অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া পর্ব_১৪

#অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৮

২৯.
এরফান চুরিচুপে ফেরদৌসকে টেনেটুনে বেলকনিতে নিয়ে এলো। ফেরদৌস দেখে চেঁচাতে চাইলে এরফান তর্জনী আঙুল দেখিয়ে একটু চুপ থাকতে ইঙ্গিত করে। ফেরদৌস দোস্তের কথা মত চুপ রইল। বেলকনিতে আনার পর এরফান ফেরদৌসকে কেন্দ্র করে রহস্যময়ী কণ্ঠে বলে,

‘দেখ যাবিয়াজ আমাদের থেকে কিছু লুকাচ্ছে। তার মুখমন্ডল অনুধাবন করেছিস। আগের চঞ্চল ছেলেটি অত্যন্ত গাম্ভীর্যে পরিণত হয়েছে।’

ফেরদৌস নিজেও ক’দিনে লক্ষ করেছে যাবিয়াজ পরিবতনশীলতা। যে ছেলে সব বিষয়ে নিখুঁত পর্যবেক্ষণ করে মনমাতানো হাসি দিতো। সে ছেলে এখন খুঁত খুঁজে পৈশাচিক হাসি দেয়। এরফানকে নিজের মত গাড় সন্দেহে পুষতে ফেরদৌস আক্ষেপময়ী কণ্ঠে বলে,

‘দোস্ত ইফদিয়ার সঙ্গে কিছু হয়েছে!’

এরফানের মস্তিষ্ক খেলে উঠে ‘ইফদিয়ার’ নামটি ফেরদৌসে মুখে শুনার সঙ্গেই। মেয়েটির সঙ্গতা ক’দিনে পরখ করেনি যাবিয়াজের মাঝে। কোনো এক প্রকার শিরঃপীড়াময় ছেদ ঘটেছে দুজনের মাঝে। ফেরদৌসের সম্মুখীন মাথা নেড়ে বলে,

‘সিউরিটি দিতে না পারলেও গ্যারান্টি দিতে পারি ইফদিয়ার সঙ্গে নিশ্চিত যাবিয়াজ কোনো না কোনো তুলকালাম বাজিয়েছে।’

ফেরদৌস উদাসীন ভঙ্গিমায় বলে,

‘মেয়েটি মেলা ভালো ছিল। যাবিয়াজ এর নিঃসঙ্গ দুশ্চিন্তাময়ী জীবনে আলোর প্রদীপশিখা হতে পারতো। না জানি উদ্ভট বালকে কি কান্ড ঘটিয়েছে।’

‘শ্রেয়িতাকে জিজ্ঞেস করি। সে বলেছিল না, ইফদিয়ার আর তার পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। নিশ্চয় ইফদিয়ার কষ্ট পেলে শ্রেয়িতার কাছে শেয়ার করবে। আফটার অল শ্রেয়িতা আমাদের ক্লুজ ফ্রেন্ড। ইফদিয়ার নিজেও দেখেছে কয়েকবার।’

ফেরদৌসের মনের গহীনে আশার আলো ঝিকঝিক করে জ্বলে উঠে। এরফানকে উত্তেজিত গলায় বলে,

‘শোন দোয়া কর শ্রেয়িতার মুখ থেকে যেন শুভ বাক্য উতলে পড়ে।’

এরফান প্রত্যত্তুরে জবাব দিল না। শুধু ফেরদৌস এর দিকে করুণ চাহনী নিক্ষেপ করেছে। যার মর্ম হলো ভাই তোর দোয়া যেন কবুল হোক। শ্রেয়িতার নামক নাম্বারে চাপ দিয়ে ফোন ডায়ল করে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষটির কাছে কল যাচ্ছে না বলে জানান দিচ্ছে সার্ভিস সেন্টার থেকে। এরফান হতাশ হয়ে ফোঁস করে উঠে। ফেরদৌস বন্ধুর অসহায়ত্ব দেখে বলে,

‘কি শ্রেয়িতা কিছু বলেছে।’

‘কি বলবে কলই যাচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে সে রাগ করেছে আমাদের ইগনোরনেস এ।’

ফেরদৌস কপাল চাপ্পড়ে ব্যবলাকান্তের ন্যায় মুখ করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,

‘দোস্তানি রাগে বোল্ড হয়েছে আইম সিউর। কারণ কালকের দিন পেড়িয়ে আজকের দিন আরম্ভ হতে হতে প্রায় শেষের দিকে। এখনো রাগ ভাঙ্গায়নি শ্রেয়িতার।’

পরক্ষণে এরফানের মাথায় বুদ্ধি এলো। সে শয়তানি হেসে ফেরদৌসের কানে ফিসফিস করে পুরু শয়তানি বুদ্ধির পদ্ধতি ঢেলে দিল। ফেরদৌস শুনে হতম্ভব হয়ে গেল। অবাককর দৃষ্টি নিয়ে এরফানের দিকে তাকায়। কাঁপা গলায় বলে,

‘এরফান তুই উল্টা ফাঁসিয়ে দিবি।’

‘দোস্তানির রাগ ভাঙ্গানোর মূখ্যকর্ম এটা।’

ফেরদৌস নিরবচ্ছিন্ন ভঙ্গিতে চুপ করে রইল। এরফান ফোনের দিকে কললিস্ট চেক করে। চেক করতে করতে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির নাম্বার না পাওয়ায় উওেজনাময় গলায় বলে,

‘হায় রে কোনো ভাবে কি হারায় ফেলছি নাম্বারটা!’

পুনরায় কললিস্টের একদম শেষে নাম্বারটি পেয়ে সূক্ষ্ম হাসি উপহার দিল ফেরদৌসকে। ইশারায় বলে ‘পেয়েছি’। ফেরদৌস মৃদু হেসে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ‘গুড’ বুঝায়। এরফান কলে চাপ দিতেই রিং হতে লাগে। কয়েক সেকেন্ড পরই কল উঠায় কাঙ্ক্ষিত মানুষটি। সে তাকে ভিন্নভাবে কথাগুলো পূর্ণবাক্যে বানিয়ে সাজিয়ে উপস্থাপন করে দিল। শেষ বাক্যে এইও বলে উঠে।

‘হ্যা অবশ্য আপনি তাকে ভালো করে চিনেন। ছবি পাঠিয়ে দিচ্ছি আপনার হোয়াইটসআপে।’

কল কেটে হোয়াইটআপে এড করে নিল মানুষটিকে। তার আইডিতে শ্রেয়িতার ছবি পাঠিয়ে দু’সেকেন্ড এর বেশি রাখল না। ফটাফট আনসেন্ড করে দিল। অপর মানুষটি খানিক বাদে করে ছোট একটি মেসেজ করে। যা দেখে এরফান মুখ ভেটকিয়ে বলে,

‘বাহ রে ঢং দেখো। বান্দরের লজ্জার ইমুজির সঙ্গে বার্তা পাঠিয়েছে। ‘দেখে নিব আমি’। লিখাটা লিখে কি নিজেকে শাহরুখ খান ভাবে সে। ধুর আজাইরা!’

ফেরদৌস সবটা শুরু থেকে পর্যবেক্ষণ করেছে। শেষে এরফানের বিরক্তিসূচক চাহনীতে বিড়বিড়ানো কথনগুলো শুনে ফেলে। নিজের হাসি গম্ভীর পরিস্থিতিতে সংযত করে এরফান এর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গলা ঝেড়ে উঠে।
এরফান সেই মানুষটিকে ‘ওকে’ বলে চ্যাট করা অফ করে দিল। ফেরদৌস এর দৃষ্টি আকর্ষণে মতঁ হয়ে এরফান আহ্লাদী গলায় বলে,

‘দেখিস শ্রেয়িতা ধামাকাদার উপহার পাইবো। নিজ হাতে নিয়া যাবো উপহারটা। আমার গ্যারান্টি খুশিতে আকাশে উড়াল দেওয়ার মত দশা হবে।’

এরফান আর ফেরদৌস শ্রেয়িতার রাগ ভাঙ্গানোর পদ্ধতি অবলম্বন করার কৌশল খুঁজার চেষ্টা করছে। অতএব তাদের এক বন্ধু যে ঠিক অন্য কাউকে অপদস্থ করতে ভোরবেলায় বেড়িয়ে গেল। তার কোনো প্রকার অনুচিন্তাও নেই তাদের ধারণায়। জানলে হয় তো রেশারেশি ঘটবে ‘বন্ধুত্ব’ নামক সম্পর্কের মাঝে। যার বিন্দুমাত্র সহ্য করার ক্ষমতা নাই যাবিয়াজ এর। হোস্টেলে বায়োজেনেটিক প্রোগাম সভার আয়োজন বসবে বিকাল বেলায়। সাইরেন বাজিয়ে একটি লোক সব ছাত্র-ছাত্রীকে অবহিত করছেন। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন ক্যানভাসে অবস্থিত উঁচু করে অঙ্কন করা পিরামিড এর চিত্রাঙ্কনের পশ্চাতে। ক্যানভাসে কোনো প্রকার দর্শনীয় স্থান না থাকলেও রয়েছে বিশেষ স্থাপত্যের আবিজাত্য। যার অভিভূত উৎস কোনো বিশেষ চিত্রশিল্পীর চমৎকার হাতের ছোঁয়া। ক্যানভাসের প্রতিটা দেওয়ালে খোদাই করা হয়েছে উচুমানসম্পন্ন চিত্রাঙ্কন। যা দেখলে বোঝা সক্ষম যে চিত্রগুলো খোদাই করতে সুস্পষ্টভাবে দেওয়ালে ফুটিয়ে তুলতে বিশেষ সময়ের প্রয়োজন হয়ে ছিল। যার পরিমাণ সীমিত নয় বরঞ্চ দীর্ঘ সময় বলা যায়।
এরফান হোস্টেলের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ফেরদৌস এর সঙ্গে আভিজাত্যপূর্ণের প্রশংসামুখর হলো। রুমের মধ্যে বেল বাজায় এরফান ভেতরে এলো। গায়ে রয়েছে মোলাটে রঙের টিশার্ট আর ঢিলেঢালা কালশিটে রঙের হাটু অব্দি প্যান্ট। দরজা খুলে দেখে হোস্টেলের কর্মচারী হাতে নাস্তার ট্রে বহন করে এনেছে। সাদরে ট্রে নিজ হাতে বহন করে নিল এরফান। পকেট থেকে ১০০টাকার একটি নোট বের করে ধরিয়ে দিল কর্মচারীর হাতে। উক্ত লোকটি আনন্দপূর্ণ নয়নে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এরফান থেকে বিদায় নিল।
বেলকনিতে পুনরায় এসে ট্রে টেবিলের উপর রেখে ফেরদৌস কে পানাহার গ্রহণ করতে ইশারা করে। মৃদু হাসি ঠোঁটের ফাঁকে ঝুলিয়ে গ্রিন ট্রি-র মগ হাতে নিয়ে মগে চুমুক দিল। তিনটি মগের দুটি তারা নিলেও একটি রয়ে গেল ধোয়াঁটে প্রভাব ছড়ানোর ব্যস্ততায়। যে মগটি ছিল তাদের বন্ধু যাবিয়াজ এর। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)

৩০.

শ্রেয়িতা হতবাক দৃষ্টিকোণ এঁটে রাখল ড্রয়িং রুমের সোফা সেটের দিকে। তার দৃষ্টি আদৌ শুদ্ধ নাকি অশুদ্ধ দৃশ্য দেখাচ্ছে। বুঝা দ্বায় হয়ে পড়ল শ্রেয়িতার! শুকনো দৃষ্টিতে ডান দিকের সোফায় বসে থাকা ভদ্র মহিলা আর ভদ্র পুরুষ এর দিকে মুখ করে তাকায়। উনারা কি সানন্দে কথোপকথন করছেন বাঁ দিকের সোফা সেটে বসারত মানুষদের সঙ্গে। বাঁ দিকের এক তালায় চোরের মত দেওয়ালের পিছে লুকিয়ে আছে শ্রেয়িতা। পরমুর্হুতে নিচে বসা মানুষটির সামনে যেতে চায় না। কোনোভাবে তার সামনে থেকে উধাও হতে পারলেই যেন বাঁচে।
শ্রেয়িতা নিজেকে নিজেই বলে,

‘তাই বলি মানুষের সঙ্গে প্যাচাঁল বাড়াতে নেই। তাহলে প্যাচাঁল বিবাহ অব্দি চলে যায়। না রে বাবাহ এই গুমোট মানুষরে বিয়ে বাপের জীবনে জম্মালেও করতাম না।’

নিজেকে সাহসী সাভ্যস্ত করে ধীরস্থীর পায়ে নিজ রুমে প্রবেশ করে শ্রেয়িতা। কাবার্ড থেকে খয়েরী রঙের ফুলের সমাবেশে অবরোধদ্ধ ফুল হাতা টিশার্ট আর সটানপূর্ণ কচমচে গুমোট ছাই রঙের প্লাজু বের করে পরে নিল। আয়নার সামনে এসে চুল আচঁরে মাঝারি আকৃতির ক্লিপ মেরে চুলগুলো ডানপাশে ঝুলিয়ে ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিল। সোফায় বসা ভদ্র যুবকটি জনাব জগৎ শন্দ্রনাথ কে বলে,

‘ধন্যবাদ আঙ্কেল সঙ্গে ভীষণ দুঃখিত রাতে না আসার জন্যে। গভীর রাত হয়ে পরায় আর বের হলাম না। ঠিক ভোরবেলায় সকলকে নিয়ে রওনা হলাম। বাই দ্যা ওয়ে কত দিনের ট্রেনিং এ শিক্ষকতার কাজ করতে হবে আমায়!’

‘এই ধরো এক-দু সপ্তাহ। আর তুমি চাইলে তোমার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট রাখতে পারো। যে তোমাকে প্রোগাম লিস্ট,নাম লিস্ট,প্রোগাম আয়োজনে সহায়তা করবে।’

ভদ্র ছেলেটি খানিকক্ষণ ভেবে মৃদু হেসে বলে,

‘জ্বি আঙ্কেল এমন যোগ্য ছাত্র হলে ভালো হয়।’

‘ইসমাইল বাবা আমার মতে যাবিয়াজ কে নিতে পারো এসিস্ট্যান্ট রুপে। সে হলো বায়োজেনিটিক বিভাগের ছাত্র। কিন্তু তার মূখ্য বিভাগই প্রকৌশল আর প্রযুক্তিবিদ্যা বিষয়ক। বায়োজেনেটিক বিভাগের উপর চর্চা অনুকরণ করতে চাই। বিধায় আমিও বারণ করেনি। সে যেমন মেধাবী তেমন বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন।’

ভদ্র ছেলেটি অর্থাৎ ইসমাইল সম্মতি দিল। যার অর্থ হলো সে যাবিয়াজ কে এসিস্ট্যান্ট স্বরুপ ট্রেড করবে।
ইসমাইল শন্দ্রনাথ সাহেবের বাড়িতে এলো যখন যোহরের আযান শেষ হলো। সে সময় গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিল শ্রেয়িতা। কলিংবেল বাজলেও জাগেনি সে। স্বয়ং তার মা গিয়ে আপ্যয়ন করে ইসমাইল, তার বোন,কাকী আর মাকে। ভদ্র মহিলাটি ইসমাইল এর মত সুর্দশন যুবককে দেখে অত্যধিক খুশি হলেন। তিনি সুশ্রী যুবক হিসেবে দেবীর কাছে আগন্তক এর মত যুবক চেয়ে ছিলেন মেয়ের জীবনসঙ্গি হিসেবে।
পরন্তু মুসলিম নামটি শুনে ভদ্র মহিলাটির মুখে কালো আঁধার ছড়িয়ে গেল। জগৎ শন্দ্রনাথ এর স্ত্রী অর্থাৎ ভদ্র মহিলাটির মুখমন্ডল পাংশুটে হয়ে পড়ে। তিনি ভেবেছিলেন এই বুঝি মেয়ের জীবনসঙ্গী স্বয়ং দেবী উনার বাসায় পাঠিয়েছেন। কিন্তু নিতান্তই যে উনার ভুল ধারণা ছিল। এমন কি জগৎ শন্দ্রনাথও ইসমাইল এর বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের অবগত করেননি। ভদ্র মহিলাটি ইসমাইল এর চুক্ষগোচরে খোঁচা দিলেন জগৎ শন্দ্রনাথ এর বাহুতে। তিনি পাত্তা না দেওয়ায় বারংবার উনার স্ত্রী খোঁচা দেওয়ায় বিরক্তবোধ করলেন। ইসমাইল কে অপেক্ষা করতে বলে স্ত্রীর সঙ্গে রুমে গেলেন। ভদ্র মহিলার হিংস্র চাহনী লক্ষ করে জগৎ শন্দ্রনাথ বুঝতে সক্ষম হলেন আসলে ঘটনা কি!
তিনি স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে আদুরে গলায় বলেন,

‘ইসমাইল মুসলিম ঘরের পুত্র। কিন্তু এতে তার ধর্মের প্রতি আমার কোনো রকম হেয় নেই। আমি তাকে স্নেহ করি নিজ সন্তানের মত অনুধাবন করি। তার প্রশিক্ষক পদটি ক্যানভাসে পড়ল। সেখানকার শিক্ষকগণ নিজেকে সৌভাগ্যভান বলছিল। কারণ ইসমাইল এর মত খ্যাতনামা ডাক্তার তাদের ক্যানভাসে প্রশিক্ষক রুপে প্রবেশ করবেন বলে। তথাপি ইসমাইল নতুন শহরে একদিনে বাসা ভাড়া কেমনে পাবে! সেজন্যে নিজ বাসায় আসতে অনুরোধ করে ছিলাম আমি। শুনো লক্ষ্মীনা কোনো প্রকার ঈর্ষা-বিদ্বেষ ছাড়া মেহমানদের সামনে মনমাতানো ব্যবহার উপস্থাপন করবেন। আমায় নিরাশ করবে না বলে আশা রাখি।’

লক্ষ্মীনা উত্তরের বিনিময়ে মুচকি হাসি উপহার দিলেন। জগৎ শন্দ্রনাথ স্ত্রীর হাসির অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি জানেন উনার স্ত্রী সবর্দা কোমল সরল প্রকৃতির। মেহমানদের প্রবেশে তাদের ধর্মে মঙ্গল মান্য করা হয়। ফলে লক্ষ্মীনা মেহমানদের যত্ন নিতে আরম্ভ করলেন।
লক্ষ্মীনা ইফদিয়ারকে নেকাপে দেখে বলে,

‘মামুনি নেকাপ একটু সংযত করো। তোমার মুখখানি দেখতে পাচ্ছি না।’

ইফদিয়ার কথাটি শুনে অস্বস্তিবোধ করে। তার সামনে আর্দশ পরিচিত শন্দ্রনাথ বসে আছেন। এমনকি পিছে দুজন ২০-২১ বছরের যুবক দাঁড়িয়ে আছে। তারা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে যেন ইফদিয়ার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করছিল। ইসমাইল বোনের অস্বস্তিদায়ক দশা বুঝে মিসেস শন্দ্রনাথকে সৌজন্যে বলে,

‘দুঃখিত আন্টি আমাদের মুসলিম ধর্মে মেয়েদের পর-পুরুষদের সামনে মুখ দেখানো জায়েজ নয়।’

লক্ষ্মীনা শুনে মুখ ফিরিয়ে পিছে তাকালেন। ডাইনিং টেবিলে উনার দু’ছেলে দাঁড়িয়ে বরাবর মুখ ইফদিয়ার দিকে করে রেখেছে। যা দেখে তেঁতে উঠলেন তিনি। ছেলেদের কাছে গিয়ে কড়া কণ্ঠে আদেশ করলেন।

‘তোমাদের অফিস নেই। যাও এখনি।’

যুবক দুজন পরপর নিজেদের দিকে তাকিয়ে চলে গেল। লক্ষ্মীনা ফিরে এসে পুনরায় ইফদিয়ার পাশে বসে। তিনি জগৎ শন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

‘মেয়ের মুখ তুমিও দেখতে পারবে!’

জগৎ শন্দ্রনাথ মাথা নাবোধক নেড়ে বাহিরে চলে যান। ক্যানভাসে জরুরি কাজ আছে সেটা সেরেই বাসায় ফিরবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। ইসমাইল পর-পুরুষ কাউকে না দেখে ইফদিয়ার কে আশ্বস্ত করল নেকাপ খুলতে।
ইফদিয়ার নিজেও চোরাচুখে পরখ করে ধীরস্থে নেকাপ উঠিয়ে মাথার পিছে ফেলল। লক্ষ্মীনার চোখ যেন আঁটকে গেল রমণীর উপর। স্বয়ং লক্ষ্মীদেবীর রুপে বসে আছে মনে হলো লক্ষ্মীনার। তিনি ইফদিয়ার থুতনীতে হাত রেখে প্রশংসাময়ী কণ্ঠে বলেন,

‘তোমার সৌন্দর্যের প্রশংসা করার ভাষা নেই।’

ইফদিয়ার সৌজন্যেমূলক হাসি দিয়ে বলে,

‘আন্টি আমাদের ধর্ম অনুযায়ী কারো প্রশংসা করলেন ‘মাশাআল্লাহ’ বলতে হয়। আপনি যদি…।’

ইফদিয়ার শুকনো ঢোক গিলল। সে ভাবে এই বুঝি আন্টি রেগে গেল না তো। কিন্তু তার ধারণাকে পুরুপুরি ভুল প্রমাণিত করে লক্ষ্মীনা ‘মাশাআল্লাহ’ বলেন। তিনি উঠে ইফদিয়ারকে বলেন,

‘তুমি আমার মেয়ের সঙ্গে রুমে থাকতে পারবে। একমিনিট মেয়েকে ডাক দেয়। শ্রেয়িতা…।’

গলা চেঁচিয়ে লক্ষ্মীনা শ্রেয়িতার নাম উচ্চারণ করে। যা শুনে ইসমাইল এর বুকপিন্ড ধুক করে উঠল। এলোথেরাপি হাতুড়ি যেন কেউ বুকের গহীনে পিঠাচ্ছে। নামটি যে তার পরীর সেটা বুঝতে সমস্যা হলো না তার। ইফদিয়ার রীতিমত অবাক। সে একপলক ভাইয়ের দিকে তাকায়। ইসমাইল গম্ভীর দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। ইফদিয়ার মনের কোণে বিষন্নতা ছাপ পুনরায় উঁকিঝুঁকি মারতে লাগে। কারণ সে ভেবেছিল কোনোভাবে যদি শ্রেয়িতাকে ভাবি বানানো যায়। ইফদিয়ার নিজে ভাবনাকে নিমিশেষে মাটিচাপা দিল। যা সম্ভবপর নয়। তার ভাই আর শ্রেয়িপ্পির মাঝে রয়েছে ‘ধর্মের দেয়াল’। পরবর্তী সময় আর কি কি ক্ষুণ্ণ পরিস্থিতির সম্মুখীন করেন একমাত্র আল্লাহ। তা নিতে একমাত্র তিনি অবহিত। ইফদিয়ার অন্তরাল হতে দীর্ঘ চাপা কষ্টের শ্বাস বেরিয়ে এলো।
শ্রেয়িতা ডাক শুনে ইতস্ততঃ বোধ কাটিয়ে পা টিপে ড্রয়িং রুমে এলো। তার বেহায়া মন না চাইতেও চোখ গিয়ে আঁটকায় ইসমাইল এর দিকে। যুবকটাকে আজ শুধু সুদর্শন নয় বরং অত্যধিক আকর্ষণীয় লাগছে। পরণে ফুল হাতা কালো রঙের শার্ট, যার উপরের দু’বোতাম উম্মুক্ত করা,ছাই রঙের প্যান্ট,হাতে কালো রঙের ঘড়ি,গম্ভীর মুখশ্রী হলেও যুবককে খারাপ দেখাচ্ছে না, মাথার চুলগুলি তেল দিয়ে একপাশে জড়িত করে রেখেছে। শ্রেয়িতার চোখের পলক পড়াও যেন বন্ধ হয়ে গেল। পরক্ষণে তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। শ্রেয়িতার দিকে এক সেকেন্ডের জন্যেও মুখ তুলে তাকায়নি ইসমাইল।
লক্ষ্মীনার ডাকে সম্মতি ফিরে শ্রেয়িতার। তিনি ইফদিয়ার কে পরিচিত করাতে চাইলে শ্রেয়িতা স্বেচ্ছায় বলে।

‘মম ইফদিয়ার আমার পূর্বপরিচিত সো ডোন্ট ওয়ারি।’

লক্ষ্মীনা মুচকি হেসে ইফদিয়ারকে তার সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। শ্রেয়িতা ইফদিয়ারকে রুমের ভেতরে গেল ঠিকি তবু মনের দ্বারপ্রান্তে হার মেনে পুনরায় ইসমাইল এর দিকে দৃষ্টি রাখে। ইসমাইল দাঁড়িয়ে লক্ষ্মীনার থেকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। শ্রেয়িতার চুক্ষদ্বয়ে পানি জমে এলো। নিজের মনকে বুঝিয়ে ইফদিয়ার কাছে গেল।
ইসমাইল ক্যানভাসে না গিয়ে নির্জন পার্কের মধ্যে এসে দাঁড়ায়। সূক্ষ্ম ধ্যানে ঘন উজ্জ্বল সবুজ ঘাসের দিকে দৃষ্টিকোণ রাখে। তার মনের অন্তরালে ‘আমার ভীনদেশী তারা’ গানটি স্মরণীয় হয়ে উঠে। সে নিজেও গেয়ে ফেলে।

~’আমার ভিনদেশী তারা
একা রাতেরি আকাশে
তুমি বাজালে একতারা
আমার চিলেকোঠার পাশে
ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে
তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে
মুখ লুকিয়ে কার বুকে
তোমার গল্পো বলো কাকে

আমার রাত জাগা তারা
তোমার অন্য পাড়ায় বাড়ী
আমার ভয় পাওয়া চেহারা
আমি আদতে আনাড়ী

আমার আকাশ দেখা ঘুড়ি
কিছু মিথ্যে বাহাদুরি
আমার চোখ বেধে দাও আলো
দাও শান্ত শীতল পাটি

তুমি মায়ের মতই ভালো
আমি একলাটি পথ হাটি
আমার বিচ্ছিরি এক তারা
তুমি নাও না কথা কানে
তোমার কিসের এতো তাড়া
সে রাস্তা পার হবে সাবধানে

তোমার গায় লাগেনা ধুলো
আমার দু’মুঠো চাল-চুলো
রাখো শরীরে হাত যদি
আর জল মাখো দুই হাতে
প্লীজ ঘুম হয়ে যাও চোখে
আমার মন খারাপের রাতে।

আমার রাতজাগা তারা
তোমার আকাশ ছোয়া বাড়ি।

আমি পাইনা ছুঁতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারী।’

ইসমাইল খালি গলায় গান গেয়েছে নিজের মনপ্রাণকে প্রশান্ত করতে। পরন্তু সেই মনের তিমিরে রংধুন যেন আজ ফিকে পড়ে গেল। হৃদয়ের ধুকপুক কে সে চাইলেও থামাতে পারে নি। মুখ ফুসকে বলে ফেলে,

‘পরী তুমি আমার সেই ভীনদেশী তারা। যার প্রতি নেশাক্ত হতে পারি তবুও তার #অস্তিত্বে_ছোঁয়া যেন বারণ।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here