আনকোরা পর্ব-৩২

0
1863

#আনকোরা
#রূবাইবা_মেহউইশ
৩২.

মাথার ওপর সূর্যটা ২৭° সেলসিয়াস তাপমাত্রা নিয়ে বড় আয়েশে আছে আকাশে। মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বড় আরাম করে বসে একটা সিঙ্গাপুরিয়ান ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছে অভিনব। অপেক্ষা তার সুইটির আসার তারপরই তারা একসাথে দেখা করবেন নিউরোলজিস্ট এলেক্স ইয়ে চাও (ছদ্মনাম) এর সাথে। আজ পনেরো দিন হলো চৈতী এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। ডক্টর রাশেদ পাঁচদিনের মত থেকে সুইটিকে অনেক ব্যপারেই জানিয়ে, বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন৷ হাসপাতালে রোগীর সাথে পরিবার পরিজন থাকার নিয়ম নেই বলেই তারা হোটেল মেরিডিয়ানে অবস্থান করেছিলেন। ডক্টর রাশেদ চলে যাওয়ার পর সুইটি একাই ছিলো এখানে৷ নিয়ম করে ভিজিটর্স টাইমে সে চৈতীকে দেখে গেছে। এরপর তার একাই কাটছিলো এখানে সময়টা৷ কিন্তু আজই হুট করে অভি এসে পৌছুলো অর্চাডে। সে এখানকার কোন হোটেলে না উঠে সরাসরিই হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয়েছে৷ রিসেপশনেই খোঁজ পাওয়া গেল ভিজিটং আওয়ার আর পেশেন্টের অভিভাবকের আসার টাইম। তাই সে রিসেপশনের পাশেই আছে৷ সুইটি এলেই চোখে পড়বে ভেবে৷ ঘড়িতে সময় তখন তিনটে বেজে গেছে যখন সুইটি এলো। অভিনব পৌঁছেছে সকাল নয়টায়। তখন থেকে এই অব্দি সে ওয়েটিং রুম, হাসপাতালের লন আর হাসপাতালের বাইরেও অনেকটা সময় কাটিয়েছে, টুকটাক খাওয়াদাওয়াও করেছে। কিন্তু প্রপার লাঞ্চ করার সুযোগটা পেয়েও কাজে লাগায়নি। সুইটি আসতেই তার দেখা হলো রিসেপশনেই। দুজনেই কুশল বিনিময় করে সুইটি জানতে চাইলো সে কখন এসেছে, কোথায় উঠেছে! অভিনব জানালো হোটেল বুকিং করা নেই আর এখনো কোন খোঁজ নেয়নি সে। আগেই ডক্টরের সাথে যোগাযোগ করলো তারা। তারপর চৈতীকে দেখার অনুমতি পেয়ে কেবিনে ঢুকলো সুইটি। অভি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ হঠাৎই ফোন ভাইব্রেট হওয়ায় নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল সুইটি আর তখনি কি মনে করে ভেতরে ঢুকলো অভি। সেও নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালো চৈতীর বেডের কাছে। গালের মাঝে সেলাইয়ের দাগ স্পষ্ট ফুটে আছে৷ যেন কেউ ক্যানভাসে কাঁটাযুক্ত গুল্মলতা এঁকেছে বেশ যত্ন করে। ঠোঁটের কোণে হালকা একটু ভাজ মনে হচ্ছে ঘুমন্ত অবস্থায়ও হাসার চেষ্টা করছে মানুষটা৷ মাথার চুলগুলো আবারও বোধহয় চেছে ফেলেছে এখানে তাই দেশে যেমনটা দেখা গিয়েছিলো এখন তারচেয়েও ছোট । মাপলে হয়তো আধ ইঞ্চ সাইজ হবে৷ তবে ব্যান্ডেজ নেই এখন আর তার মাথায়, গালে আর না হাতে। চৈতী কি অচেতন! অভির ইচ্ছে হলো নিজেই একটু পরখ করে দেখবে। কিন্তু সে দেখবেটা কি? চৈতীর রোগ তো হৃদয়ে নয় হয়েছে মাথায়, মস্তিষ্কে। এখন তার আফসোস হচ্ছে কেন সে হার্টের ডাক্তার হলো আর কেনইবা চৈতীর মাথায় আঘাত এলো! তাপনিয়ন্ত্রিত কেবিনটাতে দাঁড়িয়েও অভিনবের মনে হলো তার জুলফি বেয়ে এক ফোঁটা ঘাম গড়াচ্ছে। চৈতীর ও মুখে তাকিয়ে থাকা বড় কষ্টদায়ক। তার বোজা চোখের পাতা দুটো টানছে খুব করে৷ ঘন পত্রপল্লবে অজাগতিক এক আকর্ষণ হঠাৎই উদাস অভিনবকে এক অভিলাষী মানুষ করলো যেন! তার অভিলাষ ওই কালচে হওয়া চোখের পাতায় প্রগাঢ় চুম্বনে সকল অসুস্থতা নিমেষেই শুষে নিতে। আদৌও কি সম্ভব কারো অসুস্থতাকে শুষে নেওয়া! মন বড় বেপরোয়া জিনিস। অভি আগের চেয়েও আরেকটু কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। দুঃসাহসিক কাজ করাটাই এখন তার মনে অভিপ্রায় হয়ে আছে। ধীরে ধীরে উবু হয়ে অনেকটা কাছে এলো সে নিথর চৈতীর। তপ্ত নিঃশ্বাস তার একের পর এক আছড়ে পড়ছে চৈতীর চোখে মুখে। সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে নিজের ওপর থেকে কিন্তু সেই নিয়ন্ত্রণ ফিরতে বেশি সময় লাগেনি। হঠাৎই চৈতী চোখ খুলে তাকায়। চোখের পাতা না নাড়িয়েই সে তাকিয়ে থাকে উপরে সিলিংয়ের দিকে। ডান চোখের কোণে ঝাপসা দেখা গেল কেউ দরজা ঠেলে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কে!

অভি বেরিয়ে এসেছে কেবিন থেকে; তার চোখ শীতল হয়ে গেছে। হাত দুটো কি একটু একটু কাঁপছেও! কি জানি তার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। শুধু মনে হচ্ছে সে যা করতে যাচ্ছিলো তা অন্যায়।

“তুমি চৈতীকে এসেছো?”
সুইটি প্রশ্ন করতে করতে অভির সামনে এসে দাঁড়ালো।

“জ্বী আন্টি।” সুইটির দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলো অভিনব।

“আচ্ছা! কেমন দেখলে চৈতীকে? তোমার কি মনে হয় আরো কি বেশি সময় লাগবে!”

” ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে তো কিছুই বুঝলাম না। তবে তার বাহ্যিক ক্ষত গুলো তো আলহামদুলিল্লাহ একেবারে সেরে উঠেছে।”

“হ্যাঁ, কাটাছেঁড়া যা ছিলো তা রিকোবার করেছে। ও ঘুমিয়ে আছে! আমি তো সজাগই দেখে বেরিয়েছিলাম৷”

“হয়তো মাত্রই ঘুমিয়েছে। ডক্টর এলেক্স কে কি পাওয়া যাবে এখন?”

” না, ডক্টর এরিক তো দেখে গেছে চৈতীকে। ডক্টরের আজকের টাইমিং দেওয়া আছে একটা ফাইলে। কেবিনেই সেটা চলো হাতেও সময় কম আমাদের।” সুইটি কেবিনের ভেতর গেল পেছন পেছন অভিনবও গেল দুরু দুরু বুক নিয়ে। তার মনে হচ্ছে চৈতী তাকে দেখে ফেলেছে তখন। ভেতরে ঢুকতেই লম্বা শ্বাস নিলো সে। চৈতীর চোখ বোজা তারমানে সে ঘুমেই আছে। বেডের পাশেই একটা ছোট্ট টেবিলে মেডিসিন বক্স সাথে একটা ফাইল আছে। সুইটি সেটা অভিকে এগিয়ে দিলো, “দ্যাখো এতে আজকের সময় দেওয়া আছে।”

অভিনব ফাইলটা নিয়ে দেখলো ডক্টর চেকআপ হয়ে গেছে আরো আগেই। তবে আরো একজন স্পেশালিষ্ট আসবেন সন্ধ্যার সময় দেওয়া তাতে। আরো কিছু সময় তারা কেবিনের থেকে বেরিয়ে গেলেন। একজন নার্স এসে চৈতীকে চেক করলেন।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই সুইটি জানতে চাইলো কোথায় উঠবে অভি। তার এখনও এসব নিয়ে ভাবাই হয়নি তাই সুইটি বলল সে যেখানে আছে সেখানেই চেক করতে। রুম পেয়ে গেলে দুজনের জন্যই সুবিধা অভিও তাই করবে বলে সম্মতি জানালো। কিন্তু তার আগে অভিনবকে খাওয়ার জন্য জোর করলো সুইটি। দুজনেই ট্যাক্সিতে করে একটা বাঙালি রেস্টুরেন্টে গেল। সুইটির চেনা জায়গাটা সে এখানেই বেশিরভাগ সময় খাওয়াদাওয়া করেছে। ট্যাক্সি এসে যখন শাপলা রেস্টুরেন্টের সামনে থামলো আকাশে তখন মেঘের আনাগোনা। দেখেই মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে যেকোন সময়। তাই হলো, অভিনবের খাওয়া শেষ হতেই তারা যখন আবার হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো তখন শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। এ দেশের ওয়েদারে সবচেয়ে কমন বোধহয় এই একটা ব্যপারই। প্রায় প্রতিদিনই এখানে কোথাও না কোথাও বৃষ্টি হয়েই থাকে। অভিনবের ভালো লাগলো এই বৃষ্টির জাপটা। কিন্তু হোটেলে চেকইন করাটা তার জন্য কষ্ট সাধ্যই হলো বটে! প্রথমে রুম না পাওয়ার ঝামেলায় সে অন্য হোটেলের জন্য বের হতে যাচ্ছিলো এই বৃষ্টিতেই। কিন্তু রিসিপশনে থাকা একটা মেয়ে তাকে অনেকটা সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করছিলো। সে যখন তার ব্যাগপত্র নিয়ে সুইটিকে বিদায় জানাতে উঠলো তখনি মেয়েটা তাকে ডেকে কিছু ইশারা করলো। সে ইশারার অর্থ প্রথমে না বুঝলেও পরে বুঝলো মেয়েটা তার সাথে আন্তরিকতা দেখাতে চাচ্ছে। সেও সুযোগ নিতে পিছুপা হলো না। মিষ্টি হেসে মেয়েটিকে ইশারার জবাবে কাছে ডাকলো৷ এখানেই একটা রুম তার চাই বিনিময়ে টাকা অফার করতেই মেয়েটা টাকা নিয়েই দেড়ঘন্টার মধ্যে রুমের ব্যবস্থা করে দিলো। কি করে দিলো কে জানে এ নিয়ে অবশ্য তার মাথা ঘামানোর কিছুই নেই। সে দু দিনের জন্য এসেছে এখানেই থাকাটা সুবিধাজনক৷ হাসপাতালও কাছে সাথে সুইটি আন্টির প্রয়োজনেও হেল্প করা যাবে। সন্ধ্যার পর সে রুম পেয়ে প্রথমেই গোসল সারলো। তখনো বৃষ্টি ঝরছে অবিরাম ধারায়। কাচের শার্সি বেয়ে টপাটপ গড়িয়ে পড়ছিলো বৃষ্টির ফোঁটা। অভিনবের মন কেমন করে উঠলো তা দেখে। চৈতী সুস্থ হয়ে উঠছে তা রিপোর্ট দেখেই অনেকটা বোঝা গেছে। আসার সময় নার্সের সাথে কথা হয়েছে নার্সটিও জানালো চৈতী আজকাল উঠে বসে একা একাই। কাল নাকি বাথরুমেও গেছে কারো সহযোগিতা ছাড়া। কিন্তু,,

মনটা খারাপ হয়ে গেল মুহুর্তেই অভির। নার্সটি বলেছে আজ তার কাউন্সিলিং করা হয়েছে। কিন্তু সে কোন কথাই বলেনি। উইদাউট রেসপন্স কতখানি বোঝা যাবে তার সুস্থতা! সুইটিকে এ কথা বলেনি অভি আর না নার্সের সাথে অভির কথোপকথন তার বোধগম্য হয়েছে।

বিকেলের রোদ মরে এসেছে। বৃষ্টি হয়নি তবুও বাতাসে শীতলতা এমন যেন একটু আগেই বৃষ্টি হয়েছে। দিশা হুড়মুড়িয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো। দিলশাদ আজকাল কাউকেই সামনে দেখতে চায় না। তার মস্তিষ্কের সমস্যাগুলো দিনকে দিন বেড়েই চলছে যেন। নিয়ম করে তার ঔষধও খায়ানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। দিশাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখেই সে চিৎকার করে উঠলো, “এ্যাই তুই এই বাড়িতে এসেছিস কোন সাহসে?”

দিশা প্রথমে হতভম্ব হয়ে যায়। পরেই মনে পরে মা হয়তো আবারও দিহানকে ভাবছে। এমনটাই হয় যখন দিহানকে ভাবে তখন তার কাছে দিহান জীবিত। আর দিহান দিশাকে বাড়িতে আসতে মানা করেছিলো শুধু এই কথাটাই মনে পড়ে। হতাশ হয়ে সে মায়ের দিকে তাকায়।

“এ্যাই বের হচ্ছিস না কেন? এখনই দিহান আসবে তোকে দেখলেই সে তোর দাদুর লাঠি বের করবে। পিটিয়ে একদম ছাল তুলে ফেলবে তুই চলে যা। মা*র না খেতে চাইলে চলে যা এখান থেকে।”

দিলশাদের চিৎকার শুনে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে আসে ময়না। দোতলা থেকে ঐশীও আসে দিশার মেয়েকে নিয়ে।

“দিহান ভাইয়া আর আসবে না মা তুমি কেন মানতে চাও না বলোতো!” কাঁদতে কাঁদতে দিশা তার মায়ের পায়ের কাছে বসলো। দিলশাদের সেদিকে মনযোগ নেই। সে আবারও হাঁকডাক শুরু করলো দিশা যেন বাড়ি থেকে চলে যায়। এবার ঐশী সামনে আসতেই দিলশাদের খেয়াল হলো তার দিহান বেঁচে নেই তার নাতি বেঁচে নেই। ঐশীকে দেখলেই সে পালিয়ে যেতে চায় বাড়ি থেকে। পা থেকে দিশার হাত ছাড়িয়ে দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে গিয়ে বসলো দিলশাদ। আজ আর সে বের হবে না জানে সবাই। এমনটাই হয়ে আসছে ক’দিন ধরে। কাল চাঁদ খান এসেছিলো বোনকে দেখতে। দিলশাদ তাকে দেখে খুব স্বাভাবিক আচরণ করেছে। ভাইয়ের হাত ধরে কান্না করেছে অনেকটা সময় সেই সাথে বারংবার বলছিলো চৈতীটা যেন সুস্থ হয়ে ফিরে আসে জলদি।

দেখতে দেখতে কেটে গেছে আরো দশ দিন। অভিনব সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে এসেছিলো দু দিন পরই। চৈতীর ট্রিটমেন্ট ভালোই চলেছে সেখানে। কিন্তু মৃত্যু যাকে কাছে টানতে গিয়েও ছেড়ে গেছে তার একেবারেই কোন ক্ষতি করবে না তা কি করে হয়! স্বামী-সন্তানকে যমদূত নিয়ে গেছে। তাকে নিতে পারেনি তবে নিয়ে গেছে তার স্মৃতিগুলো। সে সাময়িকভাবেই তার সকল স্মৃতি মস্তিষ্ক থেকে হারিয়ে ফেলেছে। অভিনব থাকাকালীনই চৈতীর সাথে কথা বলতে দেওয়া হয়েছিলো সুইটিকে। চৈতী তার নিজের মাকেই চিনতে পারেনি ঠিকঠাক। কখনো বলছিলো মানুষটা তার পরিচিত আবার বলছিলো সে তাকে কখনো দেখেইনি। কাউন্সিলিংয়ের প্রত্যেকটা ধাপেই চৈতী সঠিক কোন জবাব দিতে পারেনি এমনকি তার দূর্ঘটনার কথাটাও স্মরণে নেই। ডাক্তার যা বলছে তাই সে চুপচাপ মানছে আবার সুইটি যা বলছে তাই তার কাছে সঠিক মনে হচ্ছে। অভিনব একটিবারও জাগ্রত চৈতীর মুখোমুখি হয়নি৷ দূর থেকে একবার দেখে এসেছে দেশে ফেরার দিন। ডাক্তাররা পরামর্শ দিয়েছিলো চৈতীর সামনে এমন কাউকে নিয়ে যেতে যেই মানুষটাকে চৈতী প্রচণ্ডরকম ভালোবাসে এবং যার কাছাকাছি থেকেছে সে বেশিরভাগটা সময়। সুইটির মনে হচ্ছিলো সে তখন নিজের জন্য মৃত্যু কামনা করে। কারণ, চৈতীর জীবনে সবচেয়ে কাছে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে দুজন মানুষ এই দুনিয়াতেই নেই। প্রথমজন তার দাদু দ্বিতীয় দিহান। হ্যাঁ বিষ্ময়কর হলেও এটাই সত্যি। জীবনে বেশিরভাগটা সময় চৈতীকে তারা দুজনই খুব আগলে রেখেছে, রাগে,স্নেহে সবটাতেই তারা দুজন খুব কাছের ছিলো। এরপরই মনে পড়লো দিলশাদও চৈতীর খুব কাছের। সেদিন সুইটি চিৎকার করে কেঁদেছে হোটেলে ফিরে। একটা মানুষও চৈতীর সামনে আসার মত অবস্থায় নেই। চাঁদের সাথে কথা বলে সবটা জানানোর ঠিক তিনদিন পর চাঁদ এসে হাজির হয়েছিলো সিঙ্গাপুরে। সৎ হয়ে থাকতে গিয়ে কোনদিনও সে তার কোন প্রয়োজনে ক্ষমতা প্রয়োগ করেনি অথচ মেয়ের জন্যই সে এই প্রথম নিজের ফেলে আসা পদবীর ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ভিসার ব্যবস্থা করলো। আইন নিয়ে গর্ব করা মানুষটাই আইন ভেঙে উপস্থিত হলো স্ত্রী কন্যার পাশে। চাঁদ যাওয়ার পর আরো সাতদিন চৈতী হাসপাতালে থাকলো। তারপরই তাকে নিয়ে ফিরে এলো চাঁদ সুইটি নিজের দেশে। এয়ারপোর্টে তাদের আনতে দিশান নিজেই গেল। আশ্চর্যের ব্যপার হলো দিশানকে দেখার পর থেকেই চৈতী কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকে। প্রায় চারটা মাস পরে চৈতী দেখতে পেল জগতটাকে। গত চার মাসে তার কোন যোগাযোগ ছিলো না এই পৃথিবীর মানুষগুলোর সাথে। জানা ছিলো না তার কখন রাত আর কখন দিন। কখন আকাশে মেঘ করেছে কখন আবার মাটি ভিজে কাদা হয়েছে। কে আপন কে পর কে কোথায় তার আপনজন সব কিছুই তার জানা, বোঝার উর্ধ্বে ছিলো। চৈতীকে বাড়িতে আনতেই আত্মীয়রা সবাই ছুটে এলো দেখতে। দিলশাদকেও নিয়ে এলো দিশা আর তার বাবা। সবাই অবাক হয়ে দেখছে চৈতীকে। পরনে ঢোলা এক লম্বা কূর্তা আর লেগিংস। মাথাভর্তি ছোটো ছোটো চুল ঠিক তার বাবার চুলের মত। কিন্তু মাথা একপাশে দুটো অংশে লম্বাটে খালি জায়গা। সেলাইয়ের সেই অংশে কোন চুল নেই। মুখের চামড়া ফ্যাকাশে আর বা গালটাতে সেলাইয়ের চিহ্ন।

“উহ্ কি বীভৎস লাগছে দেখতে এই কাটাছেঁড়াগুলো!” আর্তনাদ করে উঠলো দিলশাদ। প্রত্যেকেই খেয়াল করলো দিলশাদ তাকিয়ে থাকতে পারছে না চৈতীর দিকে। অথচ চৈতী কত শান্ত হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে সবাইকে। যেন সে নতুন চোখে দেখছে নতুন নতুন সকল মুখ।

সেদিন আর বাড়িটা ফাঁকা হয়নি যেদিন চৈতীকে আনা হলো দেশে। আত্মীয়রা সবাই যখন একে একে বিদায় নিলো দিলশাদ তখন বাচ্চাদের মত করে বায়না ধরলো দিশানের কাছে, “আমি যাবো না আব্বা। আমাকে এখানে থাকতে দাও না।”

অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো দিশান তার মায়ের দিকে। মা কি তার সব ভুলে যাচ্ছে! চাঁদও খুব করে বোঝালো বড় আপা থাক এখানে। হয়তো চৈতীকে দেখেই সে কিছুটা স্বাভাবিক হবে। দিশানও আর কিছু বলেনি। বাড়ির সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল। পরেরদিন খুব সকালে অভিনব এলো চৈতীকে দেখতে। আসার সময় সে তার মা বাবাকেও জোর করেছিলো। খন্দকার সাহেব আসতে রাজী হতেই অনামিকা গর্জে উঠেছিল। আর তাই শেষ পর্যন্ত অভি একাই এলো। সুইটির সাথে কথা বলে সে চৈতীকে দেখতে চাইল। সুইটি তাকে দেখিয়ে দিলো চৈতীর ঘরটা। অভিনব আসতে আসতে চৈতীর ঘরের দরজায় এসে থেমে গেল। ঘুমিয়ে আছে চৈতী গায়ে তার ওড়না বা কোন চাদর নেই। দরজার পাশেই কিছুটা সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে যাচ্ছিলো সে তখনি চৈতীর ঘর থেকে ডাক শুনলো, “চলে যাচ্ছিস কেন দিহান? ঘরে আয়। দ্যাখ তোর বউ কেমন মরার মত পড়ে ঘুমাচ্ছে। বাচ্চাটার কি খিদে পায়নি চৈতী না উঠলে খাওয়াবে কে?”

অভিনব ফিরতে গিয়েও আর ফিরলো না। এই মহিলাটি তাকেই কেন বারবার দিহান বলে ডাকে! বুকটা ভারী হয়ে যায় এই নামটা শুনলেই। শত দ্বিধা তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে চৈতীর মুখটা কল্পনা করতে গেলেও। ‘দিহান’ মানুষটা নেই কিন্তু এই নামটাই তাকে বারংবার জানান দেয় চৈতী তার নয়। মৃত মানুষকে হিংসা করা যায় না, করে লাভও নেই তবুও তার হিংসা হয় দিহানের প্রতি। ভালোবাসাটা যতই ভাবে সে ছেড়ে দিবে ততোই মনে হয় ভালোবাসা ছাড়বে কি করে যা ধরাই যায় না!

অভিনব আর এক মুহুর্তও থাকতে পারলো না চৈতীদের বাড়ি। সুইটিকে কিছু না বলেই ফিরে গেল সে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here