অসুখের নাম তুমি” পর্ব:৩

0
1637

#অসুখের_নাম_তুমি
#সোনালী_আহমেদ
৩য় পর্ব

আকাশে ‘বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে’ নাকি সৌহার্দের দেহে? সে বুঝে উঠতে পারলো না। রেশমির স্পর্শ কারেন্টের শকের মতো লাগলো সৌহার্দের নিকট। এত ঠান্ডা তাপমাত্রার মাঝেও সে ঘামতে লাগলো।

বুকের বাম পাশে দুই ফুসফুসের মাঝে অবস্থিত ত্রিকোণাকার ফাঁপা অঙ্গটি অস্বাভাবিকভাবে চলাচল করছে সৌহার্দের। সে কোনো রকম ই নিজেকে সামলাতে পারছে না। কোনো কিছু না ভেবে সে রেশমিকে হালকাভাবে ধাক্কা দিয়ে সরে গেলো।

ব্যাপারটায় রেশমি ব্যাপক লজ্জা পেলো। সে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না সামনের দিকে। ইশশ,লোকটা তাকে কী ভাববে? নিশ্চয়ই তাকে নির্লজ্জ বলছে। মনে মনে নিজেই নিজেকে গালি দিয়ে বললো রেশমি রে রেশমি তুই কি করে বসলি?

সৌহার্দ শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। সে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কাঁপছে।মনে মনে ভাবে রেশমির কাপুনি রোগ এসে কি তাকে ধরলো নাকি? তা নাহলে সে এমন কাঁপছে কেনো?

ইতোমধ্যে ঝড় আর বজ্রপাত থেমে গিয়ে তুমুল আকারে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। বৃষ্টিপাতের কারণে না কিছু দেখা যাচ্ছে আর না কিছু শুনা যাচ্ছে।চারদিকে অন্ধকার আর অন্ধকার। শুধুমাত্র দুজন দুজনকে অনুভব করছে।

রেশমি বিছানার একপাশে শুয়ে পড়লো। কাঁথা টা ভালো করে নিজের গায়ে দিয়ে দিলো। সৌহার্দ ও কিছুক্ষণ পর গিয়ে ওপর পাশে শুয়ে পড়লো। বিছানা বেশি বড় নয় আবার ছোটও নয়। মাঝারি আকারের বিছানা। বিছানায় দুটো বালিশ আর একটাই কাঁথা। যেটা ইতোমধ্যে রেশমি জুড়ে বসেছে।
বৃষ্টির ফলে আবহাওয়া আজ বেশি ঠান্ডা।সৌহার্দের পরনে নেভি ব্লু টিশার্ট আর ফুল প্যান্ট। শরীরের উপরে না কোনো কাঁথা না কোনো কম্বল। কয়েক সেকেন্ড না যেতেই তার ভীষণ শীত করতে লাগলো। সে রেশমির দিকে চাপতে লাগলো। সাপের মতো বেকে শুয়ে রইলো। রাত বাড়ার সাথে সাথে ঠান্ডার মাত্রাও বাড়তে লাগলো। ঠান্ডায় অবস্থা খারাপ তার। অথচ রেশমিকে দেখো সে দিব্বি শুয়ে আছে। পাশের লোকটার কাশির আওয়াজ ও তার কানে পৌঁছাচ্ছে না। মানুষটার প্রতি তার এত অনিহা!

সকাল ছয় টা পেরিয়ে সাত টা বেজে গেলো। রেশমির এখনো উঠার খবর নেই। এ বাড়ীতে সকল সদস্য ছয়টা বাজার পূর্বেই ওঠে যায় আর সাত টা বাজার পূর্বে একদফা নাস্তা ও শেষ হয়ে যায়। নিত্য দিনের মতো একহাতে সব সামলাচ্ছে সুমি। ঘুম থেকে সে বরারবরই সবার আগে ওঠে। তারপর প্রত্যেকের জন্য নাস্তা পানি তৈরী করতে নামে। আজও তার সময়ের একটুও হেরফের হয় নি। শাশুড়ির কথা মনে পড়তেই সে একবার ভেবেছে রেশমিকে ডেকে তুলে নিবে। পরক্ষণে তার অসুস্থতার কথা চিন্তা করে আর তুললো না।

সবাই নাস্তার টেবিলে বসে আছে। লিনা গম্ভীর মুখে বসে আছে। তার মেজাজ প্রচুর বিগড়ে আছে। সৌহার্দের উপর ভীষণ ক্ষেপে আছেন তিনি। সুমি বিষয় টা কিছু আঁচ করতে পেরেছে। তাই সবকিছুতে খুব সাবধান হয়ে কাজ করছে সে। শাশুড়ি কিছু চাওয়ার আগেই সামনে নিয়ে আসছে।

লিনা হুংকারী গলায় বলে,–‘ সুমি।’

–‘জ্ জ্বি,আম্মা।’

–‘ তোমার গুনধর ভাই কি ঘুম থেকে ওঠবো না? এত বড় কান্ড ঘটিয়ে শান্তিতে ঘুমুচ্ছে কেমনে?’

সুমি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। তার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। ভাইকে নিয়ে তার খুব ভয় হচ্ছে, কাল যা কান্ড ঘটিয়েছে না জানি তার পরিণতি কী থাকে ভাইয়ের কপালে।

লিনাকে উদ্দেশ্য করে সুমি বলে,–‘ আমি ডাইক্যা নিয়ে আসতাছি ওদের।’

লিনা জবাব দিলো না, সে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে খাবার প্লেটের দিকে। এ চাহনি দেখে সুমি তাড়াহুড়ো করে ভাইয়ের রুমের দিকে পা বাড়ায়।

৩.
গোঙ্গানির আওয়াজ কানে আসতেই ঘুম ভেঙ্গে যায় রেশমির। প্রথমে সে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো,পরক্ষণেই মনে পড়ে গেলো তার স্বামীর কথা। সৌহার্দ উল্টে বেকে শুয়ে আছে। পুরো শরীর গরম হয়ে আছে তার। রেশমি নড়তেই তার হাত সৌহার্দের দেহে লেগে যায়। হাত লাগতেই সে ছিটকে সরে গেলো। সোহার্দের শরীর আগুনের মতো গরম হয়ে আছে।

মুহূর্তেই রেশমির ঘুম উবে গেলো। সে উঠে বিছানায় বসতেই দেখলো সৌহার্দকে। তৎক্ষণাৎ সে বিষ্মিত হয়ে গেলো। এ কাকে দেখছে সে? কে এই লোক?

রেশমি কিছু না বুঝে ‘আ আ’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো। তার চিৎকার শুনে ধরফরিয়ে ওঠে বসে সৌহার্দ।

–‘কি হয়েছে?কি হয়েছে?’
বলে গোল গোল চোখে রেশমির দিকে তাকায় সৌহার্দ। তার ঘুমের ভাব টা এখনো কাটে নি।

রেশমি হা করে তাকিয়ে আছে সৌহার্দের দিকে।
এ তো ছেলে নয় রাজপুত্র! কি অপরুপ চেহারা। রেশমির দৃষ্টি সৌহার্দের চোখের উপর। এ কেমন চোখ! দেখতে একদম আকাশের মতো। তার দেখা সকল মানুষের চোখ কুচকুচে কালো, এমনকি তার চোখ ও কালো। তাহলে এ ব্যক্তির চোখ এ কালার কেনো? সে মনে মনে সৌহার্দকে তার ভ্রম ধরে নিলো। নিশ্চয়ই একটু পর লোকটা গায়েব হয়ে গিয়ে বুড়িওয়ালা মোটা বুড়ো লোক বসে থাকবে।

রেশমিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে দেখতে দেখে,সৌহার্দ তাকে ঝাঁকিয়ে বলতে লাগলো,’ এই বলো,কি হয়েছে?চিৎকার দিয়েছো কেনো?’

চোখ কচলে সামনে তাকিয়ে একই ব্যক্তিকে দেখতে পেয়ে রেশমি নিশ্চিত হলো যে এ কোনো তার কল্পনা নয়। সে হাত বাড়িয়ে সৌহার্দের মুখের উপর হাত রাখলো।

সৌহার্দ বোকা বনে রেশমির দিকে তাকিয়ে আছে। এ মেয়ে করছে কি?

রেশমি ছুঁয়ে দেখে পূর্ণ বিশ্বাস করলো যে সৌহার্দ সত্যিকার অর্থেই তার সামনে বসে আছে। হাত টা গুটিয়ে নিয়ে চোখগুলো বড় করে, উৎফুল্ল হয়ে বলে, ‘ ওমা,আফনে কি সুন্দর!’

রেশমির এমন কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় সৌহার্দ। হঠাৎ রেশমির মাথায় আসে এখানে তো তার স্বামীর থাকার কথা। এ অচেনা লোক কি করছে?

সৌহার্দ কিছু বলে উঠার আগেই রেশমি বলে ওঠে,’ আফনে কেডা? এহানে কি করতাছেন? মোর সোয়ামি কই? সে কই গিয়াছে?’

রেশমি অনবরত প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। সৌহার্দ যেনো আরো অবাক হয়ে যায়। সে ই তো রেশমির স্বামী তাহলে এসব আবোল-তাবোল কি বলছে রেশমি?

সৌহার্দ মুখ দিয়ে কিছু বের করার আগেই দরজায় বিরতিহীন ভাবে কড়াঘাত করতে লাগলো সুমি।

‘ভাই,ও ভাই!’ বলেই বারবার ডেকে চলছে সুমি।

সৌহার্দ রেশমির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দরজা খুলতে চলে গেলো। দরজা খুলতেই রুমে ডুকে পড়লো সুমি।
ডুকেই প্রশ্ন করে ওঠলো,– ‘ নিচ থাইক্যা চিল্লানোর আওয়াজ শুনলাম। কি হইছে? কে চিল্লাইছে?কি এর লাইগা চিল্লাইছো?’

–‘ ওই যে উনি,( রেশমির দিকে সুমি তাকাতেই সৌহার্দ আবারো বলে)হ্যা উনি চিল্লিয়েছেন।’

–‘কেনো?’

—‘তারে গিয়েই জিজ্ঞাসা কর।’

সুমি এক পলক রেশমির দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। তারপর ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,–‘ চাচী নিচে বইসা আছে। তাড়াতাড়ি মুখখানা ধুয়ে নিচে যাও।’

সৌহার্দ চলে যেতেই সুমি রেশমির কাছে গেলো। রেশমি বিছানা কাঁথা দিয়ে ঢেকে রেখেছে। বিছানায় বেশ ভালো করেই দাগ লেগে আছে। তাই সে কাঁথা দিয়ে ঢেকে রেখেছে।

–‘ ভাবি চিল্লাইলেন ক্যা?’

রেশমি এতক্ষণ ঘোরে ছিলো। সুমির কথা শুনে তার ধ্যান ভাঙ্গলো। সুমির দিকে তাকিয়ে অস্থির হয়ে বলে,
—‘উনি কে? উনি কেনো এহানে আছিলেন? এহানে তো বুড়ো থুক্কু মোর সোয়ামির থাকার কথা। সে কই?’

রেশমির কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ভ হয়ে গেলো সুমি। পরক্ষণেই তার মনে পড়লো বিয়ের সময় যখন ঝামেলা হয়েছিলো তখন সেখানে রেশমি উপস্থিত ছিলো না। সে তখন বিয়ের আসর থেকে বেশ দূরে অবস্থিত ছিলো। আবার ভাবলো সারা রাত একসাথে ছিলো তখনও কি সে দেখে নি?

তাই সুমি, রেশমিকে সেখানের কাহিনী বর্ণনা করে বলে,’ সৌহার্দ দাভাই ই তোমার সোয়ামি।’

রেশমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য বিমূঢ় হয়ে গেলো। সে গালে হাত দিয়ে বলে,’ তারমানে উনি কাল রাত্রে আমার লগে ঘুমাইছিলো?’

সুমি মাথা নাড়ায়। রেশমির বিষ্ময় যেনো কাটছেই না। মনে মনে নিজেকে হাজার খানেক গালি দিয়ে বলে,’ইশশ, রাতে কেনো দেখলাম না?’

সুমি রেশমির ভাবনার সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলে,’এই যে।’

রেশমি হাত নামিয়ে সোজা হয়ে বসে, তাকালো। সুমি তাকে তাড়া দিয়ে বলে,–‘ কটা বাজে দেখেছো? এত বেলা অবধি শুয়ে আছো, বাকি খবর আছে নিকি? তাড়াতাড়ি উঠে আসো, মা নিচে বসে আছে। নাহলে উনি এসে তোমার খবর করে দিবে নি!’

রেশমি উঠছে না। ইতস্ত বোধ করছে। বিছানা যে নষ্ট হয়ে আছে। সে উঠে গেলেই তো সুমি দেখে ফেলবে। আর দেখলেই তো তাকে বকা দিবে।

সুমি ভ্রু যুগল দলা করে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। উঠার কথা বলতেই মেয়েটার মুখ ওমন মলিন হয়ে গেলো কেনো?

সুমি আবার বলার আগেই দরজা দিয়ে সিয়াম দৌড়ে প্রবেশ করে বলতে লাগলো,–‘ দাদী আইসা গেছে,দাদী আইসা গেছে। ভাবী দাদী আইসা গেছে।’

সিয়ামের কথা সুমির কানে পৌঁছাতেই চোখ বড় বড় করে ফেললো সুমি। সে সিয়ামকে বলে,’কিহ? দাদী আসছে? কেমনে? দাদী তো তার বইনের বাড়ী গেছে। মিথ্যা বলোস ক্যা?’

সিয়াম ঘুরতে ঘুরতে বলে,’ সিয়াম মিথ্যা বলে না। মিথ্যা কথা পঁচারা বলে। এই দেখো দাদী আমার লাইগা গাড়ী নিয়া আইছে।’

ছোট খেলনা গাড়ী দেখে সুমি নিশ্চিত হলো সত্যিই দাদী আসছে। সে বিরবির করে বলে ওঠে,–‘সর্বনাশ!’

রেশমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না।

—‘ভাবী, ভাবী, তাড়াতাড়ি ওঠো। দাদী চইলা আসছে। তাড়াতাড়ি নিচে যাও। আজ মনে হয় কোনো না কোনো প্রলয় ঘটবোই।’

চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here