অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া পর্ব_২৭

অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া পর্ব_২৭
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)

৫১.
যাবিয়াজকে নিজের বর রুপে দেখতে পাবে ভাবতেও যেন ইফদিয়ার বুকের ধুকপুক বেড়ে চলেছে। কত বছরের সাধনা ছিল প্রিয় মানুষটিকে পাওয়ার! যে মানুষটিকে বিনা স্বার্থে মন দিয়ে ফেলে ছিল কিশোরী বয়সে। আজ সে তারই অর্ধাঙ্গীনি। তৃপ্তিকর হাসি ঠোঁটের ফাঁকে ফুটে উঠে ইফদিয়ার। হাত কুঁচলাতে থেকে বিছানায় ঘাপটি মেরে বসে আছে সে। এখনো রুমে আসেনি যাবিয়াজ। অথচ তার বন্ধুগণ তাকে রুমে এনে বসিয়ে গেল। শ্রেয়িতা ছিল কিন্তু পুনঃপুনঃ লজ্জায় ফেলছিল ইফদিয়ারকে। আকাশ পাতাল ত্রপাট পরিবেশ সৃষ্টিতে শ্রেয়িতা বুঁদ হয়ে আটার মত চিপকে ছিল ইফদিয়ার সঙ্গে। কিছুক্ষণ আগে শ্রেয়িতা রুম থেকে প্রস্থান করেছে। কেননা সে বেশ ভালো ভাবে লজ্জাবতী সদ্যবধূ কে পর্যবেক্ষণ করেছে। বিধায় দরজা আঁটকে বাহিরে দাঁড়িয়ে রইল। উদ্দেশ্য যাবিয়াজ এর থেকে পাওনা হাসিল করা। কম কষ্ট করেনি সে। পাঁচ বছরে ইফদিয়ার প্রতিটা কর্মকান্ড সম্পর্কে ক্ষণে ক্ষণে অবগত করেছে যাবিয়াজকে। এর বিশাল মুনাফা অাবশ্যিক বটে। শ্রেয়িতা খেয়াল করে কয়েকজন কাজিন এগিয়ে আসছে। তারা এসে শ্রেয়িতাকে ‘ভাবী’ সমব্ধন করে প্রশ্ন করে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)

‘ভাবী আপনি কি দরজা ধরতে দাঁড়িয়ে আছেন!’

শ্রেয়িতা চোখ টিপ মারে। যার উত্তর ‘হ্যাঁ’। কাজিনগুলো ফিক করে হেসে ‘গুড কন্টিনিউ ভাবী’ বলে প্রস্থান করে। যাবিয়াজ এর অপেক্ষায় এখন দু মানব জেগে আছে। শ্রেয়িতা মুনাফা শোধের দ্বায়ে অপেক্ষা করছে। অন্য দিকে ইফদিয়ার কাছে আজ যে তার বাসর রাত এ নিয়ে সে ভীষণ ভাবান্তর। কোনো ভাবেও হিসেব মেলাতে পারছে না। কেমনে হলো সব! তার ধারণা মোতাবেক যাবিয়াজ অস্ট্রেলিয়ায় ছিল। এবং তার আসার সম্ভাবনা নিতান্তই দুরুহ ছিল। তাহলে আকস্মিক আসার কারণ!
পরক্ষণে কি ভেবে যেন চট করে দাঁড়িয়ে গেল বিছানা হতে। মাথায় এক হাত চেপে তার ঠোঁট আপনাপনি হা হয়ে গেল। মনের মধ্যে উদয় হলো সদ্য জাগ্রত একটি নতুন প্রশ্ন। ফিসফিসিয়ে বলে উঠে।

‘আব্বা কি চোখে দেখতে পারছেন! উনি লাঠিহীন হাঁটলেন কি করে। হায় আল্লাহ! আমি আনন্দে এতটা মগ্ন ছিলাম। আব্বার দিকে ধ্যানই দিলাম না। যাবিয়াজ থেকে প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে।’

শ্রেয়িতা হাতে পরিহিত ঘড়ির দিকে সময় দেখে নিল। রাতের ১০টা বেজেছে। ঘড়ির কাটা সশব্দে নিজ গতিতে আগাচ্ছে। আনমনে ঠোঁট কামড়ে বলে উঠে।

‘ধুর ছাতা যাবিয়াজকে আনা হবে ১২টায়। এখন থেকে দাঁড়িয়ে পায়ের ব্যথা তুলছি কেন আমি!’

শ্রেয়িতা কটমট ক্রোধ প্রকাশ করল নিজের উপর। স্বয়ংপূর্ণ হয়ে যাবিয়াজ এর দরজার সামনে থেকে সরে গেল। বর্তমানে পরিবারের সকলে অবস্থান করছে যাবিয়াজ এর বাড়িতে। যা দেখতে সৌন্দর্যের রঙিনে রাঙানো। যাবিয়াজ কোর্ট ম্যারেজ করলেও রবিউল সাহেব বাসাকে সাজিয়েছেন নিজ দায়িত্বে। নিজ ছেলের চেহারার দিকে তাকান তিনি। ইফদিয়ার কে ঘোমটা দিয়ে বহু পূর্বেই যাবিয়াজ এর রুমে নিয়ে গিয়েছে তার বন্ধুগণ। এ মুহুর্তে বাসায় ড্রয়িং রুমে যাবিয়াজ সহ বুজূর্গগণ বসে আছেন। কিন্তু যাবিয়াজ এর কাছে মুহূর্তটা বিরক্তময়ী লাগছে। সে ফোঁস করে তপ্ত এক শ্বাস ফেলে অন্তরালে। এরফান তার পিছে দাঁড়িয়ে আছে। সে যাবিয়াজ এর কান বরাবর ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘বউরে ছাড়া বুঝি তর সইছে না!’

‘হারামী কত বছর পর বউ বানাইছি খবর আছে। তুই ছেড়া বহু আগেই বিড়াল মেরে ফেলেছিস তাই বুঝি আমাকে চেঁতাস।’

এরফান শয়তানি হাসি দিয়ে সরু দৃষ্টিতে তার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলে,

‘তা আর বলতে কি! আমার বিয়ে হয়ে বেঁচে গেছি। না হলে তোদের পঁচানো সহ্য করতে হতো।’

যাবিয়াজ কটমট দৃষ্টিতে এক পলক এরফান এর দিকে তাকায়। তার চাহনী দেখে এরফান মুখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। সে জানে তার বন্ধুর মারাত্মক চাহনীর অর্থ হলো ‘একবার তোকে একা পাই বুঝাব কত ধানে কত মই।’
পরন্তু সময়টা তার বন্ধুকে জ্বালানোর ফলে সেও সময়টা বিফলে যেতে দিতে চায় না। যাবিয়াজকে আঁটকে রেখেছে বুজূর্গদের সঙ্গে। এমনকি তার ডানে বামে দুপাশেই চাপাচাপী করে বসিয়ে রাখা হয়েছে রবিউল সাহেব আর জাব্বার সাহেবকে। যাবিয়াজ এর ইচ্ছে করছে সোজা রুমে চলে যেতে। তবুও ভদ্রতার কাতিরে পা-কে আঁটকা রেখেছে। সে চোখ দিকে কাঙ্ক্ষিত বোনকে খুঁজছে। যাতে তাকে এই বিরক্তির আপদ্গ্রস্ত সময় থেকে বের করতে সফল হোক!
ইসমাইল তার পরিচিত ডাক্তার কলিগদের সঙ্গে কথা বলছে। তার পাশে এসে মুখ ফুলানো দশায় দাঁড়িয়ে যায় শ্রেয়িতা। সে আপাদমস্তক বোরকা পরে ঢেকে রেখেছে। যেহেতু এখন সে মুসলিম ঘরের বউ হয়। সেহেতু তার উচিৎ স্বামীর আমানত রক্ষার্থে নিজেকে পর্দায় আবৃত রাখা। ইসমাইল অবশ্য আদরী বাণীতে আদেশ করেছিল বোরকা পরতে। এ নিয়ে শ্রেয়িতার আক্ষেপ নেই। সে খুশিমনে রাজি। তাই তো যাবিয়াজ এর বাসায় বোরকা পরে এসেছে। ইসমাইল তার স্ত্রীর মুখভঙ্গি উদাসীন দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
নিজ কলিগদের কাছে ‘এক্সকিউজ মি প্লিজ’ বলে দূর জায়গায় সরে আসে স্ত্রীর বাহু টেনে। শ্রেয়িতার নেকাপের উপর গালে হাত রেখে আদুরী কণ্ঠে বলে,

‘বউর বুঝি ক্লান্ত লাগছে!’

শ্রেয়িতা চট করে উত্তর দিল ‘না না’। শুনে স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় ইসমাইল পুনরায় শুধায়।

‘তাহলে কি হয়েছে উদ্বাস কেন লাগছে তোমায়!’

‘আসলে ১২টা না বাজা অব্দি যাবিয়াজ এর কাছে মুনাফা নিতে পারব না।’

শুনে হা করে তাকায় ইসমাইল। তার বিয়েতেও এই মেয়েটা মুনাফা নেওয়ার ফন্দিবাজী করে ছিল। এতে বেচারা ইসমাইল কে দেনমোহরের স্বাক্ষরিত করে দিতে হয়েছিল। এটি তার বিয়ের সময় কাবিননামায় আবশ্যকীয় ছিল। সেই কাবিননামায় দেনমোহর এর কাগজপত্র সযত্নে নিজ স্ত্রীর হাতে সর্পে দিয়ে ছিল সে। পক্ষান্তরে তাদের জীবনের পথযাত্রা আরম্ভ হলো নতুন দিগন্ত নিয়ে। তাদের ভালোবাসার পূর্ণতা রুপেই এলো ইসরাইব।
ইসমাইল কে অবাক দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে শ্রেয়িতা বোকার মত হাসি দিয়ে চুপিসারে চলে গেল। অথচ ইসমাইল ঘোর কেটে শ্রেয়িতার যাওয়া দেখে মুচকি হাসি দিল।
ঠিক রাতের ১২টা বেজে গেল। মধ্যরাত এর গতি আরম্ভ হয়েছে। ইফদিয়ার হৃদপিন্ডে ধড়াস ধড়াস করে মাত্রাতিরিক্ত অনুভূতির উদয় হলো। কিছুক্ষণ পূর্বেই শ্রেয়িতা রাতের খাবার খাওয়ে গেল। এখন তার বর অর্থাৎ যাবিয়াজ এর আগমনের সময়। ইফদিয়ার দরজার সামনে পায়চারী করছে। তাৎক্ষণিক সময়টা চলে এলো। দরজার বর্হিভাগ হতে হৈহুল্লোড় এর প্রতিধ্বনি আলোড়িত হলো। ইফদিয়ার বুঝতে বাকি রইল না যে যাবিয়াজ এর আগমন ঘটতে চলেছে। রমণী ঠোঁট কামড়ে তড়িঘড়ি বিছানার মাঝে বসে পড়ল। কাঙ্ক্ষিত মানুষটির আগমনের পথ গণনা করছে। হাতজোড়া একত্রিত করে কুঁচলে যাচ্ছে। কটকট শব্দে দরজা খুলার পর ইফদিয়ার ঘোমটার আড়াল হতে দেখার প্রতিক্রিয়া করে। সে বোরকা খুলে ফেলেছে বহু আগে। এখন সদ্য জর্জেট শাড়িতে বধূ সেজে বসে আছে। তার পরণের জর্জেট শাড়ির আঁচলের ঘোমটা থেকে মানুষটিকে দেখার প্রয়াস করে চলেছে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখতে সক্ষম হলো। সদ্য বিছানা হতে পা ফেলে যাবিয়াজ এর মুখোমুখি এসে পা ধরতে নিল। তৎক্ষণাৎ যুবক রমণীর কাঁধ চেপে ধরে থামিয়ে দিল। পরক্ষণে ইফদিয়ার কলিজা শুকিয়ে গেল। বছরক্ষণের জমানো অভিমানী মনটা বড্ড আনচান করে উঠল। যাবিয়াজ রমণীর মাথা বুক বরাবর চেপে ধরে আদুরী গলায় বলে,

‘অভিমান হচ্ছে কি!’

ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল ইফদিয়ার যাবিয়াজকে। রমণীর ঘোমটা সরে গেল যুবকের পাঞ্জাবীর হাতার বোতামে লেগে। ইফদিয়ার মুখটা অন্যদিক ফিরিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলে,

‘ভুল করেছি বিধায় মাফ করে ফিরে আসতে পারতেন। তা নয় বিপরীতে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর দরদ উতলে পড়ছে।’

যাবিয়াজ এর কর্ণধারে ইফদিয়ার অভিমানী ব্যক্ত পৌঁছিয়েছে কিনা জানা নেই রমণীর। কিন্তু যুবকের ভাবমূর্তিতে দুষ্টুমি লক্ষ করে ইতস্তত বোধ করছে ইফদিয়ার। ভ্রু বাঁকিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে,

‘অসভ্য দৃ দৃষ্টি নামান। ওম ওমনে তাক তাকিয়ে আছেন কেন!’

যাবিয়াজ দুহাত বুকের উপর গুঁজে বলে,

‘তোঁতলানো কবে থেকে শুরু করলে!’

চটে গিয়ে ইফদিয়ার বলে,

‘আপনার কি!’

যাবিয়াজ এর কাছে তার বিবাহিত বউ কে অত্যন্ত অর্ধাঙ্গীনি পূর্ণ লাগছে। কেননা তার বউটা অভিমান করেছে শুদ্ধ ব্যাপার। কিন্তু বউ এর ঠোঁট এর অন্তরাল হতে বেরিয়ে আসা কণ্ঠধারে ‘আপনি’ ডাক শুনতে বেশ লাগছে তার। সে এক দু কদম পেড়িয়ে এগিয়ে গেল ইফদিয়ার দিকে। রমণী যুবকের এগিয়ে আসা দেখে ঘোরের ন্যায় পিছিয়ে যেতে লাগে। যাবিয়াজ এর দৃষ্টিকোণে নেশা মোহের ঘুরপেঁচ চলছে। এক প্রকার বিমোহিত করার মত সেই দৃষ্টি। যাতে আকৃষ্ট হয়ে ইফদিয়ার নিজেকে সর্পে দিতে বাধ্য। ঢোক গিলে শুকনো ঠোঁটযুগল ভিজিয়ে নিল রমণী। অস্পষ্ট কণ্ঠে প্রশ্ন করে।

‘প্লিজ সম পরিমাণ অভিমানে উদয় হওয়া প্রশ্নের জবাবদিহিতা চাই।’

থেমে গেল যাবিয়াজ এর কদম। শান্ত দৃষ্টিগোচরে ইফদিয়ার প্রশ্নের উত্তর প্রদানের জন্যে নিজেকে ধাতস্থ করে নিল। অপ্রকট শ্বাস নিয়ে ইফদিয়ার প্রশ্নের জবাবে বলতে আরম্ভ করে।

‘তোমার উপর স্বল্প পরিমাণও অভিযোগ নেই ইফস্পরী। তুমি আমায় যোগ্যবাদী হয়ে শাস্তি দিয়েছো। হে আমি মানি বিদেশ পাড়ি জমানোর আগে রাগ হয়েছিল তোমার উপর। কিন্তু বিশ্বাস করো এক তুমি বিহীন আমি মানুষটা নিরব গম্ভীরে পুষকৃত হলাম। ড্যাড কে চোখের অপারেশন করাতে গিয়ে ছিলাম মূলত অস্ট্রেলিয়া। সেখানে ডক্টর লিও. ড্যাডের অপারেশনে পারদর্শী ছিলেন। সেই মেডিক্যাল এ ড্যাড এর জন্যে আই ট্রান্সপ্ল্যান্ট করানোর ব্যবস্থা নিলাম। মৃত্যু একজন রোগীর সঙ্গে ড্যাডের ব্লাড গ্রুপ ম্যাচ হওয়ায় তার চোখজোড়া নেওয়ার উদ্যোগ নিলাম। রোগীর পরিবার কে পরমার্শ আর ড্যাড এর অচলাবস্থার কথা জানায়। আল্লাহর রহমতে রোগীর পরিবারের সদস্যগণ হৃদয়পূর্ণ হওয়ায় আমার প্রস্তাবে নিকুচি করেন নি। স্বাদরে মৃত্যু রোগীর চোখজোড়া ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে অপারেশন এর ব্যবস্থা নেওয়া হলো। পুরু তিনদিন লাগে ড্যাড এর সুস্থতা অর্জন করতে। কেননা ড্যাডের বয়স অনুযায়ী অপারেশন করা
ছিল খুব ঝুঁকিপূর্ণ। ড্যাড নিজের জীবনে অন্ধত্ব বহন করেন কঠিন এক পরিস্থিতির সম্মুখীনে। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ ড্যাড সুস্থ হলেন তবে শরীরটা বেকায়দায় দূর্বলতা অনুভব করলেন। বাসায় এনে ড্যাড কে প্রতিনিয়ত খেয়াল রাখার জন্যে নার্স এনেছিলাম তিনজন। ড্যাড এর বিলোপ অসুস্থতার জন্যে বিদেশে এলেও যেন কোনো না কোনো দিকে তোমার শূন্যতা বড্ড পুড়াতো। তবুও তোমার করা কর্মে আমি ঠিক শাস্তি দেওয়ার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করি। অস্ট্রেলিয়ায় নিজের স্টাডি কমপ্লিট করি। ডক্টরি পেশায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হলাম। কিন্তু আমি ডক্টর হলাম বায়োজেনেটিক প্রোগ্রামের সুবিধার্থে। ভিন্ন জেনেটিক সদস্যপট ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার অভিক্ষতা নিয়ে অধ্যক্ষ হতে সফল হলাম। ভিন্ন ভিন্ন শহরে আমার প্রোগ্রামিং বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। দেশ-বিদেশ এর খবরাখবরে এর পর্যাপ্ত কথা ছড়িয়ে আছে। তবুও তৃপ্তি মিলল না। অন্যথায় আমি বিভাগীয় অনুষদে ছিলাম প্রকৌশল প্রযুক্তি বিষয়ক উদ্যোগে। অতঃপর সিদ্ধান্ত নিলাম প্রযুক্তিবিদ্যার আলোকে ভার্চুয়াল এ কর্মঠ হবো। যেই ভাবা সেই কাজ আরম্ভ করে দিলাম। ভার্চুয়ালি প্রযুক্তিসেবা প্রদানের আয়ত্তে ছিলাম আমি। দু’দিকে নজরদারি ছিল আমার। তাই বলে এই ভেবো না তোমার খোঁজ রাখিনী। বরঞ্চ আমার তৃতীয় চুক্ষ সবর্দা তোমার উপর আঁটকে ছিল। কোথায় কি হচ্ছে কে তোমায় উ্যক্ত করেছে। পই পই হিসাব আমার মাইন্ডব্লোয়িং ব্রেনে সেভ করে রেখেছি। তবে এই মুহূর্তে ব্রেনের মধ্যে প্রেম নামক ফাইল আপলোড হওয়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। সো আমি আর দেরি করতে চায় না। পুরু পাঁচটা বছর কম কষ্ট দাও নি। এবার পুষে নিবো আদরে আদরে গলিয়ে দিবো তোমার অভিমানী মনটা।’

কথার ছলে ইফদিয়ার কে কোলে উঠিয়ে নিল যাবিয়াজ। বেচারীর বিষয়টা বোধগম্য হওয়ার পূর্বেই যুবকের নেশাক্ত মোহে ভীতি রুপ ধারণ করল সে। যাবিয়াজ কে শেষ একটি প্রশ্ন করে মনকে শান্ত্বনা দিতে চাইল ইফদিয়ার। আমতা আমতা করে বলে,

‘আ আরেকটি প্র প্রশ্ন!’

যাবিয়াজ ভ্রু কিঞ্চিৎ নেড়ে তীক্ষ্ম কণ্ঠে বলে,

‘বাসর করার থেকে বাঁচবে না মনে রেখো। অনলি এক সেকেন্ড আক্স ফাস্ট।’

‘আপনার আসার সম্ভাবনা ছিল না। নয়বা আসলেন যে!’

যাবিয়াজ রমণীর লাল রঙে রাঙা ঠোঁটযুগলে দৃষ্টিকোণ ফেলে বাঁকা হেসে বলে,

‘বউকে ছাড়া সইছিল না আর। যদি তোমার কিশোরী বয়সে বিয়ে হয়ে যেত। তবে মনের তৃপ্তি মিলতো না। শুধু মোহ আবেগ সৃষ্টি হওয়ায় তোমায় কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হতো। যেটি নিতান্ত নেতিবাচক বলে আমি মনে করি।ফলে পাঁচটা বছর প্রবীর সাধনার পর তোমায় পরিপূর্ণ যুবতী রুপে গ্রহণ করলাম। ভেবে ছিলাম তিনবছর পর আসব। কিন্তু সিদ্ধান্ত বদলে পাঁচ বছর পর এলাম। কিশোর জীবনটা সকলের কাছে আবেগীয় হয়। তখন প্রেম করে অসৎ পথ বেছে নেওয়ার মানসিকতা গড়ে উঠে। হ্যা আমি চাইলেই তোমায় বিয়ে করে নিজের ব্যক্তিগত মনোসম্পত্তি বানিয়ে নিতাম। তবে চায়নি মূলত তোমার পড়াশুনার ঘাটতি পূরণে।
সংসার এর সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটাকে কখনো ছোয়া কিংবা ধরা যায় না, তাকে শুধুই হৃদয় দ্বারা অনুভব করা যায়।
সুতরাং আমার সিদ্ধান্ত অটুট বলে মনে করি।চোখের বিনিময়ে চোখ এর এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত পুরো সংসারকেই অন্ধ হয়ে থাকতে হয়।’

যাবিয়াজ দম আঁটকানোর ন্যায় তৃপ্তি সহকারে শ্বাস ছাড়ে। এতদিনের জমাটবদ্ধ হওয়া গুপ্ত কথন ব্যক্ত করতে পেরেছে সে প্রেয়সীর নিকট। ইফদিয়ার গম্ভীর ভঙ্গিমায় যাবিয়াজ এর বুকে মাথা দিয়ে রইল। কোনো কাঙ্ক্ষিত উত্তর না পেয়ে যুবক অধর্য্য সহিত কণ্ঠে বলে,

‘বোবা হয়ে গেলা নাকি!’

কিন্তু যুবক এর ধর্য্যহীনতাকে বিচ্ছেদ টেনে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ইফদিয়ার। এখনো যাবিয়াজ এর কোলে অবস্থান করছে রমণী। ফুঁপিয়ে ক্রন্দনরত রমণীকে আঁটকাল না যুবক। কাঁদতে দিল প্রিয় ইফস্পরীকে। কম কষ্ট পায়নি। বছরখানিক পেড়িয়ে সাধনার সুফলতা পেয়েছে দু’মানবের অন্তরস্থে। ইফদিয়ার কান্নারত দশায় হিঁচকি তুলে ফুঁপানো কণ্ঠে বলে,

‘আগলে নিন আমায়। যেন ছেড়ে যাওয়ার কোনো পন্থা না থাকে। গুছিয়ে দিন তুমি-আমি নামক মধ্যকার ভিত্তি।’

ক্রন্দনরত রমণীর বিমোহিত কণ্ঠধারাই যথেষ্ঠ হলো যুবকের হৃদয়ে স্পর্শীকাতর ঝংকার তুলতে।
যাবিয়াজ মুচকি হেসে ইফস্পরীর কানে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘প্রথমে আসো নামাজ কায়েম করে ফেলি। তাহলেই শুভ কাজ অত্যধিক সুখকর হবে।’

ইফদিয়ার লাজুক দৃষ্টিতে নামানোর জন্যে ইশারা করে। যুবক তার ইফস্পরীকে ওয়াশরুমের সামনে নামিয়ে দিল। রমণী ওযু করে এসে দেখে যাবিয়াজ পক্ষান্তরে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জায়নামাজে। সেও মুচকিও হেসে যুবকের সঙ্গে নামাজ কায়েম করে উঠে দাঁড়ায়। ধীরস্থিরে পা ফেলবে তার পূর্বেই পুনরায় কোলে উঠিয়ে নিল যাবিয়াজ। এবার যেন ইফদিয়ার নিরব দৃষ্টিতে মোহনীয় ভাব প্রকাশ করে। যাতে মুগ্ধ নেশাতুর হয়ে ডুবে যেতে যাবিয়াজ এগিয়ে গেল পরিপাটি বিছানায়। ইফদিয়ারকে বালিশের মাঝে শুয়ে দিয়ে তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,

‘তোমার সর্বান্তে আমার অধিকার পূর্ণতা পাবে। তোমার প্রতিটা ক্ষতচিহ্নে লাগাম দেবো আমি। সেই ক্ষত সৃষ্টিকারী মানবের শরীরে ক্ষতের তর্কমা লাগিয়ে দিব।’

ইফদিয়ার ভ্রু কুঁচকে যাবিয়াজ এর শেষাক্ত উক্তি নিয়ে প্রশ্ন করতে উদ্যোগ নিতে চাইল। তবে সেটা যাবিয়াজ সফল হতে দিল না। সে নিয়ে গেল তার ইফস্পরী কে সুখানুভূতির রাজ্যে। অন্দরের আদিম খেলায় মগ্ন হলো দুটো প্রাণপাখি।

৫২.
এরফান সোফায় অর্ধক্লান্ত অবস্থায় গা হেলিয়ে দিল। তার বন্ধুর প্রিয় বন্ধু হওয়ায় বিয়ের সরঞ্জাম আয়োজনের তদারকি করছে সে। কাল বউভাত হওয়ায় সকল সদস্যগণের মাঝে তীব্র আনন্দের উত্তেজনা। ইসমাইল এর খুশি দেখে কে!
তার বোন যে খুব স্বাদরে সৎ ধনাঢ্য এক পরিবারের সদস্য হয়েছে। তা বিশ্বাস করতে যেন তার মন বড্ড বাঁধছে তাকে। পরন্তু স্বপ্ন ভেবে ভুল করলে তো চলবে না।
শ্রেয়িতার ডাকে ইসমাইল এর ধ্যান ভাঙ্গে। ঘুম ঘুম চেহারা নিয়ে ঢুলছে সে। সবার অবস্থা প্রায় ঘুমন্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইসমাইল শ্রেয়িতাকে নিজের বাহুডোরায় আঁটকে রেখে এরফান-তিয়ানা-রুহিয়া আর তার হবু স্বামীকে বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে রুমে পাঠিয়ে দিল। রবিউল সাহেব যখন দেখলেন পরিবেশটা নির্জন হলো। তিনি নিঃশব্দে হেঁটে ড্রয়িং রুমের জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে গেলেন। ইসমাইল শ্রেয়িতা কে কোলে করে শুয়ে দিল। তার ঘুমকাতুরে বউ শান্ত ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে। বউ এর বুক অব্দি কাঁথা টেনে রুম থেকে প্রস্থান নিল ইসমাইল।
যেহেতু রবিউল সাহেব এর প্রচন্ড আবদার করে ছিলেন ইসমাইল এর পরিবার কে বাসায় না ফিরতে। একদম যেন বউভাত এর অনুষ্ঠান এর পর যাওয়ার জন্যে অনুরোধ করলেন। সেহেতু সম্মানীয় কণ্ঠে ‘জ্বী সমস্যা নেই’ বলে জবাব দিয়ে ছিল ইসমাইল। ড্রয়িং রুমে এক পলক ফেলে প্রস্থান নিতে গেলে ইসমাইল এর নজর পড়ে জানালার ধারে। সেখানে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন রবিউল সাহেব। এখন রাতের ২টা বেজে চলেছে। তবুও তিনি সজাগ রইলেন। ব্যাপারটা মন্দ লাগল ইসমাইল এর। সে নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়ে গেল রবিউল সাহেব এর পাশে। তিনি আচ করতে পারলেন যে মানুষটা কে হতে পারে! মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করেন।

‘তোমরা এসেছ তোমাদের বাসার মুরব্বিগণ আসেননি কেনো!’

ইসমাইল এর মুখখানি কালো মেঘে ঢেকে গেল। সে ইতস্ততঃ ময়ী কণ্ঠে বলে,

‘আঙ্কেল আম্মু কয়েকদিনের জন্যে চাঁদপুরে গিয়েছেন। সেখানে আম্মুর বিঘা জমি ছিল। সেগুলোর মধ্যে বাড়ির খনন এর কাজ আরম্ভ করতে।’

রবিউল সাহেব শুনে বলেন,

‘ওহ কবে আসবেন তিনি!’

‘দু’সপ্তাহখানিক লাগতে পারে।’

‘কবে গেলেন!’

‘এইতো আঙ্কেল ৫ দিন পূর্ণ হলো গিয়েছেন। অথচ আজকে ইফদিয়ার বিয়ে সেটাও জানতে পারেনি। আম্মুর ফোন বন্ধ ছিল। তথাপি কাজে আটঁকা পড়েছেন মনে হলো।’

রবিউল সাহেব ফোঁস করে নিশ্চুপে শ্বাস ছাড়লেন। ইসমাইল বারতি কথা প্রত্যাখ্যান করে আঙ্কেলকে ঘুমানোর পরামর্শ দিলেন। তিনিও নাকোচ করলেন না রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।

_______

সকাল ৯টা…

প্রসিদ্ধ শীতল হাওয়া রুমের অন্তে প্রবেশ করছে। পর্দা শীতল উম্মুক্ত হাওয়াকে দমাতে না পেড়ে নড়েচড়ে উঠছে। দীর্ঘ প্রশান্তির শ্বাস নিয়ে যাবিয়াজ ঘুমন্ত চোখজোড়া স্থীরভাবে উম্মুক্ত করে। বুকের উপর কারো গরম নিঃশ্বাস পেয়ে নিষ্পলক চাহনী নিক্ষেপ করে। দেখে তার প্রিয় ইফস্পরী পরম আদুরে চাহনীতে ঘুমিয়ে আছে। তাদের শরীর ঢেকে রয়েছে সাদা রঙের চাদরে। যাবিয়াজ ভোর বেলার নিষ্প্রতিভে ইফস্পরীর নিষ্পাপ মুখশ্রীতে চুম্বনের ছোঁয়া দিল। গালের এক পাশে হাতের ছোঁয়া দিয়ে স্লাইড করে নেশাক্ত কণ্ঠে বলে,

‘আজ পরিপূর্ণ হলো আমাদের দূরত্বের মোচন। তোমার মনে আচর পাওয়া প্রতিটি খন্ডে নিজের ছোঁয়া বর্ষিত করেছি। চিন্তা করো না মূল্য শোধ ঠিকই পূরণ করে নিব তার থেকে।’

যাবিয়াজ এর চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল। গুপ্ত ক্রোধ নিজের মাঝে চেপে নিল। ইফদিয়ার সঙ্গে করা অন্যায়কারীকে সে ছাড় দেবার পাত্র নয়। সে দেখে ছিল বিয়ের দিন নাজমুল কে সকলের অগোচরে পরিচিত মানুষদের মাঝে মুখোশধারী বেশে। তবুও মুখ ফুটে কিছু বলেনি। কেননা সে চায়নি আনন্দদায়ক পরিবেশটা বেদনাময় হোক! ফলে এরফানকে ডেকে উক্ত ব্যাপারে অবহিত করে। যার কারণে সে চোখে চোখে রেখেছিল নাজমুলকে।
নাজমুল বাসা হতে বিদায় না হওয়া অব্দি এরফান স্বচক্ষে নজরদারি চালিয়ে ছিল। যাবিয়াজ দৃঢ় এক শ্বাস নিয়ে ভাবনার ছেদ ঘটালো। রমণী নিভু নিভু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে যুবক এর উপর। নম্রতায় প্রেমময়ী শিরঃদাড়া বয়ে গেল পুরু শরীরে। আজ থেকে যে সে পরিপূর্ণ নারীতে পরিণত হলো। তার দেহমন সাক্ষি যে, এই পৃথিবীতে তার স্বামীই তার সর্বাঙ্গে নিজের অধিকারের সিলমোহর দিয়েছে। লাজুক হেসে উঠার প্রয়াস করায় কাঁথা সরে গেল রমণীর পিঠ থেকে। যাবিয়াজ এর চোখে ইফদিয়ার শ্যামবর্ণী পিঠের উজ্জ্বলতা দেখে পুনরায় আসক্তি জম্মালো। আবেদনময়ী দৃশ্যটি সহে নিতে পারেনি। হেঁচকা টান মেরে রমণীর মাঝে মেঁতে উঠল। নাকচ করেনি ইফদিয়ার। স্বামীর পূর্ণ অধিকার পূরণে সাড়া দিল।

কয়েকঘণ্টা হয়ে গেল শ্রেয়িতাকে সম্মুখে দেখেনি ইসমাইল। বউটা যে কোথায় গায়েব হলো সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। শ্রেয়িতা হাসিমুখে রুমে প্রবেশ করে। ইসমাইল চট করে তেজী কণ্ঠে প্রশ্ন করে।

‘কি করছিলে কোথায় চলে গিয়ে ছিলে!’

‘উফ বলিও না যাবিয়াজ ভাই থেকে ৫০,০০০ টাকা লুটে নিলাম।’

ইসমাইল এর কান ছানাবড়া। সে বিস্ময়ময়ী কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে।

‘হোয়াইট দ্যা ফুসফুস! আমি কি তোমায় কম খাওয়ায়। যে ভাইয়ের থেকে ওত টাকা লুটে নিলা।’

‘এ্যা বোনের দিব্য হক আছে টাকা লুটার। তো তুমি চুপ থাকো।’

‘আচ্ছা থাকব না। চলো রোমান্স করি।’

‘অসভ্য যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। ইসরাইব কে খাওয়াতে হবে।’

‘যথা আজ্ঞে বেগমসাহেবা।’

ফিক করে হেসে দিল শ্রেয়িতা। ইসমাইল সন্তোপর্ণে হুট করে আলতো পরশ এঁকে দিল পরীর ওষ্ঠে। শ্রেয়িতা মৃদু রাগ করার ভান করে বকতে নিলে ভৌদৌড় দিল ইসমাইল।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here