অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া পর্ব_২১
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
৩৮.
তিরিক্ষপূর্ণ মেজাজে শ্রেয়িতা কেঁপে উঠে। তিমির রাত্রিতে ছাদের মধ্যে এপাশ ওপাশ পায়চারী করছে সে। রাগটা যেন তার সাত আসমান চুম্বী। কেননা ‘ইসমাইল’ নামক আলগা পিরিত ওয়ালাকে অন্য মেয়ের সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি করে হাসাহাসি করতে দেখেছে। শ্রেয়িতার গা-পিত্তি যেন সেখানেই জ্বলে পুড়ে ছাই হবার মত অবস্থা। কিন্তু অগণিত মানুষের সামনে ইজ্জতের বারোটা বাজালো না। চুরিচুপে চলে এলো বাসায়।
এখন যেন নিজের রাগ দমাতে না পেরে ছাদে এসেই মহামান্য বকাবকি শুরু করে হাঁটাহাঁটি করছে সে।
লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
আজ বিকালে এনজিও ক্যানভাসে শিক্ষকদের মিলনমেলা উপলক্ষে অনুষ্ঠান ছিল। উক্ত অনুষ্ঠানে শুধু আমন্ত্রিত ছিল শিক্ষকদের পরিবার। বাহিরের অন্য কোনো ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক আমন্ত্রিত ছিল না। জগৎ শন্দ্রনাথ হলেন অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা। তিনি শিক্ষকদের সঙ্গে ট্রেনিং নেওয়ার সম্পর্কে আলোচনা করতে চান। অনুষ্ঠান থাকায় বিষয়টা উনার মতে আরো সহজতর হলো। তিনিও পরিবারসহ যথাসময়ে রাত ১০টায় উপস্থিত হলেন। কিন্তু জগৎ শন্দ্রনাথ এর আসার আগে চলে এসেছিল সেন আর রৌশ। তারা অনুষ্ঠানে অন্যান্য কর্মচারীদের সহায়তা কর ছিল। তারা ছিল ব্যবস্থাপক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত। স্বয়ং পদটি জগৎ শন্দ্রনাথ দিয়েছেন।
তিনি এসেছেন সঙ্গে এসেছে মূখ্য খ্যাতনামা ডাক্তার সাহেব ইসমাইল বুহিয়ান। কিন্তু সঙ্গে আর কেউ আসে নি। আসেনি বলতে ভুল হবে তার বোনকে অর্থাৎ ইফদিয়ার কে আসার কথা বলে ছিল। কিন্তু তার বোন ভীষণ ক্লান্ত ছিল বিধায় জোর করেনি আনতে। ইসমাইল জগৎ শন্দ্রনাথ তার আঙ্কেলের পরিচিত বলে সঙ্গে এসেছে।
ইসমাইল এর সঙ্গে অনেক সৌন্দর্য মোহনীয় রমণী এসে পরিচিত হবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করল। সব রমণীদের দিকে তাকানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে পোষণ করেনি ইসমাইল। সে শুধু একপলক তাকিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে ফোন কানে ধরে কথা বলার ভান আরম্ভ করে দিতো। অনুষ্ঠানে প্রতিটা
বয়স্ক প্রশিক্ষকদের মেয়ে এসেছে। সেই সব মেয়ে ইসমাইল কে দেখে তাদের লোভাতুর ইচ্ছে মিটাতে লেগে পড়ে। কোনো না কোনোভাবে গা ঘেঁষে ইসমাইল এর সান্নিধ্য পেতে চাই।
ইসমাইল নিজের আত্মায় দৃঢ়সংকল্পিত। কোনো রমণীকেও ‘হাই হ্যালো’ টুকু বলল না। শ্রেয়িতা অনুষ্ঠানে এসেছে কিন্তু বেহায়া মন তার ইসমাইল কে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ইসমাইল এসেছে তাদের সঙ্গেই। কিন্তু যুবকটা তার দিকে এটুকু লক্ষ করেনি। যাতে বেশ মন খারাপ হচ্ছে তার।
অনুষ্ঠানের জন্যে শ্রেয়িতা সাধারণ সাজে সেজেছে। উচ্চ ধনাঢ্য দেখানোর মত সাজ সাজেনি। অথচ অনুষ্ঠানে আসা কিছু রমণীর সাজ দেখে তার গলায় বমির পূর্বাভাস অনুভব করছে। শ্রেয়িতা সাদা আটামাখা মেয়েদের দেখে বিড়বিড়িয়ে বলে,
‘অনুষ্ঠানে আসছে নাকি ছেলে পটাতে আসছে আল্লাহ জানেন! দেখে ভদ্র ঘরের মেয়ে মনে হলেও কু-ইঙ্গিত এর চেয়ে কম মনে হচ্ছে না। যতসব ন্যাকামো মার্কা ঢং।’
ভীষণ বিরক্ত শ্রেয়িতা তাদের সাজগুজে। কারণ সে এতো সাদা মুখে মাখতে পছন্দ করে না। সে প্রাকৃতিকভাবে আহামরি সুন্দর না হলেও তার হালকা সাজই তাকে ভীষণ মায়াবী করে তুলে।
শ্রেয়িতা ফোঁস করে শ্বাস নিয়ে মোবাইল বের করে নিজের মুখের উপর ধরে। দেখে তার ডান গালে একটি ছোট তিল, গোলাপী ঠোঁটের উপর লাল রঙের লিপস্টিক, চোখের কাজলে কাজল টানা, ডাগর চোখের পাপড়ির উপরের অংশে কালো-নীল রঙের আইস্যাডো দেওয়া, আইলানার দিয়ে চোখের পাতা টান টান করা, মুখে নেই কোনো প্রকার ফাউন্ডেশন এর ছাপ। হালকা এটুকু সাজায় অসাধারণ তাকে আবৃত করেছে। অনুষ্ঠান উপলক্ষে লক্ষ্মীনা মায়ের উপদেশ মতে শাড়ি পরেছে। শাড়ির রঙটা হচ্ছে ঘন নীল রঙের। দেখতে কালো রঙের দাগকাটা ছাপ ফুটে উঠে। ফুলহাতা ব্লাউজ পরায় তার শরীরের অংশ পুরুপুরি ঢেকে আছে। একদম মার্জিত পরিমাণদর্শী নারী হয়ে এসেছে শ্রেয়িতা।
লক্ষ্মীনা দ্বিমত পোষণ করেনি মেয়ের সাধারণ সাজে।
তিনি সেজেছেন ঠিকিই।
শ্রেয়িতা ফোন ব্যাগে রেখে চৌপাশে নজর বুলিয়ে দেখতে থাকে। তখনি ক্যাফের বাঁ পাশের দুটো চেয়ারে বসে থাকা ব্যক্তিদের উপর তার নজর পড়ে। সে সরু চোখযুগল তীক্ষ্ম করে তাদের দেখতে থাকে। হাতজোড়া মুঠোবদ্ধ করে লুচির মত ফুঁসতে আরম্ভ করে। বিড়বিড়িয়ে বলে,
‘ইসমাইল আপনার সাহস দেখে অবাক না হয়ে পারছি না। এখানে আমাকে ইগনোর মেরে অন্য মেয়ের সঙ্গে মাতামাতি করেন।’
ক্রোধটা কে যথেষ্ঠ পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ করে আড়চোখে ইসমাইল আর অপরিচিত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে শ্রেয়িতা। কিন্তু হঠাৎ একটি দৃশ্য দেখায় সে চেয়ার থেকে উঠে। বাসায় চলে যায়। আসলে দৃশ্যটি ছিল ইসমাইল এর শার্টে অপরিচিত মেয়েটি নিজের হাতের স্পর্শ দিয়ে কি যেন করছিল। যা দূরে বসায় শ্রেয়িতা স্পষ্ট দেখতে পায়নি। শ্রেয়িতার স্বচ্ছ নরম মনটা উতলা হয়ে পড়ে। চলে যায় সেখান থেকে। বেশিক্ষণ থাকলে বুঝি হাত-পা ছড়িয়ে মারামারি করে ফেলবে।
ছাদে এসে শ্রেয়িতা হিসাব মিলাতে আরম্ভ করে। তার সঙ্গে ইসমাইল এর এড়ানো ভাব করে চলা। তার এহেন ঘাড়ত্যাড়া ভাব সহ্য হচ্ছিল না শ্রেয়িতার। যখনি শ্রেয়িতার সামনে অকস্মাৎ ইসমাইল উদয় হতো। তখনি যুবকটা চোখ ঘুরিয়ে গা ছাড়া ভাব দেখিয়ে টোটালি এড়িয়ে যেতো। শ্রেয়িতা দিনকে দিন যুবকের এড়ানোর দিকটা মানতে পারছিল না। তার মন চাইতো এখনি গিয়ে যুবকটার ভাব চুটিয়ে দিতে। কিন্তু না পারছে চুটাতে, না পারছে মানতে। রাগে ফোঁস ফোঁস করে শ্রেয়িতা বলে,
‘আজ তুই বড় গলদ কাম করলি ইসমাইল। তোকে জান দিয়া লাবিউ করি বলি অন্য মাইয়ার সঙ্গে রং মারোস। আরে গলইদা একবার কি আমার প্রতি তোর মন পুড়ে না। কানকাটা গন্ডাল না বুঝে মন , না বুঝে পরান। এ আল্লাহ বিচার দিলাম তোমায়!’
‘আল্লাহ কে কেনো বিচার দিবে, তোমার তো তোমাদের রাম পালকে বিচার দেওয়ার কথা।’
কোনো পুরুষেলী কণ্ঠে পূর্ণবাক্যের সমাচার শুনে প্রচন্ড বেগে ঘাবড়ে গেল শ্রেয়িতা। ঢোক গিলে পিছু ফিরবার মত সাহস যেন একনিমিষে উড়াল দিল। যুবকটি ভ্রুযুগল খানিক নেড়ে কপালে তর্জনী আঙুল দিয়ে চুলকানোর ভান করে হেঁটে এলো। শ্রেয়িতার পাশে ডান কাঁধ বরাবর দাঁড়িয়ে স্থীর দৃষ্টি রাখল। সামনে থাকা নির্জন গাছ-গাছালির দিকে। শ্রেয়িতা নজর লুকিয়ে বিপরীত দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে গেল। ইসমাইল একই চাহনি নিয়ে শ্রেয়িতার মুখোমুখি হলো। এবার যেন রমণীর হৃদপিন্ডে বড়জোড় ধুমকা হাওয়া বয়ে গেল। ধুকপুক করার শব্দটা ঘনিষ্টতায় রুপান্তর হতে লাগল। শ্রেয়িতা আমতা আমতা করে বলে,
‘দেখুন আপনি যা ভাবছেন ওমন কিছুই নয়।’
‘আমি কি ভাবছি সেটা যদি বুঝতে! তা হলে আমার বাচ্চার চেহারা দেখা হয়ে যেতো।’
শ্রেয়িতা ইসমাইল এর কথায় পাল্টা জবাবের বাক্য হারিয়ে ফেলল। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি নিয়ে ইসমাইল কে পর্যবেক্ষণ করতে লাগে রমণী। কেমন যেন যুবকের চোখে ঘোরলাগা দৃষ্টি দেখতে পেল শ্রেয়িতা। ঢোক গিলে ঠোঁটযুগল আলগা করে চেপে প্রসারিত করে বলে,
‘দেখুন।’
‘এত যখন দেখাতে চাও। না দেখিয়ে অপেক্ষা কেনো করাছো পরী!’
শ্রেয়িতা ‘পরী’ ডাকটি আজ অনেকদিন পর বোধ হয় শুনতে পেল। প্রকৃতির বাতাসের সঙ্গে মনে হচ্ছে তার মনেও ধুমচে ঘন বাতাসের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টি নত করে নিল রমণী। ইসমাইল দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ ফিরিয়ে ছাদের দরজার দিকে দৃষ্টপাত করে। শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করে শ্রেয়িতাকে।
‘আদৌ কি তুমি সনাতন ধর্মালম্বী! শুদ্ধ জবাব চাই। হ্যাঁ হলে তড়ঘড় অনুষ্ঠানে পরিচিত হওয়া রমণীকে বিয়ে করার ব্যবস্থা করব।’
কথাটি শ্রেয়িতার কর্ণপাত হতেই হাতযুগল আনমনে খামচি ধরে নিল শাড়ির আঁচলে। চোখযুগলে অশ্রুের লুকোচুরি উম্মাদনা এসে জোড়ো হলো। আনমনে ভাবতে লাগল শ্রেয়িতা।
‘যেখানে আপনাকে পরনারীর সঙ্গে কথা বলতে মনটা ব্যথিত হয়। সেখানে পুরুপুরি আপনি যদি পরনারীর স্বামী হয়ে যান। তাহলে এই যে শ্রেয়িতা নামক মানুষটির অস্তিত্ব থাকবে! আল্লাহ কোন দুটানায় ফেলেছো আমায়। মুখ ফুলিয়ে বলতে চায় তোমায় প্রিয়! যে চাই আমি আপনার সঙ্গে বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হতে। সুন্দর নৈমিত্তিক দ্বীনি জীবনের স্বাদ গ্রহণ করতে। আদৌ কি তা সম্ভব!’
শ্রেয়িতার নিরবতা ইসমাইল এর হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করছে। সে রমণীর মুখ থেকে নেতিবাচক শব্দটি শুনতে চাই। ইতিবাচক নিরবতা নয়। পারলে যেন সে শ্রেয়িতাকে বুকমাঝাড়ে বেঁধে হলেও নিজের করে নিতো। কিন্তু হায় সুখ পাখি উড়ে যাওয়ার প্রবর্তনা করেছে !
ইসমাইল শক্ত মুখ করে কাঠকাঠ গলায় বলে,
‘নিরবতা সম্মতির লক্ষণ। ভালো থাকবেন শ্রেয়িতা।’
আর একদন্ত অপেক্ষা না করে চলে গেল ইসমাইল। যেতে গিয়ে দেখতে পেল না হতশ্রী রমণীর বেদনাময় মুখখানা। শ্রেয়িতা ধপ করে ছাদের মেঝেতে বসে পড়ে। চোখের কার্নিশে আটকে থাকা জল গড়িয়ে পড়ে। তার মুখ থেকে অস্পষ্টসুরে বেরিয়ে আসে।
‘ভালোবাসি আপনাকে অস্তিত্বের নিবিড়ে অন্তরজুড়ে।’
৩৯.
ইফদিয়ার নাকের ডগায় রাগ এনে ঘাপটি মেরে বসে আছে। তার সম্মুখে হ্যাবলার মত দাঁড়িয়ে আছে ইসমাইল। বোনকে উদাসীন দেখায় ভুলভ্রান্তে বলে ফেলেছে যে,
‘ওই দিয়াশলাই শোন তো।’
ইফদিয়ার নাক-মুখ কুঁচকে সরু দৃষ্টিতে রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বলে,
‘কি বললি আমি দিয়াশলাই তো তুই মগের মুল্লক।’
‘সেটাই তোকে দেখে মগের মুল্লকই লাগে।’
‘ভাই সহি করছো না বলে দিলাম।’
‘আয় আগুন জ্বালাবো তোরে দিয়া। তোর নাম ইফদিয়ার না রেখে দিয়াশলাই রাখা উচিৎ ছিল।’
ব্যস শুরু হলো রাগের দ্বন্দ। ইফদিয়ার রাগ ভাঙ্গাতে ইসমাইল হে হে করে হাসি দিয়ে বলে,
‘তোর নাকের ডগায় আগুন লাগছে যা নিভিয়ে আয়।’
‘ভাইইইই!’
খানিক চেঁচিয়ে ফেলায় ইসমাইল থতমত খেয়ে গেল। হাত জোড় করে ইশারায় চুপ করতে বলে সে। ইফদিয়ার শান্ত হয়ে ‘হু’ পিছিল শব্দ করে মুখ
ঘুরিয়ে রাখে। ইসমাইল বাধ্য হয়ে বলে,
‘শোন তোর বাসায় মন ঠিকচ্ছে না। একটা কাজ কর কয়েকদিনের জন্যে তিয়ানার বাসায় চলে যা।’
এক ঝটকে খুশিতে গদগদিয়ে উঠল ইফদিয়ার। তার তিয়ানা দোস্তের সঙ্গে থাকার কথা নিজ মুখে বলেছে ইসমাইল। শুনে যেন সে আকাশে উড়াল দিয়ে তিয়ানার বাসায় চলে যাবে। বোনের খুশি দেখে ইসমাইল খুশিটাকে তীব্রতর করতে গলা খাঁকড়ি দিয়ে উঠে। দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইফদিয়ারকে বলে,
‘তোর এডমিশন তিয়ানার কলেজে করে দিয়েছি। তোদের রেজাল্ট বের হতে আরো দুমাস আছে। তাই কোচিং করবি বান্ধবীদের সঙ্গে।’
ইফদিয়ার অবাক তার ভাই কিনা সব জোগাড় করে বসে আছে। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
‘ভাইয়া তুমি জানলে কেমনে তিয়ানা কোন কলেজে ভর্তি হয়েছে আর সে যে চিকেনপক্স এর মত ছোঁয়াচে রোগ সেরে উঠল!’
ইসমাইল খানিক ভাবুক ভঙ্গিতে চুপ রইল। পরক্ষণে হেসে বলে,
‘সে কি শুধু তোর বান্ধবী! সে আমার একান্ত পেশেন্ট ছিল। তাকে চিকিৎসা করতে বাসায় খুব কম যেতাম। তবে নিয়মিত মেডিসিন আর মলম এর প্রেসক্রিপশন আঙ্কেলকে পাঠিয়ে দিতাম। আমি এখানে মেডিক্যাল সামলাতে ব্যস্ত সেখানে কেমনে তিয়ানার চিকিৎসা করতাম! ভেবেচিন্তে সাবধানে চিকিৎসা করেছি। এরই মাঝে তার অসুস্থতা পরিত্রাণ পাওয়ার পর নতুন কলেজ এর ভর্তি হওয়ার কথা জানলাম। তোকেও সেখানে ভর্তি করিয়ে দিলাম। এবার তুই বল কবে যাবি তিয়ানার বাসায়!’
ইফদিয়ার খুশিতে ‘আজ’ বলতে গিয়ে থেমে যায়। মনের অন্তরালে শোক নেমে এলো। চুপচে যাওয়া মুখ করে বসে পড়ে। ‘যাবিয়াজ’ নামক মানুষটিকে ঘটনার পর থেকে তার চৌপাশে পা ফেলতেও দেখেনি। এতে ইফদিয়ার ভীষণ ব্যথিত হচ্ছিল সকলের চুক্ষগোচরে।
ইসমাইল ইফদিয়ার কে চুপটি মেরে যেতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘আজ কি যাবি!’
‘আব না মানে দুদিন পর।’
বোনের কথায় দ্বিমত পোষণ করল না ইসমাইল। ক্যানভাসে যাওয়ার আগে মিসেস জাবিয়াকে পরখ করে গেল। তিনি এখন শুয়া থেকে বসতে পারেন, হাত-পা মোটামুটি নড়বড় করতে পারেন। আগের মত গুটিয়ে থাকেন না। অবশ্য এখন তিনি নিজেকে বুঝিয়েছেন। স্বামী অপরাধী, দোষকর হলে এর শাস্তি কেন বাচ্চাদের দিবে!
উনার অসুস্থতা ঘিরে থাকায় কষ্ট কে পেল উনার স্বামী নাকি বাচ্চাগুলো। তিনি আয়নার দিকে নিজেকে দৃষ্টপাত করে কথাগুলো ভাবছেন।
তখন উত্তর হিসেবে একটি শব্দই উচ্চারিত হলো।
‘বাচ্চারা’ উনার অসুস্থতায় ইসমাইল সেবাযত্ন করেছে। ইফদিয়ার রাত-বিরাতে মায়ের জন্যে দোয়া মোনাজাত পাঠ করেছে। শ্রেয়িতা নামক মেয়েটি উনাকে ওষুধ আর খাবার সময়মত নিতে সহায়তা করেছে। এই বাচ্চারাই তো উনার সব!
মিসেস জাবিয়া নিজ উদ্যোগ সুস্থ হওয়ার প্রবণতা প্রকাশ করছেন।
মিসেস হালিমা নিজের মালকিনকে বসা দেখে চট জলদি ইফদিয়ার রুমে গেল। ততক্ষণে ইফদিয়ার গোসল সেরে বের হলো। মাথা মুছছিল তখন মিসেস হালিমা ধড়ফড়িয়ে রুমের ভেতর প্রবেশ করলেন।
ইফদিয়ার আকস্মিক কেঁপে পিছে ঘুরে তাকায়। মিসেস হালিমাকে উত্তেজিত দশায় দেখে চিন্তিত কণ্ঠে ইফদিয়ার বলে,
‘কাকীমা তুমি হাঁপিয়ে গেছো। কি হয়েছে!’
‘মামুনি আপা ঠিক হইয়া গেছো। আহো রুমে দেহো আপা নিজের থেইকা উঠে বইছে।’
ইফদিয়ার ঠোঁটে হাসির উজ্জ্বলতা বেড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ মায়ের রুমে গিয়ে দৃশ্যটি সত্য দেখে জড়িয়ে ধরে। মিসেস জাবিয়া আগলে নিতে না পারলেও ঠোঁটের ফাঁকে মিষ্টি হাসি টেনে নিলেন। যা দেখে ইফদিয়ার নিশ্চিত তার মা সুস্থতার পথে চলতে আরম্ভ করেছে। আর কোনো ‘আহসান’ নামক পাপ তাদের দ্বারপ্রান্তে আসবে না।
দুপুর পেড়িয়ে বিকাল হতে শুরু করেছে। কিন্তু এখনো শ্রেয়িপ্পিকে না দেখে ইফদিয়ার ভাবতে লাগে। কোথায় বেড়িয়েছে সকাল থেকে! একটা ফোন অব্দি করল না মেয়েটি! ভাইকে জিজ্ঞাসা করি। ভেবেই সে ফোন বের করে ইসমাইল কে কল দিল। ইসমাইল ক্যানভাসে ক্লাস করা ছিল। বায়োজেনেটিক প্রোগ্রাম নিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ সম্পর্কে যুবক-যুবতীদের অবহিত কর ছিল সে। ফোনের টিংটু শব্দে ইসমাইল ক্লাস চলাকালীন ধরল না। ক্লাস শেষে দরজা পেড়িয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে। কল লিস্টে ইফুপাখি নামটি দেখে চিন্তিত হয়ে কল ব্যাক দিল।
ইফদিয়ার পায়চারী করছে শ্রেয়িতার কোনো খবর নেই। কিছুক্ষণ আগে লক্ষ্মীনা আন্টি নিজ পায়ে হেঁটে এসে মেয়ের খোঁজ লাগাতে বললেন! তিনিও সকাল থেকে মেয়েকে না দেখে উদগ্রীব হয়ে আছেন।
ফোনের তীব্র শব্দে ইফদিয়ার হুঁশ ফিরে। সে ফোন কানে ধরতেই অপরপাশ থেকে ইসমাইল বলে,
‘ইফুপাখি এত কল কি মায়ের কোনো সমস্যা হয়েছে!’
‘না ভাই কিন্তু শ্রেয়িপ্পিকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। সকালে বেড়িয়ে ছিল এখন অব্দি বাসায় ফিরেনি। ইনফ্যাক্ট আন্টি কল দিলেও বলে ফোন সুইচড অফ। ভাই একটু খুঁজে দেখো না। আমার খুব ভয় লাগছে।’
‘শোন বাসায় সবার খেয়াল রাখ। শ্রেয়িতার কোনো আপডেট পেলে জানাইস।’
‘ওকে।’
ফোন কেটে ইসমাইল ক্যানভাস হতে বেড়িয়ে গেল। গাড়িতে বসে ইঞ্চিন চালু করতে করতে শ্রেয়িতা কোথায় যেতে পারে তা ভেবে চলছে। তার হঠাৎ চলে যাওয়ার কারণ কি তার কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না সে। আনমনে নিজেকে প্রশ্ন করে উঠে সে।
‘কোনো ভাবে আমার কথায় কষ্ট পেয়ে স্টেপ নিলো কি! ওহ শীট পরী তোমাকে শুধু কথাটা শুনিয়েছে আসলে কি পারতাম তোমাকে হিনা অন্যের সঙ্গে জীবনের পথযাত্রায় আগাতে। প্লিজ পরী পিক আপ দ্যা কল!’
ইসমাইল বারংবার কল করছে শ্রেয়িতাকে। কিন্তু সেই একই কথা ‘কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির ফোন বন্ধ।’
যুবক চিন্তায় উম্মাদের মত ফোন করেই চলেছে। একই কথা শুনার পরও কল করে যাচ্ছে। গাড়ির জানালা দিয়ে ডানে-বামে-সামনে-পিছনে লক্ষ করছে। এই বুঝি শ্রেয়িতার দেখা পাবে সেই আশায়! কিন্তু রমণীর চিহ্নটুকু পাওয়া যাচ্ছে না।
‘কই তুমি পরী তোমার অস্তিত্ব জানান দাও প্লিজ। হে আল্লাহ সহায় হোন!’
ইসমাইল গাড়ি ঘুরিয়ে মনিরামপুরের রাস্তায় ঢুকে। সেখানে অগণিত গাড়ির চলাচল। চৌপাশে রয়েছে তার তীক্ষ্ম দৃষ্টি। ফোনেও লাগাতার কল করে চলেছে। মনিরামপুরের ভার্সিটির সামনে এসে গাড়ি থামায়। পুরু ভার্সিটি বন্ধ। ভেতরে কেউ নেই কিন্তু কেনো যেন ইসমাইল এর মনে বিপদ সংকেত এর ধারণা হচ্ছে। এই বুঝি শ্রেয়িতা বিপদে আঁটকা পড়েছে। সে এখানেই হয়ত তার জন্যে অপেক্ষা করছে। ভার্সিটির প্রবেশদ্বারে কোনো দারোয়ান দাঁড়িয়ে নেই। যতদিন ক্যানভাসে কাজ শেষ হয়নি ততদিন ভার্সিটি বন্ধ থাকবে। ইসমাইল এর হৃদয়ে কেউ যেন ছুড়ি ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সে যতই পিছে ফিরার চিন্তা করছে ততই মন তাকে ভেতরে প্রবেশ করতে আহ্বান জানাচ্ছে।
ইসমাইল নিজের মনের ভ্রম ভেবে বলে,
‘উঁহুম শ্রেয়িতা একা বন্ধ ভার্সিটিতে কেনো আসবে! তাও আবার সকাল থেকে। তারা তো কেশবপুরে আছে। মনিরামপুরে আসার কোনো কারণ থাকতে পারে। তবে এমনি কাউকে না জানিয়ে আসার মত মেয়ে সে নয়। তাও মনটা কেনো ভেতরে পরখ করতে আদেশ করছে।’
ইসমাইল দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোমরে হাত রেখে কপাল চুলকানি দিল। চোখযুগল ভার্সিটির প্রতিটা রুমের দিকে বুলিয়ে নিল। সূক্ষ্ম কোনো প্রমাণ না পেয়ে হতাশ হয়ে গাড়ি উঠে বসে সে। মনজুড়ে তার চলছে একটিই কথা।
‘কোথায় তুমি পরী!’
চলবে…..