আঁধারের_গায়ে_গায়ে তমসা_চক্রবর্তী পর্ব-১৬

আঁধারের_গায়ে_গায়ে
তমসা_চক্রবর্তী
পর্ব-১৬

।।৪২।।

হাঁটুর বয়সী নাতনির মনের গোপন কুঠুরিতে জমে থাকা সুপ্ত ক্ষোভ, প্রতিশোধ স্পৃহায় স্তব্ধ প্রিয়নাথ সাহা। পরিস্থিতি আজ তার মতো ধুরন্ধর রাজনৈতিক নেতাকেও বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। একদৃষ্টিতে রাইমার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনের মধ্যে চলতে থাকা উথাল পাথালের তল পেতে চাইছেন, কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছেন না। এইটুকু একটা বাচ্চা মেয়ের দৃঢ়তার সঙ্গে আজ কিছুতেই পেরে উঠছেন না এম এল এ প্রিয়নাথ সাহা।

-“মিস্টার সাহা” – বৈঠকখানার নৈঃশব্দ্যতা খানখান ডাকে সম্বিৎ ফিরল প্রিয়নাথ সাহার।তবে আজ আর ‘স্যার’ নামক সৌজন্যতা দেখালো না মিলি।

-” ‘সেনেরা কিচ্ছু ভোলে না’ এই শিক্ষাটা তো রাইমা বংশ পরম্পরাতেই পেয়েছে,তাই না! যেমন চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করতে চাওয়ায়, শুভেন্দু বাবুর বাবার বিরূপ প্রতিক্রিয়া বা অনুসূয়া দেবীর করা অপমান কোনটাই উনি কোনোদিন ভোলেননি।সময় সময় ঠিক প্রতিশোধ নিয়ে গেছেন। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রেখে দিয়ে,অনুসূয়া দেবীকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর একাকিত্বের অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে উপযুক্ত প্রতিশোধই নিয়ে ছিলেন শুভেন্দু বাবু।কি বলেন মিস্টার সাহা!” – মিলির গলায় খেলে গেল একরাশ বিদ্রূপ।

মিলি একটু থামতেই, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রিয়নাথ সাহাকে জরিপ করে নিতে চাইলো উজান। মিলির কথার কোনো উত্তর না দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দুবার ঢোক গিললেন প্রিয়নাথ সাহা।

-“তবে রাইমার মনের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভ বা প্রতিশোধ স্পৃহার উৎস কিন্তু শুভেন্দু বাবু নয়, মিস্টার সাহা”!!

-“তাহলে”!! – শূন্য দৃষ্টিতে মিলির দিকে তাকিয়ে রইলেন এম এল এ সাহেব। মিলির কথাগুলো এখনো ঠিক মতো বোধগম্য হচ্ছে না ওনার।

-“গত ষোলো বছর ধরে রাইমার মধ্যে এই প্রতিহিংসার আগুনকে সযত্নে প্রতিপালন করে গেছেন মিসেস অনুসূয়া সেন”!!

-“দিদি”!!রীতিমতো বিদ্যুত চমকে উঠলো প্রিয়নাথ সাহার শরীরে। রাইমা বাদে বৈঠকখানায় উপস্থিত সকলেই স্তম্ভিত।

-“হ্যাঁ,আপনার দিদি মিস্টার সাহা।আমি জানি না, আপনি কতটুকু জানেন বা আদৌ জানেন কিনা যে সৌমিলি সেনের মৃত্যুটা আদপে কোনো অ্যাক্সিডেন্ট ছিল না।তবে ওনার মৃত্যুকে সুপারি কিলিং বললে মনেহয় খুব একটা ভুল হবে না”!!

-“সুপারি কিলিং!!কি আজে বাজে কথা বলছেন আপনি!সৌমি তো কার অ্যাক্সিডেন্টেই..”,

-“উনি ঠিকই বলছেন দাদাই” – প্রিয়নাথ সাহাকে থামিয়ে দিয়ে চাপা গলায় হিসহিসিয়ে উঠলো রাইমা।

-“তবে এখানেই যে শেষ নয় দাদাই। মা’কে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য কে লোক পাঠিয়েছিল জানতে চাইবে না!” – প্রিয়নাথ সাহার চোখে চোখ রেখে কাটা কাটা স্বরে প্রশ্ন করল রাইমা।

-“ক..কে?” গলাটা কেঁপে উঠলো প্রিয়নাথ সাহার।

-“মিস্টার শুভেন্দু সেন”!!

-“শুভেন্দু দা!!” হতভম্বের মতো রাইমার দিকে তাকিয়ে রইলেন প্রিয়নাথ সাহা।

-“হ্যাঁ, দ্যা গ্রেইট শুভেন্দু সেন। কিন্তু বৌমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলার ছক বাধার সময় শুভেন্দু সেন ভুলে গিয়েছিলেন, ‘ভগবানের লাঠিতে শব্দ হয়না’! তাই বোধহয় নিজের কৃতকর্মের শাস্তি পেয়েছিলেন প্রায় সাথে সাথেই। ওই একই অ্যাক্সিডেন্টে হারালেন নিজের একমাত্র সন্তানকে।যাকে বলে, ‘Collateral Damage’ ! – দাঁতে দাঁত চিপে তাচ্ছিল্যভরে বলে উঠলো রাইমা। কিন্তু পরমুহুর্তেই সে ভীষনররকম আবেগপ্রবণ।চোখের জল গোপন করার আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে সে বলতে থাকলো,

-“ঠাম্মি সেদিন হারিয়ে ছিল তার দুই সন্তানকে, আর আমি!!আমি সেদিন পেয়েছিলাম এক নতুন পরিচয় – অনাথ” – জল টলটলে চোখে মিলির মুখের দিকে তাকাল রাইমা।

-“ঠাম্মির ডায়েরিতে হয়তো আপনি সবটাই পড়েছেন,তাই না অহনা!”

মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় মিলি। শুকনো মুখে রাইমা আবার বলতে শুরু করল।

-“জানেন অহনা,আমি যখন হাসপাতালের বিছানায় জীবন মৃত্যুর সাথে লড়ছিলাম, সব হারিয়েও ঠাম্মির তখন একমাত্র লক্ষ্য ছিল আমায় সুস্থ করে তোলা।সব ভুলে সেসময় আমাকে আঁকড়ে ধরেছিল ঠাম্মি।ডাক্তারদের কাছে হাতজোড় করে বারংবার অনুনয় করছিল, যাতে আমাকে প্রাণে বাঁচানো যায়।সম্ভবত দাদাইও ছিল সেই সময় ঠাম্মির সাথে। কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যাপার জানেন, দাদানকে কিন্তু সেসময় একদিনের জন্যও হাসপাতালে আসতে দেখিনি। ছোটবেলা থেকেই মেয়ে হওয়ার অপরাধে, আমায় বিশেষ একটা পাত্তা দিত না দাদান।শিশুমনে ভীষন আঘাত লাগতো,খুব খারাপ লাগতো জানেন। কিন্তু বাড়ির বাকিরা আমায় এত আদর দিত,এত ভালোবাসত যে দাদানের অভাবটা জীবন থেকে আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছিল। আমরা যথেষ্ট সচেতনভাবেই দুজন দুজনকে জড়িয়ে চলতাম। কিন্তু তা বলে আমার অমন সিরিয়াস অবস্থাতেও মানুষটা একবারও আমাকে হাসপাতালে দেখতে আসবে না,এমন সাংঘাতিক বিতৃষ্ণা, সেই ছোট বয়সে আমার ঠিক বোধগম্য হয়নি।একটু সুস্থ হতেই প্রশ্নের পর প্রশ্নে বিধ্বস্ত করে দিতে লাগলাম ঠাম্মিকে।প্রথম প্রথম চুপ থাকলেও বেশিদিন নিজেকে সংযত রাখতে পারেনি ঠাম্মি।আমার প্রশ্নবাণের চোটে একদিন হাসপাতালের কামরায় কান্নায় ভেঙে পড়ল ঠাম্মি। সেদিনই ঠাম্মির মুখ থেকে সবটা জানতে পেরেছিলাম। জানিনা কিভাবে অহনা, কিন্তু ওই ছোট বয়সেও মাথায় একটা জেদ চেপে গিয়েছিল। যেভাবেই হোক শুভেন্দু সেনকে হারাতেই হবে।

কিন্তু এরপর‌‌ই আবার একটা ধাক্কা খেল ঠাম্মি। ডাক্তারবাবু ঠাম্মীকে জানায়, আমার চোখ দুটো অ্যাক্সিডেন্টে খুব বাজেভাবে এফেক্টেড। অপারেশন যদি কোনো কারনে সাকসেসফুল না হয়, তাহলে হয়ত আমি সারাজীবনের মতো দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারি।আবার ভেঙে পড়ল ঠাম্মি। কিন্তু ঈশ্বর হয়ত আমাদের আর নিরাশ করতে চাননি।তাই আমার চোখের অপারেশনটা সাকসেসফুল হয়। আর আট বছরের আমি পেলাম নতুন এক সঙ্গী – মাইনাস ছয় পাওয়ারের চশমা।চশমা ছাড়া প্রায় কিছুই দেখতে পেতাম না। তখনই বোধহয় ঠাম্মির মাথায় আইডিয়াটা ক্লিক করেছিল। হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স সবাইকে ম্যানেজ করে নিয়েছিল, আমার জন্য পাওয়ার দিয়ে কালো চশমায় বানিয়েছিল।যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে আমি দেখতে পাই।আর আমাকে কি বুঝিয়েছিল জানেন – সবার অজান্তে সবটা দেখবে রাই, কিন্তু কেউ যেন কখনো বুঝতে না পারে..”,

-“কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা, তাই না!! একদিন টিফিন পিরিয়ডে, ফাঁকা ক্লাসরুমে ড্রইং করতে গিয়ে হঠাৎই ধরা পড়ে যান ডঃ কৃষানুর কাছে।তাই তো ডঃ প্রধান!!”

মাথা নাড়লেন ডঃ কৃষানু প্রধান।

-“রাইমাকে দেখে আমি মনে মনে খুব আশ্চর্য হতাম। বাবাকে কয়েকবার জিজ্ঞেসও করেছিলাম, একজন দৃষ্টিহীন মানুষ কিভাবে এত স্বাভাবিক থাকতে পারে!বাবা বলতেন, মনের জোর থাকলে নাকি মানুষ সব পারে। কিন্তু সেদিন টিফিনে ফাঁকা ক্লাসরুমে ঢুকে দেখি রাইমা একমনে বাইরের গাছে বসা একটা পাখির ছবি এঁকে চলেছে।পা টিপে টিপে ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়াই। ছবিটার ডিটেলিং দেখেই সেদিন বুঝেছিলাম,ও দৃষ্টিহীন হতেই পারেনা, মিথ্যাচার করছে সবার সাথে।ভীষন রেগে গিয়ে ছুটির সময় ওর ঠাম্মির সাথে ছুটে গিয়েছিলাম অভিযোগ জানাতে। কিন্তু আমার মুখে সবটা শুনে ঠাম্মি ভীষন নার্ভাস হয়ে পড়েন।তারপর যদিও রাইমা আর ঠাম্মি দুজনেই আমার কাছে সেদিন সবটাই স্বীকার করেছিলেন। রাইমার জন্য ভীষন খারাপ লেগেছিল।তাই এব্যাপারে আর কাউকেই কিছু জানাইনি। বরং চেষ্টা করতাম যাতে রাইমা ধরা পড়ে না যায়।তাই সাহায্য করতাম ওকে।স্কুলে প্রায় ছায়ার মতো লেগে থাকতাম ওর সাথে”!

কথা বলতে বলতে হাঁফিয়ে উঠলেন ডঃ কৃষানু প্রধান। রাইমার চোখে টলটল করছে নোনা জল।

-“তা ঠিক কি ধরনের সাহায্য করতেন আপনি রাইমাকে?” – বেশ বাঁকা স্বরেই প্রশ্নটা করল মিলি।

ছোট্ট একটা দর্শনীয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপরাধীর মতো চোখে মিলির দিকে তাকালেন ডঃ কৃষানু প্রধান।

-“চেষ্টা করতাম, যাতে কোনো বিপদ রাইকে ছুঁতে না পারে।তাই…”,

-“তাই লন্ডনে পড়তে গিয়ে মিসেস সেনকে পরামর্শ দিলেন, চিকিৎসার জন্য রাইমাকে লন্ডনে নিয়ে আসার!যাতে স্মার্ট গ্লাস ব্যবহার করার ফলে রাইমার ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য হয়ে যায়। কি, তাই তো!!”

কোনো উত্তর দিলেন না ডঃ প্রধান।

-“আর সেই একই পন্থা অবলম্বন করেই তো আপনি এপ্রিল মাসে আবার ফোন করেছিলেন শুভেন্দু বাবুকে।ঠিক বলছি তো বঃ প্রধান!”

এবার আর চুপ করে থাকলেন না ডঃ কৃষানু প্রধান।

-“ঠাম্মি আর রাইয়ের সাথে আমি রেগুলার কন্ট্যাক্টে থাকলেও পড়াশোনার ব্যস্ততার কারণে বেশ মাস দুয়েক, কথা বলে উঠতে পারিনি কারুর সাথেই। এরমধ্যেই একদিন ঠাম্মি ফোন করে রাই আর হিমাংশুর বিয়ের কথা জানান আমাকে। সেদিনই প্রথমবারের জন্য আমি ঠাম্মিকে অনুশোচনা দগ্ধ হতে দেখেছিলাম।ঠাম্মি বুঝতে পারছিলেন, প্রতিহিংসার আগুনে রাইয়ের জীবনটা অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে।তাই ঠাম্মি রাইকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে বদ্ধ পরিকর হয়ে উঠেছিলেন।ঠাম্মি চেয়েছিলেন, আর পাঁচটা মেয়ের মতোই রাই নিজের সখ আহ্লাদের মধ্যে দিয়েই বাঁচার রসদটা খুঁজে নিক। জীবনটাকে উপভোগ করুক।আর তাই আমি উন্নত চিকিৎসার নামে রাইকে আবার লন্ডনে নিয়ে আসার প্রস্তাব রাখি শুভেন্দু বাবুর কাছে। ওনাকে বলেছিলাম, সব ঠিক থাকলে, ওখানকার উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থায় রাই হয়তো পুরোপুরি না হলেও আংশিকভাবে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে পারে”!!

নিজের অনুমান শক্তির আর ডঃ প্রধানের স্বীকারোক্তি হুবুহু মিলে যাওয়ায় একটা চওড়া হাসি ছড়িয়ে গেল মিলির মুখে।

-” আচ্ছা ডঃ প্রধান আপনার সাথে সমতার আলাপটা কিভাবে হয়েছিল”!!

।।৪৩।।

প্রশ্ন শেষে মিলি তীক্ষ্ণ নজরে ঘরে উপস্থিত সবাইকে জরিপ করতে থাকল।এহেন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে, বিস্ময়ে প্রত্যেকে শিথিলচৈতন্যের মতো মিলির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।ব্যাতিক্রম শুধু ডঃ প্রধান এবং সমতা।ডঃ প্রধানের শিরায় উপশিরায় ফুটে ওঠা আত্মগ্লানির ছাপ স্পষ্ট। নিমেষেই মিলি চোখ ঘুরিয়ে সমতাকে দেখে নিলো।সমতার ঘাবড়ে যাওয়া রক্তশূন্য মুখে ঘামের সুক্ষ রেখা।ভয় আর আতঙ্ক যেন একসাথে জড়িয়ে ধরেছে তাকে।

বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উজানের দিকে তাকিয়ে আরক্ত নয়নে গর্জে উঠল রাইমা।

-“এসব কি হচ্ছেটা কি অফিসার!কি শুরু করেছেন আপনারা!এসব ফালতু প্রশ্ন করে কি ইঙ্গিত করতে চাইছেন আপনার ডিটেকটিভ!”

-“কি হলো ডঃ প্রধান, উত্তর দিন!কবে থেকে চেনেন আপনি সমতাকে!” – রাইমার বক্তব্যকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পুলিশসুলভ কর্কশ কন্ঠে ধমক দিয়ে উঠলো উজান।

-“গতবছর রাইয়ের জন্মদিনে ওকে সারপ্রাইজ দেব বলে কাউকে না জানিয়েই দেশে ফিরেছিলাম। কিন্তু…”,

বজ্রপাত হলো যেন সেনেদের বৈঠকখানায়। নিস্তব্ধ দৃষ্টিতে ডঃ প্রধানের দিকে তাকিয়ে থাকে রাইমা।

-“তুই ডিসেম্বরে কলকাতায় এসেছিলি,অথচ আমার সাথে একবারও দেখা করিসনি! কেন কৃষ!”

মুহূর্তের বিহ্বলতা কাটিয়ে অবরুদ্ধ কন্ঠে তাকে প্রশ্ন করল রাইমা।

-“কারন এয়ারপোর্ট থেকে সোজা সেন পাবলিকেশনের অফিসে পৌঁছে কৃষানুবাবু জানতে পারেন, আপনি ততক্ষনে হিমাংশু বাবুর সাথে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছেন।আই গেজ, জন্মদিনে হবু স্ত্রীকে নিয়ে একান্তে কিছু প্ল্যান করেছিলেন হিমাংশু বাবু। তবে সেদিন আপনার কেবিনে আপনি নিজে উপস্থিত না থাকলেও কিছু জরুরী কাজ শেষ করার জন্য সমতা রয়ে গিয়েছিল।তাই না ডঃ প্রধান!!”

ডঃ প্রধানের অসম্পূর্ণ কথা দায়িত্ব নিয়ে শেষ করল মিলি।

মিলির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন ডঃ প্রধান। শূন্য দৃষ্টি। উল্টোদিকের সোফায় বসা সমতার শরীরটা যেন এক অজানা আতঙ্কে বারবার কেঁপে উঠছে।

-“হ্যাঁ ম্যাডাম, সেদিনই সমতার সাথে আমার প্রথম আলাপ হয়।যদিও রাইয়ের মুখে সমতার সম্পর্কে অনেক কথাই শুনেছিলাম। কিন্তু বছর দুয়েকের মধ্যে আমি যে কয়েকবার দেশে ফিরেছিলাম, প্রত্যেকবারই রাইয়ের সাথে, হয় ওর বাড়িতে দেখা হয়েছিল অথবা আমি ওকে বাড়ি থেকেই পিক করেছিলাম আউটিংয়ের জন্য।তাই সমতার সাথে আলাপ করার সুযোগ হয়ে উঠেনি!” – ভাঙা গলায় উত্তর দিলেন ডঃ প্রধান।

-“মানে দীর্ঘ দুবছরের সব বাধা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত রাইমার জন্মদিনে আপনার আলাপ হলো সমতার সাথে।তারপর..!”

প্রশ্নের ধরনে উজানের মুখের দিকে তাকাল সমতা। উজানের ঠোঁটে তখনও ঝুলছে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি।

-“সমতার সাথে আমার আলাপ পর্বটা খুব একটা মধুর ছিল না অফিসার।” – ক্রমাগত বাঁকা বাঁকা প্রশ্নে সমতাকে ক্রমাগত কুঁকড়ে যেতে দেখে বিরক্ত গলায় বলে উঠলেন ডঃ প্রধান।

-“আমি সেদিন যখন রাইয়ের অফিসে পৌঁছাই, সমতা ওয়াজ ক্রাইং দ্যাট টাইম। আমাকে দেখে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলেও, খুব বেশিক্ষন নিজেকে আটকাতে পারেনি।আমি ঠাম্মির থেকে রাই আর হিমাংশু বাবুর সম্পর্কের কথা বেশ কয়েকদিন আগেই জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু সমতা যেহেতু অলমোস্ট আমাদের সেম এজ থেকেই বিলং করে,তাই হিমাংশু বাবুর সম্পর্কে ওর থেকেই জানতে চাইছিলাম। সমতা সেদিন খুব ডিসটার্ব ছিল।তাই খানিকক্ষণ আমার প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও একটা সময়ে রাগে,দুঃখে উত্তেজিত হয়ে, নিজের স্লিভলেস সালোয়ারের উপরে থাকা ওড়নাটা সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে।

সমতার ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে থাকা দুই বাহুডোরে তখনও জ্বলজ্বল করছিল হিমাংশু রায়ের পাঁচ পাঁচ দশ আঙুলের ছাপ। অনেক কষ্টে ওকে শান্ত করে জানতে পারি, হিমাংশু রায়ের কুপ্রস্তাবে সায় না দেওয়ার অপরাধে ওকে প্রায়ই অফিসে এই ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়া সমতার পক্ষে সম্ভব ছিল না।কারন ওদের সাংসারিক পরিস্থিতি। তাছাড়া এখানে ও যে পরিমাণ স্যালারি পাচ্ছিল, সেটা হয়ত অন্য কোনো সংস্থাই ওকে দিতো না।তাই খানিকটা বাধ্য হয়েই মুখ বন্ধ রেখেছিল মেয়েটা। আর সেই সুযোগে হিমাংশু রায়ের অত্যাচার দিনের পর দিন বেড়েই চলেছিল। এমনকি আমার পরামর্শে রাইকে সরাসরি ব্যাপারটা না জানালেও ঘুরিয়ে জানিয়েছিল। কিন্তু রাই সেসময়ে হিমাংশু রায়ের প্রেমে এমনি হাবুডুবু খাচ্ছিল যে ব্যাপারটায় বিশেষ পাত্তা দেয়নি। এমনকি ঠাম্মাকেও হিমাংশু এমন প্রভাবিত করে রেখেছিল যে তাকেও এই কথাগুলো আমি বলে উঠতে পারিনি।সমতাকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়ে রাইয়ের সাথে দেখা না করেই সেবার লন্ডনে ফিরে যাই। কিন্তু মেয়েটার ওপর একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল।তাই..”,

-“তাই মাস দুয়েক পর সবার অজান্তে আবার দেশে ফিরলেন।তাই তো!”

বিস্ময়ে হতবাক রাইমা নিজের প্রিয় বন্ধুর দিকে তাকিয়ে রইল।ডঃ প্রধানও এই প্রথমবারের জন্য চোখ রাখলেন রাইমার চোখে ।সেই দৃষ্টিতে নেই বিন্দুমাত্র গ্লানির ছাপ ।গোটা ঘরে ছেয়ে আছে লুসিড ইন্টারভ্যাল – উন্মাদনার মধ্যে বিরাজ করা ক্ষনিক বিরতি।

#ক্রমশ

/*কমেন্ট বক্সে আগের পর্বগুলির লিংক শেয়ার করা আছে*/

© আমার ভিনদেশী তারা-amar bhindeshi tara-কলমে তমসা চক্রবর্তী
#AmarBhindeshiTara
#TamosaChakraborty
# ভালো লাগলে লেখিকার নাম সহ শেয়ার করবেন 🙏।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here