আনকোরা পর্ব-২৮

0
2309

#আনকোরা
#রূবাইবা_মেহউইশ
২৮.

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি সেই সাথে বাতাসে বকুলের ঘ্রাণ মিশে একাকার। নগরী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকার টঙ দোকানে এক কাপ চা হাতে সময়টা সত্যিই উপভোগ্য কিন্তু অভি শত চেষ্টার পরও তা উপভোগ করতে পারছে না। আর না পারছে তার সঙ্গী মিষ্টার আহমেদ। দুজনেই বৈশাখের ঝড়ে আটকা পড়ে আছে ঢাকা থেকে কিছুটা দূর আড়াইহাজারের একটি গ্রামে। সাথে গাড়ি আছে অভির কিন্তু গ্রামের মেঠোপথে কাদামাটি ডিঙিয়ে যাওয়াটা বেশ কষ্টসাধ্যই বটে! তাই বাজারের কাছাকাছি একটা টং দোকানের শেষ মুহুর্তের কাস্টমার হয়ে বসলো দুজন৷ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তারা কথা বলছিলো নিজেদের নিয়ে। দোকানদার তাড়া দিলো দোকান বন্ধ করবে বলে। দোকানের ঝাপ ফেলে দিলেও সামনে আরেকটা চালা আছে তার নিচেই বেঞ্চ পাতা। অভি কাপের শেষটুকু চা ঢেলে দিলো গলায়। তারপরই কাপ ফেরত দিয়ে ওয়ালেট বের করছিলো। তখনি মিষ্টার আহমেদ তাকে থামিয়ে বলল, “এতটুকু অন্তত দিতে দিন। আর্থিক অবস্থা খারাপ হলেও এক কাপ চা তো আমার অর্থে দিতেই পারি।”

অভি হালকা হেসে বলল, “এভাবে বলাটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। আপনিই দিন আর আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে পড়া উচিত রাত বাড়ছে।”

“হুম”।

মিষ্টার আহমেদ চায়ের দাম দিয়ে দিতেই দোকানি দোকান বন্ধ করে বেরিয়ে গেল। বাড়ি কাছেই লোকটার কিন্তু এই ঝড় বাদলে কাষ্টমার আসার সম্ভাবনা নেই বলেই বাড়ি চলে গেল। অভির গাড়িটা দোকানের পাশেই রাস্তার ওপর। মাত্র হাত দশেক পরেই পিচ ঢালা রাস্তা কিন্তু গাড়ির চাকা যেভাবে মাটিতে আটকে আছে তাতে ধাক্কা ছাড়া এটাকে সরিয়ে নেওয়া অসম্ভব। আর বাইরে যা বৃষ্টি তাতে গাড়ি ধাক্কা দিলে নিজেরা কাদামাটি সাথে বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার হবে। এই যে বেঞ্চিতে বসে আছে সেখানেই তো বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে গায়ে, মুখে।
অভি ফোন বের করে সময়টা দেখলো। এখানে ভালোই নেট পাওয়া যাচ্ছে তাই সে হসপিটালে ফোন করলো। প্রথমবারেই ফোনটা রিসিভ হলো। সে প্রশ্ন করলো, ” এখন কেমন আছে?”

ওপাশ থেকে জবাব এলে পুনরায় জানতে চাইলো, “আজ কি একবারও কথা বলেনি, বা কোন প্রকার ইশারা করেনি?”

তারপরের জবাব শুনে হতাশাপূর্ণ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল অভি৷ ফোনটা পকেটে রেখে অদূর অন্ধকারে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। পাশে থাকা মানুষটা এবার কৌতূহলী হয়েই প্রশ্ন করলো, ” কি হয়েছিলো তার?”

অভি উদাস আর নিষ্প্রাণ চোখে এবার ফিরে তাকালো মিষ্টার আহমেদের দিকে। বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে। অভি বলল, “প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় হবে আমি তাকে প্রথম দেখেছিলাম হাসপাতালের করিডোরে। দেখেছি বললে ভুল হবে ভুলবশত ধাক্কা খেয়েছিলাম৷ সে পায়চারী করছিলো সেখানে। আর আমি চট্টগ্রাম মেডিকেলে যাবো বলে বাড়ি থেকে তৈরি হয়ে বেরিয়েছিলাম সেদিন। আম্মু, আব্বু দুজনেই হাসপাতালে ছিলো তাই ভাবলাম দেখা করে যাই।আম্মুর সাথে ফোনে কথা বলতে বলতেই ঢুকেছি আমি। কখন যে তার সাথে ধাক্কা লেগে গেলো খেয়াল করিনি সেও করেনি। কিন্তু সে নিজের দোষ না দেখে উল্টো আমাকেই ধমকে উঠলো। আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আম্মুর কাছে গেলাম। তবে যেতে যেতে বেশ অবাক হয়েছিলাম তার উচ্চতার জন্য। মেয়েটা এত লম্বা! কৌতূহল নিয়ে আবার পেছন ফিরে তার মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু সে নেই সেখানে। আমি আম্মুর সাথে কথা বলতে বলতেই একজন মহিলা কেবিনে ঢুকলো। খেয়াল করলাম এই মহিলাটাও ঠিক মেয়েটির মতোই লম্বা৷ আম্মু আমাকে সেই মহিলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন আম্মুর বন্ধুর বোন বলে। সেই আন্টির ছেলেকে ভর্তি করিয়েছে বলেই আম্মু সকালে আবার এসেছেন। আব্বু খুব যত্ন নিয়ে তাদের পেশেন্টের চিকিৎসা করছেন। আর তার কিছুক্ষণ পরই আমি দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে মোহনীয় আর সাংঘাতিক রাগী মুখটা দেখতে পেলাম আম্মুর পাশে৷ এই প্রথম ঠিক প্রথমবার আমি অনুভব করলাম আমার জীবনে সবচেয়ে প্রিয় সমুদ্রের জলের চেয়ে প্রিয় কিছু এই দুনিয়ায় আছে। আম্মু জোর করে তাকে নাশতা করাচ্ছিলো আর আমি কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে পর্দার আড়াল থেকেই তাকে দেখে চলে গেলাম। মন বলছিলো এখানে আর এক মুহুর্ত থাকলে আমার বুকে ঝড় বইবে।”

অবাক হয়ে শুনছে মিষ্টার আহমেদ কিন্তু তিনি পুলকিতও হচ্ছেন অভির মুখের হাসি দেখে। একটু আগেই কেমন উদাস ছিল ছেলেটা আর মুহুর্তেই কেমন মুখের রঙ বদলে গেল প্রেয়সীর কথা বলতে বলতে। ভালোবাসা জিনিসটাই এমন মানুষকে বদলে দেয়, বদলে দেয় মানুষের মন আর রুপ সবটাই। সে নিজেও তো একটা মানুষের জন্য বদলে গিয়েছিলো। বৃষ্টি একদমই হচ্ছে না এখন তবে বাতাসের জোর কমেনি৷ অন্ধকারে ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে আর কতক্ষণ বসা যায় তার চেয়ে ভালো কাদামাটি ডিঙিয়ে রাস্তায় ওঠা দরকার। অভি বলল, আমাদের এখান থেকে বের হওয়া দরকার। এমনিতেও শুনেছি এই এলাকায় প্রচুর ডাকাতি হয়। মিষ্টার আহমেদ সম্মতি জানিয়ে উঠে দাঁড়ালো। অভি গাড়ির কাছে যেতেই মিষ্টার আহমেদ বলল, আপনি গাড়িতে বসুন আমি ধাক্কা দিচ্ছি৷ অভি ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। গাড়ি চলতে শুরু করলো এবার ঢাকার উদ্দেশ্যে। অভি আজ সকালে এসেছিলো আড়াইহাজারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ইনভাইট পেয়ে। মিষ্টার আহমেদের মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই লোকটা ছন্নছাড়া হয়ে জীবন কাটাচ্ছে৷ বাড়িতে কেউ নেই তার। কিছুদিন হলো ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে শপিংমলে কসমেটিক শপ কিনেছেন। ব্যবসা ভালোই চলছে শুধু জীবনটাই তার কেমন যেন চলছে না কিছুতেই। অভির সাথে তার প্রথম আলাপ হয়েছিলো হাসপাতালেই যখন মিষ্টার আহমেদের মা মৃত্যু শয্যায় আর অভির মা যখন অভির সাথে স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত। তাদের পরিচয়ের সূত্রটা একই ঘটনায় ভেঙে পড়া নিয়ে। সে আরেক সময় খোলাসা করা যাবে।

গাড়ি যখন চলছে তখন মিস্টার আহমেদ বললেন, ” সমস্যা না হলে ড্রাইভিংয়ের ফাঁকেই আপনার প্রিয় মানুষটাকে পাওয়ার গল্পটা শুনি।”

বাঁকা হাসলো অভি। সপ্রতিভ সে হাসিতে মুগ্ধতা। মিস্টার আহমেদ অনুভব করলেন অভির হাসিটা কেবলই তার প্রিয় মানুষের জন্য। অভিও বলা শুরু করলো, “এরপরের ঘটনা আমি আমার নেক্সট ডিগ্রির জন্য বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম কিন্তু কোথায় যেন একটা বাঁধা টের পেলাম। এবং সেই বাঁধাটা শুধু ছিলো সেই মেয়েটিকে নিয়ে ভাবনা। রেগুলার কাজের মধ্যে যুক্ত হয়ে গেল রুটিন হিসেবে তাকে নিয়ে দু বেলা ভাবা। এই প্রথম কোন মেয়ের চোখ কেমন, তার চুল কেমন এসবের প্রতি আমি আকৃষ্টতা অনুভব করলাম। আমার পড়াশোনা, প্র্যাক্টিসিং সবেতেই একটা ঝিমিয়ে পড়া ভাব এলো। আম্মুর চোখে পড়লো এসব আর আম্মুই যেচে প্রশ্ন করলেন সমস্যাটা কোথায়। এ জীবনে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু আমার আম্মুই ছিলো। স্কুল, কলেজে সব জায়গায় আম্মুই প্রথমে জানতো আমি কোন মেয়ের সাথে কথা বলছি, কার সাথে আমার বন্ধুত্ব কিংবা কে আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। আমি নিজে কখনো কারো প্রতি নরম হইনি নিজের ভালোলাগাকেও প্রাধান্য দেইনি। এই প্রথম আমি বুঝলাম নিজেকে আর পোষ মানিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সরাসরিই আম্মুকে বলে দিলাম মেয়েটির কথা।”

“আপনার আম্মু কি বলল?”

“আম্মু তো বলল বিয়েটা কি যাওয়ার আগে করবো না পরে?”

“সত্যি! তাহলে আপনার সাথে আমার যেদিন পরিচয় হলো সেদিন তো আমি অন্য কিছুই শুনেছিলাম আপনার মায়ের মুখে।”

“বলছি, আম্মু প্রশ্ন করার সাথে সাথে আমি বলেছি মেয়ে পক্ষ মানলে বিয়েই করে যাবো। আম্মু বললেন তারা মানবে এবং বিয়েটাই হবে। কিন্তু তা আর হয়নি । কয়েকদিন পরই আম্মু গেল মেয়েটির ফুপির বাড়িতে৷ আর তারপরই আমরা এমন এক সত্যির মুখোমুখি হলাম যে আমার মন থেকে কাউকে ভালোলাগা কথাটাই মুছে দিতে চাইলাম আমি। তা কি আর সম্ভব হয়! আমার ভালোলাগা আমার অগোচরেই ভালাবাসায় বদলেছিলো কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য আমি একজনের স্ত্রীকে ভালোবেসেছি।”

“কি বলছেন আপনি, মেয়েটি বিবাহিত?”

“হুম, সেদিন মেয়েটি বিবাহিত ছিলো। ওই যে বললাম হাসপাতালে যেই পেশেন্ট নিয়ে তারা এসেছিলো সে মেয়েটিরই হাজবেন্ড ছিলো। কথা হলো তাদের বিয়েটা নাকি খুব ড্রামাটিক হয়েছে। মানে তারা মামাতো- ফুপাতো ভাইবোন। বিয়েটা দিয়েছে জোর করে তারা দুজন তখন মানতো না বিয়েটা।”

অভির মুখে কথাটা শুনেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এলো মিস্টার আহমেদের। পরক্ষণেই সে কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলো, “তাহলে এখন সে হাসপাতালে কেন তাও আবার আপনার অবজারভেশনে!”

“তাদের বিয়ের পরও নাকি তেমন মিল ছিলো না তাদের মধ্যে তবে একটা সময় জানা গেল মেয়েটি প্রেগন্যান্ট। তার প্রেগন্যান্সির শেষের দিকে এসে কিছু কম্লিকেশন ধরা পড়ে। সমস্যাগুলো বাচ্চা সম্পর্কিতই ছিলো আর তাই মাস দুই আগে তাকে হাসপাতালে ভর্তির উদ্দেশ্যে নিয়ে আসা হচ্ছিলো। সেদিনটায়ও আজকের মতোই বৃষ্টি ছিলো কিন্তু ঝড় ছিলো না। হয়তো তার জীবনে ঝড় উঠবে বলেই প্রকৃতির ঝড় থেমেছিলো সেদিন।” অভির চোখ ভিজে এলো বলতে বলতেই। সে পরপর কয়েকবার পলক জাপটে চোখের পানি আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করল।

” তারপর কি হলো?”

” আমাদের হাসপাতালের বা’ দিকে নতুন একটা আট তলা বিল্ডিংয়ের কনস্ট্রাকশন চলছে দেখেছেন নিশ্চয়ই?”

“হ্যাঁ!

” তার বর সেদিন ড্রাইভ করছিলো পাশেই সে বসেছিলো। গাড়ি যখন বাঁক নিয়ে হাসপাতালের রাস্তায় ঢুকবে ঠিক তখনি সেই বিল্ডিংয়ের রড বোঝাই ট্রাক কোন এক কারণে ইউ টার্ন নিয়ে পেছনে মোড় নিতেই অনাকাঙ্ক্ষিত সেই দূর্ঘটনাটা ঘটলো। সাদা মার্সিডিজ বেঞ্জটা মুহুর্তেই দুমড়ে মুচড়ে গেল। রাস্তার ডানে এসে ট্রাকটা ধাক্কা খায় বড় এক শিমুল গাছের গুঁড়িতে আর দশ মিনিটের মধ্যে রাস্তার তিন মোড় ব্লক আর শতশত মানুষ জমে গেল আর,,, ”

অভি কথা শেষ করতে পারলো না। সে গাড়ি ব্রেক করলো রাস্তার কিনারায়। তার ভারী পুরুষালী দেহটায় কান্নার দমক। মিস্টার আহমেদ কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইলো। এই রাত বড়ই অন্ধকার সাথে কিছু মানুষের জীবনও৷ প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে কিছু না কিছু ভয়ংকর সময় থাকে। সেই মেয়েটির জীবনেও তাই সাথে অভির। নইলে ভালোবাসার মানুষটা তার না হোক অন্তত মানুষটা সুস্থ আর সুখী থাকলেও তার জীবনে দুঃখের ভাগ কিছুটা কম হতো। মিষ্টার আহমেদের মনটা অস্থির হয়ে রইলো জানতে মেয়েটার বর আর বাচ্চাটা কেমন আছে? মন ভাবতে না চাইলেও বারবার মনে হচ্ছে মেয়েটার বাচ্চাটা বেঁচে নেই। কিন্তু তার বর সে যদি বেঁচে থাকে নিশ্চয়ই একই হাসপাতালে আছে। একবার সময় করে সে অভিকে বলবে একটাবার দেখতে চায় তাদের স্বামী-স্ত্রীকে। আর মন থেকে দোয়া করবে তারা যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। অভি নিজেকে সামলে আবার গাড়ি স্টার্ট দিতেই তার ফোনটা বেজে উঠলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জানালো মেয়েটির ফুপি এসেছে। না চাইতেও মুখ বিকৃত হয়ে এলো অভির।

“কি হলো?” মিস্টার আহমেদ প্রশ্ন করতেই অভি অনেকটা চিৎকার করেই বলল, তার ফুপি এসে ঢুকেছে তার কেবিনে।”

“তাকে দেখতে এসেছে হয়তো।”

“কতোটা কেয়ারলেস লোকজন এরা? একটা মেন্টালি সিক মানুষকে বাড়ি থেকে বের হতে দেয়?”

” তার ফুপি পাগল!”

“সেই ঘটনার পর তার ফুপি অসুস্থ হয়ে গেছেন। ট্রমাটা তার সহ্য ক্ষমতার বাইরে ছিলো। ব্রেন স্ট্রোক করেছেন ভদ্র মহিলা। এরপর এক মাসেই শারীরিক ভাবে সুস্থ লাগলেও তিনি মেন্ট্যালি এবনরমাল সাথে হাত আর পা’ও প্যারালাইজড ছিলো। পা এখন যথেষ্ট ভালো। উনাকে সম্ভবত বাহিরে নিয়ে যাওয়ার প্রিপারেশন নিচ্ছে।”

অভির মুখে এখন অব্দি যতটুকু শুনেছে তাতেই মিস্টার আহমেদ মনে মনে বলল, আলহামদুলিল্লাহ! আমার জীবনে আমি একজনকে খুশি রাখতে অন্যজনকে হারিয়েছি আর তাতেই আমি কাল পর্যন্তও নিজের মৃত্যু কামনা করেছি এই ভেবে, এত কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকা বড় কষ্টদায়ক। অথচ আজ এখন সেই মেয়েটির আর তার পরিবারের দূর্বিষহ ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে ওপরওয়ালার দুনিয়ায় আমি অনেক সুখী। অন্তত প্রিয়জনদের এমন করুণ অবস্থা দেখার দূর্ভাগ্য আমার হয়নি।

বাকিটা পথটা আর কোন কথা হলো না দুজনের মাঝে। চুপচাপ ড্রাইভ করলো অভি। বৃষ্টি অনেক আগেই থেমেছিলো এখন আর বাতাসটাও তেমন নেই।

“আমার পক্ষে আর সম্ভব নয় দিশান। আমার একটু স্বস্তি চাই প্লিজ। গত দুইটা মাসে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি চারদিকের এত হাহাকার আর দুঃখ দেখে। মা আজও লুকিয়ে বেরিয়ে গেছে বাড়ি থেকে এ অবস্থায়। সারাটাদিন চোখে চোখে রেখেছি। এখন এশারের নামাজের জন্য দাঁড়াতেই কোন ফাঁকে বেরিয়ে গেছে টের পাইনি।”

ঐশী বলতে বলতেই হাঁপিয়ে উঠেছে। দিশান কপালে হাত ঠেঁকিয়ে বিছানায় কুঁজো হয়ে বসে আছে। সে মাত্রই অফিস থেকে ফিরেছে। বাড়ি ফিরে স্বভাববশত প্রথমেই মায়ের ঘরে ঢুকেছে। মা ঘরে নেই মনে হলো দোতলায় ঐশীর কাছে কিংবা ময়না খালার সাথে লনে বসেছে৷ বৃষ্টি বৃষ্টি আবহাওয়ায় মা সবসময়ই লনের সামনে যান। তাঁর ভালো লাগে শীতল বাতাস কিন্তু না দিশান অনেক খুঁজেও তাকে কোথাও পেল না। ময়না খালা রান্নাঘরে পায়েস রাঁধছে। মা’ই নাকি খাবে বলে বায়না করছে৷ দিশান তাই দোতলায় গেল নিজের ঘরে। সেখানেও মা নেই আর তখন থেকেই পুরো বাড়ি খুঁজেও কোথাও পাওয়া গেল না। গেটের দারোয়ান বলল মা বের হয়নি অথচ মানুষটা বাড়ির ভেতরেও নেই। আর তা শোনার পর থেকেই ঐশী একের পর এক বলে চলছে। সে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে এসবে এখন আর ইচ্ছে হয় না এ বাড়িতে থাকতে। দিশান অনেকটা সময় চুপ করে থেকে বলল, “কাল সকালে রেডি থেকো অফিস যাওয়ার পথে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে যাবো।”

ঐশী আর কোন কথা বলেনি। দুঃখ-দুর্দশা আর জীবনের নির্মম পরিহাসের পর সুন্দর সম্পর্কগুলোও কেমন তিক্ত হয়ে উঠছে। দিশাও ছোট মেয়ে নিয়ে পারে না সবসময় মাকে এসে দেখে যেতে। দিহানের বাবা মানুষটাও এখন আর আগের মত হাস্যমুখী নেই। অফিসে যেটুকু সময় থাকে ততক্ষণই শুধু মানুষটার ব্যস্তার আড়ালে চাপা পরে মানসিক চাপগুলো। দিশান একলা একটা মানুষ ব্যবসা, বাবা এমনকি মা তিনটা দিক সামলাতে গিয়ে ঐশীর দিকে ফিরে তাকানোর সময়টাও পায় না। রাতটুকু সে নিদ্রাদেবী হিসেবে ঐশীর হাতের কোমল পরশটুকু চায় নিজের মাথায়। কিন্তু ঐশী কার কাছে চাইবে একটু মুক্তি! একটুখানি স্বস্তি!

চাঁদ চাকরির শেষ সময়ে এসে সব ছেড়ে দিয়ে আজ মেয়ের জন্য চলে এসেছে ঢাকা শহরে। এ নিয়েও দ্বন্দ্ব সুইটি আর তার মধ্যে। যে সুইটি কোনদিনও চাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের প্রয়োজনটাও বলতে পারতো না সে আজ উচ্চস্বরেই কথা বলে স্বামীর সাথে। তার কথাও এতোটা মন্দ নয়। মেয়েটা যখন ছোট থেকে বাবার সঙ্গ চাইতো তখন সে দেশের প্রতি দশের প্রতি দ্বায়িত্বের বাণী শুনিয়ে দূরে ছিলো। নিজ হাতে গড়া বাবার ব্যবসা তাকে কিছুতেই টানেনি সেই মানুষ আজ কেন মৃত্যুর সাথে লড়ে যাওয়া মেয়ের জন্য সব ছাড়বে! শেষ মুহুর্তের দ্বায়ভার কেন মেয়ের কাঁধে পড়বে? সে করুক তার দেশ সেবা। সুইটি এখনও বেঁচে আছে।

চলবে

(গল্পের নতুন মোড়। জানি না পাঠকদের কেমন লাগবে তবে আমি যেমন ভেবে রেখছি সমাপ্তি সেভাবেই টানবো। “মন গহীনের গল্পে”ও আমি তাই করেছি এবং শেষ পর্যন্ত আপনাদের পছন্দই হয়েছিলো। আশা করছি এটাও তেমনই হবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here