আনকোরা পর্ব-১৩

0
2809

#আনকোরা
#রূবাইবা_মেহউইশ
১৩.

সময়ের বেপরোয়া ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে একটা পুরনো সম্পর্ক। খুব পুরনো না হলেও সে ন মাস পুরনো ছিলো। অভ্র আর চৈতী বিচ্ছেদের দাবানলে ঝলসে গেছে গতকালের গৌধূলি বেলায়। অভ্র যখন দিহানকে ডিভোর্সের কথা বলছিলো তখন চৈতীও ছিলো তাদের সামনে। অভ্র মা’কে সি এন জিতে বসিয়ে রেখে এসেছিলো। অভ্রের মা খুশি মনেই ভাবছিলেন মেয়েটাকে দারুণ মানাবে তার অভ্রের পাশে। ভাবতে ভাবতেই নিজের গলায় হাত দিলেন। খুব শখের চেইনটা আজ পরে এসেছিলেন শাড়ির সাথে। আজ না হয় কাল এই চেইনটা তিনি অভ্রের বউকেই দিতেন। তাই ভাবলেন আজই পরিয়ে দিলে কেমন হয়! অভ্র খুব খুশি হবে নিশ্চয়ই! গলা থেকে চেইনটা খুলে সি এনজি থেকে নেমে গেলেন। রেস্টুরেন্টের কাঁচের দরজা খুলতেই তিনি শুনতে পেলেন অভ্রের গলা।
“তোমাদের ডিভোর্সটা তো এখনো হয়নি। তাই,,”

অভ্রের মা কথাটা শুনে চমকে যান। কার ডিভোর্সের কথা বলছেন তিনি! মনে সন্দেহ দানা বাঁধতেই তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে যান। আর এর পরের যেটুকু কথা শুনেছেন তাতেই বুঝতে পারেন দিহান আর চৈতী স্বামী-স্ত্রী। দুনিয়া দেখেছেন তিনি সম্পর্কের মূল্যও খুব বোঝেন৷ ছেলের খুশি ভেবেই তো এসেছিলেন চৈতীকে আপন করতে কিন্তু তাই বলে একটা বিবাহিত মেয়েকে কি করে মানবেন! এরা কি বিয়েটাকে ছেলে খেলা মনে করে? আর দেরি না করে এগিয়ে যান তিনি৷ তাকে দেখেই দিহান ক্ষোভে ফেটে পড়ে অভ্রের ওপর। সে এতক্ষণ এই ভয়টাই পাচ্ছিলো বলে অভ্রকে ফোনে কথা বলতে বলেছে কিন্তু অভ্রের ভাগ্যরেখায় আগেই বুঝি মুছে গেছে চৈতীর নাম। তাইতো এমন বোকার মত সে এই সময়েই ডিভোর্সের কথা তুলল। আবার এর অন্য অর্থও ধরা যায়, হয়তো তাদের বিচ্ছেদ হবে বলেই আজ সে এ কথা তুলেছিলো। হতে পারে ডিভোর্স একটা উছিলা মাত্র। অভ্রের মা রেস্টুরেন্ট ভর্তি লোকের সামনেই চেঁচিয়ে প্রশ্ন করেন, চৈতী বিবাহিত কিনা? অভ্র সত্যি স্বীকার করতেই তিনি আবারও প্রশ্ন করেন, “চৈতীর স্বামী কি দিহান!”

অভ্র এটাও স্বীকার করে আর তারপরই অভ্রের মা ছেলের হাত তাঁর নিজের মাথায় তুলে বলেন, “আজকের পর এই মেয়ের সাথে তোর কোন প্রকার যোগাযোগ থাকলেই মনে করবি তোর মা, বোন মৃত! হয় আমরা না হয় এই মেয়ে। আর তোমাকে বলি, মা বাবার সম্পর্কের দিকে তাকিয়ে হলেও নিজের বিয়ের সম্মান বজায় রেখো।” শেষের কথাটা চৈতীর উদ্দেশ্যে বলেই তিনি আর অপেক্ষা করলেন না। অভ্রকে ছেড়েই চলে গেলেন একা। মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই নির্বাক হয়ে গেল অভ্র। চোখের সামনে সবটা দেখে নিশ্চুপ দিহানও আর চৈতী ছলছল চোখে কিছু সময় তাকিয়ে ছিলো অভ্রের মুখের দিকে। সে বুঝতে চেষ্টা করছিলো অভ্র কি ভাবছে। কিন্তু না, অভ্রের মুখের বর্ণ অপরিবর্তনীয়। এরপর আর চৈতী অপেক্ষা করেনি৷ সে চুপচাপ বেরিয়ে গেল রেস্টুরেন্ট থেকে কাউকে কিছু না বলেই। অভ্রও ফিরে গেল নিজ গন্তব্যে আর নিঃশব্দে দিহানও ফিরে গেল। ছন্নছাড়া পথিক এতদিন শুধু দিহানই ছিলো আজ যুক্ত হলো অভ্র আর চৈতীও। বাড়ি ফিরে হাসি হাসি মুখে চৈতী ফুপির সাথে বউ বরণের কাজ করলো। মেহমানদের আদর আপ্যায়ন করলো ঠিক বাড়ির বড় বউয়ের মতই। রাতের প্রায় এগারোটা পর্যন্ত সে এ কাজ ওকাজে ব্যস্ত রইলো। দিহান বাড়ি ফেরেনি আর বিকেল থেকেই৷ দিলশাদ খুব মনযোগে দেখছেন চৈতীকে। বিকেলে দিশানের বউ আনার আগেই দিহান চৈতী বেরিয়ে এসেছিলো কনভেনশন হল থেকে। দিলশাদকে বলেছিলো তারা কোথাও একটা শপিংমলে যাবে৷ চৈতী নাকি কি কিনবে। কিন্তু বাড়ি ফিরেছে সে খালি হাতে সাথে দিহান ছিলো না আর না চৈতীর কাছে কোন শপিংব্যাগ। তবে ফেরার পর থেকেই দেখছে চৈতীর মুখ জুড়ে হাসির ফোয়ারা। আত্মীয়রা যেই আসছে তার সাথে খুব হাসিমাখা সুরে কথা বলছে। ভালো লাগলো তার এই দেখে কিন্তু দিহান কই!

রাত এগারোটার পর দিলশাদ আর ময়না খালার সাথে মিলে চৈতী রাতের খাবার সার্ভ করলো সবাইকে৷ একে একে সব কাজ শেষ করে নিজের খাবার বেড়ে ঘরে নিয়ে গেল সে৷ ফুপি জানতে চাইলে বলল পরে খাবে তাই ঘরে নিয়ে রাখছে। দিলশাদ আর কোন প্রশ্ন করেনি৷ চৈতী ঘরে এসে খাবার রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। চোখ দুটো তার সিলিংয়ের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে আর মনটা তার বেরিয়ে গেছে দেহ থেকে। চৈত্রের খরার মত শুকিয়ে চৌচির হয়ে আছে বুকটা। সেই যে বিকেলে চোখ দুটো ছলছল হয়েছিল তারপর আর কান্না পায়নি।চোখে জল জমেনি আর না অভ্রের জন্য বুক চিরে কোন আর্তনাদ হচ্ছে! ঘড়ির সময় দেখতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু দিহান তো এখনও বাড়ি ফেরেনি তাই ফোনটা হাতে নিয়ে কল দিতে চাইলো। পরে মনে পড়লো দিহানের নাম্বার তো সে কখনো সেভই করেনি৷ চোখে ঘুম দরকার ভেবেই সে চোখ বুজলো। তার যখন ঘুম ভাঙলো প্রকৃতিতে তখন ভোরের আলো জ্বলে উঠেছে৷ চারদিকে বসন্তের সুতির মত মিহি ঠান্ডা বাতাস আর তেজহীন রোদ৷ পাখির ডাক থেকে থেকে কর্ণকুহরে বেজে উঠছে৷ চৈতীর ঘুম ভাঙতেই মনে হলো সে ক্ষুধার্ত রাতের খাবার খায়নি। বিছানা ছাড়তে গিয়ে ওড়না টেনে সরাতে না পেরেই পাশে তাকালো৷ তার ডানপাশে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে দিহান৷ পরনে তার ট্রাউজার আর পাতলা একটা গেঞ্জি। ঘরের দরজা ভেতর থেকেই বন্ধ। ক্ষণিকের জন্য থমকে গিয়েও আবার নিজেকে সামলে নিলো। নিয়তি তো এই ছিলো তার পাশে দিহান ভাই থাকবে! বাথরুমে ঢুকলো চৈতী একেবারে জামাকাপড় নিয়ে। গোসল করে আপাতত মাথার ভেতরের সুক্ষ্ম যন্ত্রণাটাকে দূর করা জরুরি৷ ঝটপট গোসল শেষে সে খাবারের প্লেটের সামনে গেল যা রাতে নিজের জন্য এনে রেখেছিলো। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো প্লেট বাটি সব খালি আর এঁটো। দিহানের দিকে ফিরে সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রাতে নিশ্চয়ই দিহান বাড়ি ফিরে এই খাবারই খেয়ে ঘুমিয়েছিলো। এঁটো থালা বাসন তুলে নিয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রান্না ঘরে ঢুকতেই সামনে পড়লো দিহানের চাচী আর তার মা। চৈতীর চুল ভেজা সে তোয়ালে দিয়ে ভালো করে মোছেনি। টপটপ করে চুলের পানি ঝরছে কোমর বেয়ে তা দেখে যেন দিহানের মা আর চাচী অন্যকিছু ভেবে নিলো।কাল এমনিতেও দিহান আর চৈতীর সাজসজ্জা, পাশাপাশি চলা আবার ঘুরতে যাবে বলে বের হওয়া সবটাই নজরে ছিলো দিলশাদের। না চাইতেও বুকের ভেতর মিহি বাতাস বয়ে গেল প্রশান্তির। অবচেতন মন নিজেই অনেক দূর অব্দি ভেবে নিলো। চৈতী ফুপির দিকে তাকিয়েই বলল, “খিদে পেয়েছে ফুপি কিছু কি হবে?”

“হ্যাঁ হবে না কেন৷ আর এঁটো থালাবাসন গুলো সিংকে রাখ।”

চৈতী রাখলো সেগুলো। দিলশাদ একটা প্লেটে পরোটা দিতে দিতে জানতে চাইলেন দিহান উঠেছে কিনা! চৈতী বলল সে উঠেনি এখনো। পরোটা আর এক কাপ দুধ চা নিয়ে সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে বসলো। যেতে যেতে অবশ্য দুজনকে জিজ্ঞেস করেছিলো তারা নাশতা করেছে কিনা! চাচী জানালো উনি এত সকালে খান না। আরো পরে খাবেন আর দিলশাদও ছেলেদের সাথে খান। আজ তো দিশানের অপেক্ষা চলে না তাই অপেক্ষা করছেন দিহান উঠলে খাবেন।

দুপুরে রিসেপশন অনুষ্ঠান তাই চৈতীকে বলা হয়েছে আজও পার্লারে সাজতে। নতুন বউয়ের জন্য লোক আসবে তাদের দিয়েই সাজাতে চাইলো দিলশাদ। চৈতী রাজী হলো না কিন্তু সাজও বাদ রাখলো না। সে আজও সাজলো খুব সুন্দর করে। আজ আঁচল খোলা রেখে শাড়ি পড়েছে। চুলগুলো আজ আর খোঁপা নয়। খুলে রেখেছে। হাত ভর্তি চুড়ি আর কানে স্বর্ণের ঝুমকা যা দিলশাদ নিজে পছন্দ করে দিলো। অনেক জোর করেও গলায় কিছু পরানো গেলো না তাকে। ঐশী বার কয়েক ডেকেছিলো চৈতীকে তার মত করে সাজতে। কিন্তু চৈতীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে সম্ভব হলো না। আজকের দিনটাও চমৎকার ভাবে কেটে গেল। দিশান চলে গেল নিয়ম মেনে শ্বশুর বাড়ি। আত্মীয়রা দিহানদের সব বাড়িতেই ছিলো আর চৈতীর ইচ্ছে হচ্ছিলো নিরালায় একটু থাকার। কলিজা ছেঁড়া আঘাত জমাট বেঁধে ভেতরটা খুব ভারী করে তুলছিলো। বাড়ি ফিরে সব অসহ্য লাগতে শুরু করলো তার। সকলের সামনে কোন অশোভন আচরণ না করে ফেলে সেই ভয়েই সে নিজেকে একা রাখতে চাইলো। কিন্তু ভরা বাড়িতে তা কি করে সম্ভব! বাধ্য হয়েই সে ফুপিকে বলল, “আমি কি একটা রাত মায়ের সাথে থাকতে পারি!”

দিলশাদ ঘরে ফিরে হাতের বালা খুলছিলেন। রিসেপশন বলে আজ তিনি নিজেও খুব করে সেজেছিলেন। তাই এখন ফ্রী হয়েই আগে শাড়ি গয়না বদলানোয় ব্যস্ত হচ্ছিলেন। চৈতীর কথা শুনে আচমকাই তার মুখের দিকে তাকালেন। বুঝতে চাইলেন মেয়েটা কি ঠিক আছে! দুটো মাস কেটেছে অমানুষিক কায়ক্লেশের মধ্যে কিন্তু কাল থেকে পরিবর্তন চোখে পড়েছে খুব। তবে ভাবনাগুলে দমিয়ে রেখেই সে জবাব দিলো, ” তোর মা তো সেন্টার থেকেই চলে গেছে। আমি দিহানকে বলছি বাড়ির গাড়ি নিয়ে যা দুজনে। দুজনেরই রেস্ট দরকার আর এ বাড়িতে এমনিতেও হৈ চৈ এসবের মাঝে থাকতে পারবি না।”

চৈতী শুনলো কিন্তু কিছু বলল না৷ সে চাইছে না দিহান সাথে আসুক কিন্তু ফুপিকে কিছু বলতেও ইচ্ছে করছে না। দিলশাদ সত্যিই দিহানকে পাঠালেন চৈতীর সঙ্গে। কাল বৃষ্টি ছিলো না আজও সকাল থেকে আকাশ পরিষ্কার ছিলো। সন্ধ্যের আগে যাই একটু মেঘ করেছিলো তাতে মনে হয়নি আজ বৃষ্টি হবে। কিন্তু চৈতীরা যখন তাদের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছুলো তখনি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। গাড়ি নেয়নি দিহান সে তার বাইকে করেই এসেছে। বৃষ্টির তেজ একটু একটু করে বাড়ছিলো বলেই দিহান বলল, “পাশে কোথাও থামি?”

“বাইক চালাতে সমস্যা হলে সাইড করে থামো কোথাও।” বৃষ্টির শব্দে কথাগুলো স্পষ্ট শোনা গেল না চৈতীর তাই বাধ্য হয়েই একটা বন্ধ দোকানের সামনে বাইক থামালো দিহান৷ ততক্ষণে অসময়ের এই হঠাৎ বৃষ্টি ভিজিয়ে দিয়েছে তাদের কিছুটা।

“থামলে যে!”

“বৃষ্টি বাড়ছে। যেতে যেতে দু মিনিটেই ভিজে যাব পুরোপুরি।”

“এমনিতেও ভিজে গেছি আমরা।”

“চৈতী! কিছু কথা বলি তোকে?” দিহানের কথায় মনে হলো সে ইচ্ছে করেই বাইকটা থামিয়েছে এখানে। বৃষ্টি কোন কারণ নয়৷ চৈতী কৌতূহল বোধ করলো না তবে মনযোগ দিতে চাইলে দিহানের কথায়। তারা যেখানটায় থেমেছে এখানে এই একটা চায়ের দোকান ছাড়া আর কিছুই নেই। চারপাশে ল্যাম্পপোস্ট নেই আর না আছে কোন বাড়িঘর। বৃষ্টির রাত বলে ফুটপাতও জনমানবশূন্য। চায়ের দোকানটায় একটা কাঠের বেঞ্চ পাতা। চৈতী সেখানটায় বসে ওড়নার নিচ থেকে চুল গুলো বের করলো। দিহান বেঞ্চটার পাশেই দাঁড়িয়ে কথা শুরু করলো।

“কাল থেকে তুই খুব গুমোট হয়ে আছিস। আমি জানি এটা তুই নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করছিস কিন্তু তোর এই চেষ্টাটা ঠিক হচ্ছে না৷ আমি বলবো কান্না পেলে কেঁদে ফ্যাল৷ বেশিক্ষণ না একটুই কাঁদ তবুও কাঁন্না কর। বুকের ভেতর কষ্টকে চাপা দিয়ে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করে কিছুই হাসিল করতে পারবি না।”

“এসব কথা কেন বলছো দিহান ভাই!”

“জানি না।”

“তাহলে বাদ দাও আমি ঠিক আছি।”

“পরবর্তী চিন্তা কি তোর?”

দিহানের এ কথায় চৈতী চকিতেই তাকালো তার মুখের দিকে। অন্ধকারে মাঝেমাঝে একটা দুটো গাড়ি যাচ্ছে আর তার আলো চোখে মুখে পড়ছে। চৈতী কি দেখতে চাইলো দিহানের মুখে জানে না। কিন্তু কিছুই সে দেখতে পেল না। বৃষ্টির ছাঁটে দিহান পুরোপুরি ভিজে যাচ্ছে। সে আবারও বলল, “তুই কি আবার আমাদের বাড়ি ফিরবি?”

চৈতী নিশ্চুপ ; দিহান বিরক্ত হলো। আবারও বলল, “কাল অভ্রের মা যা করলো তারপর নিশ্চয়ই তুই চাইবি না অভ্র তোকে বিয়ে করুক বা তুই অভ্রের জীবনে থাক!কারণ, অভ্রের জীবনে তুই যতটা গুরুত্বপূর্ণ তারও হাজারগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ অভ্র। তার মা আর বোনের জীবনে। তোকে বিয়ে করলে সে দুটো মানুষ তাকে ত্যাগ করবে।যতটুকু বুঝলাম মহিলা সংগ্রাম করে জীবনে পার করেছে সে এখন হুট করেই ছেলের এমন অনৈতিক সিদ্ধান্ত মানবেন না। আর অনৈতিক সিদ্ধান্ত বলছি কারণ বিবাহিত একটা মেয়েকে কোন মা বাবাই কখনো নিজের একমাত্র ছেলের পাশে চাইবেন না। আর সে ছেলে যদি হয় সব দিক থেকে নিখুঁত, পরিপূর্ণ। তুই নিজেই ভাব একটু।”

দিহান বুঝতে পারছে না সে কিসব বলছে এগুলো। ঠিক বলছে না ভুল তাও আন্দাজ করতে পারছে না। কালকে অভ্রের মায়ের কথা শুনে আর মুখ দেখে তার মনে হলো মহিলা বেঁচে থাকতে চৈতীকে কখনোই মানবেন না৷ হয়তো তার মাও এমনটাই করতো। চৈতীর নিস্তব্ধতা তার ভালো লাগছে না। এদিকে বৃষ্টি থামার নাম নেই উল্টো তেজ বাড়ছে। এত মেঘ আকাশে তো দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না তবে এত বৃষ্টি কোথা থেকে এলো!

“কিছু বলবি না?”

“আমি ভিজে গেছি পুরোপুরি। শীত শীত লাগছে বাড়ি যেতে চাই।”

“আমি কিছু বলছি তোকে।”

“শুবলাম। এবার চলে আমি বাড়ি যাবো৷”

হতাশ হলো দিহান। তার ভালো লাগছে না চৈতীর এমন নির্লিপ্ত আচরণ।সে চাইছে চৈতী রিয়াক্ট করুক, কান্না করুক। কিশোরী বয়সের আবেগ কান্নায় ধুয়েমুছে যাক এই বর্ষণের মত। তার মত তো আর চার বছরের সম্পর্ক শেষ হয়নি চৈতীর। তার মত প্রিয় মানুষটাকে নিজ হাতে দাফন করতে হয়নি৷ কাফনে মোড়ানো দেহটাকে না মেহরাম হওয়ার দায়ে অদেখা রাখতে হয়নি প্রিয় মানুষটিকে শেষ বারের মত। তবুও কেন চৈতী এত গুমোট হয়ে গেল। চৈতী তার চোখের সামনে বড় হয়েছে, ছোট বেলা থেকে কত আদর, শাষণে বড় কটেছে ওকে আর সেই মেয়েটাকে এখন কারো জন্য গুমরে থাকতে দেখতে কি ভালো লাগে! নিজের কষ্টে অনুভূতি সব ভোঁতা হয়ে গিয়েছিলো আজ সেই ভোঁতা অনুভূতিতে খোঁচা দিচ্ছে চৈতী অভ্রের বিচ্ছেদ। বসন্তে কেন বৃষ্টি হবে! বসন্ত হবে প্রেমের মাস, বসন্ত হবে নির্মল রোদে তিরতিরে হাওয়ার অনুভূতি। এই বসন্তেই কেন বিচ্ছেদের অনল জ্বলবে! দিহানের অতিষ্ট লাগছে সব৷ সে বাইকে বসলো সাথে সাথে চৈতীও উঠে বসলো। মিনিট তিনের মধ্যেই চৈতীদের বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো। ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে রাত আটটা বেজে গেছে৷ সুইটি প্রথমে দিহান, চৈতীকে দেখেই অবাক হয়েছে পরমুহূর্তেই আবার আনন্দিত হলেন এই ভেবে, মেয়ে আর জামাই এসেছে থাকবে বলে। কাজের বুয়ার শরীরটা ভালো না তাই তাকে ঔষধ দিয়ে সন্ধ্যায়ই শুতে বলে দিয়েছিলো। দিহান, চৈতী এসেছে বলে সুইটি নিজেই রান্নাঘরে ঢুকে গেল। বৃষ্টিতে ভিজে গা বেয়ে পানি পরছে তাই চৈতী নিজের ঘরে ঢুকে আগেই পোশাক বদলালো। বিপত্তি ঘটলো দিহানকে নিয়ে। সে থাকবে বলে আসেনি কিন্তু বাইরে বৃষ্টি একটু কমছে আবার বাড়ছে৷ সুইটিও রান্না বসিয়েছে তাই আজ চাইলেও যেতে দিবে না। কিন্তু এই ভেজা কাপড়ে থাকবে কি করে! কিছু সময় সে ভেজা কাপড়েই বসার ঘরে পায়চারী করলো। সুইটি এসে এক ফাঁকে বলল, “দিহান তোমার মামার কাপড় দেবো? সেগুলো পরো ভেজা কাপড়ে কতক্ষণ থাকবে!”

“না মামী। মামার কাপড় অনেক লম্বা আমাকে তোয়ালে আর হেয়ার ড্রায়ারটা দেন।”

চৈতী কাপড় বদলে আসতেই সে তোয়ালে দিলো। কিন্তু সমস্যা আবার হলো হেয়ার ড্রায়ারটা নষ্ট। সুইটি একটু জোর করেই একটা লুঙ্গি দিলো দিহানকে।

“এটা তোমার মামার জন্য কেনা হলেও উনি পরেননি একবারও৷ নাও এটাই পরো আর রাতের বেলা ঘুমাবেই তো।”

দিহান লুঙ্গিটা হাতে নিয়ে ইতস্তত করতে করতেই পরে নিলো। শার্ট খুলে শুকনো আরেকটা তোয়ালেই গলায় ঝুলিয়ে রাখলো। রাতের খাওয়ার পর কিছু সময় ফোন নিয়ে বসে রইলো দিহান আর চৈতী তার মায়ের বিছানায় মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে রইলো চুপচাপ। সুইটির মনে হলো মেয়েটা তার অস্বাভাবিক রকম চুপচাপ হয়ে গেছে। আজ দুদিন ধরে যেই সাজসজ্জা দেখছেন সবটাই তার ভেতরের কষ্ট লুকিয়ে রাখার বৃথা চেষ্টা। মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতেই প্রশ্ন করলেন, “এ মাসে তোর পিরিয়ড হয়েছে?”

“না।”

চমকে তাকালেন সুইটি মেয়ের দিকে৷ অনেকটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, “কতদিন হলো ডেট গেছে!”

চৈতী বুঝলো না কথাটা তাই বলল, ” অনেকদিন তো হলো।”

“তারমানে কি!”

থেমে গেলেন সুইটি৷ বুঝতে পারলেন না প্রশ্নটা কি করে করতে হবে মেয়েকে৷ কিন্তু তার সকল কনফিউশান দূর করে দিলো চৈতীর একটা বাক্যই।

“আমার তো সপ্তাহ খানিক প্রতিবারই লেট হয়৷ হয়ে যাবে দু একদিনে।”

“ওহ!”

চৈতী আরো কোন কথা বলতে চাচ্ছিলো আর তখনই দিহান বলল, “আমার ঘুম পাচ্ছে। কোন ঘরে ঘুমাবো মামী?”

সুইটি তৎক্ষনাৎ পা থেকে চৈতীর মাথা সরিয়ে দিলো।

“পাশের ঘরটাই চৈতীর। তুমি যাও, এ্যাই চৈতী যা বিছানা ঠিক কর গিয়ে ছেলেটা সেই কখন থেকে বসার ঘরে বসে আছে।আমি যাই দুধটা গরম করি তুই এসে নিয়ে যাস।” একদমে কথাগুলো বলে সুইটিই আগে রুম ছেড়ে রান্নাঘরে চলে গেল। হতভম্ব হয়ে চৈতী দিহান একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

দুধের গ্লাস খালি করেই দিহান বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। চৈতীর একটু গরম লাগছে বলে সে ফ্যান ছেড়েছিলো। কিন্তু ফ্যান ছাড়তেই দিহানে লুঙ্গি একটু একটু উড়তে লাগলো। তা দেখে কপাল কুঁচকে চৈতীকে জিজ্ঞেস করলো, ” তুই কি ফ্যান ছেড়ে ঘুমাবি!”

“কেন! তোমার লুঙ্গি কি বাতাসে দেশ ত্যাগ করবে!”

চলবে
(পর্ব বড় করতে গিয়ে আর রিচেক করা হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here