অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া পর্ব_২৪
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
৪৪.
অতৃপ্ত মন শান্ত হয় না প্রিয়সীর স্পর্ধায়। তাকে হিনা শরীরটা অসাড় মনে হয়। আকাশে যেন ঘন মেঘ রয়েই যায়। এই মেঘের অন্তরালে যদি রোমাঞ্চকর বর্ষণ আরম্ভ হতো। তাহলে জননীর বুকে বয়তে শুরু করতো সুখের সমাধি। প্রিয়সীর বুক মাঝারে লুকিয়ে দুষ্টু বিলাপ করতে চাওয়া হলো প্রতিটা প্রেমিক পুরুষের চিরন্তর আকাঙ্ক্ষা। প্রিয়সীর মান্য অভিমানী চেহারায় রক্তজবার আভাস ফুটে উঠে। মনে হয় যেন সদ্য রক্তে ভিজা গাল দুটো বিমোহিত করে চলেছে। এই বুঝি পাগলা প্রেমিক কবির ন্যায় আচরণ করবে যাবিয়াজ।
সে অস্ট্রেলিয়ার খ্যাতনামা মেডিক্যাল এ অবস্থান করছে। নিজের চেম্বারে জানালার দিকে মুখ করে রকিং চেয়ারে ভর ছেড়ে বসে আছে। চুক্ষদ্বয়ের চাহনী জানালার বর্হিভাগে থাকা বিশাল খোলা আসমানে। উজ্জ্বল নীল রঙে রাঙানো রয়েছে উম্মুক্ত আসমানটি। আসমান এর দিকে তাকিয়ে যাবিয়াজ ভেবে চলেছে প্রিয় অপ্সরীর বিষয়প্রাণ। সে মনমাতালে আঁকা রঙিন মনছবিতে যুবতীর মুখপানে চেয়ে তার প্রেক্ষিতে বলে,
‘পাঁচ বছর যে কেমনে চোখের পলকে কেটে গেল। বুঝতেই পারছি না ইফদিস্পরী। আহ আর কত নামে তোমায় আখ্যায়িত করব বলো! তুমি কোনটা শুনতে পছন্দ করবে। ইফদিমনী নাকি অপ্সরীমনী নাকি ইফস্পরী। নামে তো সমস্যা নাই। কিন্তু এবার জ্বালানোর সময় আমার ঘনিয়ে আসছে ইফস্পরী। অনেক তো আমায় জ্বালালে। এবার আমার ভয়ানক পীড়ন জ্বালা সহ্য করতে প্রস্তুত হয়! মধুময়ী অত্যাচারী পীড়নের ভোগান্তি করতে আসছি আমি।’
রকিং চেয়ার কে যাবিয়াজ নিজের শরীরের ভর দিয়ে পুনরায় দুলতে ধাক্কা দিল। এতে রকিং চেয়ারটি প্রসারিত হয়ে পূর্বের ন্যায় সামনে পিছনে দুলতে আরম্ভ করে। তার হাল যেন বেহাল। শান্ত মুখশ্রীতে রাজ্যের ক্লান্ত ভর করেছে। এর উপর প্রিয়সীর করা মানসিক অত্যাচারগুলো অসহনীয় হয়ে উঠেছে তার নিকট। সান্নিধ্য পেতে চাই তার প্রিয়সীর। প্রিয়সীর প্রতিটা ছোঁয়া যেন অনুভব করতে চাই সে গভীরভাবে। যাবিয়াজ চোখ বুজে দুলা থামিয়ে দিল। হাত দিয়ে কাঁচের কিউব বক্সটি শক্ত করে চেপে ধরে সে। নিজের কলার সটান করে দাঁড়িয়ে যায়। তার সম্মুখে থাকা দরজা খুলে কিছু দূর হেঁটে একটি কাঁচের দরজার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে গেল। সেটি খুলেই দেখল ভেতরে রয়েছে বিশাল আকৃতির টেবিল। তার চৌপাশে ১০-১৫টি চেয়ারে কয়েকজন ফরেইন ক্লাইন্ট বসে রয়েছে।
পাওয়ার ফুল চোখের চশমা পরিদান করে যাবিয়াজ। এগিয়ে এসে তার নিজের আসনে বসল। তার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে মর্ডান পোশাক পরিহিত এক ২৩ বছরের রমণী। সে যাবিয়াজকে দেখে আবেদনময়ী হাসি উপহার দিল। যার প্রভাব মুটেও পড়েনি যুবকের উপর। হিতে বিপরীত হয়ে গেল। ছু মেরে রমণীর হাত থেকে রিপোর্ট ছিনিয়ে নিল যাবিয়াজ। রমণীর মুখখানি যেন মুহূর্তেই ফাটা বেলুনের ন্যায় হা হয়ে গেল। কোথায় ভাবল যাবিয়াজ তার দিকে তাকিয়ে ফিট খেয়ে পড়বে! তা আর হলো কই! রমণী ক্রোধে এক প্রকার ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল।
যাবিয়াজ রিপোর্টটি পুরুপুরি চোখ বুলিয়ে নিল। সযত্নে টেবিলের উপর রিপোর্টটি রেখে দর্শকবৃন্দের দিকে পরখ করে। ফরেইনার ক্লাইন্টস তার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। যাবিয়াজ চোখের চশমা খুলে টেবিলে রেখে দু’হাত উচু করার মত প্রসারিত করে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
‘মাই প্রোগ্রেস রিপোর্ট নেভার ব্রেক ডাউন! এগেইন আওয়ার বায়োজেনেটিক্যাল প্রোগ্রেস গিভেন।’
রমণী অবাক দৃষ্টিতে যাবিয়াজ এর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,
‘কিন্তু ডক্টর যদি প্রব্লেম হয়!’
‘নট এট এল শায়েনা। বায়োজেনেটিক প্রোগ্রেস নিয়ে আমি তিনবছর ধরে চর্চা করে চলেছি। এবার চর্চার ফলাফল দেখব। আই বিলিভ প্রোগ্রেস রিপোর্ট ভঙ্গন ধরবে না। ভঙ্গন ধরার কোনো পথই রাখব না।’
শায়েনা নামক মেয়েটি চুপছে যাওয়া মুখ করে নিল। সে নামে মাত্র এসিস্ট্যান্ট যাবিয়াজ এর।
শায়েনার মুখভঙ্গি দেখে যাবিয়াজ এর সন্দেহ হলো। মনভ্রান্তে খটকা লাগে তার। তবুও তাৎক্ষণিক সময়ে মনের সন্দেহটা প্রকাশ করল না। জমাট রাখল নিজের মনের অধীনে। যাবিয়াজ এর কথায় ক্লাইন্টস একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। সবাই রাজি হলেও একজন সাহস করে বলে উঠে।
‘বাট স্যার আই ওয়ান্ট টু সি দ্যা প্রোগ্রেস রিপোর্ট এগেইন।’
ক্লাইন্ট এর কথায় যাবিয়াজ মুচকি হেসে নিজ আসনে বসা অবস্থায় হাতের ইশারায় শায়েনা কে কিছু ইঙ্গিত করে। শায়েনা দেখে বুঝতে পারল। যাবিয়াজ তাকে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর চালু করতে বলেছে! সে দক্ষিণ দিকের কোণায় গিয়ে ছোট বর্গাকৃতির টেবিলে রাখা প্রজেক্টর এ প্রেস করে। সঙ্গে সঙ্গে এলইডি লাইট বন্ধ হয়ে গেল। জ্বলে উঠল নীল রঙের ড্রিম বাতি। কেবিনটাও নিভু আলোকিত হয়ে উঠে। শায়েনা এবার ল্যাপটপ স্ক্রিনের রিপোর্ট লেখা ফাইলটিতে প্রেস করে। রিপোর্টটি অটোমেটিক্যালি চালু হয়ে প্রদর্শিত হতে আরম্ভ করে। মাল্টিমিডিয়ার আধুনিক প্রদর্শনতায় উক্ত ক্লাইন্ট খুশি হলো। সে হাসিমুখে বলে,
‘থ্যাংকস ইটস রেয়ালি নাইচ।’
যাবিয়াজ শুনে ‘ওয়েলকাম’ বলে দাঁড়িয়ে যায়। আজকের মিটিং আলোচনা সমাপ্ত হয়েছে তা বুঝতে পেরে সসম্মানে প্রস্থান করে। একে একে ক্লাইন্টসও প্রস্থান করে চেম্বার হতে। যাবিয়াজ সদর মেডিক্যাল এর দরজা পেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে। শায়েনা মেয়েটি ছুটে এসে যাবিয়াজ এর গাড়ির সম্মুখে দাঁড়িয়ে গেল। হাঁপাতে থেকে আমতা আমতা করে বলে,
‘স্যার আপনি কি আমায় বাসা অব্দি পৌঁছে দেবেন!’
যাবিয়াজ এর বিরক্ত লাগে তার এই এসিস্ট্যান্ট শায়েনা কে। তার কাছে বিরক্তির মূল কারণটি হলো শায়েনার ন্যাকামি করা, অত্যধিক রঙলিলার বাহানা তৈরি করা। তবুও রাস্তার মোড়ে থাকায় কোনো প্রকার তামাশা যাবিয়াজ চাই না। ভদ্রতার কাতিরে সে হাসার অভিনয় করে ভেতরে বসতে বলে। শায়েনা যেন অতি খুশিতে পাগল হবার উপক্রম। যাবিয়াজ তাকে বসতে বলেছে দেখে জট করে কোমর বাঁকিয়ে উঠে বসে। শায়েনা টু শব্দ করার পূর্বেই গাড়ির ইঞ্চিন চালু করে ফেলে যাবিয়াজ। গাড়ির গতি আরম্ভ হয়ে যাওয়ায় শায়েনা জানালার বাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তার মনে চলছে শয়তানি কারবার। সে চাইলে নিজেই বাসায় যেতে পারতো। তবুও যাবিয়াজ কে একা যেতে দেখে নিজের লোভাতুর ইচ্ছে দমাতে পারিনি। তার বসের সঙ্গে একলা গাড়িতে করে বাসায় যাবার নাম করে উঠে পড়েছে। শায়েনার বাসার রাস্তায় পৌঁছাতে দু’ঘণ্টা লাগবে। গাড়ি অনেকটা দূরে চলে আসলে শায়েনা ইচ্ছাকৃতভাবে তার হাতের স্পর্শ যাবিয়াজ এর কাঁধ বরাবর দিল। যুবক তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলার পূর্বেই হাত সরিয়ে নেই। যাতে কোনো তর্ক না করতে পারে। পুনরায় শায়েনা হাতটা তার বসের হাতের উপর মৃদু স্পর্শে ভরিয়ে দিল। যাবিয়াজ এর শরীর ক্রোধে কাঁপতে থাকে। শায়েনা তার বসের অস্বাভাবিক কাঁপুনিতে ভাবছে উনার শরীরে যৌন চাহিদা মেটানোর স্পর্ধা জাগ্রত হয়েছে। কিন্তু বোকা মেয়েটা জানেই না যাবিয়াজ এর রাগটা ঠিক কিসের!
এই রাগটা যে আগুনে পুড়ার মত সেটা কিছুক্ষণ পরই যাবিয়াজ শায়েনাকে বুঝিয়ে দিবে।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
এখনো সময় অবহিত থাকায় সে ভাবছে কিভাবে গাড়ির থেকে শায়েনা নামক আপদ কে বিদায় করা যায়। গাড়ির স্টেয়ারিং শক্ত করে চেপে ধরেই মুভমেন্ট করছে যাবিয়াজ। আনমনে রাস্তায় দৃষ্টি রেখে বাঁকা হেসে ভাবে।
‘ইশ! আমার এসিস্ট্যান্টটা এত ইডিয়ট কেন বুঝি না। নোংরা ইচ্ছে পোষণ করার জন্যেই আমার পাশে বসেছে। এর জন্যে কিছুটা সুফল দিতেই পারি আমি।’
যাবিয়াজ নিজেই শয়তানি হাসি দিয়ে গাড়িটা ইচ্ছেকৃতভাবে অন্য রাস্তায় নিল। সেখানের একটা শপিংমলের সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে দিল। শায়েনা ভ্রু কুঁচকে শপিংমলের দিকে তাকায়। যাবিয়াজ এর দিকে প্রশ্নতুর চাহনী নিয়ে বলে,
‘আমরা এখানে কেনো এসেছি!’
‘আমার শপিং এ যেতে হচ্ছে। তাই তোমাকে দায়িত্ব দেবো পূরণ করবে। ইটস মাই অর্ডার!’
শায়েনা দৃষ্টি নত করে বলে,
‘ওকে বাট অর্ডারটা কি!’
যাবিয়াজ বলে ‘চুপ করে বাসায় না পৌঁছা অব্দি চোখের মধ্যে কাপড়টি বেঁধে রাখবে। তোমাকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হবে, যা করা হবে কথার খেলাফ হতে পারবে না। না হলে চাকরী থেকে বরখাস্ত করে দেবো।’
‘নো নো স্যার আই উইল রেসফেক্ট ইউর অর্ডার!’
যাবিয়াজ একটি কাপড় এগিয়ে দিল শায়েনার নিকট। শায়েনা সেটি পরে ফেললে যাবিয়াজ নিশ্চুপে গাড়ি থেকে বের হলো। তার সামনে চলে আসে একটি মেয়ে। যে কিনা একজন লেস*****। তাকে যাবিয়াজ এর দোস্ত এরফান পাঠিয়েছে বাইক করে। কেননা যাবিয়াজ গাড়ি চলাকালীন এরফানকে আপদ সম্পর্কে অবহিত স্বরুপ মেসেজ করে। এরফান দুষ্টু হেসে ‘ডান’ বলে একটি ঠিকানা পাঠিয়ে দিল। সেই ঠিকানা অব্দি এসে এবার মেয়েটিকে ইশারায় বুঝায় বসা মেয়েটিই আসল।
লেস**** টাইপ মেয়েটি গাড়িতে বসে পড়ে। তার সঙ্গে আনা বাইকে বসে হেলমেট পরিদান করে যাবিয়াজ। গাড়ি চলে যেতেই সে ফিচেল হেসে বলে,
‘নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলে মিস শায়েনা।’
যাবিয়াজ বাইক চালু করে নিজের বাসার পথে রওনা দিল।
৪৫.
পরিবর্তনশীলতা পৃথিবীর বিবর্তনের সূত্রে ছিল, আছে আর রইবে। এক প্রজম্মের পর অন্য প্রজম্মের আবির্ভাব হয়। বছর পেরিয়ে যায়। ইসমাইল আর শ্রেয়িতার সম্পর্কটাও গাড় হলো। দুজনের সম্পর্কটা গাড় হওয়ার পেছনের মূল ভিত্তি হলো ইসরাইব। যার মাত্র চার বছর বয়স। ছেলেটা বাবা পাগল। ইসমাইল ক্লান্ত হয়ে বাসায় প্রবেশ করে। তার মা মিসেস জাবিয়া চশমা এঁটে খবরাখবর পড়ছেন। উনার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে গেল শ্রেয়িতা। হাতে ট্রের মধ্যে ঠান্ডা পানীয় গ্লাস। মিসেস জাবিয়া ইসমাইলকে দেখে মুচকি হাসি দিলেন। ইসমাইল এসে মুখ-হাত-পা ধুয়ে সোফায় গা হেলিয়ে দিল। মাকে সালাম করে প্রিয়সীকেও সালাম দিল সে। শ্রেয়িতা লাজুক কণ্ঠে সালামের উত্তর দিল। এগিয়ে দিল লেবুর ঠান্ডা শরবতের গ্লাসটি ইসমাইল এর দিকে। সে আড়চোখে প্রিয়সীকে চোখ টিপ মারে। এতে বেচারী শ্রেয়িতা শ্বাশুড়ির সম্মুখে ত্রপাটে দৃষ্টি নত করে নিল। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে মৃদু হেসে রান্নাঘরে চলে গেল। ইসমাইল শরবত পান করছিল। তখনি
‘আব্বা’ বলে চেঁচিয়ে উঠে ইসরাইব।
লেবুর শরবত যা পান করছিল তার অর্ধভাগ মুখ ফুসকে পড়ে যায় ইসমাইল এর। মুখ ফুসকে পড়ায় মিসেস জাবিয়া তড়িঘড়ি ইসমাইল কে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিলেন। ইসমাইল সহ তিনিও মাথা ঘুরিয়ে পিছে তাকান।
ইসরাইব দৌড়ে এসে বলে,
‘আব্বা ফুপ্পিকে বলাটে পোলারা আততে দেয় না।’
ইসরাইব এর আদু কণ্ঠে বলা কথাটি কর্ণপাত হতেই ইসমাইল এর মাথায় ধপ করে আগুন লেগে গেল। তার প্রিয় বোনের শরীরে সামান্য আচ সহ্য করতে পারে না সে। সেখানে বখাটে ছেলের কিনা সাহস কত বড় হাত ধরার!
ইসমাইল দ্রুত গতিতে বাহিরে এসে যে দৃশ্যটি দেখে। সজোরে লাঠিচার্জ আরম্ভ করে। তার দরজার পাশে রাখা লাঠিটা দিয়ে ইফদিয়ার কে যে স্পর্শ করেছে। তার হাতে কড়াঘাত করতে আরম্ভ করে। ইফদিয়ার ভীতি মনে তার মায়ের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। ইসমাইল লাঠিচার্জ করা অবস্থায় ক্রোধান্বিত গলায় চেঁচিয়ে বলে,
‘পুনরায় আমার বোনের দিকে নজর দিবি। সব কটার গলা কেটে নদীতে ফেলব।’
‘আরে যা তো। তোর বোনকে চাই মানে চাই। ওকে বিয়ের পীরিতে বসাব দেখিস!’
‘তোর মত হারামজাদার সঙ্গে জীবনেও বসতে দেব না।’
ইসমাইল লাঠিটা ফেলে দিল। সে গিয়ে ছেলেটার মুখের উপর দরজা বেঁধে দিল। ইফদিয়ার ভাইকে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে। ভাইও কি করবে! কম চেষ্টা করেনি বখাটে নাজমুল এর কড়া শাস্তির জন্যে। কিন্তু পারিনি চেয়ারম্যান সাহেব এর দন্ডায়মান আসনের ফলে। ইসমাইল ইফদিয়ার গাল আঁকড়ে ধরে অস্পষ্ট কণ্ঠে ‘হুশ থাম’ বলে।
শান্ত হতে বলে সে। তাও যেন রমণীর কান্না থামে না। ইসমাইল তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘চিন্তা করিস না সে চলে আসবে। তোর জন্যে হলেও সব বিপদের মোকাবেলা করতে সে আসবে।’
‘আসবে না ভাইয়া। দোষটা নিতান্তই যে আমার। আমার দোষেই সে বদলে গেল, চলে গেল নিজের অপ্সরীমনীকে ছেড়ে। আমি খুব নিষ্ঠুর ভাইয়া। পারিনি তার যোগ্য ভালোবাসার দাবিদার হতে।’
ইফদিয়ার ভাইকে ছেড়ে রুমে প্রবেশ করে। দরজা আঁটকে শুয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। শ্রেয়িতা চেয়ে আছে দরজার দিকে। ইসমাইল এর দিকে এক নিষ্পলক চাহনী নিয়ে তাকায়। নিজের মনকে দৃঢ়স্থ করে সিদ্ধান্ত নিল সে আজ পুরু ঘটনার খোলাসা করে দিবে যাবিয়াজ এর কাছে। ঠোঁট কামড়ে ভেবে নিল মধ্যরাতে কল দিবে তাকে শ্রেয়িতা। ইসমাইল এর কাছে গিয়ে ফ্রেশ হতে ইশারা করে সে। ইসমাইলও দ্বিমত পোষণ করেনি। শরীরের কাঠুনি কেটেছে পুরুদিন। মেডিক্যাল, এনজিও ক্যানভাস এখনো এর মাঝে সীমাবদ্ধ কাজের ব্যস্ততা।
রাস্তার মোড়ে চায়ের টংবাজারে বেঞ্চের মধ্যে ক্লান্ত আহত শরীর নিয়ে বসে আছে নাজমুল। কিছুক্ষণ আগে মেডিক্যাল থেকে ড্রেসিং করে এসেছে সে। এই বখাটে ছেলেটাই ইফদিয়ারকে পাওয়ার কামনায় তার পিছে ঘুরঘুর করে। প্রতিবার ইফদিয়ার কে ভার্সিটির সামনে উ্যক্ত করা হলো নাজমুল এর নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম। কিন্তু সফল হয়না অনেকবার ইসমাইল থাকায় ইফদিয়ার দ্বারে কাছেও ঘেঁষতে পারে না নাজমুল। তখন সময়ে ছাড় পেয়ে যায় ইফদিয়ার। তবে যখনি ইসমাইল থাকতো না তখনি ইভটিজিং এর মত হয়রানির সম্মুখীন হতে হতো ইফদিয়ার কে। নাজমুল যেন তার পিছে মজনুর ন্যায় ঘুরে, উ্যক্ত করে, নোংরাভাবে স্পর্শ করে। ইফদিয়ার মুখ ফুটে সব কথা তার ভাইকে বলতে চেয়েও পারে না। কারণ তার ভাই মেডিক্যাল-এনজিও ক্যানভাসের কর্মে ব্যতিব্যস্ত থাকে। ফলে প্রচুর কাঠুনি কেটে রেহাই পায় তার ভাইটা। ইফদিয়ার ভাইয়ের কর্মের ব্যস্ততা, অধ্যবসায় বুঝতে পারে বলে চুপ থাকে। নাজমুল যেন এতেই আরো সুযোগ পায়। আজ তো গজব হতে চলে ছিল ইফদিয়ার জীবনে। কিন্তু এহেন মুহূর্তে ইসরাইব তার বাবা অর্থাৎ ইসমাইল কে বলে ফেলে। ইফদিয়ার ইসরাইব কে সঙ্গে নিয়ে ভার্সিটি এসেছিল। অতঃপর তাকে সঙ্গ নিয়েই বাসার পথে হাঁটা ধরে ছিল ইফদিয়ার। ইসরাইবকে আইসক্রীম কিনে দিয়ে যেই বাসায় প্রবেশ করবে। তেমনি সেখানে নাজমুল এসে ইফদিয়ার বোরকা ধরে টানাটানি করে। ইফদিয়ার যেন সন্ত্রাসীর হাতে ধরা পড়েছে মনে হলো। তার চুক্ষদ্বয়ে অশ্রুর ঘূর্ণিপাত আরম্ভ হলো। আকুতির কণ্ঠে নাজমুল কে ‘ছাড়তে’ বলে ছিল। অন্যথায় নাজমুল তাকে নোংরামির দৃষ্টান্ত স্বরুপ বলে,
‘ঠোঁটে ঠোঁটে চুমু দিয়া বাসায় যেতে পারবে।’
ইফদিয়ার ঘৃণায় নাক ছিটকায়। এর পর ইসমাইল এসে নাজমুল কে বেধড়ক পিঠায়।
নাজমুল হলো চেয়ারম্যান এর ছেলে। তার সঙ্গে এলাকার লোকেরা ভয়ে কথা বলতে পারে না। মেয়েরা রীতিমত তার হাতে ইভটিজিং এর শিকার। ক্ষুধার্ত হায়েনার ন্যায় মেয়েদের ব্যবহার করে সে। এতো গত সপ্তাহের শনিবারে রাত ৯টায় এক ধর্ষিতার লাশ পাওয়া গিয়ে ছিল। লাশটি ছিল সদ্য ১৮ বছরে পা দেওয়া এক যুবতীর।
তাকে ধর্ষণ করে ছিল নাজমুল। তার শারীরিক নিযার্তনের পীড়ন অসহ্য হওয়ায় মৃত্যু বরণ করে সেই যুবতী।
নাজমুল রাতের আধাঁরে নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েদের কে শরীরের চাহিদার জন্যে ব্যবহৃত করলেও রাস্তাঘাটে কচি শরীরের গড়নের মেয়ে পেলেই শিকার করে ফেলে। কিন্তু তার জঘন্য কাজে যে কত মেয়েদের জীবনহানি হলো। তার হিসাব নেই। এলাকাবাসী ক্ষুদ্ধ রুক্ষ মেজাজে তেঁতে উঠলেও চেয়ারম্যান এর ক্ষমতার দ্বায়ে মুখ খুলতে পারেনি। নাজমুল এর উপর আরোপ হওয়া শত ফাইল-কেস নাজমুল এর বাবা সরিয়ে ফেলেছে ক্ষমতার মাধ্যমে।
তার বাবার ক্ষমতার উপর ভর করেই সে ইফদিয়ার পিছে লেগেছে। তার মনের বাসনা পূরণ করার জন্যেই সে ঘুরঘুর করছে। ইফদিয়ার কে তার মত লালসার চোখে কামনা জেগে ছিল একটি ভুলের কারণে। ভুলটি ছিল দ্বিপাক্ষিক। অর্থাৎ ইফদিয়ার যেহেতু বোরকা পরিহিত আর আর্দশ ইসলামিক নারী রুপে বাসার বাহিরে যেতো। সেহেতু তার পিছে বখাটে ছেলে পরার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু নাজমুল এর মত গুন্ডা বখাটে পিছে পড়েছে। একবার ইফদিয়ার ইসরাইব এর সাথে পার্কে ঘুরতে এসে ছিল। তখন ভুলবশত ইসরাইব এর সঙ্গে খেলাখেলিতে ইফদিয়ার নেকাপ খুলে গিয়ে ছিল। সেই পার্কে নাজমুল তার দলবল নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল এবং অন্যান্য মেয়েদের উ্যক্ত নোংরা বাজে ব্যবহার করছিল। ইফদিয়ার কে দেখেও না দেখার ভান করে ছিল। কারণ সে বোরকা পড়ে ছিল। আকস্মিক ইফদিয়ার মুখ দেখে ফেলে একমাত্র শয়তান নাজমুল এর চোখজোড়া। সেই থেকে তার মুখে লাভার মত উচ্চারিত হয় ইফদিয়ার নাম। প্রতিবার তার কাছে গিয়ে লাঞ্চিত হয়েও বেহায়ার সীমা পাড় করে ফেলে নাজমুল। ইতিমধ্যে সে তার বাবার কাছে ইফদিয়ার এর তথ্য পাঠায়। সেই সঙ্গে এ কথাও বলে যে,
‘আব্বা মাইয়াটারে বেডে শুয়া চাই। হের লাইগা বিয়া দাও মোর।’
চেয়ারম্যান সাহেবও দাঁত কেলিয়ে বলেন,
‘উলে আমার পুত্র। তুই চাইলি আর আমি দিবো না তা হবে। এই মাইয়াকে তোর বউ বানাইয়া আনমু নে।’
নাজমুল শয়তানি হাসি হেসেছিল সে দিন মনে মনে। তার ইচ্ছে পূরণ হলেই কিসের বউ, কিসের বিয়ে এমন ব্যাপারটা ঘটবে। তা চিরন্তন অজানা নয় সকলের।
৪৬.
রাত ৯টা শ্রেয়িতা ইসমাইল এর উম্মুক্ত বুকে শুয়ে আছে। ইসমাইল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শুধু নিদ্র নেই শ্রেয়িতার অক্ষিজোড়ায়। মাথা উঠিয়ে এক পলক ইসমাইল এর দিকে তাকায়। পরক্ষণে যাবিয়াজ ভাইয়ের কথা ভেবে ধীরস্থীরে নিজের বুকে চাদর পেঁচিয়ে উঠে বসে সে। বিছানার পাশে হাতড়িয়ে তার পোশাক খুঁজে। পেয়েও গেল। গায়ে জড়িয়ে শব্দহীন ভাবে উঠে দাঁড়ায়। বেলকনির দরজা খুলে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে যাবিয়াজ কে কল দিল। পর পর তিনবার রিং পড়লেও যেন ধরেনি সে। হতাশ হলো শ্রেয়িতা। ইফদিয়ার কথা বলবে ভেবেছিল আর হলো কি!
ফোনটা বেলকনির টেবিলে রেখে আকাশপানে তাকায়। আজ অগণিত তারা আকাশে ভেসে উঠেছে। সব তারার উজ্জ্বলতা ঝিকিমিকি রুপে সোভা পেয়েছে।
সে ভাবে পুরোনো ইতি দিনের কথা। কোথায় যেন হারিয়ে গেল সেই আড্ডাটা আর নাই রে! 🙂
যেখানে বন্ধুমহলের হাসির প্রাণ ছিল এরফান, ফেরদৌস আর বলদ রুপী ছন্দবেশ যাবিয়াজ। সেই হাসির খোড়াক-প্রাণ মিলিয়ে গেল তারার মাঝে। কে, কোথায় আছে আজও অজানা শ্রেয়িতার।
কেননা যাবিয়াজ এর অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার দিন ছিল বন্ধুমহলের ইতির দিন। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ছিল বন্ধুগণ। অসহায় সঙ্গহীন কি! সেটা বুঝিয়ে দিয়ে ছিল ইফদিয়ার কে তারা। এরফান আর ফেরদৌস যাবিয়াজ এর যাওয়া সহ্য করতে পারিনি। তার যাওয়ার পিছনে দোষী সাব্যস্ত করে ছিল ইফদিয়ার কে। রমণী যেন ক্ষত বিক্ষত হওয়া মনে সবার কাছে মাফ চাই। কিন্তু তারা মাফ করেনি। ফলে সঙ্গহীন, মানসিকভাবে নিপীড়িত হলো ইফদিয়ার। শ্রেয়িতার অক্ষিদ্বয় হতে দু’তিন ফুট অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। পুরোনো সেই ‘ইতি দিনের’ কথা স্মরণ করে।
তাৎক্ষণিক ভাবে মিরাক্কেল হলো! যাবিয়াজ নিজ সন্তোপর্ণে কল দিল। শ্রেয়িতার মুখে ফুটে উঠে হাসির ঝিলিক। ফোন কানে ধরে উত্তেজিত খুশির চটে বলে,
‘ভাই তুই আছিস! তোর কল পেয়ে সত্যি মনটা নেচে উঠেছে। কবে আসবি সব বিগড়ে যাচ্ছে রে ইয়ার।’
যাবিয়াজ বিছানায় শুয়া অবস্থায় স্থীর চাহনী তার উপরের দিকে রাখে। তার দৃষ্টিতে থাকা সম্মুখীন চাহনীতে রয়েছে ইফদিয়ার প্রাণবন্ত হাসির ছবি। ঠোঁট প্রসারিত করে বাঁকা হাসির ন্যায় বলে,
‘দোস্তানি রিলেক্স মুড অন করে ফেল। এভরিথিংক উইল বি ফাইন। কজ আইম ব্যাক।’
চলবে……
(গল্পটা দুদিন বা একদিন পর পর দেবো। আলহামদুলিল্লাহ অনেকটা সুস্থ হয়েছি। তাই চেষ্টা করব কালকেই দেওয়ার। এখন সামনে পরীক্ষা পড়াশুনাও করতে হচ্ছে। সময়টা খুবই নগণ্য। আপনাদের সঙ্গে ততদিন রইব যতদিন গল্পটা শেষ হলো না! গল্প শেষ হলেই আমিও মিলিয়ে যাবো গল্পের হারানোর জগৎ এ। গল্পটাও শেষ পর্বের দিকে এগিয়ে আসছে শিগ্রী। হ্যাপি রিডিং)