#আনকোরা
#রূবাইবা_মেহউইশ
২.
মায়ের মাথায় বন্দুক ঠেকানো দেখে কবুল বলেই ফেলেছি। কিন্তু মনের ভয় কি করে কাটাই! অভ্রের কোন খোঁজ তো এখনও পেলাম না। অন্তরাত্মা তো ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠছে বিপদের কথা ভেবে। কি ভাগ্য আমার বাবা মায়ের বিবাহবার্ষিকী হয়ে গেল আমার বিয়ের দিন৷ বাবা তো বলেছিলো কাবিন হবে কিন্তু পরক্ষণেই মত বদলে বলল বউ বিদায়ও হবে। জীবনের কাল আর আজকের দিনটা আমার কোন চলচিত্রের চেয়ে কম কাটলো না। বাবা হয়ে গেলেন ভিলেন,মা অবলা, দিহান ভাই শুধু খলনায়কের জায়গায় থেকেও বিয়েটা করে ফেললেন। নিজেকে বোধহয় তিনি নায়কের চরিত্রেই রেখেছেন কিন্তু এখানেও তো স্ক্রিপ্ট ভুল আছে। নয়ক হাসিমুখে নায়িকাকে বিয়ে করে কিন্তু উনি তা করেননি। তার চোখমুখ আমি একবারই দেখেছি তাকে খুন করার অভিলাষ নিয়ে কিন্তু মনে হলো সে নিজেও কাউকে খুন করার আকাঙ্ক্ষায় চেহারায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দিয়েছেন। বাইরে আকাশ ঘোলাটে মেঘে ঢাকা। মেঘ জমে আছে আমার হৃদয়েও। বিয়ে করেছি বাধ্য হয়ে তাই বলে কি সংসার করবো ওই দিহান বদমাশের সাথে! হ্যাঁ আজ থেকে আমি তাকে ওই নামে ডাকবো। আমার পায়ের নখও তাকে আর কখনো ভাই বলে সম্মোধন করবো না। কিন্তু সে তো আর ভাই রয়নি আমার। বদমাশ! বদমাশ! খুব বড় বদমাশ সে নইলে কেন কাল অভ্রকে মারলো। আমাকে তো সে কোনদিন আদর যত্নও করেনি আর না কখনো পছন্দ করা টাইপ নজরে দেখেছে। তাহলে আজ কেন সে বিয়েটা আটকালো না? আমি ক্ষণে ক্ষণে হাজারটা প্রশ্ন করেছি নিজের মনকে অথচ ভুলে বসে আছি দিহান কেন আমার চৌদ্দগুষ্টির কেউই আমার বাবার উপর কথা বলে না। সেখানে ওই বদমাশ কোন ছার! বিয়ের পর বেশি দেরি হয়নি বদমাশটা মানে দিহানটা কাউকে কিছু না বলেই আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। ফুপিও আর দেরি করতে চাইলেন না বাবাকে বলে আমাকে নিয়ে চলে যেতে প্রস্তুত হলেন৷ ব্যথাময় গাল আর পা নিয়ে আমি বসেছিলাম আমার ঘরে৷ বিয়েটাও পরানো হয়েছে আমার ঘরেই কাজী আর বদমাশটাকে এনে। মা আর ফুপিও ছিলো কিন্তু মায়ের মাথায় ছিলো তখন বাবার ছোট্ট রিভলবারটা। বাবার কাছে একটা রিভলবার সরকারি ভাবেই ছিলো বছর দেড়েক হলো। আমি তা শুধু শুনেছি আর তা দেখলাম আজই প্রথম৷ কলিজাটা ভয়ে আমার দেহ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো তখন৷ কাজী সাহেবও হকচকিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু কিছু বলার সাহস তিনি করেননি৷ পরনের জামা পরেই আমি রওনা হচ্ছিলাম ফুপিদের সাথে মা হঠাৎ ধীর কণ্ঠে বললেন, ‘ বিয়েটা তো হয়েই গেছে যদি একটা শাড়ি।’ ঝড়ের তোড়ে কম্পিত হওয়া বাতাস আর পাতার শব্দের মত কম্পিত আর করুণ শোনালো আমার মায়ের কণ্ঠস্বর। বাবা বসেছিলেন আমার ঘরেরই কাউচে। মায়ের কথা শুনে তিনি তার গৌরবর্ণ গম্ভীর মুখটাকে কিছুটা কোমল করলেন৷ গত দু দিনে বাবা এই প্রথম তাঁর মুখের পরিবর্তন করলেন বলে আমার মনে হলো। তিনি বসা থেকে উঠে মায়ের পাশে দাঁড়ালেন, ‘আজ কিছুই করতে হবে না সুইটি৷ ওদের এভাবেই যেতে দাও শুধু চৈতীর প্রয়োজনীয় কিছু কাপড়চোপড়, জিনিসপত্র দিয়ে দাও সাথে৷ আমি যাওয়ার আগেই ধুমধামে একটা অনুষ্ঠান করে সব দিবো।একটা মাত্র মেয়ে আমার তোমার কি মনে হয় আমি তাকে অনাথের মত পার করবো?’ বাবার কথাটা শেষ হতেই আমি মনে মনে বললাম, ‘আজ থেকে আমি অনাথ বলেই জানবো নিজেকে।’ মনের অভিব্যক্তি আমার মুখের উপরও প্রভাব ফেলল বোধহয়৷ বিষাদীনির মত চোখ ছলছলে হয়ে গেছে। ফুপি বাবাকে কিছু বলতে উদ্যত হচ্ছিলো আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। গেইটের কাছে আসতেই টের পেলাম পেছনে পেছনে মা,বাবা আর ফুপিও আসছেন ৷ ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম সত্যিই তারা পেছনে তাই মুখ খুললাম, ‘চিন্তা করতে হবে না। যে জাহান্নামে পাঠাতে চাইছো সেখানেই যাবো। আর হ্যাঁ আজকে থেকে আমি অনাথ বলে জানবো নিজেকে।’ কথাটা শেষ করে আর দাঁড়াইনি এক সেকেন্ডও। যেতে যেতে কানে এসেছে চাঁদ খানের হিংস্র গর্জন সাথে তার বোন মানে আমার ফুপিরও। শুধু কানে এলো না আমার মায়ের নিষ্প্রাণ কন্ঠস্বর। হয়তো ভয়ে, কষ্টে তিনি নির্বাক হয়ে চোখের জল ফেলছেন! আমি আজ থেকে সত্যিই তাদের মৃত বলে জানবো আমার জীবনে। ছোট থেকে তাদের রক্ষণশীলতার দ্বায়ে আমি নিপতিত ছিলাম আমার একলা ভুবনে। ভাই-বোন নেই, ছিলো না বন্ধু, ছিলো না চাচা, চাচী আর না চাচাতো ভাই-বোন।দাদা-দাদী আমার জন্মের আগেই মারা গিয়েছিলেন তাই পাই নি তাদের আদর। নানা নেই নানী থেকেও কাছে আসেন না আর না আমাকে কাছে ডাকেন। সবটাই বাবার কৃপায়। কাছে আসার মধ্যে আসতো দুই ফুপু আর তার ছেলে মেয়েরা। কিন্তু সেখানেও বড় ভাই দিহান সবসময়ই নাকে দম করে রেখেছে ঠিক আমার বাবার ছায়া হয়ে। দিশান ভাই আর ছোট ফুপির মেয়ে দুটো যা আসতো কাছে তারাও বাবা বাড়ি এলে ভয়ে আসতে চায় না। আজ সব ছিন্ন হয়ে গেছে এ জীবনের বন্ধন থেকে৷ ফুপুদের আদরের ছিলাম কিন্তু আজ থেকে আর বড় ফুপিরও আদরের থাকবো না। থাকার পথটাই রাখবো না আমি। বড় ফুপির বড় কলিজা দিহানকে আমি তিলে তিলে শেষ করে ছাড়বো৷ সে-ই হলো আমার জীবনের শনি। চোখের জল গড়ানোর আগেই দু আঙ্গুলে তা মুছে গাড়িতে বসলাম৷ এরপরের সময়টা কেটেছে আরো অবিবীর্ণীয়!
এইটুকু বলেই চৈতী তার গালের কোণায় ভেসে যাওয়া জলটুকু মুছলো৷ দুপুরের খাওয়া শেষ হতেই ভাতঘুমের আয়োজন চলে দিহানদের বাড়িতে। কিন্তু দিশানের বাগদত্তা ঐশীর জোরাজুরিতে চৈতী ঘুমাতে গেল না। চৈতীর বিয়ের আজ এক সপ্তাহ চলে এই এক সপ্তাহে দিহান বাড়িতে আসেনি একবারও। দিহানের ছোট ভাই দিশান ঐশীকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে আজ চৈতীর জন্যই। মেয়েটা জোরজবরদস্তির এই বিয়েটা মানুক বা না মানুক দিশান খুব কেয়ার করে তার। চৈতীকে সে ভাবী বলে মানবে কিনা ঠিক নেই কিন্তু মামাতো বোন হিসেবে এতকাল দেখে এসেছে আজও তেমনই দেখে। চৈতীর মনমরা হয়ে থাকা তার ভালো লাগে না আর তাই সে মাকে বলেছিলো চৈতীকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু চৈতীর ফুপুও তার বাবার মতোই জেদী মানুষ৷ তিনি এক কথায় বলে দিয়েছেন, ‘চৈতীকে আমি এ বাড়ির ত্রিসীমানা থেকে বের হতে দিবো না। কিসের এত বড়াই দেখাচ্ছে এই মেয়ে! আমার দিহান তার জন্য বাড়ির বাইরে পড়ে আছে এর শাস্তি তো তাকে দিবোই।’ মায়ের কথা দিশানের ভালো লাগেনি। সম্পর্কগুলো এভাবে নষ্ট করার কোন মানে হয় না! সে নিজেই আজ ঐশীকে এনেছে আর আগেই বলে রেখেছে তাকে চৈতীর সাথে গল্প করতে। এতে হয়তো চৈতীর মনের গুমোটভাবটা একটু কাটবে! বিয়েটা ছেলে খেলা নয় দিহানের এমন গায়েব হওয়া তার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। দিশান জানে দিহান অফিস একাউন্ট থেকে টাকা তুলে সেই টাকায় দূরে কোথাও গিয়েছে। বড় ভাই যতোটা বাউন্ডুলে দিশান ছোট হয়েও ততোটাই গোছালো ছেলে। বাবা হলো মেনিমুখো শাষণ বারণ জানেন না।
ঐশী তার হবু ভাশুরের আচমকা বিয়ের খবরটা পেলেও ঘটনা কি ঘটেছিলো তা জানতো না৷ আর তাই খাওয়ার পরপরই সে চৈতীকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জানতে চায় কি হয়েছিলো আসল ঘটনা৷ চৈতী স্বাভাবিকভাবেই এতক্ষণ সবটা বলেছে। ঐশীর মন খারাপ হয়ে গেল সব শুনে। সে কিছুই বলতে পারছে না যেন সে শকড ঘটনা শুনে৷ চৈতী খাটের হেডবোর্ডে হেলে বসেছিলো। এখন সে খাট থেকে নেমে এলোমেলো চুলগুলোকে হাত খোঁপা করে নিলো৷
‘কি ভাবছো আপু?’ ঐশীর উদ্দেশ্যে কথাটা বলেই চৈতী ঘরে থাকা পানির জগটা হাতে নিলো। দিশানের বিয়ে অনেক আগেই ঠিক হওয়ায় ঐশীকে আপু বলে ডাকে। কথা ছিলো দিশান ভাইয়ের বউ হিসেবে ভাবী ডাকবে ভবিষ্যতে কিন্তু পরিস্থিতি বদলে এখন চৈতী সম্পর্কে বড় হয়ে গেল। ঐশী মুখটাকে পাংশু করে চৈতীর দিকে তাকালো।
‘চৈতী, মামা মানে তোমার বাবা কি তোমার আপন বাবা নয়?’ ঐশীর কথা শুনে হাসি পেল খুব চৈতীর। সে হাসতে হাসতেই বলল, ‘ঐশী আপু বসো তুমি। পানি নিয়ে আসি জগটা খালি’ বলেই চৈতী ঘর ছাড়লো। দিহানদের বাড়িটা তিন তলা আর তারা থাকে নিচ তলায়। উপরের দুই তলায় দিহানের বাবার গোডাউন। চৈতী ডাইনিংয়ে রাখা ফিল্টার থেকে জগ ভরে পানি নিয়ে আসলো নিজের ঘরে। ঘরটা দিহানের আর তাই যেদিন চৈতী এ বাড়ি এলো সেদিনই এ ঘরে প্রবেশ করেছে থাকার উদ্দেশ্যে। কেউ কিছু বলেনি তাকে আর না সেও কারো কোন কথার অপেক্ষায় ছিলো! পানির জগ নিয়ে ঘরে ঢুকতেই ঐশী ব্যতিব্যস্ত হয়ে চৈতীর মুখোমুখি হলো।
‘ অভ্র মানে তুমি যাকে ভালবাসো সে এখন কেমন আছে বা তার সাথে কি হয়েছে তা কি তুমি জানো!’ ঐশী কথাটা বলেই কেমন ভয়ার্ত চোখে তাকালো চৈতীর দিকে৷ মেয়েটা কি কষ্ট পেল এই প্রশ্ন করায়!
চৈতী একটুও কষ্ট প্রকাশ না করে ঠোঁট দুটো টেনে প্রশস্ত করলো৷ মাথা এপাশ ওপাশ করে জবাব দিলো না সে জানে না৷ কয়েক মিনিট নিঃশব্দে কাটলো সময়। তারপরই চৈতীর ফুপু এসে ঢুকলেন ঘরে।
‘আরেহ মামনি তুমি এখানে কি করছো? আসো একটু রেস্ট নাও। আবার তো বিকেল হতেই চলে যেতে চাইবে।’
‘না আন্টি রেস্ট নিতে হবে না। চৈতী একা এখানে তাই ভাবছিলাম বসে গল্প করি৷’
চৈতী জগ থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে মুখে দেওয়ার সময় আঁড়চোখে দেখলো তার ফুপি তির্যক চোখে তার দিকেই চেয়ে আছে। সেই চাহনিকে তোয়াক্কা না করেই চৈতী বলল, ‘ফুপি অনেক দিন তো হলো আমার বিয়ে হয়েছে। বলেন তো বাসরটা কবে হবে? আমার বর হাঁদারাম’ বলেই জ্বিভে কামড় দিয়ে আবার বলল, ‘না মানে আমার বরটা কবে যে বাড়ি আসবে!’
চৈতীর কথাটা এমন শোনালো যেন দিহানকে না দেখতে পেয়ে মরমে মরে যাচ্ছে সে। আর ঐশী তো লজ্জায় চোখ দুটো বুঁজে নিচ্ছিলো। চৈতী এসব কি বলছে আন্টির সামনে ভাবতেই ঐশীর শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেল। চৈতীর ফুপুও হাড়ে বজ্জাত মহিলা তিনিও ছেড়ে দিলেন না।
‘তোর কারণেই তো আমার ছেলেটা বাড়ি আসে না। নিজের ভাইয়ের ভালো করতে গিয়ে আমি আমার ছেলের সর্বনাশ করে ফেলেছি।’ ফুপির কন্ঠে শ্রাগ তিনি বড় ছেলে বাড়ি নেই বলে সত্যিই কষ্ট পাচ্ছেন।
সন্ধ্যের পর ঐশী চলে গেছে নিজের বাড়িতে। দিশানই দিয়ে এসেছে তাকে আর যেতে যেতে ঐশীকে বারংবার জিজ্ঞেস করছিলো চৈতীর সাথে কি কথা হলো? ঐশী মুখ খোলেনি কিন্তু একটা কথা সে অবশ্যই বলেছে।
দিশানের হাত দুটো ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছে, ‘ আর যাই করেন দিশান আমাকে ছেড়ে দিয়েন না। ভালোবেসে ফেলেছি খুব প্লিজ পারিবারিক কোন সমস্যা হলেও ছাড়বেন না আমায়।আমি চৈতীর মত স্ট্রং নই মরে যাবো ঠিক আপনি ছেড়ে গেলে।’ দিশানের বড্ড অস্থিরতা শুরু সেই থেকেই। ঐশী কি চৈতীর কষ্ট ভেবে এগুলো বলেছে! রাতে বাড়ি ফিরে সে এলো চৈতীর ঘরে৷ চৈতী তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ করে ছিলো।
‘কি দেখছিস আকাশে?’
দিশানের গলার আওয়াজ পেয়ে চৈতী তড়িঘড়ি করে গাল মুছলো। বারান্দার আলো নেভানো কিন্তু ঘরের আলো কিছুটা পড়ছে বারান্দায় আর সেই আলোতেই দিশান দেখেছে তাকে চোখ মুছতে। খারাপ লাগলো তার এই বোনটির জন্য কিন্তু মুখে তা প্রকাশ না করে সে আবারও বলল, ‘মামীর কথা মনে পড়ে না তোর?’
‘কার কথা বলছো?’
‘এমন ঢং করিস না চৈতী। সত্যি করে বল তুই একটা সপ্তাহ ধরে এখানে আছিস আর এই এক সপ্তাহে মামি তোকে অসংখ্যবার ফোন দিয়েছে।কথা বলিস না কেন তাঁর সাথে! বেচারীর কি দেষ বলতো যা করেছে দিহান ভাইয়া আর মামা করেছে।’
‘ওহ রিয়্যালি ভাইয়া!’ শ্লেষাত্মক হাসি হেসে বলল চৈতী।
‘তোমার মামি কিছুই করেনি এটাই তার দোষ ভাইয়া। দুনিয়া জুড়ে আমার মা স্যরি তোমার মামীর মত মেরুদণ্ডহীন মা আর কোথাও পাবে না খুঁজে দেখো।’ চৈতীর চোখ বেয়ে গড়িয়ে গেল অশ্রুধারা। দিশান চুপ করে রইলো কি বলবে! চৈতী আবারও বলল, ‘আমার জন্মটা আমার পাপ বলে মনে হয় জানো!’
‘এভাবে বলিস না বোন আল্লাহ নারাজ হবে।’ এ কথাতেই যেন চৈতী চুপ হয়ে গেল কিন্তু তার কান্না থামলো না। দিশানের আর ভালো লাগলো না দাঁড়াতে। সে কি বলতে এসেছিলো তাই যেন ভুলে গেল। ডান হাতটা উঠিয়ে কান্নারত চৈতীর মাথায় কয়েক সেকেন্ড রেখে সে চলে গেল। যাওয়ার সময় ধাক্কা লাগলো দরজায়। দিহান এসেছে হন্তদন্ত হয়ে। চৈতী তখনও বারান্দায় টের পায়নি দিহানের ঘরে প্রবেশ। দিশানও চুপচাপ বেরিয়ে গেল।
দিহান ঘরে ঢুকে প্রথমেই তার আলমারি খুলতে গেল। মাসখানেক আগেই তার এক বন্ধু তাকে চট্টগ্রামের বড় এক কোম্পানিতে জব অফার করেছিলো। বাবার ব্যবসায় ঢোকার কোন ইচ্ছে তার কখনোই ছিলো না। ব্যবসাটা দিশানের জন্যই ঠিক আছে তার চাকরি করার সাধ! আজ বন্ধুটি আবারও বলেছে করতে চাইলে চট্টগ্রাম আয় তোর সিভি,সার্টিফিকেটসহ। জব হয়ে গেলে মাত্র ছ’মাস তারপরই অফিস থেকে ফ্ল্যাট পাবে থাকার জন্য।’ মনঃপুত এই চাকরির কথা সে ফেলতে চায় না আপাতত এটাই করবে দু’বছরের মধ্যে সে বিদেশে চলে যাবে। তারপর সেখানেই স্যাটেল হবে। চৈতীর মুখদর্শনও করবে না এরপর। মামা জোরজবরদস্তির বিয়ে দিলেই হবে নাকি! সে তো চৈতীকে বিয়ে করার জন্য সেদিন অভ্রকে মারেনি। নিজেদের বাড়ির মেয়েকে ওভাবে খোলামেলা জায়গায় একটা ছেলের সাথে দেখে তার রাগ হয়েছিলো। কে জানতো সেই রাগ তার গলায় এনে চৈতীকে বাঁধবে তাহলে সেদিন ভুলেও এমন কিছু করতো না। মামার সম্মানের কথাও ভাবতো না৷ চৈতী যাক জাহান্নামে তার মরুভূমির মত জীবনটায় কোন ভাবেই বর্ষনকে ঠাঁই দেওয়া সম্ভব নয়। আলমারি থেকে নিজের প্রয়োজনীয় সার্টিফিকেটসহ কাগজপত্র গুছিয়ে আলাদা একটা ফাইলে রাখলো। এবার ট্রিপে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করতো যেই ট্রলিব্যাগটা সেটা নামালো আলমারির উপর থেকে৷ সেটা নিচে রাখার সময় একটু শব্দ হলো আর সেই শব্দেই চৈতী বারান্দা থেকে ঘরে এলো। শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে দিহানকে দেখে স্বাভাবিক ভাবে সামনে এসে দাঁড়ালো। তখনো তার দু গালে জলের ছাপ৷ গলার ওড়ানাটা বুকের উপর ঠিকঠাক নেই তা দেখেও সে ঠিক করলো না। দিহান একপলক তাকে দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো। আলমারি থেকে কাপড়চোপড় নামিয়ে ব্যাগে ভরে নিলো। চৈতী চুপচাপ দৃশ্যটা অবলোকন করছে। দিহানের ব্যাগ গোছানো শেষ হতেই সে নিজের ফোনটা পকেট থেকে বের করে ছুঁড়ে মারলো বিছানায় সেই সাথে ওয়ালেট থেকে কয়েকটা পাঁচশো টাকার নোটও ছুঁড়ে ফেলল।ব্যাগটা টেনে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোর সেই নাগরকে ফোন করে দেখিস ব্যাটা জীবিত আছে কিনা। থাকলে ওই টাকাগুলো নিয়ে কোন এক ফাঁকে তার সাথে পালিয়ে যাস।’
চলবে