#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_১৭
” আমি বিবাহিত! ভুলেও আমায় স্পর্শ করবেন না পূর্ব ভাইয়া।”
তুলির কঠিন স্বরে উচ্চারিত বাক্যটা ঝংকার তুলে উপস্থিত সকলের শ্রবণ গ্রন্থিতে প্রবেশ করল। বিমূর্ত দৃষ্টিতে চকিতে তাকাল দু’জন মানুষ। বাকি সবার মুখের ভঙ্গিমা চিন্তিত, নিরলস হলেও পূর্ব, আশফিয়া চৌধুরীর মুখে অবাকতার ছাপ। পূর্ব নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না তুলির কথাটুকু। বুকের কোথাও একটা অংশে চিনচিন করে ব্যাথা অনুভব করল পূর্ব। ব্যাথা টা ক্রমশ বেড়ে বিস্তার করে চলেছে হৃদপিণ্ডের কানায় কানায়। বাড়ন্ত হাত টা গুটিয়ে নিল তড়িৎ বেগে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
” তুমি মজা করছো তাই না তুলি?”
” না মজা করছি না আমি। ”
ভেজা কন্ঠে বললো তুলি। চোখের কার্ণিশে জল জমে আছে,যেকোনো মুহুর্তে গড়িয়ে পড়বে। গলায় আঁটকে থাকা অশ্রু টুকু ঢুক গিলে,তেজী স্বরে বললো,
” আপনারা কিভাবে এমনটা করতে পারেন দাদী?আমি বয়সে ছোটো হতে পারি আপনাদের থেকে তাই বলে কি আমার মতামত প্রয়োজন নেই?বাড়িতে আসা মেহমানদের সাথে বুঝি আপনারা এমন আচরণ করেন?বিয়ে কি ছেলে খেলা যে ধরে বেঁধে আমায়, আমার অভিভাবকের অনুমতি বিহীন রিং পড়িয়ে মোহরানা লাগিয়ে দিবেন? আমার বাবাই-মা,শশুর -শাশুড়ী কাউকেই আপনি কথা বলার সামান্য সুযোগ টুকু দেন নি দাদী। বাবা আপনাকে বুঝিয়ে ভদ্রতার সহিত বলতে চাইছিল কিন্তু সেই সুযোগ টুকুও ওনাকে দেওয়া হয় নি। আপনি নিজের মতো করে অন্যের মতামত ভেবে নিতে পারেন না। গল্প,সিনেমার মতো ধরে বেঁধে বিয়ে দেওয়ার অধিকার আপনার নেই। যদিও আমাদের প্রত্যেকের জীবনের কোনো না কোনো অংশে গল্প,উপন্যাসের পাতার সাথে মিলে যায়, তাই বলে এই না যে বিয়ে নাম পবিত্র বন্ধন নিয়ে আমার সাথে অন্যায় করবেন।
এটুকু বলে সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল তুলি। আজ সাহস যেন তার আকাশচুম্বী। তুলি নিজেও অবাক এতো সাহস তার মধ্যে কোথা থেকে এলো। শুধু এতটুকু বুঝতে পারল এই সাহস এমনি এমনি আসে নি। কারণ একটাই!এবং তা হলো ‘আদ্র’। আদ্রর সঙ্গ। আদ্রর সঙ্গতা তুলির উপর বিশেষ প্রভাব ফেলছে।আদ্রর প্রতিবাদী সোচ্চার রূপ তুলি নিজের অজান্তেই কিছুটা হলেও নিজের মাঝে ধারণ করে নিয়েছে। কই আগে তো তুলি ভীতু প্রকৃতির একটা মেয়ে ছিল। স্কুল জীবনে রাস্তায় কোনো ছেলে সামনে এসে পথ আটকালে থরথর করে পায়ের তলা কাঁপত তার। ছোট্ট দেহের হৃদপিণ্ড যেনো তখন আরো ছোট্ট হয়ে যেত। আজ তুলির কিছুতেই ভয় হচ্ছে না। ভয়,লজ্জা, জড়তা,ভালোবাসা সবটুকু স্রেফ আদ্রর জন্যই গচ্ছিত। তুলি কন্ঠ খাদে নামিয়ে, কোমল স্বরে বলে উঠল,
” ক্ষমা করবেন আমাকে। কিন্তু আপনার কাজ কর্ম আমাকে এতোটা ক্ষেপে যেতে বাধ্য করল দাদী। ইনশিতা আপুর শশুড় বাড়িতে এমন ধরনের বেয়াদবি অথবা সিন ক্রিয়েট করার কোনো ইচ্ছে ছিল না আমার। আপনার ও পূর্ব ভাইয়ার কাছ থেকে আমি এমনটা একদম আশা করি নি। শুধু একটা বার আমাদের কিছু বলতে দিতেন তাহলে এমনটা হতো না। আমি সত্যিই আপনার কাছ থেকে আমি এমন টা আশা করি নি পূর্ব ভাইয়া।”
পূর্বর দিকে তাকিয়ে শেষ কথাটা বললো তুলি। পূর্বর চোখে জলের ছাপ স্পষ্ট। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বললো,
” আমাকে ক্ষমা করে দিও তুলি। আর দাদী আমার জন্য একটু বেশিই ডেস্পারেট। তোমার পিছনে দাঁড়ানো ব্যক্তিই কি তোমার বর?”
পূর্বর কথায়, চোখের ইশারায় তুলি দ্রুত গতিতে পিছন ফিরে চাইল। চক্ষে বিধঁল আদ্রর হাসি মুখের মাদকতায় ভরপুর চেহারা। তুলির অন্তস্থল কেঁপে উঠল আদ্রর প্রগাঢ় দৃষ্টিতে। পাক্কা তিনদিন পর মানুষ টা কে জলজ্যান্ত দেখার সৌভাগ্য অর্জন হলো তার। আদ্রর কর্ণকুহরে কোনো কথা যায় নি তো?ভয়ে তটস্থ হয়ে গেল তুলি। ভীত-সন্ত্রস্ত মনে জাগল-” তুলকালাম না বাঁধিয়ে দেয় আদ্র!” পকেটে হাত গুঁজে তুলির থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল আদ্র। শুধু যে ভয় হচ্ছে তেমন না,তুলির ভীষণ লজ্জাও অনুভূত হচ্ছে। সাহসের ঝুলি বুঝি আদ্রর সামনেই খুলতে হলো!আদ্র বড় বড় পা ফেলে তিন কদম হেঁটে এসে তুলির খানিকটা পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। পূর্বর দিকে চেয়ে তুচ্ছার্থক হেসে বললো,
” ইয়েস! শি ইজ দ্যা ওয়াইফ অফ ডা.আদ্র আহনাফ। ”
ভালোবাসা! শব্দ টা মধুর হলেও এতো কষ্ট অনুভব হচ্ছে কেন পূর্বর?তবে কি এই মেয়েকে ভালোবাসার আগে চোটের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত ছিল তার?কোনো প্রকার শব্দ বিহীন পূর্ব প্রস্থান করল ঘর থেকে। তুলির পাশে আদ্রর অনুপস্থিতি কাটার মতো বিঁধছিল তার দেহের সর্বাঙ্গে। রাদিফ সাহেব এগিয়ে এসে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই, থামিয়ে দিল আদ্র।
” আমি সবটাই স্বচক্ষে দেখেছি বাবা। আমার ধৈর্য জল গড়ানোর রেখা অব্দি সীমাবদ্ধ । বেশি গড়িয়ে গেল পরিণাম অথবা পরিণতি যেটাই বলা হোক তা কারো কারো জন্য ভয়ংকর হতো,বিনাশ কৃত রূপ ধারণ করতো।”
অলক্ষ্যে -অগোচরে আদ্রর থ্রেট মূলক বাক্যে ঢুক গিলল আশফিয়া চৌধুরী। কতোদিন পর প্রেমিক পুরুষের দেখা মিলল,অথচ এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হলো নিজের দোষে। আশফিয়া চৌধুরী ভাবেন নিজের দাম্ভিকতা,ক্ষমতার জোরে তিনি সবাইকে কাবু করতে পারবেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই মন মানসিকতা বেড়েই চলেছে। সাইকিয়াট্রিস্টের মতে,তিনি মানসিক রোগে ভুগছেন,যার প্রভাবে তিনি অন্যের উপর নিজের মর্জি চালাতে পিছুপা হন না। আশফিয়া চৌধুরীর লুকোচুরি করে ভয়ের চোটে ঢুক গিলা টা আঁড়চোখে পর্যবেক্ষণ করল আদ্র। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল মুহুর্তেই। রাদিফ সাহেবকে লক্ষ্য করে বললো,
” আপনি সবাইকে নিয়ে নিচে যান বাবা। এতোদিন পর দেখা আশফিয়া চৌধুরীর সাথে,একটু কুশলাদি বিনিময় না করলে কি হয়?আপনি যান আমি একটু কথা বলে আসি।”
নিরবতা ছেয়ে গেল রুমে। আশফিয়া চৌধুরী শুষ্ক ঠোঁট দুটো জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিল। পূর্বর জন্য ওনার বুকটা হাহাকার করছে।আদ্র আশফিয়া চৌধুরী কে তীর্যক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” কেমন আছো আশফি?”
“ভালো! আপনি কেমন আছেন ডাক্তার?”
“ভালো আর থাকতে দিলে কই?যেভাবে আমার বউ নিয়ে তুমি টানাটানি শুরু করলা,শান্তি তো আমার বিনষ্ট করে দিলে। তিনটে দিনের জন্য দূরে যেতে না যেতেই তোমরা দাদী,নাতি মিলে আমার বউ কেঁড়ে নেওয়ার যুদ্ধ নেমেছিলে। আমার বউয়ের ক্ষেত্রে যুদ্ধে আমি হাজার বার জয়ী হবো। দরকার হলে তোমাকেও হাসিল করে নিব। কিন্তু তোমায় দিয়ে খুব একটা লাভ হবে না, উল্টো কেইস খেয়ে যাবো। বুঝলে বুড়ি?”
রসাত্মক স্বরে কথাগুলো বলে তুলির এক হাত টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল আদ্র। লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল তুলির মুখশ্রী। আশফিয়া চৌধুরী কেমন চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে,তুলির নজরে পড়তেই হাত ছাড়ানোর জন্য বৃথা চেষ্টা চালাল। আদ্রর বলিষ্ঠ হাতের কাছে তুলির শক্তি পিঁপড়ের মতো হলেও তুলি হাত মুচড়াতে লাগল অনবরত। শেষমেশ নীলাভ চোখের অগ্নি তেজে নিভে গেল তুলি। পরাজয় ঘটল সঞ্চিত সাহসের। আশফিয়া চৌধুরী চোখ কুঁচকে লাজুক স্বরে বললেন,
” বুঝি নি ডাক্তার।”
রীতিমতো অবাক হলো তুলি। মনে আগুনের শিখা জ্বলে উঠলো। ‘ বুড়ির ভাব দেখলে তো মনে হয় বুড়ি এ বয়সে আমার জামাইয়ের উপর ক্রাশ খেয়েছে। চোখ খুলে ফেলবো বুড়ি,আমার ডাক্তার সাহেবের দিকে নজর দিলে।” মনে মনে কথাগুলো বলে তুলি ক্ষান্ত হলো। ঠোঁটের কার্ণিশে বাঁকা হাসি টেনে বলে উঠল আদ্র,
” আমার বউ কে দেখেছো আশফি?আর তুমি নিজেকে দেখেছো?বউ কে আদর করলে লজ্জায় মাথা তুলতে ভুলে যাবে,মোমের মতো গলে পড়বে আমার প্রশস্ত বক্ষে। আর তোমায় করলে তোমার শ্বাস টাও চলবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহবান আমি। জেলের খাটুনি চাই না। বুড়ির চেয়ে অষ্টাদশী বউ আমার ঢেড় ভালো।”
চোখ কপালে ঠেকেছে তুলির। আদ্র লাগামহীন কথায় কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। কথার মাঝে আদ্র কী বুঝিয়েছে তুলির অবুঝ মন আজ বিচক্ষণ ব্যক্তির ন্যায় এক নিমিষেই ধরতে সক্ষম। মনে মনে হাজার বার আদ্র কে অসভ্য,নির্লজ্জ ধাঁচের মানুষ বলে অভিহিত করে ফেললো। অথচ সামনে উপস্থিত আশফি চৌধুরী নির্লজ্জ হয়ে লজ্জালু গলায় বললো,
” কী যে বলেন না ডাক্তার! আমি আপনার বউ থাইক্কা ও সুন্দর আছি।”
আদ্র তুলির দু’হাত নিজের হাতে নিয়ে আলতোভাবে আশফি চৌধুরীর দেওয়া হাতের বালা দুটো খুলে নিল। সেদিকে কোনো হদিস নেই তুলির। সে তো মনে মনে ফুঁসছে। হঠাৎ আদ্রর স্বর কর্ণপাত হতেই তুলি লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নত করে ফেলল ঝটপট। কানে বাজলো, –” আমার চোখে তুমিই ভীষণ সুন্দর তুলা।”
বালা দু’টো হাতে নিয়ে আদ্র আশফিয়া চৌধুরীর হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বললো,
” আমার তুলার হাতে কাঁচের চুরি বেশ মানায়,তোমার স্বর্ণের বালা নয়। কারণ তোমার স্বর্ণের বালার সেই রিমিঝিম আওয়াজ নেই,যেই আওয়াজ কর্ণে প্রবেশ করে ঠিক আমার বুকের বা পাশে গিয়ে বিঁধে। তোমার বর কে যদি কেউ কেড়ে নিতে চাইত তুমি কি করতে?”
আশফিয়া চৌধুরীর হাতটা ছেড়ে দিয়ে উত্তরের অপেক্ষায় ঠাঁই দাড়িয়ে রইল আদ্র। ভ্রু যুগল কুঁচকে আছে কিঞ্চিৎ। আশফিয়া চৌধুরী স্বভাবে একটু ত্যাড়া হলেও স্বামী কে ভালোবাসতেন খুব। থমথমে গলায় জবাব দিল,
” কেটে কুঁচি কুঁচি করে মশলা মাখিয়ে জলে ভাসিয়ে দিতাম, যদি কোনো ফকিন্নি সোয়ামীর উপর নজর দিতো!”
রহস্যময় হাসি হাসল আদ্র। আশফিয়া চৌধুরীর দিকে হালকা ঝুঁকে নিচু স্বরে বললো,
” আমি কাটবো না, জলেও ভাসাবো না। কিন্তু আমার তুলার দিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করলে দেহাবশেষের অস্তিত্ব টুকুও থাকবে না। হয় নাতিকে শোধরানোর চেষ্টায় নামো,নাহয় আমার স্টেপ নেওয়ার অপেক্ষা করো আশফি। ডাক্তার হয়ে যেমন হার্টের চিকিৎসা করতে পারি,তেমনি টেনে হিঁচড়ে হৃদপিণ্ড বের করে নিতে জানি।”
#চলবে,,,,!
(ভুল -ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গতকাল গল্প দিতে পারি নি সেজন্য দুঃখিত। সামনে প্র্যাক্টিক্যাল এক্সাম, তাই সবগুলো খাতা এতো শর্ট টাইমে রেডি করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। লং গ্যাপ দিলে আপনারাও গল্প পড়ার মজা হারিয়ে ফেলবেন তাই চেষ্টা করি নিয়মিত দেওয়ার। প্র্যাক্টিক্যাল খাতাগুলো নিয়ে ব্যস্ত তাই কারো কমেন্টের রিপ্লাই পর্যন্ত দিতে পারছি নি। আমার উপর কেউ রাগ করবেন না প্লিজ। ইনশাআল্লাহ আমি নিয়মিত গল্পটা দেওয়ার চেষ্টা করব।)