আঁধারের_গায়ে_গায়ে
তমসা_চক্রবর্তী
পর্ব-৮
।।২২।।
সকাল থেকেই শরীরটা ভাল লাগছে না রাইমার।গা’টা বড্ড ম্যাজম্যাজ করছে।তাও কষ্ট করে শরীরটাকে বিছানা থেকে টেনে তুলল। বেড সাইড টেবিল হাতড়ে চশমাটা চোখে গলিয়ে খাটের পাশে রাখা নিজের সাদাছড়িটা হাতে নিয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল রাইমা। চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে নিজের ইজি চেয়ারে বসে, টেবিলের ওপর রাখা বেলটা বাজালো।আওয়াজ পেয়ে নিচতলা থেকে বনমালী দৌড়ে এলো।
-“কিছু লাগবে দিদিমনি!কাল রাত থেকে তো কিছুই খাওনি।একটু দুধ কনফ্লেক্স আনি”!
-“না বনমালী দা,এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।তুমি বরং একটু কড়া করে চা বানিয়ে দাও।মাথাটা খুব ধরেছে”!
শুকনো মুখে উত্তর দেয় রাইমা।
-“কিন্তু দিদিমনি,খালি পেটে চা খেলে যে তোমার অ্যাসিডিটি হয়ে যায়।আমি বরং সুলেখাকে বলি তাড়াতাড়ি দুটো পরোটা করে দিতে।আগে ওটা খাও।তারপর চা এনে দিচ্ছি।কেমন”!!
ক্লান্ত শরীরে কাঁধ দুটো ঝাঁকালো রাইমা।
-“দাও যা দেবে।তবে চা’টা একটু তাড়াতাড়ি দিও। নাহলে মাথাটা ছাড়বে না”!
-“এক্ষুনি আনছি”!
কথা শেষ হওয়ার আগেই বনমালী দরজার দিকে পা বাড়ায়।তবে রাইমার পিছুডাকে আবার থামতে হলো তাকে।
-“সমতা কোথায় গো বনমালী দা!উঠে থেকে ওর কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না”!!
-“সমতা দিদি তো সকালে উঠেই আপিসে চলে গেল।সুলেখা জিজ্ঞেস করতে বলল, আপিসে আজ কিসব যেন মিটিং আছে। তবে বলে গেছে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।ওহ্ হ্যাঁ, দিদি বলে গেছে, তোমার কোনো প্রয়োজন হলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে ফোন করতে”!
-“আচ্ছা। তুমি যাও, আর চা’টা দিও তাড়াতাড়ি”!!
বনমালী চলে যেতে বিছানা হাতড়ে হাতড়ে নিজের ফোনটা খুঁজে টাচ সেন্সরে আঙুল ছুঁইয়ে ফোনটা আনলক করল।অভ্যস্ত হাতে মেপে মেপে ঠিক গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টকে খুঁজে নিয়ে ফোনের কাছে মুখটা নামিয়ে এনে রাইমা বলে ওঠে,
-“কল দাদাই”!
-কলিং দাদাই, মোবাইল- মিষ্টি গলায় গুগল নিজের কাজ শেষ করতেই রাইমা ফোনটা কানে লাগিয়ে অন্যপ্রান্ত থেকে ভেসে আসা কলার টিউনটা শুনতে থাকে।
-“হ্যালো রাই, শরীর ঠিক আছে তো এখন”!!
প্রিয়নাথ সাহার গলায় একরাশ দুশ্চিন্তা।
-“এখন ঠিক আছি দাদাই।শুধু শরীরটা একটু ম্যাজম্যাজ করছে”!
-“তুই কি এখনই উঠলি! খেয়েছিস কিছু”!!
প্রিয়নাথ বাবুকে আশ্বস্ত করে রাইমা বলে,
-“এই খাব এবার। আচ্ছা দাদাই, পুলিশ কিছু বলতে পারল! হিমাংশু হঠাৎ করে কিভাবে..”,
কথা শেষ করতে পারল না রাইমা।গলাটা ধরে এল।
-“পুলিশ তদন্ত করছে মা। চিন্তা করিস না। হিমাংশুর সাথে যদি কোনো ফাউল প্লে হয়ে থাকে তবে আততায়ী ঠিক ধরা পড়বে।তবে যতক্ষন না সবকিছু জানা যাচ্ছে,তোকে কিন্তু একটু সাবধানে থাকতে হবে”।
-“হুম” – চোখের জল মুছে অস্ফুটে বলে রাইমা।
-“বেশ।এখন খাওয়া দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নে। আমার একটা মিটিং আছে সি এমের সাথে। সেটা শেষ করে আমি বিকেলের দিকে আসব,কেমন! রাখি তাহলে এখন”!
ফোনটা রেখে রাইমা শরীরটাকে ইজি চেয়ারে এলিয়ে দিতেই বনমালী পরোটার থালা হাতে ঘরে ঢুকল।থালাটা রাইমার হাতে দিয়ে, আমতা আমতা করে বলে,
-“দিদিমনি একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে নিচে এস। পুলিশের দুজন লোক এসেছে। তোমার সাথে দেখা করতে চাইছে”!
এটাতো হওয়ারই ছিল।ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে রাইমা বলল,
-“ওনাদের নিচের ঘরে বসাও।বল আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি”!
।।২৩।।
হাতে সাদাছড়ি,চোখে বাদামী চশমা, অবিন্যস্ত খোলা চুলে বিধ্বস্ত চেহারার রাইমাকে একঝলক দেখলে যে কেউ উপলব্ধি করতে পারবে, মেয়েটার মনের ওপর দিয়ে কি প্রবল ঝড় বয়ে যাচ্ছে।রাইমাকে হিসেব কষে একটার পর একটা সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে দেখে মিলি এগিয়ে গেল। অজানা হাতের স্পর্শে থমকালো রাইমা।
-“আপনি”!!
-“আমি অহনা। অহনা গঙ্গোপাধ্যায়। প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর”!!
-“প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর!! কিন্তু আমি তো জানতাম, পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ হিমাংশুর মৃত্যুর তদন্ত করছে।তাহলে আপনি”!
মিলির পরিচয় বিস্মিত করল রাইমাকে।খানিকটা আশ্চর্যও বটে।
-“নমস্কার মিস সেন।আমি উজান।এসিপি উজান রায়।ক্রাইম ব্রাঞ্চ।আর অহনা ক্রাইম ব্রাঞ্চের তরফ থেকেই রিক্রুটেড ম্যাডাম। হিমাংশু রায়ের মৃত্যুর তদন্তে আমাদের সাহায্য করছে”!!
অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা উজানের সহজাত পুলিশি গাম্ভীর্য অনুভব করে মৃদু হাসল রাইমা।
-“মিস গঙ্গোপাধ্যায়, থ্যাঙ্ক ইউ ফর ইওর কনসার্ন। কিন্তু বিনা দৃষ্টিতেও এবাড়ির আনাচকানাচ আমার নখদর্পণে। আমার ঠাম্মির এতগুলো বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে আমি কিন্তু যথেষ্ট স্বনির্ভর”!
নিজের প্রতি এক দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় ঠিকরে পড়ছে রাইমার কথায়। মিলিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সোফার দিকে এগিয়ে গেল রাইমা।পিছন পিছন মিলি এসে বসল উজানের পাশে।
-“বনমালী দা, ওনাদের জন্য চায়ের বন্দবস্ত করো”!
গলা উঁচিয়ে নির্দেশ দেয় রাইমা।
-“আসলে কাল আপনার শরীরটা ঠিক ছিল না বলে আপনার সাথে আর কথা বলে ওঠা হয়নি।তাই আজ আসতে বাধ্য হলাম।আপনি প্লিজ ব্যস্ত হবেন না মিস সেন”!
-“ব্যস্ততার কিছু নেই এসিপি রায়।সকাল থেকে শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে, তারসাথে মাথাটাও বাজেভাবে ধরে আছে। তাই আপনাদের সাথে সাথে আমারও এক কাপ চা জুটে যাবে”!
উজানের কথার প্রত্যুতরে মলিন মুখে জবাব দেয় রাইমা।
-“মিস সেন, আপনাদের পরিবারে এত কম সময়ে অনেকগুলো দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। এই বিষয়ে আপনার কিছু বলার আছে”!
একটা উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাইমা।
-“কি বলব বলুন তো!কয়েকদিন ধরে ঠাম্মির প্রেশারটা আপ ডাউন করছিল।ডাক্তারও দেখানো হয়েছিল। কিন্তু ওষুধপত্রের প্রতি ঠাম্মি বরাবরই ভীষনরকমের উদাসীন।কখনো ওষুধ খেত আবার কখনো খেত না।আমি মনে করাতে গেলে সবসময় বলত,এত চিন্তা করিসনা।আমি ওষুধ খাচ্ছি ঠিকঠাক।
কিন্তু সেদিন মাথাঘুরে পড়ে যাওয়ার পর বুঝেছিলাম,ঠাম্মি বরাবরই আমাকে মনভোলানো কথা বলত। ঠাম্মির এই উদাসীনতা শেষ পর্যন্ত ঠাম্মিকে আমার থেকে কেড়েই নিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ হয়ে গেল জানেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়টুকু পর্যন্ত দিল না”!
হুহু করে কান্নায় ভেঙে পড়ল রাইমা।
-“শক্ত হন মিস সেন। আপনার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি। এই মুহূর্তে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু আমরাও তো অপারগ, বুঝতেই তো পারেন। আপনার সাহায্য ছাড়া তদন্তের অগ্রগতি একেবারেই অসম্ভব”!
রাইমার কান্নায় উজান বেশ অপ্রস্তুত হয়ে যায়।
-“আই অ্যাম রিয়েলি ভেরি সরি।আসলে আমি ছোট থেকেই ঠাম্মির ভীষন ক্লোজ ছিলাম।আর বাবা মাকে হারানোর পর তো আমার গোটা জগৎটাই ঠাম্মি ছিল।তাই ঠাম্মির এভাবে চলে যাওয়াটা এখনো ঠিক মেনে নিতে পারছি না”!
চোখের জল মুছে নিজেকে সামলানোর আপ্রান চেষ্টা করলেও গলাটা এখনও মাঝেমাঝে কেঁপে উঠছে রাইমার।
-“আচ্ছা মিস সেন, আপনার ঠাম্মির মৃত্যুর সময় কি আপনি বাড়িতেই ছিলেন”!!
-“হ্যাঁ। শনিবার ছিল।দুপুরেই ফিরে এসেছিলাম অফিস থেকে”।
সংক্ষেপে জবাব দেয় রাইমা।
-“সেইসময় বাড়িতে আর কে কে ছিলেন”?
-“দাদান, বনমালী দা,সুলেখা দি আর হিমাংশু”- একটু ভেবে নিয়ে আবার বলল -“হ্যাঁ, এই চারজনই ছিল”।
-“আর সমতা ম্যাডাম! উনি ছিলেন না বাড়িতে”!!
মিলির প্রশ্নে সংক্ষেপে জবাব দিলো রাইমা।
-“না, ও ছিল না বাড়িতে। কারন তখন তো সমতা এইবাড়িতে থাকত না”!
-“আচ্ছা, হিমাংশু বাবুর সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল সেব্যাপারে যদি একটু বলেন”!
হিমাংশু রায়ের প্রসংঙ্গটা উঠতেই রাইমার শিরায় উপশিরায় বিদ্যুতের মতো প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রনাটা ছড়িয়ে পড়ল। তবুও নিজের মনের ওপর যথাসম্ভব সংযম রেখে বলতে শুরু করল।
-“হিমাংশুর সাথে আমার প্রথম আলাপ সেন পাবলিকেশনের অফিসে।ওর পান্ডুলিপি আমাদের পছন্দ হওয়ায় দাদান ওকে ডেকে পাঠিয়েছিল। তখনই পরিচয়।ওর প্রথম বইটাই বেস্টসেলার হয় সেবার বইমেলায়।তারপর থেকে প্রায়ই আসত আমাদের অফিসে। কখনো নতুন পান্ডুলিপি জমা করতে,কখনো প্রচ্ছদ ফাইনাল করতে,কখনো রয়ালটি কালেক্ট জন্য তো আবার কখনো এমনি এমনিই”!
-“এমনি এমনিই”?
রাইমা থামতেই প্রশ্ন করল উজান।
-“হ্যাঁ এমনি এমনিই। অফিসে আসত, আমার সাথে খানিকক্ষণ গল্পগুজব করত, তারপর দাদানের সাথে দেখা করে ফিরে যেত। যত দিন এগিয়েছে, হিমাংশুর কথাবার্তায় ততই আমার প্রতি, ওর দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। মিথ্যে বলব না, ওর সাথে সময় কাটাতে,গল্প করতে আমারও ভাল লাগত।ও চলে যাওয়ার পরও বুঝতে পারতাম, সেই ভালোলাগার রেশ রয়ে যেত আমার সমগ্র সত্বায়।যদিও আমার আর হিমাংশুর এই মেলামেশা আর ক্রমবর্ধমান সান্নিধ্য ঠাম্মি আর দাদানের নজর এড়ায়নি।আর আমিও কখনো ঠাম্মির কাছে আমাদের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করিনি।
এরপর একদিন দাদান আমার ঘরে আসে, ঠাম্মিকে নিয়ে। খুব অবাক হয়েছিলাম সেদিন।দাদান আর ঠাম্মিকে শেষ কবে একসাথে দেখেছিলাম ঠিক মনে করতে পারিনি। খুব সম্ভবত বাবা মা থাকাকালীন দুজনকে শেষ একসাথে দেখেছিলাম। সেদিন দাদান আমায় বলেছিল, আমি যদি হিমাংশুকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পছন্দ করে থাকি, তাতে ঠাম্মি বা দাদান কারোরই কোনো আপত্তি নেই।তবে শর্ত একটাই। হিমাংশুকে সারাজীবনের জন্য এই সেন বাড়িতেই থাকতে হবে”!
-“ঘর জামাই”!! বেশ হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলায় উজান।
-“হ্যাঁ,ঘরজামাই।দাদানের যুক্তি ছিল,ওতো একপ্রকার অনাথ।শ্যামবাজারে একটা বাড়িতে পেইন গেষ্ট হিসেবে থাকে।ওর তো এখানে থাকতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথাই নয়। কিন্তু এই প্রসঙ্গে দাদান নিজে হিমাংশুর সাথে কথা বলতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। তাই হিমাংশুকে এবাড়িতে থাকার ব্যাপারে রাজি করানোর গুরু দায়িত্ব এসে পড়ল আমার উপর।এইব্যাপারে হিমাংশুর সাথে কথা বললে,ও প্রথমে তীব্র আপত্তি জানায় আমার প্রস্তাবে। কিন্তু দাদান ছিল নিজের সিদ্ধান্তে অনড়।সেন বাড়িতে এসে না থাকলে এই বিয়ে হবে না। এমনকি হিমাংশু রায়ের আর কোনো বইও সেন পাবলিকেশন ছাপবে না বলেও তাকে জানিয়ে দিয়েছিল দাদান। অবশেষে আমার অনেক অনুরোধের পর, আমাকে সেই প্রথমবার ভেঙে পড়তে দেখে নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে হিমাংশু। বলতে পারেন খানিকটা বাধ্য হয়েছিল।ও আসলে আমাকে কোনোভাবেই কষ্ট দিতে চাইতৈ না।তাই মাসতিনেক আগে আমাদের বাগদানের দিনই পাকাপাকি ভাবে এই সেনবাড়িতে শিফ্ট করেছিল হিমাংশু। সামনের মাসের দশ তারিখ আমাদের বিয়ের ডেটও ফিক্সড হয়েছিল। কিন্তু তারপর ঠাম্মির মৃত্যুতে আমাদের সবার ওপর দিয়েই একটা ঝড় বয়ে যায়।আমি চাইনি ঠাম্মির বাৎসরিকের আগে কোনো নতুন বন্ধনে নিজেকে জড়াতে। তাই বিয়েটা পোস্টপন্ড করে দিই। কিন্তু তারপর দাদানের আচমকা চলে যাওয়াটা আমাদের আরও একবার নাড়িয়ে দিল।দাদানের মৃত্যুর সাথে আমার মাথার ওপর থেকে শেষ ছাতাটাও সরে গেল। আমার মনের অবস্থা আর পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে দাদানের কাজের পর দাদাই, মানে আপনাদের এম.এল.এ সাহেব হিমাংশুকে একান্তে অনুরোধ করে, অন্তত অগাষ্টের দশ তারিখে রেজিষ্ট্রিটা করে নেওয়ার জন্য।নাহলে পাঁচজনে হয়ত পাঁচ কথা বলবে যেটা আমাদের জন্য খুব একটা ভালো হবে না। হিমাংশুর এখানে থাকাটা নিয়েও হয়ত কুৎসা রটতে পারে।তাই ও আর না করেনি। আমিও ভেবে দেখলাম, দাদাই হয়ত ঠিক কথাই বলছে।তাই রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু কপালে সুখ লেখা না থাকলে সে কপালে পাথর ঠুকেই বা কি লাভ! আমার বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনকেও ভগবান নির্দয়ভাবে আমার থেকে কেড়ে নিল।কত বয়স ছিল ওর বলুন তো!একটা তরতাজা প্রাণ এভাবে.…”,
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না রাইমা। এতক্ষন বহুকষ্টে সংযত আবেগ উতপ্ত বারিধারার মতো ঝরে পড়তে থাকে তার চোখ থেকে।রাইমাকে এই অবস্থায় দেখে মনটা ভারি হয়ে এলো উজানের।আড়চোখে একঝলক মিলির দিকে তাকাল। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে আছে মেয়েটা। মাঝেমাঝেই ভীষন অচেনা লাগে মিলিকে। এমনিতে ভীষন আবেগপ্রবণ তবুও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভীষন উন্নাসিক।কি ভাবছে কে জানে!
-“আচ্ছা রাইমা,হিমাংশু বাবু কি কোনোরকম মানসিক অশান্তিতে ভুগছিলেন”!
মিলির প্রশ্নের আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পড়ল রাইমা। চোখের জল মুছে উত্তেজিত কন্ঠে বলে ওঠে,
-“মানসিক অশান্তি! কি বলছেন আপনি! হিমাংশু কেন মানসিক অশান্তিতে থাকবে”!
-“নাহ্,যদি তাই হয়,তাহলে উনি নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খেতেন কেন”!!
এবার খানিকটা স্বস্তির শ্বাস নিল রাইমা।
-“ঠাম্মি চলে যাওয়ার পর থেকে ও মাঝেমাঝে খুব ভয় পেত।বিশেষ করে রাতের বেলায়।বলত, বারেবারে মনে হয় ঠাম্মি যেন ওর আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।আসলে ঠাম্মিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য যখন অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয় ওর কোলে মাথা রেখেই তো ঠাম্মি পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছিল!তাই হয়ত অবচেতন মনে সবসময় ঠাম্মির জন্য একটা ভাবনা কাজ করত।ডাক্তার দেখানোও হয়েছিল। তখনই ডাক্তার ওকে রাতে একটা করে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলেন”!
-“হুম্। কিন্তু রাইমা, হিমাংশু বাবুর পোস্ট মর্টেমে ওনার ব্লাডে অস্বাভাবিক মাত্রায় অ্যালপাজোলামের ট্রেস পাওয়া গেছে।এরমানেটা বুঝতে পারছেন? উনি মৃত্যুর আগে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন এটা স্পষ্ট। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন”!!
মিলির সুতীক্ষ্ণ প্রশ্নতীরের ফলা বিদ্ধ করতে থাকে রাইমাকে।অসহায় গলায় প্রশ্ন করে মিলিকে।
-“আপনি কি বলতে চাইছেন হিমাংশু আত্মহত্যা করেছে! কিন্তু দ্যাটস ইমপসিবল। হিমাংশুর মতো একটা ছেলে হঠাৎ করে আত্মহত্যা করতে যাবেই বা কেন”?
মিলির প্রশ্নবান সামলে ঘুরে দাঁড়াতে একটু সময় নিল রাইমা। অদ্ভুতভাবে মিলি প্রসঙ্গাতর ঘটিয়ে রাইমাকে বলে ওঠে,
-“আমরা একটু সমতা আর আপনার ঘরটা দেখতে চাই ম্যাডাম।সম্ভব হলে মিসেস সেনের ঘরটাও”।
এতক্ষন মিলির প্রশ্নবানে জর্জরিত রাইমার চোখে দপ করে যেন আগুন জ্বলে উঠলো।চোয়ালে চোয়াল চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্ন করল,
-“সার্চ করতে চাইছেন যে, সার্চ ওয়ারেন্ট এনেছেন ম্যাডাম প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর”!!
রাইমার দিকে একটা কুট হাসি ছুঁয়ে দিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে তার হাতে তুলে দিল মিলি।
-“অবশ্যই এনেছি।এই নিন।এবার আশা করি আপনার আর কোনো অসুবিধা নেই রাইমা”!!
কাগজটায় দুবার হাত বুলিয়ে মিলির গলার স্বর থেকে ওর বসার জায়গাটা আন্দাজ করে সেদিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করল রাইমা।
-“বনমালী দা, বনমালী দা..”!!
রাইমার রুক্ষ কন্ঠে তড়িঘড়ি ছুটে আসে বনমালী।
-“ডাকছো দিদিমনি”!!
-“এনাদের ওপরে নিয়ে যাও।ওনারা ওপরের ঘরগুলো সার্চ করতে চান। তুমিও থেকো ওনাদের সাথে”! – তারপরই মিলি আর উজানের উদ্দেশ্যে বলল -” ওর সাথে যান।আশা করছি আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না”!!
মিলি একদৃষ্টিতে রাইমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রাইমার মুখের অভিব্যক্তি তার মনের ভাব সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে, কেউ জোর করে ওকে গরল পান করিয়ে দিয়েছে। বেচারি না পারছে গিলতে না পারছে উগরাতে।মিলি ক্ষীন হেসে উজানকে সঙ্গে নিয়ে বনমালীকে অনুসরণ করল।
ওদের প্রস্থান উপলব্ধি করে মাথাটা আর ঠিক রাখতে পারল না রাইমা।হাতের কাগজটা দুমরে মুচরে ফেলে দিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে দাদাইয়ের নম্বরটা ডায়াল করার নির্দেশ দিল গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টকে।
#ক্রমশ
/*কমেন্ট বক্সে আগের পর্বগুলির লিংক শেয়ার করা আছে*/
© আমার ভিনদেশী তারা-amar bhindeshi tara-কলমে তমসা চক্রবর্তী
#AmarBhindeshiTara
#TamosaChakraborty
# ভালো লাগলে লেখিকার নাম সহ শেয়ার করবেন 🙏।