আনকোরা পর্ব-২২

0
2706

#আনকোরা

#রূবাইবা_মেহউইশ
২২.

প্রকৃতি মানুষকে উজার করে দেয় আর এটাই বোধহয় প্রকৃতির সত্তা।কিন্তু আমরা মানুষরা কি তা পারি! মানুষের প্রবৃত্তিতে স্বার্থ এক অলিখিত নিয়ম৷ স্বার্থের কড়াল গ্রাসে মানুষ কত কি ভুলে যাই! দিহানের প্রেমিক মন তার মৃত প্রেমিকার আত্মতৃপ্তির স্বার্থেই সে জাগতিক বর্তমান সম্পর্ক ত্যাগ করে চলে এসেছে। কিন্তু তাতে কি আদৌও মৃত ব্যক্তির আত্মতৃপ্তি সম্ভব! মৃতদের এই জগতের সাথে সকল সমন্ধের সমাপ্তি ঘটে শেষ নিশ্বাসের সাথেই। মৃত ব্যক্তি অব্দি এ জগত থেকে যদি কিছু পৌঁছায় তা হলো আপনজনদের দোয়া। কিন্তু সেই দোয়াও তখনি তার প্রাপ্য হয় দোয়াকারী ব্যক্তিটা যদি হয় তার মাহরাম। হালাল সম্পর্কের মানুষ কিন্তু দিহান তো তাও নয় প্রিয়ন্তির জীবনে। আর এখানেই তার কষ্টের দেয়ালটা মোটা। তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার জন্য সে মাহরাম নয় , নাজায়েজ সম্পর্কের এক মানুষ। দিহানের জীবনের ছন্দ কেটে গেছে তা আর জোড়া লাগার নয়।কিন্তু নতুন ছন্দে নিজেকে সুর তরঙ্গে বুনতেও সে নারাজ। বাড়ি থেকে সেদিন সে চট্টগ্রামে এসে উঠেছিল বন্ধুর বাড়িতে। বন্ধু বিবাহিত মানুষ দুই কামরার এক ফ্ল্যাটে তারা স্বামী-স্ত্রী আর এক বছরের কন্যা থাকে। দিহানকে সে অনায়েসেই গ্রহণ করলো তার বাড়িতে মেহমান হিসেবে। কিন্তু সেটা সল্প সময়ের জন্য।দিহানের ভার্সিটি ফ্রেন্ড অপু বছর দুই আগেই বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছিলো চট্টগ্রামে। তার ভালে একটা কোম্পানিতে ম্যানেজার পদে চাকরি হয়েছে। সেই সুবাদেই এখানে থাকা। সে তারই কোম্পানিতে দিহানের অনুরোধে চাকরির ব্যবস্থা করেছিলো একবার৷ তখন দিহান বিয়ে আর পরিবারের ঝামেলায় আসতে পারেনি। কিন্তু এবার যখন সে এলো বন্ধুর কাছে তখন আর সেই চাকরির সুযোগ নেই। ছন্নছাড়া, বিধ্বস্ত রুপী দিহানকে দেখে বন্ধু অপু প্রথমেই চাকরি নিয়ে কিছু বলতে পারেনি। তাকে নিয়ে নিজের বাড়িতে রাখলো সপ্তাহখানেক। কিন্তু চাকরির ব্যবস্থা হুট করেই সম্ভব নয় তবে ভাগ্য ভালো আগের বার সার্টিফিকেটের যেই কপি গুলো দিয়েছিলো সবই এক্সট্রা কপি ছিলো অপুর কাছে। সে তার এক পরিচিতের মাধ্যমে অন্য এক কোম্পানিতে চাকরির ব্যবস্থা করে দিলো। দিহান আসার সময় টাকা পয়সা নিয়ে আসেনি। হাজার পাঁচেক ক্যাশ আর তার বিকাশ একাউন্টে কিছু আছে। ভেবেছিলো একটা ফ্ল্যাট নিবে কিন্তু তা অসম্ভব। তার যা আছে টাকা পয়সা তাতে সে ফ্ল্যাটের এডভান্সই পে করতে পারবে না আর যা চাকরি তাতে বেতনও খুব কম। জন্মের পর থেকে বাবার টাকায় জীবন চালিয়েছে বলেই হয়তো তার চোখে বাস্তব রঙিন ছিল। কিন্তু এক সপ্তাহ থাকার পরই যখন এক রাতে শুনলো অপু আর তার বউয়ের তর্কাতর্কি সেদিন প্রথম উপলব্ধি করলো জীবন নিজ মর্জিতে চলে না। অপুর যা ইনকাম তাতে তার দিহানকে একমাস বসিয়ে খাওয়ানো অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু অপুর বউ মানুষটা একটু হিসেবি সেই সাথে নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে একটি বেশিই চিন্তিত। মাস শেষে খরচের বাইরের সবটা সে জমা রাখে। কিন্তু দিহানের কারণে তার প্রতিদিনকার খরচের পরিমাণ বেড়ে গেছে। সেই সাথে মাছ, মাংসের রান্নাটাও বেড়েছে। বলা বাহুল্য, দিহান বাড়িতে থাকলে সে ঘর থেকে বেরুতে একটু সংকোচবোধ করে। আর এটাও তার সমস্যায় যুক্ত আরেকটা কারণ। নিজের ঘরে নিজেকেই সারাক্ষণ সতর্কভাবে চলতে হয় পরপুরুষের জন্য এটা মেনে নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো অপুর বউয়ের। দিহান তাদের তর্কাতর্কির মূল কারণ জানতেই পরেরদিন বেরিয়ে গেল একটা থাকার জায়গা খুঁজতে। প্রথমদিন না পেলেও দ্বিতীয়দিন ব্যবস্থা হয়ে গেল একটা মেসে। এক রুমে দু’জন দুটো কাঠের চৌকিতে থাকবে। দিহান চলে এসেছে অপুর বাড়ি থেকে আর চাকরিতেও জয়েন করেছে যথাসময়ে।এক টানা এক মাস সে খোঁজ নিলো না বাড়িতে। বাড়ি থেকেও কেউ তার খোঁজ নেয়নি আর কেনো নেয়নি সে জানে। মা নিশ্চয়ই ঘোষণা দিয়েছে দিহানের সাথে সব সম্পর্ক শেষ। কিন্তু দিহান ভাবে নিজেকে বুঝিয়ে নেই আরেকটু তারপর নিজেই যাবো মায়ের কাছে। মা বেশিক্ষণ মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবে না তার থেকে। কিন্তু সে কখনো চৈতীকে ক্ষমা করবে না। সময় পেলে সে নিশ্চয়ই নিজেকে চৈতীর জীবনে জড়িয়ে নিতো কিন্তু তার সত্যিই অনেকটা সময় দরকার ছিলো। যা চৈতী তাকে দেয়নি। সেদিন সে এতোটাও নেশায় ছিলো না দিহান জানে। এনেস্থিসিয়াতে মানুষ এতখানিও বেহুঁশ হয় না সে জেনেছে কিন্তু চৈতী কেন সেদিন এমন আক্রমণাত্মক আচরণ করলো কিছুতেই বুঝতে পারলো না দিহান। শুধু মনে হলো চৈতী যা করেছে তা অন্যায় আর এ অন্যায় সে কিছুতেই ক্ষমা করবে না।

“তোর কি খুব বেশিই খারাপ লাগছে চৈতী?”
বিছানায় আধশোয়া চৈতীর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করলো দিলশাদ। চৈতী চোখ মেলে ফুপির দিকে তাকালো। দিলশাদ আজ বহুদিন পর শাড়ি পরেছে। দিশানের বিয়েতে পরেছিলেন প্রায় প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানেই৷ তখন তিনি চুলে ফুলও গুঁজেছিলেন খুব যত্ন করে। চৈতী খেয়াল করেছিলো তার ফুপিকে বাড়িতে সেলোয়ার-কামিজে দেখলে বয়সটা বোঝা যায় কিন্তু তিনি শাড়ি পরে একটু সাজগোজ করলেই কেমন বয়সটা কম লাগে। আর দেখতেও ভারী মিষ্টি লাগে। আজও লাগছে কিন্তু আজ চুলের খোঁপায় কোন ফুল নেই। চৈতী ফুপির কথার জবাব না দিয়ে বলল, “তোমাকে অনেক মিষ্টি লাগছে ফুপি।”

“আচ্ছা! তোকে যা জিজ্ঞেস করলাম তা বল।”

“না বেশি তো খারাপ না তবে পেটের ব্যথাটা এখনো আছে।”

“তোর কি প্রত্যেকমাসেই এমন হয়! ডাক্তার দেখিয়েছিলি?”

“কই না’তো গত মাসেও কোন পেইন ছিলো না। হ্যা পিরিয়ড চলাকালীন কিছুটা থাকে।”

“ডাক্তারের কাছে যাবি? এক কাজ করি অনামিকার নাম্বার আছে তাকেই ফোন করি।”

” আরে না ফুপি লাগবে না। ডেট তো আরো দু দিন পরে। পিরিয়ডের সময় কাছে তাই হঠাৎ হচ্ছে হয়তো।ঐশী আপু কি তৈরী হয়ে গেছে?”

“হ্যাঁ সবাই তৈরী কিন্তু তুই!”

“আমি বাড়িতে থাকি। দিশা আপুর জন্য ঘরটা আরেকটু সাজিয়ে দিবো। তোমরা যাও বেরিয়ে পড়ো।” চৈতী বিছানা ছেড়ে নামলো। আজ দু দিন হয় দিশানরা দোতলায় শিফট হয়েছে। দিশার সকল অন্যায় ভুলেই তাকে আজ বাড়িতে আনা হবে। যতোই হোক মেয়ের প্রথম সন্তান হবে তাই দিলশাদ আর মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারলো না। দিশার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আগেই সব মেনে নিয়েছিলো এবার দিলশাদও মেনে নিলো। আর তাই দিশার প্রেগন্যান্সির ছয় মাস পূর্ণ হতেই সে আয়োজন করে মেয়েকে আনতে যাচ্ছে। কাল থেকে চৈতীও খুব উৎসাহ নিয়ে তোড়জোড় চালাচ্ছিলো খুশিতে৷ কিন্তু সকাল থেকেই তার হঠাৎ পেটে,কোমরে ব্যথা অনুভব করছে। পিরিয়ড ডেট সামনে বলেই হয়তো ব্যথা এটাই ভেবে নিয়েছে সে। ঐশীও একবার এসে দেখে গেল চৈতীকে। যাওয়ার সময় বারবার সতর্ক করে গেল যেন সাবধানে থাকে। বাড়িতে চৈতীর কাছে ময়না খালা ছাড়া আর কেউ নেই। চৈতীর মায়েরও এখানে থাকার কথা ছিলো কিন্তু দিহানের হঠাৎ গায়েব হওয়ার কথা যেদিন জানতে পারলো সেদিনই একটা যুদ্ধের সূচনা হয়ে গেল চাঁদ খান আর তার বোনের মধ্যে। সুইটি প্রথমে নিশ্চুপই ছিলো কিন্তু চৈতীকে নিজেদের কাছে ফিরিয়ে নিতে চাইলে দিলশাদ বাধ সাধেন। তাই আর সুইটি মুখ না খুলে পারেনি সেদিন৷ তার পর কি করে কি করে যেন চৈতীও নিজে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। সে এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না। চাঁদ আর সুইটিকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর আর সুইটি চৈতীর সাথে কথাটাও বলছে না ঠিকঠাক। দু দিন আগে যখন দিশাকে আনতে যাওয়ার কথা হলো তখন দিলশাদ নিজেই ফোন করে দাওয়াত করলেন ভাই আর তার বউকে। কিন্তু তারা কেউ আসবে না বলে মুখের ওপর সাফ জানিয়ে দিয়েছে।

আকাশে আজ রোদের উত্তাপ নেই। চৈতী ব্যাথা কম হয়েছে অনুভব করলো। পরীক্ষা চলছে তার প্রথম বর্ষের। এ সপ্তাহে তার একটাই পরীক্ষা আর প্রস্তুতিও ভালোই নেওয়া আছে। তবুও বইটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলো। বই খুলে বইয়ের পাতায় চোখ রেখে চলে গেল সে অন্য ভাবনায়। গত মাসে দিহান যেদিন ভোরে বাড়ি ছেড়ে গেল সেদিন সে সারাদিন তার ফুপির চোখের সামনে গেল না। দিলশাদ খুব কেঁদেছিলেন সেদিন আর তার কান্না দেখে চৈতীর মনে হচ্ছিলো এ কান্নার পেছনে কারণটা সে। ফুপির সন্তান ফুপি থেকে দূরে চলে গেছে তার ভুলের কারণে৷ এতোটা তাড়াহুড়ো সত্যিই সেদিন অন্যায় হয়েছে কিন্তু কি করতো সে! দিহানকে মনের ভেতর কিছুতেই আনতে পারছিলো না৷ মন না হোক মস্তিষ্কে বসানোর জন্য হলেও কিছু না কিছু করা দরকার ছিলো। তার মনে হয়েছিলো প্রতিটা এ্যারেন্জ ম্যারেজ নিশ্চয়ই পাত্র পাত্রীর পছন্দ জেনে হয় না কিন্তু তবুও তারা সংসার করছে,সন্তান জন্ম দিচ্ছে৷ আর একটা সময় তারা খুব স্বাভাবিকভাবে সংসারও করছে যেমনটা করছে তার ছোট ফুপি! সে জেনেছিলো তার ছোট ফুপিকে মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়েছে দাদু শুধুমাত্র ফুপা ইন্জিনিয়ার বলে৷ ফুপাও ফুপিকে ঠিক পছন্দ করে বিয়ে করেননি মায়ের বাধ্যগত ছেলে বলে মায়ের পছন্দে করেছেন৷ কিন্তু তারা এখন আদর্শ স্বামী-স্ত্রী কেউ কারো পছন্দের না হয়েও৷ দুই সন্তানের সুখী মা- বাবা তারা অন্তত তার নিজের মা বাবার চেয়ে। সেও চাইছিলো মন না হোক দেহের সংস্পর্শে কাছে থাকুক তারা। এতে দুই পরিবারে তাদের দুজনের সৃষ্টি জটিলতাগুলো তো অবসান হতো। হায়! এটাই যে তার করা চরম ভুলে পরিণত হবে তখন কি সে জানতো!

“কিছু খাইবা না খালা?”
হঠাৎ ময়না খালার প্রশ্নে চৈতীর ঘোর কাটে। সে ভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাকায় ময়না খালার দিকে৷ খিদে নেই তার সকাল থেকেই এখন যেন খাওয়ার কথা শুনতেই গা গুলিয়ে গেল।
“না খালা এখন খাবো না।আপনি নাশতা করেছেন?”

“না, তোমার খাওয়া হয় নাই দেইখা অপেক্ষা করতাছিলাম।”

“আপনি খেয়ে নেন খালা।আমি দুপুরের আগে কিছু খাবো না।”

ময়না চৈতীর চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো একটু সময়।হঠাৎই প্রশ্ন করে বসলো, “তোমার কি কিছু হইছে? শরীরের কি কোন পরিবর্বতনের আভাস পাও?”

“বুঝলাম না খালা কিসের পরিবর্তন! ”

ময়না খালা চৈতীর মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও বলল, “তোমার চোখ মুখ শুকনা লাগে। চোখের নিচে কালি পড়ছে আবার দু একদিন পর পরেই তোমার খাওয়া বালা লাগে না কও।”

“ওহ! তেমন কিছু না পরীক্ষার জন্য রাত জাগছি কিছুদিন ধরে। এজন্যই চোখ মুখ শুকাচ্ছে আবার খাবারে অনীহা। রাত জাগলেই আমার এমন হয়।”

“ও আইচ্ছা, আমি আরো অন্য কিছু মনে করছিলাম।”

“অন্য কিছু কি!”

“কিছু না তুমি খিদা লাগলে আমারে কইয়ো।বেলা অনেক হইছে এট্টু পর তো দুফুরের খাওনের সময় হইবো।” কথাটা বলে ময়না খালা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। চৈতী হাতের বইটা কোলের ওপর রেখে ভাবতে লাগলো সত্যিই তার পরিবর্তন হয়েছে। মানসিক সাথে শারীরিকও কিন্তু ময়না খালা কোন পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিলো!

রাতে দিলশাদের বাড়িতে ঈদের আমেজ ফিরে এলো মেয়ে আর মেয়ে জামাই আসতেই। চৈতীরও ব্যথা নেই এখন সেও খুশিতে ছুটোছুটি করছে।কখনও দিশার কাছে বসছে কখনও দিশার পেটে হাত রেখে বাচ্চাকে অনুভব করতে চাইছে আবার কখনো দিশার হাজবেন্ড আবিরের আপ্যায়নে ব্যস্ত হচ্ছে। চৈতীর এত হুড়োহুড়ি দেখে দিশা তো বলেই ফেলল, “তুই এখনও বড় হলি নারে চৈতী! এত ছুটোছুটি করে কোথাও একটা ব্যথা লাগিয়ে বসবি।”

“কিছু হবে না আপু আ,,,,,” জবাব দিতে দিতেই চৈতী পা পিছলে ফ্লোরে পড়ে যাচ্ছিলো। একটু পানি ছিলো সেখানে আর তাতেই অসাবধানতার জন্য এমনটা হয়েছে । ভাগ্যিস আবির সামনেই ছিলো। সে চৈতীর কনুই চেপে ধরে রাখায় আর পড়তে পারেনি নিচে।সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলো চৈতী কিন্তু হাসির বিপরীতে তার চোখে আবিরের অন্যরকম দৃষ্টি আটকালো। দিশা দুজনের দিকেই তাকিয়ে সে চৈতীকে উদ্দেশ্য করে বলল, ” বড় ভাইয়ার সাথে তোর কথা হয়?”

“আপু তুমি চা খাবে?”

“না’রে আমি একটু শোব। শরীরটা বেশ ক্লান্ত লাগছে।”

“আমাকে দিতে পারো এক কাপ শালি সাহেবা নিজ হাতে যদি বানিয়ে আনো।”

দিশা তার স্বামীর মুখে তাকিয়েই রইলো। চৈতী কোন জবাব না দিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দিশাদের থাকার জন্য দিশানের ঘরটা রাখা হয়েছে। ভারী শরীর নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠা সম্ভব নয় তার পক্ষে। তাই দিশান দোতলায়ই শিফট হয়ে গেছে। চৈতী চা বানিয়ে দশ মিনিট পরই ময়না খালার হাতে পাঠিয়ে দিয়েছে৷ সে খেয়াল করেছে দিশার হাজবেন্ড আসার পর থেকেই একটু কেমন করে যেন তাকায় সেই সাথে দিহানকে নিয়ে কিছু না কিছু বলছেই। শুধু মাত্র বাড়ির জামাই বলেই চৈতী পাত্তা দিতে চাইছে না তার আচরণ। দিশা এখানে থাকবে এক সপ্তাহের মতন তারপরই দিশার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়রা এসে নিয়ে যাবে দিশাকে আর আবিরও এক সপ্তাহ এখানেই থাকবে। বিয়েটা যেহেতু পালিয়ে হয়েছিলো সে হিসেবে অনুষ্ঠানাদি হয়নি কিন্তু এবার জামাই বাড়ির মোটামুটি কিছু আত্মীয়কে খাওয়ানোর আয়োজন হবে৷ হলোও তাই এক সপ্তাহ পর আবিরের আত্মীয়রা প্রায় পঁচিশ- ত্রিশ জন এসে নিয়ে গেল তাদের। আর এতে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো চৈতী। কারণ এই এক সপ্তাহই আবির যখন তখন তার সাথে কথা বলতে চাইতো। কোন না কোন উছিলায় সে চৈতীর আশেপাশে ঘুরেছে যা পরিবারের সবাই শালি দুলাভাইয়ের হাসিঠাট্টার মত করে দেখেছে। শুধু মাত্র চৈতী আর দিশার চোখেই লেগেছে আবিরের অন্য দৃষ্টি। যে দৃষ্টির অর্থ ছিলো সুযোগ খোঁজা।এ সপ্তাহে যেদিন চৈতীর পরীক্ষা ছিলো সেদিন হুট করেই আবির তৈরি হয়ে দিশাকে বলল তার অফিসে কাজ আছে একটু। বলতে নেই আবিরও ভালো এক অভিজাত পরিবারের সন্তান। তার বাবার নিজের বড় ব্যবসা সেখানেই সে কর্মরত। পড়াশোনা ও মেধায় কিছুতেই কমতি নেই শুধু কমতিটা তার চরিত্রে। আর এই একটা কারণেই দিহানের সাথে তার বন্ধুত্বের পরিসমাপ্তি ঘটেছিলো। আর শত্রুতার শুরু দিশার দিকে নজর দেওয়ার পর থেকে কিন্তু দিহানের বোনটা বোকা ছিলো খুব। ফাঁদে পা সে ঠিকই দিয়েছিলো কিন্তু দিলশাদের বুদ্ধির কারণেই দিশাকে বাড়ি থেকে বের করার আগে আবিরের সাথে বিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাতে সংসারে তাদের স্বামী-স্ত্রী হয়ে একসাথে থাকা ছাড়া বিশেষ ফায়দা হয়নি৷ আবির চ যাওয়ার পথে চৈতীকে পরীক্ষার হলে নামিয়ে দিয়ে যাবে বলছিলো।কথাটা শুনতেই চৈতীর মুখ রক্ত শূন্য হয়ে আসে৷ তার প্রতি পরীক্ষায় দিশান নিয়ে গেছে সেদিনও দিশানেরই যাওয়ার কথা। কিন্তু জরুরি কোন মিটিংয়ের জন্য দিশান আর সময় করতে পারেনি এদিকে আবিরও সকলের সামনে দারুন অভিনয় করলো বড় বোনের স্বামী হিসেবে। বাধ্য হয়েই চৈতী তার সাথে যায় আর সারাপথ আবিরের মুখ নিঃসৃত কথা শুনে প্রচণ্ড রকম তিক্ততা অনুভব করে। তার সাধ্যের মধ্যে হলে সে নিশ্চয়ই সেদিন আবিরকে খু/ ন করতো। কিন্তু সে দিনটা কোনমতে কাটলেও সমস্যা বাঁধলো আরো মাস দেড়েক পর যখন দিশাকে ডেলিভারির জন্য একেবারে নিয়ে আসা হলো। সাড়ে সাত মাস চলতেই বাপের বাড়ি এলো দিশা সেই সাথে এলো আবিরও৷ দিশা যে কয়মাস বাবার বাড়ি থাকবে সে কয় মাসে প্রায়ই আবিরও এসে থাকবে৷ দিহান অনেক ভাবেই যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে তার মায়ের সাথে। বাবা আর দিশান প্রায়ই কথা বলে দিহানের সাথে তার সকল প্রকার খোঁজখবরও নেয়। দিহানও নেয় মায়ের খোঁজ, দিশার খোঁজ শুধু এড়িয়ে যায় চৈতীর খবর নেওয়াটা। কেন জানি তার মনে হয় চৈতীর খোঁজ নেওয়াটা আদিখ্যেতা হবে। এরই মাঝে দুয়েকবার ভিডিও কলে দিশাকেও দেখেছে সে। ভাবতেই অবাক লাগে বোনটাকে শেষ যখন দেখেছিলো বাড়ি থেকে বের করার দিন সেদিনও বোনটাকে একদম বাচ্চা লাগছিলো। অনার্সে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছিলো তখন দিশা। মাত্র বছর দেড় গেল আর তাতেই মেয়েটা কেমন বড় হয়ে গেছে। ভারী শরীর, চোখে মুখে মায়া আগের চেয়ে বেড়ে গেছে যেন কয়েক গুণ৷ বোনটা হয়েছে তার মায়ের মতোই দেখতে।দিহানের খুব ইচ্ছে করছিলো কাছে বোনটার মাথায় হাত বুলাতে। তার হবু বাচ্চার জন্য হাজারো খেলনাপাতি দিয়ে ঘর ভরিয়ে ফেলতে। ছোট বেলায় কত আবদার করতো দিশা সেই আবদার গুলো আবারও করুক সে নিজের সাধ্যের সবটা দিয়ে দেবে৷ কিন্তু দিশার পাশেই বসা চৈতীকে তার আওয়াজ শুনেই আর দেখতে ইচ্ছে করলো না।

গত মাসে চৈতীর পিরিয়ডস হয়নি কথাটা সে ভুলে গিয়েছিলো। হতে পারে সেই কোমরের ব্যথা সারতেই আর তার খেয়াল হয়নি৷ কিন্তু এ মাসেও যখন তার পিরিয়ডের ডেট গেল তখন হঠাৎ মনে পড়লো দিশার কথা যা সে ঐশীকে বলছিলো। মেয়েলি আলাপ আলোচনায় থাকতে চৈতীর লজ্জা লাগতো কিন্তু সেদিন ঐশী আর দিশার সাথে বসে আচার খেতে খেতে সে সবটা শুনেছিলো৷ প্র্যাগনেন্সির সময় পিরিয়ড মিস, দৈহিক পরিবর্তন আবার অনেকের শুরুর দিকেই খাওয়ার দাওয়ার সমস্যা।এমনই আরো অনেক সিম্পটম যখন বলছিলো চৈতী শুনেছে এবং নিজ অজান্তেই নিজের সাথে মিলিয়েছে কিছুটা। কিন্তু তখন তার পরীক্ষা সবে শেষ হলো। পরীক্ষার আগে থেকে রাত জেগে পড়াশোনা করছে তাই ধরেই নিয়েছে তার সমস্যাগুলো রাত জাগা নিয়ে। কিন্তু আজ কেন জানি মন খুব অস্থির হয়ে অন্যকিছু ভাবছে। তবে কি ময়না খালার বলা অন্যকিছু এগুলোই ছিলো! অনেকটা সময় নিজেকে বুঝিয়ে বুঝ নিতে না পেরে চৈতী ফুপির কাছেই। মায়ের মত সে তার ফুপির সাথেও সব কথা বলতে পারতো আগে। কিন্তু আজ ফুপির সামনে দাঁড়াতেই সে গুটিয়ে গেল।

“কি রে! কিছু বলবি?”

আলমারির কাপড় গুছিয়ে তাকে রাখতে রাখতে প্রশ্ন করলো দিলশাদ। চৈতী আরো কিছু সময় চুপ থাকলে দিলশাদ এবার হাতের কাজ রেখে ফিরে তাকালো। দু পা এগিয়ে চৈতীর মুখোমুখি হয়ে জানতে চাইলো, “কি হয়েছে? মুখটা মলিন কেন লাগছে তোর! কি বলবি? অনেক দিন ধরেই লক্ষ্য করছি তুই কেমন সেঁধিয়ে যাচ্ছিস তোর ঘরের কোণে। ঠিকমত খাস ন…”

“ফুপি আমার পিরিয়ডস মিস দু মাস ধরে।” ফুপির কথা শেষ হওয়ার আগেই বলল চৈতী। দিলশাদ কথাটা শুনে খুব হালকা ভাবে নিলেন। বললেন, “হয় অনেকসময় এমনটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।”

“আচ্ছা” বলেই চৈতী চলে গেল দিলশাদের ঘর থেকে। দিলশাদও আবার নিজ কাজে মনযোগ দিলো। তারপরই আবার ভুলে গেল চৈতীর কথাটা এমনকি চৈতীও আর মনে করতে পারেনি। পরীক্ষা নেই সারাদিন খাওয়া, ঘুম আর দিশা,ঐশীর সাথে আড্ডা দিয়ে কেটে যায়। কিন্তু এই খাওয়া আর ঘুমের মাঝেও তার অনেক বদল চোখে পড়তে লাগলো সবার। চৈতী যখন বিছানায় যায় তখনি সে ঘুমে তলিয়ে যায় আর খাওয়ার বেলায় গা গুলিয়ে আসে সবসময়ই। আরো এক মাস পরও যখন তার পিরিয়ডের ডেট মিস হলো সেদিনই সে বলল দিলশাদকে। এবার আর দিলশাদের ভুল হলো না। তার নিজেরও এবার খুব চিন্তা হচ্ছিলো চৈতীকে দেখে। একটা মানুষ হঠাৎ করেই কোন কারণ ছাড়া শুকিয়ে যাবে, খেতে পারবে না আবার সে কোন কিছুতেই খিটখিটে আচরণ করবে কেন! এবার চৈতীর সাথে কথা বলতেই সে প্রথম যে প্রশ্ন করলো তা শুনে চৈতী কয়েক মিনিট নিশ্চুপ হয়ে মাথা নুইয়ে রেখেছিলো।
অধের্য্য হয়ে দিলশাদ বললেন, “কি হয়েছে কথা বলছিস না কেন?”

চলবে
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। লেখায় অনেক ধরনের ভুল থাকে। দৃষ্টিকটু কোন কিছু চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here