয়।”
“কিন্তু দিজা…”
দিজা আমার মুখে আঙুল ঠেকিয়ে বলল, “আমি কিচ্ছু জানি না। দ্যাখো আরজু, আমি আজ পর্যন্ত তোমাকে সন্দেহ করিনি। আজও করব না। তবে এ-বাড়িতে পা রাখার পর সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। মনে হচ্ছে কিছু তো একটা হয়েছে এখানে! কিছু তো একটা আছে! কিন্তু কী? কী আরজু? বলবে প্লিজ?”
আমি নিরুত্তর বসে রইলাম। দিজা রুষ্ট গলায় বলল, “ঠিক আছে। বলতে হবে না। তবে জেনে রেখ, তোমার বদলে যাওয়ার কারণ যদি কোনো মেয়ে হয় তবে আমি বাঁচব না। তোমার চোখের সামনে সুইসাইড করব এই বলে দিলাম।” বলতে বলতেই দিজা নাক ফুলিয়ে কাঁদতে শুরু করল। আমি এক-আধবার তার চোখের জল মুছে দেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই সে অভিমানে আমাকে দূরে ঠেলে দিলো। আমি অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলাম।
দুপুরবেলা গোসল শেষে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুল শুকাচ্ছিল দিজা। মেহেদি রঙের শাড়িটায় এত সুন্দর লাগছিল যে আমি বিভোর হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। দিজার ভেজা চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল। মেয়েটা এখনও রেগে আছে। রাগ ভাঙানোর উদ্দেশ্যেই একটু এগিয়ে গেলাম। আর তখনই শ্যাম্পুর ঘ্রাণ নাকে এল। লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে আরো কাছে গেলাম। যেই তাকে ধরতে যাব ঠিক তখন সে দূরে সরে গেল। কড়া গলায় নিষেধ করল, “ছুঁবে না। ছুঁবে না বলছি।”
আমি টিপ্পনী কেটে বললাম, “এতদিন পর শাড়ি পরেছ ব্যাপার কী হুম?”
দিজা তাচ্ছিল্য করে বলল, “ব্যাপার ট্যাপার কিছু না। এমনিই পরেছি। কারোর দৃষ্টি আকর্ষণ করার ইচ্ছে আমার নেই।”
আমি বললাম, “কিন্তু আমার কুনজর যে তোমার উপর পড়ে গেল! এখন কী হবে?”
দিজা কোনোমতে হাসি চেপে রেখে কঠিন গলায় বলল, “অসভ্য! দূরে যাও। দূরে যাও আমার থেকে। কাছে আসবে না বলছি।”
“যদি জোর করে কাছে আসি?”
“ভালো হবে না কিন্তু!”
“ভালো হবে না? দাঁড়াও দেখাচ্ছি।” বলেই দিজাকে ধরতে যাব ঠিক তখন সে ছুটে পালাল। ছুটতে ছুটতে শোবার ঘরের এক কোণে যেতেই আমি তার পথ আটকে দাঁড়ালাম। আর তখনই দিজা তার পায়ের কাছ থেকে এক টুকরো কাগজ কুড়িয়ে নিল। অনেক্ষণ সেই কাগজের দিকে তাকিয়ে রইল। সেখানে বারবার একই কথা লেখা। অমিশাকে ভালোবাসি। অমিশাকে ভালোবাসি। অমিশাকে ভালোবাসি। আমি ভেবেই অবাক হচ্ছি সেদিন তো এইসব উল্টোপাল্টা লেখার পর কাগজ পুড়িয়ে ফেলেছিলাম! তারপর আবার কখন লিখলাম!
দিজা কাগজের টুকরোটা আমার চোখের সামনে ধরে রেখে বলল, “এটা কার হাতের লেখা?”
আমি আমতা আমতা করে বললাম, “আ-আমার।”
দিজা কোনোমতে কান্না আটকে রেখে বলল, “অমিশা কে?”
আমি নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইলাম। দিজা এবার চেঁচিয়ে বলল, “বলো অমিশা কে? কে এই অমিশা? এই মেয়েটার জন্যই কি তোমার এত পরিবর্তন? বলছো না কেন কিছু? বলো?”
চিৎকার করতে করতে কান্নায় ভেঙে পড়ল দিজা। কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়েছে। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছি। বুকের ভেতর থেকে উথলে উথলে উঠছে কান্নার ঢেউ। নিজেকে সামলে রেখে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। তবে কতক্ষণ সামলে রাখতে পারব জানা নেই।
চলবে
মো. ইয়াছিন
[গতকাল এক পাঠক ই-মেইল করেছে, বলেছেন তিনি আমার বই আমাকেই গিফট করতে চান। এবং সেইসঙ্গে দীর্ঘ চিঠি লিখেছেন। যার ফলে আজকের দিনটা বেশ ভালো কেটেছে। অশেষ ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা সেই পাঠকের প্রতি। শুধু তিনি নন; সব পাঠকের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। হ্যাপি রিডিং।]
গত পর্বের লিংক :
https://www.facebook.com/107969461087579/posts/346618580555998/?app=fbl