আঁধারের_গায়ে_গায়ে
তমসা_চক্রবর্তী
পর্ব-১৫
।।৪০।।
সকাল সকাল মায়ের সাথে কিছুক্ষনের প্রানের আলাপ, মিলির বহু পুরানো অভ্যেস। এই সময়টা মা মেয়ের একান্তই আপন সময়। সুবীর বাবুও তাই খুব দরকার না পড়লে এইসময় মা মেয়েকে বিশেষ একটা ঘাঁটান না।কিন্তু আজকের সকালটা ভীষন অন্যরকম।সুবীর বাবু শোয়ার ঘরের জানালার পাশে রাখা সোফায় শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে সবে খবরের কাগজের পাতা চোখ রেখেছেন। মেয়েকে ঘরে ঢুকতে দেখে হাসি মুখে ‘গুড মর্নিং’ বলেই আবার কাগজে মনোনিবেশ করতে গেলে, মিলি আজ বাবার কাছে এসে জড়িয়ে ধরল বাবাকে।ঠিক সেই ছোটবেলার মতো।এমন ঘটনা সচরাচর ঘটেনা, তাই বেশ আশ্চার্যান্বিত হয়েই মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন।
-“কি ব্যাপার, মিস মার্পেল!!আজ মা’কে ছেড়ে বাপিকে আদর”!!
-“কেন!! মা’কে আদর করলে কি বাপিকে আদর করা যায় না!নাকি বাপিকে আদর করতে গেলে বিশেষ দিনের প্রয়োজন হয়”!!
ঘুম জড়ানো আদুরে গলায় সুবীর বাবুর কৌতুকের জবাব দেয় মিলি।
-“তা ঠিক নয়,তবে আজ কেমন যেন মনে হচ্ছে, আমার মেয়ে সকাল সকাল বেশ খুশি।কেস সলভড”!!
মিলির সাথে মশকরা করতে করতেই সপ্রশ্ন চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন সুবীর বাবু।
-“এটা অন্য কেস”! – মিটিমিটি হাসতে থাকলেন আহেলী।
-“ভালবাসার রঙ তুলিতে মনের ক্যানভাসে যে নানা রংয়ের সমাগম চলছে। অনেক দিন পর তোমার মেয়ে, মনের মানুষের সাথে নিভৃতে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে এসেছে যে কাল।তাই ভালোলাগার রেশটা এখনো মনের চিলেকোঠায় বিরাজ করছে” – একটা ফিচেল হাসি মিলির দিকে নিক্ষেপ করেলেন আহেলী।
– “তবে যাই বল সুবীর, আমাদের আই.পি.এস অফিসারটি কিন্তু বেশ কিপটে, সাথে আনরোমান্টিকও বটে! এতদিন পর একান্তে একটু সময় পেয়েছে, কোথায় নির্জন রাস্তায় লং ড্রাইভে যাবে,তা নয় বিকেল থেকে রাত অবধি মেয়েটাকে নিয়ে শুধু ইকো পার্কেই বসে রইল”!
মায়ের ফাজলামোতে কর্ণপাত করল না মিলি।বরং মায়ের বলা শেষের কথাগুলোয় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল তার।কয়েকদিন ধরে মনের গহীনকোনে উঁকি দেওয়া বেশ কিছু প্রশ্ন আবার ঘুরপাক খাচ্ছে মিলির মাথায়।সপ্তাহ দুয়েক ধরেই অস্বস্তিটা মনে দানা বাঁধছিল, কয়েকটা ঘটনা মাথার মধ্যে কেমন যেন ধোঁয়াশা তৈরি করেছিল।তবে আজ ধোঁয়াশা কেটে সবটাই দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মনের আকাশ আবার রৌদ্রজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।আত্মতৃপ্তির উচ্ছাসের বহিঃ প্রকাশ না করে শুধুই মুচকি হাসল মিলি।
-“উজান মোটেই কিপটে নয়, বুঝলেন মিসেস গঙ্গোপাধ্যায়।আর আন রোম্যান্টিক তো একেবারেই নয়”!!
মেকি অভিযোগের ঝুলি সাজিয়ে বিছানায় উঠে এলো মিলি। রোজকার মতন মায়ের কোলে মাথা রাখলো।
-“বাবাহ্!আর পারিনা!এই দুদিন আগে কতকিছু বলল, আর এখন পুরো পাথরটি কেস!প্রেম উথলে উঠেছে!!তা অমন কাঠখোট্টা পুলিশ বাবুটি কি এমন করলেন শুনি,যে আমার মেয়েটা প্রশংসার ঝুলি সাজিয়ে বসেল”!!
মেয়ের সাথে খুনসুটি করার সুযোগ ছাড়লেন না আহেলী।
-“সূর্য ঢলে পড়ার তোড়জোড় করছিল, আকাশের বুকে উড়তে উড়তে পাখিরা ফিরে যাচ্ছিলো নিজের বাসায়, প্রতি মূহুর্তে রং বদলাচ্ছিল আকাশ, হলুদ থেকে কমলা, কমলা থেকে লাল; গোধূলির আলো রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল তিলোত্তমা নগরীর প্রতিটা কোনাকে।শরীর জুড়ানো হালকা ঝোড়ো হাওয়া, শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে ছবির মতন অপূর্ব এক সূর্যাস্তের সাক্ষী থাকলাম কাল”।
বন্ধ চোখের পর্দায় ভেসে উঠছে গতকাল বিকেলে উজানের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্তের জলছবি। হৃদয়ের ভাঁজে ভাঁজে উজানের স্নিগ্ধ সান্নিধ্যের অনুরণন। এখনো সবটাই কেমন যেন স্বপ্নের মতো।অন্যরকম এক ভালোলাগার আবেশে ওঠে মিলির সমগ্র সত্বা।
-“ইকো পার্ক থেকে”!! – নিবিষ্ট মনে মেয়ের কথা শুনতে থাকা আহেলী, মিলির মনের মধ্যে চলতে থাকা আলোড়ন অনুভব করতে পারছিলেন।তাই মিলির দিবাস্বপ্ন না ভেঙেই ছোট্ট প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিলেন তার দিকে।
রহস্যময় হাসি মায়ের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিয়ে মিলি জবাব দেয়,
-“The Westin Kolkata, ইকো পার্কের অপোজিটে।ওদের rooftop ৩২ তলায়” -বন্ধ চোখের ওপারে আবার ফিরে গেল কালকের সন্ধ্যায়। -“গোটা কলকাতা শহরটা ওখান থেকে যেন এক মায়াবী নগর। সন্ধ্যে নামার সাথে সাথেই এক অদ্ভুত আলোআঁধারির খেলায় ভেসে উঠল প্রাণের শহরটা। সে এক অনন্য অনুভূতি,যা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই মা,”!!
মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে ভালোলাগার আবেশে নিজেকে আবার জড়িয়ে নিল মিলি।আহেলীও আর কথা না বাড়িয়ে মেয়ের মাথায় আলতো হাতে বিলি কেটে চলেছেন।
‘ছেলে মেয়ে দুটো সারাদিন এত ব্যস্ত থাকে,একে অপরের সাথে সামান্য সময়টুকু কাটানো মুশকিল হয়ে যায়।তাই কাল দুটিতে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে আজ বেশ রিফ্রেশড’।
এলোমেলো ভাবনাদের আনাগোনার মাঝেই হঠাৎ করে খাটের ওপর রাখা মিলির মোবাইল ফোনটা কর্কশ স্বরে বেজে উঠতে সম্বিৎ ফিরল মা মেয়ের।ঘাড় বেঁকিয়ে স্ক্রীনের দিকে তাকাল মিলি।
– উজান কলিং
-“গুড মর্নিং”!! – মায়ের কোল থেকে মাথা না তুলেই ফোনটা রিসিভ করল মিলি।
-“গুড মর্নিং ম্যাডাম। আপনার কথা মতো অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আর সার্চ ওয়ারেন্ট রেডি।ডাক্তারবাবুকেও তুলে আনা হয়ে গেছে।তাই স্যার জিজ্ঞেস করছেন লালবাড়িতে কি আপনার চরনধূলি পড়বে!! জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করতে হবে যে”!!
কিছু কিছু মানুষ যতই বড় হয়ে যাক না কেন, দুষ্টুমি করার অভ্যেসটা তাদের কোনোদিনও যায় না। অরণ্য ঠিক তাদেরই দলে। মিলির সাথে খুনসুটি করার সুযোগ আজও ছাড়লো না অরণ্য।
-“ঋক!! সাহিত্য ব্যাপারটা না আমাদের দুজনেরই আসেনা।সো প্লিজ চেপে যা।ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আসছি।আর ডাক্তারবাবুর ফোনটা বাজেয়াপ্ত করেছিস তো” – আড়মোড়া ভেঙে প্রশ্ন করল মিলি।
-“সকাল সকাল একটু মাতৃভাষার চর্চা করবো ভাবলাম,দিলি তো সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে!যাকগে শোন,তুই যেমন যেমন বলেছিলি তেমনভাবেই সব হয়েছে। আর, হরতাল বলছেন তোকে কষ্ট করতে হবে না। আমরা মিনিট দশেকে বেরোচ্ছি।তোকে পিক করে নেব রাস্তায়”!
হ্যাঁ বলতে গিয়েও কিছু একটা ভেবে থেমে গেল মিলি।
-“নারে তোদের আসতে হবে না।আমি নিজের গাড়িতেই আসবো।কেমন”!!
অরণ্যকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই ফোনটা ডিসকানেক্ট করে দিল মিলি।
মায়ের কোল ছেড়ে উঠে বসল মিলি। মুখে ফিচেল হাসি ঝুলিয়ে বলল,
-“টাইম টু ওয়ার্ক মম।না হলে তোমার আইপিএস অফিসার বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছেন”!!
।।৪১।।
সকাল সকাল বাড়িতে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীকে দেখে সেনবাড়ির সদস্যরা রীতিমতো হতভম্ব।সবার মুখ থমথম করছে। সাথে মহিলা পুলিশ দেখে সমতার মুখে চিন্তার ভাঁজ। রাইমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে খবরটা শোনাতেই রাইমার মুখে নেমে এলো অমবস্যার কালো মেঘ। সেদিকে নজর পড়তেই উজান রাইমার দিকে এগিয়ে এলো।
-“আমরা গোটা বাড়িটা আরেকবার সার্চ করব মিস সেন।আপনারা প্লিজ ততক্ষন ড্রয়িং রুমেই বসুন”!!
-“এই তো দুদিন আগেই বাড়ি সার্চ করে গেলেন, কিছুই তো পাননি।তাহলে আবার কেন এভাবে হ্যারাস করছেন আমাদের অফিসার”!!
-“কে বলল পাইনি”!! – উজানের কন্ঠস্বরের কাঠিন্যে রাইমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ভয়ের চোরা স্রোত নেমে এলো।
-“ম্যাডাম, সেদিন আমাদের হাতে এমন বেশ কিছু এভিডেন্স এসেছে,যার জেরে আপনার বাবা-মা আর দাদুর খুনি এখন গারদের পিছনে। আপনার অতি পরিচিত আরও একজনকে আজ ভোর রাতে গ্রেফতার করা হয়েছে।তাই বলছি, ভালোয় ভালোয় আমাদের কাজটা করতে দিন মিস সেন।অযথা আমাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না”!!
মাথায় কেউ যেন হাতুড়ির বাড়ি ঘা মারল। নিজের মনেই বিড়বিড় করে উঠে রাইমা।
-‘অতি পরিচিত…সে তো..’ পা দুটো যেন হালকা কেঁপে উঠল রাইমার। এরমধ্যেই সমতা নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে।চট করে রাইমার হাতটা ধরে ফেলল। ধীরে ধীরে ওকে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসালো।
একজন মহিলা কনস্টেবলকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রেখে ভুবন তালুকদারের নেতৃত্বে একটা টিম একতলার ঘর আর উজানের তত্ত্বাবধানে মিলি সহ আরেকটা টিম দোতলার ঘরগুলো সার্চ করতে শুরু করল।প্রায় ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে জোর তল্লাশির পর দুটো দল নিজেদের কাজ শেষ করে আবার ড্রইংরুমের দিকে পা বাড়াতেই মিলি খেয়াল করলো ইতিমধ্যেই রাইমার ফোন পেয়ে প্রত্যাশামতোই সেনবাড়িতে পৌঁছে গেছেন প্রিয়নাথ সাহা।অন্য দিকে মিলির ফোন পেয়ে অবিনাশ বিশ্বাসও উপস্থিত হয়েছেন সেনবাড়ির বৈঠকখানায়। সম্পূর্ণ পুলিশ বাহিনীকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখেই হম্বিতম্বি করতে করতে উজানের দিকে এগিয়ে এলেন প্রিয়নাথ সাহা।
-“ব্যাপারটা কি বলুন তো অফিসার! আপনার স্পর্ধা দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি।বলা নেই কওয়া নেই, বারেবারে এভাবে মেয়ে দুটোকে অযথা হ্যারাস করছেন! কার পারমিশনে আপনারা বাড়ি সার্চ করছেন!সার্চ ওয়ারেন্ট কোথায়”!!
উজানকে রীতিমতো ধমকাতে শুরু করলেন প্রিয়নাথ সাহা।পুলিশের চাকরিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং নেতা মন্ত্রীদের চোখ রাঙানি নতুন কিছু নয় উজানের কাছে।চাকরি জীবনের প্রথম দিকে এইসব ঘটনা ভীষনভাবে বিচলিত করত উজানকে।এখন যদিও হামেশাই এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে হয় তাকে। সুতরাং এইসব পরিস্থিতিতে কি করনীয়,তা ভালোই বোঝে উজান।তাই বিন্দুমাত্র উত্তেজিত না হয়ে ভুবন তালুকদারকে চোখের ইশারায় সার্চ ওয়ারেন্টখানা এম.এল.এ সাহেবকে দেখানোর নির্দেশ দেয়।
ভুবন তালুকদারের হাত থেকে সার্চ ওয়ারেন্ট খানা প্রায় ছিনিয়ে নিলেন প্রিয়নাথ সাহা। কিন্তু ছাপা অক্ষরগুলো নজরে আসতেই চোখ সরু হয়ে গেল প্রিয়নাথ সাহার। কপালে চিন্তার ভাঁজ। স্বয়ং পুলিশ মন্ত্রী সুপারিশ করেছেন। জ্বলন্ত চোখে তাকালেন উজানের দিকে।মনে মনে মুচকি হেসে মিলির ক্ষুরধার বুদ্ধির তারিফ করল উজান।
‘মেয়েটার এলেম আছে।সোর্স লাগিয়ে ঠিক খবর বের করেছে।পুলিশ মন্ত্রীর সাথে প্রিয়নাথ সাহার সম্পর্কের অবনতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রধান সাহেবের সাহায্যে ঠিক অ্যারেস্ট ওয়ারেন্টখানা জোগাড় করা গেছে’।
মাথায় চলতে থাকা ভাবনাগুলোকে একপাশে সরিয়ে রেখে, ঠোঁটের কোনে সুক্ষ্ম হাসি ঝুলিয়ে, সামনের বিশালাকৃতির সোফা জোড়ার দিকে ইশারা করলো উজান।
-“আসুন স্যার।বাকি আলোচনাটা না হয় বসেই করা যাক”!!
মিলি ততক্ষনে মুঠোফোনে অরণ্যের নম্বরটা ডায়াল করেছে।
-“ওনাকে নিয়ে ভেতরে আয় ঋক”!!
মিনিট দুয়েকের মধ্যেই অরণ্যের সাথে সেনেদের বৈঠকখানায় উপস্থিত হলো বছর পঁচিশের এক যুবক।হাতে হাতকড়া, মুখে দিন দুয়েকের না কাটা খোঁচা দাড়ি, উশকো খুশকো চুল, বিধ্বস্ত চেহারা। আগুন্তকের আগমনে উত্তেজনা সংবরণে ব্যর্থ রাইমা সেন নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
-“কৃষ!!একি অবস্থা তোর”!!-পরিস্থিতির জটিলতা, পারিপার্শ্বিক মানুষজনের উপস্থিতি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে, উত্তেজনায় থরথর কাঁপতে থাকে রাইমা।
-“কৃষানু বাবুর উপস্থিতি আপনি কিভাবে টের পেলেন রাইমা”!! – বিন্দুমাত্র কালবিলম্ব না করে রাইমাকে প্রশ্নের জালে জড়াতে শুরু করল মিলি।
প্রশ্নের আকস্মিকতায় ঘরে উপস্থিত সবাই স্তম্ভিত।নির্বাক দৃষ্টিতে ডঃ কৃষানু প্রধানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে রাইমা।
-“চুপ করে থেকে কোনো লাভ হবে না মিস সেন।উত্তর দিন”।
শাসনের সুরে ধমকে উঠল উজান।সারা শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে রাইমার। চেহারায় ফুটে উঠেছে আতঙ্কের ছাপ। কাঁপতে কাঁপতেই ধপ করে সোফায় বসে পড়ল।চোখের কালো চশমা ছাপিয়ে কয়েক ফোঁটা জল চিবুক ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়ল হাতের তালুতে।
-“উত্তর দিতে,আমি একটু সাহায্য করি রাইমা” – মিলির প্রস্তাবে মুখ তুলে তাকালো রাইমা সেন।
-“কি ভেবেছিলেন মিস সেন!সারাজীবন এইভাবেই কাটিয়ে দেবেন! কেউ কোনোদিন জানতেও পারবে না যে অ্যাক্সিডেন্টের কারনে আপনার দৃষ্টিশক্তি বেশ দুর্বল হয়ে পড়লেও দৃষ্টিহীন আপনি মোটেও নন”!!
-“হ্যাঁ হ্যাঁ দেখতে পাই আমি।সব দেখতে পাই।অন্ধ নই আমি”!! -চোখের ওপরে থাকা কালো চশমাটা সরিয়ে আরক্ত চোখে গর্জে উঠল রাইমা। উজান,মিলি এবং অরণ্যের ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠেছে রূপালী হাসির সুক্ষ্ম ঝিলিক। অন্যদিকে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে মাথা নিচু করল কৃষানু।
ঘটনার আবর্তে উপস্থিত সবাই হতবাক, নিঃশ্চুপ।পিন পতনের নৈঃশব্দ্য ছেয়ে গেছে ঘরের মধ্যে। চরম বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাপ কাটিয়ে নৈঃশব্দ্য ভাঙলেন প্রিয়নাথ সাহা।
-“তুই দেখতে পাস রাই!তবে কিসের জন্য এতগুলো বছর শুধু শুধু দৃষ্টিহীনের মতো কাটিয়ে দিলি রাই!কেন এতোগুলো বছর সবার করুনার পাত্রী হয়ে থাকলি!কেন!!বল মা,আর চুপ করে থাকিস না!কেন করলি আমাদের সাথে এতবড় প্রতারনা”!!
নিমেষেই রাইমার চেহারার গোবেচারা, শান্ত মুখোশটা ঝরে পড়লো। চোখের কোনে শুকিয়ে যাওয়া জলের রেখা।শুকনো চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে আগুনের গোলা। চেহারায় হা হুতাশের চিহ্নটুকুও বিলুপ্ত।হিসহিসে গলায় উত্তর দিল রাইমা।
-“প্রতারণা!!আমি করেছি প্রতারণা!! – চোখের দৃষ্টি পরিবর্তিত হতে হতে হিংস্র হয়ে উঠছে – রাইমার মুখ।
– ” নিজের সবথেকে কাছের মানুষগুলোর দ্বারা প্রতারিত হয়েছো কখনো দাদাই!ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজের প্রিয়জনকে হারিয়েছো কখনো! সারাজীবন তো শুধু জামাইবাবুর তাবেদারীই করে গেলে, কখনো উপলব্ধি করেছো, প্রতিটা মুহূর্তে নিজের রক্তের সম্পর্কের দিদির সাথে কত প্রতারনা করেছো!আর আজ এসেছো আমার থেকে প্রতারণার জবাব চাইছে!লজ্জা করল না তোমার দাদাই”!! – চাপা গলায় হুংকার করে উঠলো রাইমা।
হাঁটুর বয়সী নাতনির মনের গোপন কুঠুরিতে জমে থাকা সুপ্ত ক্ষোভ, প্রতিশোধ স্পৃহায় স্তব্ধ প্রিয়নাথ সাহা। পরিস্থিতি আজ তার মতো ধুরন্ধর রাজনৈতিক নেতাকেও বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। একদৃষ্টিতে রাইমার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনের মধ্যে চলতে থাকা উথাল পাথালের তল পেতে চাইছেন, কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছেন না। এইটুকু একটা বাচ্চা মেয়ের দৃঢ়তার সঙ্গে আজ কিছুতেই পেরে উঠছেন না এম এল এ প্রিয়নাথ সাহা।
#ক্রমশ
/*কমেন্ট বক্সে আগের পর্বগুলির লিংক শেয়ার করা আছে*/
© আমার ভিনদেশী তারা-amar bhindeshi tara-কলমে তমসা চক্রবর্তী
#AmarBhindeshiTara
#TamosaChakraborty
# ভালো লাগলে লেখিকার নাম সহ শেয়ার করবেন 🙏।