অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া পর্ব_০৫

অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া পর্ব_০৫
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)

৯.
আহসান সাহেবকে কয়েকজন লোক মিলে জেরা করছেন। বাসার ভেতরে হট্ট-গোলের শব্দ ভেসে আসায় পড়া থেকে উঠে দাঁড়ায় ইফদিয়ার। মিসেস জাবিয়া জেগেছেন প্রায় অনেকক্ষণ হলো। বেশ সুস্থ আছেন। মিসেস হালিমা রান্নার কার্য সেরে বসে ছিলেন নিজের রুমে। উনার জন্য বরাদ্দ করে রাখা হয়েছে নিজস্ব এক রুম। ছোট খাট, একটি তাক,আলমারি,ড্রেসিং টেবিল দিয়ে রুমটা সাজিয়ে হালিমাকে দিয়েছেন মিসেস জাবিয়া।
মিসেস হালিমার এই পৃথিবীতে আপন বলতে একটা ছেলে আছে। তবে সেই ছেলের মধ্যে ছিল না মায়ের প্রতি কোনো স্নেহ-মায়া। বরং নিজের মত একটা মেয়ে পছন্দ করে বিয়ে করে সংসার করছে। মা কোথায় আছে এর খবর আজও জানে না উনার ছেলে। বৃদ্ধাশ্রমে ছেড়ে চলে গিয়ে ছিল উনার ছেলে। সেখান থেকে একদিন মিসেস জাবিয়া খাতুনের সঙ্গে পরিচয় হলেন মিসেস হালিমা বেগম। তিনি বৃদ্ধাশ্রমে প্রতিদিন না হলেও কয়েক মাস পর পর ঘুরে আসতেন। সেখানের লোকজনের সঙ্গে উনার বেশ হাবভাব রয়েছে। মিসেস হালিমার মধ্যে বোন-বন্ধুত্ব স্বভাব পাওয়ায় মিসেস জাবিয়া নিজের টিনের বাসায় ছাদ করে দেন।
বাসার বাহির থেকে হৈচৈ শুনতে পেলেন মিসেস হালিমা। তিনিও উঠে চলে এলেন মিসেস জাবিয়ার কাছে। ইফদিয়ার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাহিরে প্রচুর কথা শুনা যাচ্ছে। শুনেই বুঝতে পেরেছে পাড়া-প্রতিবেশি সকলে জমাট হয়েছে। কেনো যেন খুব ভয় হচ্ছে তার। সমাজের মধ্যে বাস করে তারা। এখন না জানি কি কুকর্ম রটিয়েছেন জনাব আহসান। বাবাকে গালমন্দ করে দরজা খুলে দিল ইফদিয়ার। তৎক্ষণাৎ হরমুড়িয়ে প্রবেশ করে কয়েক বৃদ্ধ লোক। বেশ আশ্চর্য হয়ে গেল তিনজন।

মিসেস জাবিয়া নিজের শাড়ির আঁচল পিঠে টেনে এনে ঘোমটা মাথায় নিলেন। বাসার মধ্যে লোকজনের সঙ্গে চেয়ারম্যান এসেছেন এই পাড়ার প্রধান পরিচালক। উনাকে দেখে ইফদিয়ার জড়তার ন্যায় রুমে চলে গেল। কিশোরী রমণীকে দেখে চেয়ারম্যান কিছু বলল না। মিসেস জাবিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

‘আপনি কি অক্ষম হয়ে পড়েছেন মিসেস বুহিয়ান?’

চেয়ারম্যান সাহেবের কথায় মিসেস জাবিয়া আর হালিমা চোখ তুলে তাকান। মিসেস জাবিয়ার গায়ের লোমহর্ষক হয়ে উঠে। শরীরে যেন কেউ বড়জোড় আঘাত করেছে এমন করুণ মনে হলো উনার। করুণ দৃষ্টি নিয়ে আহত গলায় বলেন,

‘এমন কেনো বলছেন ভাইসাহেব। আমার দ্বারা কি কোনো ভুল হয়েছে।’

‘তা আমি নয় আপনার স্বামী থেকে জিজ্ঞেস করুন।’

‘তিনি কি করেছেন এমন?’

চেয়ারম্যানের পিছে থাকা কয়েকজন যুবক ছেলে দেখতে বখাটে ধরনের ছিল। তারা পরিবেশটাকে আরো তিক্ত করতে পিছপা হলো না। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে বলে,

‘বুড়া বয়সে বুঝি খুব চাহিদা পূরণের ইচ্ছে জাগে আন্টি।’

মিসেস জাবিয়া যুবকের কথা শুনে লজ্জায় মাথা নুয়ে নিলেন। মাকে কটুক্তি কথা শুনতে হচ্ছে। যা মুটেও সহ্য করতে পারছে না রুমে বদ্ধ থাকা ইফদিয়ার। সে গিয়ে প্রতিবাদ করতে চাই। কিন্তু তার হাত তালাবদ্ধ। কেননা দরজা খুলার কিছুক্ষণ আগে তার মা প্রতিজ্ঞা করিয়েছেন।

‘শোন মা যা কিছু হোক না কেন। তুই দরজা খুলে সোজা রুমে ঢুকে যাবি। কোনোমতেও বাহিরে আসবি না। কসম দে আমায়।’

মায়ের কথায় বিরক্ত হলো ইফদিয়ার। সে সোজাসুজি নাকচ করে দিল। কিন্তু মিসেস জাবিয়ার কড়া কঠিন মুখশ্রী দেখে চুপ করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ইফদিয়ার এখন নিজের চুল ছিঁড়তে মন চাচ্ছে। কেন যে মায়ের উপরে কথা বলতে পারিনি। আজ যদি বলতো তাহলে তার মাকে বাজে কথা শুনতে হতো না।
কিন্তু সেও কি করবে! মাকে কোনোভাবেও নিরাশ বা হতাশ বা দুঃখ দিতে চায় না। তাই তো মায়ের কথা রক্ষার্থে চুপটি করে বসে আছে রুমে।
বাহিরে কি কথা হচ্ছে। শুনার জন্য পুনরায় দরজায় কান পেতে শুনার চেষ্টা করে ইফদিয়ার।
যুবকের ঠাট্টাময় কথায় চেয়ারম্যান সাহেব সরাসরি বলেন,

‘আপনার স্বামী অথাৎ আহসান বুহিয়ানকে পতিতালয়ের মত ঘৃণ্য পরিবেশে পাওয়া গিয়েছে। সেখানে উনি এক বেশ*** সঙ্গে রুমে ছিলেন।’

কথাটি যতটা সরল বাক্যের ন্যায় শুনতে লাগছে। ততটা হৃদয়ের মধ্যে জটিল বাক্যের ন্যায় শুনাচ্ছে। দহনক্রিয়া আরম্ভ হয়েছে হৃদপিন্ডে। আচ্ছা কোনো স্ত্রী কি নিজের অর্ধাঙ্গকে অন্যকারো মধ্যে ভাগ দিবে। এটা ভাবতে যেমন তিক্ত লাগছে তার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। মিসেস জাবিয়ার থেকে ফলস্বরুপ কোনো উত্তর না পেয়ে চেয়ারম্যান সাহেব গলা ঝেড়ে বলেন,

‘শুনেন এমন স্বামীর সঙ্গে সংসার করার চেয়ে ছেড়ে দিয়ে বেঁচে থাকা শ্রেয় বলে মনে করি।’

চেয়ারম্যান নিজের সাঙ্গপাঙ্গদের ইশারা করলেন আহসান সাহেবকে রেখে যেতে। তারা ইশারা অনুকরণ করে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল আহসান সাহেবকে। দলবল বেরিয়ে যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরু বাসায় নিরবতা বিরাজ হলো। আহসান সাহেব ঢুলছেন। এখনো বোধ হয় মদের নেশা মিটেনি উনার। মিসেস জাবিয়া ধপ করে বসে পড়েন মেঝের উপর। ইফদিয়ার এতক্ষণ হওয়া সব কথা নিজ কানে শুনেছে। আর দমে রাখতে পারিনি নিজেকে। বেরিয়ে এসে মাকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সম্মুখে আহসান সাহেবকে পড়ে থাকতে দেখে মিসেস হালিমাকে বলে,

‘নোংরার কিটকে ধাক্কা মেরে বাসার বাহিরে ফেলে দেন কাকি।’

মিসেস হালিমা আদেশের অপেক্ষায় ছিলেন।তিনি ফোন বের করে উনার পরিচিত একজন ছেলেকে ডাকেন। ছেলেটা বাসার পাশে টংবাজারে কেনাবেচার কাজ করে। সে এসে যায় পান চিবাতে চিবাতে। লুঙ্গি পরিহিত ছেলেটাকে দেখে ইফদিয়ার ভ্রু কুঁচকে কাকির দিকে তাকায়। মিসেস হালিমা পরিচিত বলে অবগত করেন। ইফদিয়ার মাকে রুমে নিয়ে গেল। ছেলেটি আহসান সাহেবকে উঠিয়ে নোংরা আবর্জনাপূর্ণ জায়গায় ছুঁড়ে ফেলে দিল। নিজের হাত ঝাড়তে থেকে বলে,

‘কিটপতঙ্গ কিল্লে জম্ম লই। ইশ! হেগো গু খাইয়া মরে না কা।’

নিজের মত মন্দভাষা উচ্চারণ করে ছেলেটি চলে যায়। আহসান সাহেবের জ্ঞান নেই। মদের তীব্র নেশার কারণে আর শারীরিক চাহিদা মিটানোর ফলে তীব্র ঘুম হানা দিয়েছে উনার চোখে। ফলে যেখানে আছেন ওখানেই পড়ে ঘুমিয়ে গেলেন।
ইফদিয়ার মাকে এই সেই বলে পূর্বের কথা ভুলানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মিসেস জাবিয়া চুপ করে আছেন। সে হতাশ হয়ে রান্নাঘরে গেল। মিসেস হালিমা সুস্বাদু পোলাও,গরুর মাংস রান্না করেছেন। সেখান থেকে প্লেট ভর্তি পোলাও মাংস নিয়ে মায়ের রুমে এলো। মাকে বসিয়ে খাবার মুখে তুলে দিল।
মিসেস জাবিয়া রোবট এর মত হা করেন আবার চুপ হয়ে যান। মায়ের নিরবতা দেখে কষ্টে ফেটে যাচ্ছে ইফদিয়ার বুক। কান্না যেন দলা পাঁকিয়ে গলায় আঁটকে আসছে। মনের অনুমতি থাকলে চোখযুগল রাজি অশ্রুসিক্ত নিক্ষেপ করতে। কিন্তু ব্যর্থ মন নিজেকে শক্ত রেখে অশ্রু পড়তে দিল না।
খাবারের পর্ব চুকিয়ে মাকে পরিষ্কার করে বিছানায় গা হেলিয়ে দিল। ঘণ্টা পেরিয়ে গেল তবুও মা কোনো কথা না বলায় যেন সন্দেহ জাগে ইফদিয়ার মনে। দিনের বেলা কেমন অাচরণ করে তার অপেক্ষায় শুয়ে পড়ে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)

১০.

রাতের গভীরতা যত বাড়ছে তত চিন্তার বেগ বেড়ে চলেছে যাবিয়াজের। বেলকনির মধ্যে রেলিং শক্ত করে চেপে ধরে আছে। দৃষ্টিকটু আকাশপানে স্থীর। আজ আকাশে ঘনকালো মেঘ। যা রাতের আঁধারে ছাই রঙের আভসা আলোতে বুঝা যাচ্ছে। মনের মধ্যে যন্ত্রণা হচ্ছে। মস্তিষ্ক অকারণে ব্যথার আহবান জানাচ্ছে।

‘কেনো মনে হচ্ছে এই যন্ত্রণার মূল কারণ ইফদিয়ারকে ঘিরে। সে কি আমার অধঃপতনের কারণ। নারী তুমি রয়ে গেলে কিশোরী মেয়ে। তোমার মাঝে দেখিয়াছি কি নিজের সর্বনাশ! এই চরণে কি বুঝায়। কারো পৌষ মাস তো কারো সর্বনাশ। সময়টা কি পৌষ মাসে আবদ্ধ হচ্ছে। পারছি না ভাবতে। প্রচন্ড ব্যথা করছে মাথা।’

রুমের ভেতরে চলে আসে। বিছানার উপর টান হয়ে শুয়ে পড়ে। ভাবতে থাকে আজকে ঘটনাটা।

পূর্বের ঘটনা…

বাবার মুখে ‘বিয়ে’ নামক পবিত্র শব্দটি শুনে আশ্চর্য হয়ে পড়েছিল যাবিয়াজ। তাও আবার তার জন্যে মেয়ে ঠিক করেছে। সে ভাবল এই কেমন পরিস্থিতিতে আঁটকা পড়ল সে!
রবিউল সাহেব ছেলের মুখের দিকে দৃষ্টি করে রেখেছে। তবুও আশানুরুপ কোনো জবাব পেল না। একরাশ হতাশা এসে ভীড় করে উনার মনে। যাবিয়াজকে কখনো জোড় করেনি রবিউল সাহেব। তথাপি ছেলেকে নিজের মন মতো চলতে দেন। কিভাবে পারবেন ছেলেকে প্রাপ্ত সুখ না দিয়ে পরপারে যেতে। হায়াত আছেও বা কত দিন। চোখে নেই কোনো প্রকার রশ্নি কোনো না কোনো দিন অঘটনের ফলে পরপার নিশ্চিত হতেই পারে। এতে ছেলের কি দোষ! ছেলের একটা প্রাপ্ত সংসারিক জীবন চাই উনার ভাষ্যমতে। আকাঙ্ক্ষা নিয়ে স্থীর বসে আছেন। আজ উনার বন্ধুকে বিয়ের কথাবার্তার জন্যে ডেকেছেন। বাহিরে বসা মেয়েটির পরিবার হলো রবিউল মেশরাফের বন্ধু।
জাব্বার আহমেদ এর পরিবার আর একমাত্র মেয়ে আয়েশা আহমেদ।

যাবিয়াজ প্রফুল্লচিত্ত কণ্ঠে বলে,

‘দেখো ড্যাড। আমি কখনো তোমার কথার খেলাফ হয়নি। তাই আজও হবো না। শুধু বলব তুমি আগে তারপর আমার সংসার। তোমাকে আগেও বলেছি এখনো বলছি। তোমার চোখের অপারেশন না করা অব্দি আমি কোনো সংসারে লিপ্ত হবো না।’

রবিউল সাহেবের মনে উৎকণ্ঠা ভর করল। তিনি আশ্বস্ত কণ্ঠে বলেন,

‘তুই কি কাউকে পছন্দ করিস! মানে কাউকে ভালো লাগে।’

বাবার কথায় যাবিয়াজ চুপ হয়ে গেল। মনের মধ্যে একটি নাম উঁকিঝুঁকি হয়ে চলাফেরা করছে। তবে কার নাম ! তার কোনো মেয়েকে পছন্দ হয়নি। জীবনের একমাত্র আসল জিনিস হলো অপ্রত্যাশিত জিনিস। অন্য সবকিছুই কেবল মায়া।
মোহ আর মায়া
দুটোই যেন ঘোর আপত্তি
দাম্ভিক ব্যক্তিত্ব, মিষ্টি কথার মোহ
ভালোবাসা জড়িয়ে স্বপ্নে জড়ানোর মোহ এগুলো সত্যি বড্ড অদ্ভুত পরিস্ফুটন জীবনের।

যাবিয়াজ এর ধ্যান ফিরে রবিউল সাহেবের ডাকে। অপ্রতিভ ভঙ্গিমায় ‘না’ বলে চলে গেল। রবিউল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে জাব্বারকে বিষয়টি জানান। তিনি শুনে বলেন,

‘সমস্যা নেই ছেলের সঙ্গে পরিচিত হলাম। আলবাত সব ঠিক হবে।’

জাব্বার সাহেব বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

দুদিন পর….

ইফদিয়ার দিকে অগ্নিশর্মা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যাবিয়াজ। তার সুন্দর পাঞ্জাবির উপর এক বালতি পানি ছুঁড়ে মেরেছে ইফদিয়ার। ভয়-ভীতি কোনটিই কাজ করছে না ইফদিয়ার মনে। বরঞ্চ বাঁকা হাসি ঠোঁটের কোণে টেনে ভাব নিয়ে বলে,

‘ইশ! ওমনে দেখবেন না ট্রু লাভ ওয়ালা ফিলিং হয়। ইচ্ছে করে খেয়ে ফেলি।’

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here