আনকোরা পর্ব-১

0
8316

১.
অভ্রের সাথে সাত মাস প্রেম করে আজ তার আবদার রাখতে ঘুরতে এসেছিলাম৷ বাড়ির কেউ দেখে না ফেলে সেই ভয়ে নিজের এলাকা ছেড়ে অভ্রদের এলাকায় একটা পার্কের মতন জায়গায় এসেছি। জায়গাটা তেমন বড় নয় তবে ছোটখাটো একটা পুকুর আর খোলা জায়গা। পুকুরের কিনারায় কিছু ফুলগাছ ঝোপের মত বেড়ে উঠেছে। অভ্র আর আমি সেখানেই বসেছিলাম সবে মাত্র আর তখনি আমার কলিজা কাঁপিয়ে বড় বড় পা ফেলে সামনে হাজির হলো আমার ফুপাতো ভাই দিহান। হাতে তার ক্রিকেট খেলার ব্যাট, বল,স্ট্যাম না কি যেন বলে সেগুলো। সেই সাথে তার সঙ্গী আরো ছয় সাত জন৷ ভার্সিটিতে আজ ক্লাস ছিলো না বলেই আজকের দিনটায় মিথ্যে বলে বেড়িয়েছিলাম। আমার বাবা মিশন থেকে ফিরে ছুটিতে আছেন তিন মাস আর এই তিনমাস আমার জীবনে থাকবে ভয়াবহ বন্দীদশা। প্রতিবার বাবা ছুটিতে এলেই আমার সাথে বন্দিনী আচরণ শুরু করেন। আজ আর সেই আচরণের ভয় না করে এসেছিলাম প্রেমজীবনের একটু আনন্দ উপলব্ধি করতে সেখানেও শনি চলে এলো। দিহান ভাইকে দেখেই আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি কিছু বলবো ভেবে। কিন্তু আমার ভাবনাকে ধাক্কা মেরে তিনি হাতে থাকা ভারী ব্যাটটা দিয়েই বারি মেরে বসলেন অভ্রের পায়ে। ভর দুপুরে খা খা রোদে আমি চোখের সামনে সে দৃশ্য দেখেই আৎকে উঠেছি। এরপরের ঘটনা আমার আর ঠিক মনে নেই। যখন চোখ মেলে তাকাই তখন টের পাই আমার বা গালে প্রচণ্ড ব্যথা। বিছানায় শোয়া আমি আর আমার ডান পাশে আমার বোকা,ভীতু মা জননী বসে আছে। আমি মাকে দেখে কিছু বলবো তার আগেই মা খুব শীতল কণ্ঠে আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘ছেলেটা মারা গেলে তার দ্বায়ভার কে নিবে চৈতী?’

মায়ের কথা শুনতেই আমি ভড়কে গেলাম। তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসলাম আর তখনি অনুভব করলাম আমার বাম গালে তীব্র ব্যথা। কিন্তু সেই ব্যথার খোঁজ নেওয়ার আগেই আমি ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম, ‘কার কথা বলছো মা?’

-জেনে শুনে যেই ছেলেটাকে মৃত্যুর মুখে এনে দাঁড় করেছিস।

‘কে মারা যাবে মা! তুমি কার কথা বলছো, কি বলছো এসব?’ আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। ভর দুপুরে যা ঘটেছে চোখের সামনে তা সিনেমার কোন সিনের মত চোখের পর্দায় ভেসে উঠলো। মায়ের চোখে জল ছলছল৷ মা বড্ড বেশি আবেগী তাই যে কারো বিপদ দেখলে কেঁদে ফেলে। কিন্তু এখন মা যা বলছে তা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে আমার। দিহান ভাই কি অভ্রকে কিছু করে ফেলল! না না কিসব ভুল ভাবছি আমি। দিহান ভাই রগচটা আর কিছুটা পাগল কিসিমের তাই বলে সে মানুষ খুন করবে তা কি করে সম্ভব!

‘মা আমাকে বাড়িতে কে এনেছে? অভ্র কি ঠিক আছে?’

-ছেলেটার নাম অভ্র! কম্পিত কন্ঠস্বরে মা বলল।

‘হ্যাঁ মা, অভ্র খুব ভালো ছেলে বিশ্বাস করো। আর দিহান ভাই ওকে ব্যাট দিয়ে আঘাত……’

‘ওর কপাল মন্দ তাই দিহান ওকে ব্যাট দিয়ে আঘাত করেছে। আমার চোখে পড়লে সরাসরি শুট করতাম।’ ভারী গম্ভীর স্বরে বলল আমার বাবা চাঁদ খান। আমার যেটুকু হুঁশ ছিলো তা যেন পুনরায় হারাবার জো বাবাকে দেখে। ভয়ে মায়ের গায়ের সাথে সেঁধিয়ে যাচ্ছি আমি। অনুভব করলাম আমার মত ভয়ে আমার মা’ও কাঁপছে কিছুটা। সময়ের আঘাতটা বরাবরই করুণ আমাদের মা মেয়ের জীবনে। আর্মির একজন উচ্চপদস্থ লোকের ঘরে তার বউ -স্ত্রী থাকে কয়েদিদের মত চোখের তারায় বন্দী। বছরের প্রায় বারোটা মাসই বাবা তার কাজে দেশের এ অঞ্চল সে অঞ্চলে পড়ে থাকেন। কখনোবা মিশনে যান দেশের বাইরে৷ প্রয়োজনের সময় টাকা আর বাবার পক্ষ থেকে পাঠানো হেফাজত কর্মী ছাড়া কাউকেই তেমন পাই না আমরা। আত্মীয় স্বজন বলতেও নানা বাড়ির কেউ তেমন আসেন না আমাদের দেখতে আর না আমাদের কোন উৎসব অনুষ্ঠানে আমাদের দাওয়াত করেন! কারণ একটাই, আমার বাবা কোন উৎসব,অনুষ্ঠানে গেলেও দূর থেকেই হাজারটা নিষেধাজ্ঞা জারি করেন আর তাই বিরক্ত হয়েই কোন আত্মীয় ভিড়ে না আমাদের দিকে৷ স্কুল জীবনে বন্ধু – বান্ধব বাছাইয়ের সুযোগটাও পাই নি আর এখন বড় হয়েছি। স্মার্টফোন পেয়েছি কলেজে উঠে আর তাতেই সুযোগ হয়েছিলো সোশ্যাল সাইট গুলোতে ঢোকার। মাস সাতেক আগে ফেসবুকেই প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছিলাম অভ্রের কাছ থেকে; অভ্র পাশের এলাকার ছেলে তাই অচেনা নয়৷ তাই সে আমার বাবার সম্পর্কে অবগত ছিলো আর ভয়েই কখনো মুখোমুখি হয়নি আমার। আজ হঠাৎ করেই নাকি তার খুব ইচ্ছে হলো আমাকে সামনে থেকে দেখার। জীবনের সবগুলো বছর আমার গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীতেই কেটেছিলো। এই প্রথম বসন্ত কড়া নেড়েছিলো আমার দরজায় সেও কিনা কাল বৈশাখীর ঝড় নিয়ে! মনের ভেতর প্রচণ্ড ঝড় বইছে আমার। এই ঝড় কাকে দেখাবো? কি করে জানবো আমি অভ্রের খোঁজ? অন্তরের ভেতর উথাল পাথাল ঢেউ আমাকে ভাসিয়ে নিচ্ছিলো ক্ষণে ক্ষণে তবুও দাঁতে দাঁত চিবিয়ে পড়ে রইলাম সারাদিন৷ বাবা আমাকে তেমন কিছুই বলেননি আর। দিন পেরিয়ে গৌধূলি যখন ডুবন্ত তখন হঠাৎ কানে এলো ফোনের রিংটোন। আমার ফোন বাজছে কিন্তু ফোনটা কোথায় আছে! ব্যথা পাওয়া গালে হাত বুলাতে বুলাতে বিছানা ছেড়ে ফোনটা খোঁজলাম। রিংটোনের শব্দের উৎস কোথায় কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না তখনি কানে এলো দিহান ভাইয়ের কন্ঠস্বর।

‘মামী! নেন কথা বলেন আপনার হবু জামাতার নম্বর থেকে কল এসেছে।’ ব্যাঙ্গাত্মক সুর তার কথায়। এই লোকটা বেয়াদব প্রচুর পরিমাণে কিন্তু তার বেয়াদবির কথাটা শুধু আমি আর আমার মা জানে সেই সাথে বাড়ির বোকাসোকা কাজের লোকগুলোও জানে৷

মা কিছু বলছে না কিন্তু পায়ের শব্দে বুঝলাম তারা আমার ঘরে আসছে। আমি দ্রুত পায়ে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘরে এলো তারা আর সাথে সাথেই দিহান ভাই ডাকলো, ‘ এ্যাই চৈতী উঠ, দেখ তোর অভ্র ফোন করেছে। শালা আখাস্তা,হারামি একটা। এত মাইরের পরও কল দেয় কেমনে!’ কপালের রগ ফুলে উঠেছে দিহানের।রাগে তার শরীরের রক্ত টগবগ করছে এখনও। আমার উপরও তার প্রচণ্ড রাগ কিন্তু এখন বাবা দেশেই আছে তাই সে আমাকে ছেড়েছে। নইলে আজ অভ্রের সাথে আমাকেও মরণপথ দেখিয়ে আনতো। তাদের বাড়ির মেয়েরা নাকি যাবে পার্কে প্রেম করতে! সে বেঁচে থাকতে অন্তত এসব মেনে নিবে না কখনও৷ দিহান ভাইয়ের এমন আচরণ নতুন নয় এর আগে সে তার আপন বোন দিশা আপুকেও মেরেছিলো খুব৷ দিশা আপু পালিয়ে বিয়ে করে দেশ ছেড়েছে বছর দেড়েক আগে। এখনও আপু ফুপিকে কল করলে আতঙ্কে থাকে অভ্র ভাই ফোন তোলে কিনা সেই ভয়ে। এখন অবশ্য আপুর আর ভয় নেই সে এখন প্রেগন্যান্ট তাই সামনে আসলেও হয়তো মারবে না আর কিন্তু জিজুকে ছাড়বে না বলেই রেখেছে৷ তাই তো আপু আসে না দেশে। কপাল মন্দ তাই আমিও পড়েছি দিহান ভাইয়ার শকুনি নজরে। তার চেয়ে ভালো হতো যদি দিশান ভাইয়ের চোখে পড়তাম৷ তিনি তাহলে এতক্ষণে ফুসলে ফাসলে বাবাকে আমার বিয়ে দেওয়ার কথা বলতো। গালের ব্যথাটা তীব্র হয়ে এবার ধীরে ধীরে মাথায়ও বইছে৷ চিনচিনে সে ব্যথা সওয়ার ক্ষমতা রইলো না দেহে। চোখের সামনে মা আর দিহান ভাইয়ের মুখটা ঝাপসা হয়ে গেল অচিরেই।

ভোরের আলো ফুটেতেই কানে এলো কিচিরমিচির পাখির ডাক৷ আমাদের বাড়িটা চারপাশে গাছে ঘেরা হওয়ায় এই একটা আমুদে ব্যাপার পাই প্রতিদিন। কাৎ হয়ে শোয়া থেকে সোজা হতেই শরীরটা ব্যথায় যেন মড়মড়িয়ে উঠলো ভাঙা পুরনো খাটের মত৷ এত ব্যথা যে কি করে এলো এই শরীরে! ভাবতে ভাবতেই শোয়া থেকে বসলাম। গালের পাশে একটুখানি ব্যথা ছিলো সেটাতে হাত বুলিয়ে বুঝতে পারলাম ব্যান্ডেজ নেই এখন আর। কালকে তো ছিলো, হয়তো রাতে মা কিংবা বাবা বদলে দিয়েছে। আলুথালু হওয়া চুল গুলো দু হাতে খোঁপা করতে করতে বিছানা ছাড়লাম। আহ্! পায়ের গোড়ালিতেও দেখছি ব্যথা আছে।

-কিরে! ঘুম ভেঙে গেছে?

-হ্যাঁ মা, বাবা কোথায়?

-‘তোর বাবা দৌঁড়াতে বেরিয়েছেন নামাজের পর। তুই জলদি মুখ হাত ধুয়ে নিচে আয় তো জলদি।’ তাড়া দিলো আমাকে কিন্তু আজ মায়ের মুখটা খুব উজ্জ্বল লাগলো। কালকের ঘটনার পর মাকে এত উচ্ছ্বসিত মুখে দেখবো এটা কল্পনা বৈ অন্য কি হতে পারে!

‘মা!’

‘হ্যাঁ রে বল।’

‘তোমাকে হ্যাপি হ্যাপি লাগছে খুব।’

‘তো কি মন খারাপ করে থাকবো? আচ্ছা শোন উঠেছিসই তো তাড়াতাড়ি এক কাজ কর। নাশতা করে একটু রুপচর্চা কর। মুখের যে হাল তাতে তো মনে হয় না কিছু লাগিয়ে ঘঁষতে পারবি। থাক, তুই বরং জামাকাপড় ডিসাইড কর কোনটা পরবি?’

‘বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান!’

‘ভুলে গেলি!’ মা যেন হতাশ হলো আমার ভুলে যাওয়ায়।

‘বলো তো কি আজকে?’

‘বিবাহবার্ষিকী আমার আর তোর বাবার।’

‘ওহ!’ এবার বুঝতে পারলাম কেন এখনও বাবা নিশ্চুপ কালকের ঘটনা নিয়ে। আজ আমাদের বাড়িতে মেহমান থাকবে খুব৷ বাবা বাড়িতে থাকা অবস্থায় যতবারই তাদের বিবাহবার্ষিকী হয়েছে প্রতিবারই আয়োজন হয়েছে মোটামুটি রকমের। আজও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু আমার তো বুকটা খা কা করছে অভ্রের কথা ভেবে। কাল আমার ফোনে সে ফোন করেছিলো কিন্তু কি বলেছিলো বা এখনও ফোনটা কোথায় তাই তো আমি জানি না। চাপা এক কষ্ট বুকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।

দুপুরের পর মেহমান আসতে শুরু করেছে বাড়িতে। আমি কাটা গাল নিয়ে ঘর ছেড়ে বের হতেই চাচ্ছিলাম না কারণ, যে দেখবে সেই জানতে চাইবে কেটেছে কি করে? তখন কি বলবো, প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ভাঙা ইটের উপর পড়েছিলাম! যাইহোক, সন্ধ্যার পর আর সম্ভব হলো না ঘরে বসে থাকা। আত্মীয় বলতে তো নানীর বাড়ির কেউ আসেনি এসেছে সব বাবার চৌদ্দ গুষ্টির লোক তার মধ্যে আমার দুই ফুপু আর তার সন্তানেরা শুধু তিনটা ভাই ছাড়া। দিহান ভাই, দিশান ভাই আর ছোট ফুপির ছেলে তামজীদ। বসার ঘরে এসে সবেই পা রেখেছি আর তখনি কানে এলো বাবার গলা।
‘ যত দ্রুত সম্ভব দিহান আর চৈতির এনগেজমেন্ট করাতে চাই তোরা কি বলিস?’ বাবা ফুপির উদ্দেশ্যে বলল।

‘ আমি দিহান ভাইকে কিছুতেই বিয়ে করবো না।’

দিহান ভাইয়ার সাথে বিয়ের কথা শুনতেই খেঁকিয়ে উঠলাম আমি একঘর ভর্তি মেহমানের সামনে। রাগ চড়ে গেছে আমার কি করে এতোটা নিজেও জানি না। বাবা তখন হাতের কাছে থাকা ফুলদানিটা কর্ণার টেবিল থেকে তুলে নিলেন। বিনাবাক্যে সেটাকে ছুঁড়ে মারলেন আমার পায়ের উপর। সিরামিকের ফুলদানিটা মুহূর্তেই টুকরো হয়ে ফ্লোরে পড়লো। তার আগে আমার পায়ে আঘাতটাও ঠিকঠাক করে তবেই ভেঙেছে সেটা। চাঁদ খান মানে আমার বাবা ঘরভর্তি সবার উদ্দ্যেশে ঘোষণা দিলেন কেউ যেন এক পা না এগোয় তার মেয়ের দিকে। ব্যথায় আমি কঁকিয়ে উঠলেও মা কিংবা কোন আত্মীয় সত্যিই এগিয়ে আসেনি আমার কাছে। আজ বিয়ের কথা বলবে বলেই হয়তো ফুপি তার ননদ, দেবর, ভাশুরদেরও নিয়ে এসেছেন আমাদের বাড়িতে। । আমি জানতো আজ মেহমান আসবে বাবা মায়ের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে । কে জানতো এমন ভরা মজলিশেই আমাকে এমন এক চমক পেতে হবে! পা কেটেছে সামান্য কিন্তু ব্যথাটা লেগেছে গভীর। আমার বাবা বরাবরই স্বভাবে রাগী,বদমেজাজী।

‘দিহানকে কেউ খবর দাও আজকেই কাবিন হবে।’ বজ্রপাতের মত গম্ভীর অথচ ভয়ংকর কন্ঠে বললেন আমার বাবা।

চলবে

#আনকোরা

#রূবাইবা_মেহউইশ

( প্রিয় পাঠকগণ,বানানে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার নজরে দেখবেন। আর বাক্য কিংবা অন্যান্য বিষয়ের ভুলগুলো ধরয়ে আশা করি শুধরানোর সুযোগ করে দিবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here