আনকোরা পর্ব-৩১

0
1759

#আনকোরা
#রূবাইবা_মেহউইশ
৩১.

রাত একটা; দিশার চোখে ঘুম নেই। মেয়েটা ঘুমিয়েছে অনেক কান্নাকাটির পর। আবির বাড়ি ফেরেনি আজ এখনও। দিশা খাবার টেবিলে শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করেছিলো আবির এখনো অফিসে কিনা! তার শ্বশুর জানালো আবির আজ পাঁচটায় বেরিয়েছে অফিস থেকে। সেই থেকেই দিশার মন উচাটন আবির কোথায় গেল! ফোন করেছিলো দিশা তখন বলল কোন এক কাজে আছে। তারপর আর ফোন দিলেও ধরছে না। বাড়ির মানুষগুলোও আজকাল আবিরের বিষয়ে কোন কথা বলে না। আবিরের বাবা প্রথম প্রথম শাসন করলেও এখন আর করেন না। করে লাভও হয় না কিন্তু তাদের খারাপ লাগে নাতনিটার জন্য নইলে অনেক আগেই দিশাকে তারা চলে যেতে বলতো। আবেগের বশে যে ভুল দিশা করেছে সে ভুলের সাজা এখন তাকেই ভোগ করতে হবে। রাতের খাবারটা খাওয়া হয়নি কিন্তু এখন খুব পিপাসা পাচ্ছে দিশার। জগ থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে মাত্রই চুমুক দিলো তখনি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো আবির। পানিটা শেষ করে দিশা উঠে দাঁড়ালো।

“কাজকর্ম মাত্রই শেষ হয়েছে নিশ্চয়ই?”

“আর বোলো না। কাজ তো অনেক আগেই শেষ হয়েছে কিন্তু বন্ধুরা এমন করে ধরলো যে আড্ডা একটু দিতেই হলো।”

খুব সাবলীল ভঙ্গিতে কথাগুলো বলতে বলতে আবির পরনের শার্ট খুলল। দিশার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল, “তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আজকে ভীষণ গরম আমি গোসলটা করে ঘুমাই নইলে ঘুম আসবে না।”

দিশা দু পা এগিয়ে এলো আবিরের সামনে। তীক্ষ্ণ নজরে পরখ করলো তার স্বামীকে তারপরই সে থাপ্পড় লাগালো আবিরের গালে। আচমকা থাপ্পড়ে হকচকিয়ে গেল আবির পরক্ষণেই দিশার দু গাল চেপে ধরলো।

দিশাও থেমে নেই সেও আবিরের হাত খামচে ধরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। চেঁচিয়ে উঠলো সে এই মধ্য রাতেই, “ঘরে পোষায় না তোমার এখন বেশ্যাপড়ায়ও পা বাড়িয়েছো! ছিহ, এতদিনেও তুমি নিজেকে পরিবর্তন করতে পারলে না আবির। মেয়েটার কথা ভেবেও অন্তত,,,,” দিশার চিৎকারে আবিরের বাবা, মাও এসে দাঁড়ালেন ঘরের দরজায়। কিন্তু ছেলে আর বউয়ের কথা বুঝতে পেরেই তারা কেউ ভেতরে পা বাড়ায়নি। যদিও উচিত ছিলো সে সময়টায় আবিরকে শাসন করা সাধ্যনুযায়ী কিন্তু তারা এসবে যেন কানই দিতে চাইলেন না। দিশার কথার এক পর্যাবে আবির তাকে মারধোর শুরু করলো। এই মারামারি তাদের নতুন নয়। দিশা আগেও আবিরের হাতে মার খেয়েছে এবং প্রতিবারই সে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলেছে। কিন্তু আজ তার সীমা অতিক্রম করায় সে আর চুপ রইলো না। এতোদিন শুধু অন্য মেয়েদের দিকে কুদৃষ্টি দিয়েই ক্ষান্ত ছিলো বলে জানতো দিশা কিন্তু আজ যে সে কোন নারীর শয্যাসঙ্গী হয়ে ফিরেছে তা আবিরের বুক, পিঠ আর ঠোঁট দেখেই স্পষ্ট হলো দিশার কাছে। কে জানে আগেও এসবই ছিলো কিনা! আর সহনশক্তি রইলো না দিশার। মার খেয়ে পড়ে রইলো অনেকক্ষণ মেঝেতে। নিস্তেজ দেহে সে শুধু মনে মনে দোয়া করছে যেন নিঃশ্বাসটা ফুরিয়ে আসে এখনই। আফসোস হচ্ছে খুব সেদিন কেন ভাইয়ের হাতে মার খেয়ে সে এই অমানুষটার সত্যতা বুঝলো না। দিহান তো বারংবার বলেছিলো আবির একটা নেশাখোর জানোয়ার। বোন হয়ে সেদিন ভাইয়ের করা শাসনটাকে অত্যাচার আর এই জানোয়ারের বলা মিথ্যেকে সত্যি ভেবে কতখানি ভুল করেছে তা আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। আবির মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাথরুমে ঢুকে গেল। দিশা প্রচণ্ড ব্যথা নিয়েই টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো। শরীরের জামাটা ছিঁড়ে গেছে অনেক জায়গায়। কোনমতে গায়ের জামাটা পাল্টে ওড়না জড়িয়ে ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে তুলে নিলে। যে কাজটা দিহান বেঁচে থাকতেই করা উচিত ছিলো সে কাজটা আজ করবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। নিজের ফোনটা নিতে গিয়েও নিলো না সে। শুধু পার্স থেকে গাড়িভাড়ার টাকাটা নিয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে৷ গেইটের দারোয়ান নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে চাবি নেওয়া দরকার। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে তার মনে পড়লো গেটের চাবি দারোয়ান যেখানে বসেছে সেই দেয়ালেই একটা রিং ঝুলানো। নিশুতি রাত, ব্যথায় জর্জরিত দেহ নিয়ে আট মাসের মেয়েটাকে কোলে রাখা আরো কষ্টদায়ক। তবুও আজ আর হাল ছাড়া যাবে না। এদিক ওদিক তাকিয়ে দারোয়ানকে পাশ কাটিয়ে দেয়াল থেকে চাবিটা নিলো। পাশ কাটাতে গিয়েই তার ওড়না লাগলো লোকটার হাতে কিন্তু ভাগ্য ভালো লোকটার গাঢ় ঘুমটা ভাঙেনি। ছোট গেইটের তালা খুলে চাবিটা গেইটে ঝুলিয়ে রেখেই বেরিয়ে পড়লো দিশা। বাড়ি থেকে বের হতেই সে টের পেল পুরো বাড়িতে আলো জ্বলে উঠেছে। তারমানে আবির তাকে না পেয়েই পুরো বাড়িতে খোঁজ করছে। মনে মনে দুরুদ পড়তে পড়তেই পা চালালো। কোনমতে সে তার বাড়ি পৌঁছে গেলেই আবিরের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারবে। কিন্তু পায়ে হেঁটে কতদূর যেতে পারবে! ফোনটা না এনে এখন মনে হলো ভুল হয়ে গেছে। অন্তত দিশান ভাইয়াকে একটাবার ফোন করে সবটা বললে নিশ্চিত ভাইয়াই কিছু একটা করতো। ভয়ে ভয়ে হাটতে হাটতে সি এনজি চোখে পড়লো। বয়স্ক লোক সম্ভবত বাড়ি ফিরছেন। দিশা হাত তুলে থামাতে বললেও লোকটা প্রথমে চলে গেল। খানিকটা এগিয়েই আবার থেমে গেল। দিশার ভয় হলো লোকটা মন্দ কিনা! পরক্ষণেই মনে হলো সি এনজিতে ওঠার আগে সে লোকটার কাছে ফোন চাইবে। এগিয়ে গেল সিএনজির সামনে।

“চাচা গুলশানের দিকে যাবেন?”

লোকটা দিশার কোলে বাচ্চা দেখে আগেই প্রশ্ন করলো, ” বাচ্চা চুরি করছেন?”

“না না চুরি করবো কেন এটা আমার মেয়ে ।”

“মিছা কথা কন! অহনই পুলিশে দিমু” বলেই লোকটা ফোন বের করলো পকেট থেকে। দিশার মনে হলো এটা হলেই ভালো হয়। কারণ আবির যদি তাদের খুঁজতে বের হয় তাহলে গাড়ি নিয়ে আসতে তার দু মিনিটই যথেষ্ট। এর চেয়ে ভালো লোকটা পুলিশকে জানাক সে উছিলায় বিপদ কাটবে।

“আপনি করুন ফোন এতে আমি আর আমার মেয়েটা বেঁচে যাবো৷ থানায় গিয়ে অন্তত বাবাকে বা ভাইয়াকে খবর দিতে পারবো।”

এবার লোকটার মনে হলো মেয়েটা সত্যিই বিপদে পড়েছে। ভালো করে তাকিয়ে বলল, “কি হইছে আপনের? ”

“আমার স্বামী আমাকে মারধোর করেছে। আমি মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি।”

লোকটা এবার খেয়াল করলো দিশার গালটা কালচে হয়ে আছে। আলো নেই রাস্তায় সিনএনজির আলোয় রক্তগুলোই কালো লাগছে দেখতে। লোকটা নিজেই এবার তাড়া দিলো, “উইঠা বহেন। কোন জায়গায় যাইবেন ঠিকানা কন।”

লোকটা দিশাকে তাদের বাড়ির গেইটে এনে নামতে বলল। কিন্তু দিশা চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। কোনমতে মেয়েটাকে জড়িয়ে আছে দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা এখুনি পড়ে যাবে। সিএনজির ড্রাইভার এবার আতঙ্কবোধ করলো৷ কয়েকবার দিশাকে ডাকার পর বুঝলো বাচ্চাটা কোনমতে হাতে রেখেই মেয়েটা জ্ঞান হারিয়েছে। বাড়ির দিকে তাকিয়ে লোকটার মনে হলো এত বড় বাড়ি এত বড় গেইট নিশ্চয়ই গেইটে দারোয়ান থাকবে। তাই দিশার জড়ানো হাত ছাড়িয়ে লোকটা বাচ্চাটাকে কোলে তুলে গেইটে ধাক্কালো কয়েকবার। কিছুক্ষণ পর গেইটের ওপাশ থেকে দারোয়ানের কন্ঠ শোনা গেল। এরপর আর দেরি হয়নি। দশ মিনিটের মধ্যে ভেতর বাড়িতেও খবর গেল। দিশানরা দোতলায় বলেই ময়না খালা আর তাদের এত রাতে ডাকলেন না। কিন্তু বাড়ির কাউকে তো ডাকতেই হতো তাই বাধ্য হয়েই দিহানের বাবাকে ডাকলো। মেয়ের অবস্থা দেখে রাতভর আর চোখ বুজতে পারেননি তিনি। ময়না জেগে রইলো দিশার পাশে। ভোর হতেই হাসপাতালে নেওয়া হলো দিশাকে। দিশানকে ভোরেই ডেকে দিশার কথা বলতেই সে রাগে, ক্রোধে তখনি বের হচ্ছিলো আবিরকে মা*রতে। ঐশী বাঁধা দিয়ে বলল আগে দিশাকে সুস্থ করা জরুরি। তাই করা হলো দিশার জ্ঞান ফিরলেও শারীরিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। তার শরীরে মারের আঘাত গভীর কিন্তু কোথাও তেমন কাটাছেঁড়া নেই। শুধু ঠোঁটের কোণ কেটে কিছুটা রক্ত ঝরেছে রাতে। দিশান আবিরকে নিজে কিছু করতে না পারলেও ছেড়ে দেবে না বলে ঠিক করলো। সকালেই সে পুলিশ কেইস করলো নারী নির্যাতনের। দিশা নিজেই স্বাক্ষী হয়ে স্ট্যাটমেন্ট দিলো লিখিত, মৌখিক দু রকমেই। তাৎক্ষণিক একশনে আবিরকে জেলে দেওয়া হলো। তার বাবার রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও লোকটা কোন কিছুই করলো না ছেলের জন্য শুধু দিশার কাছে অনুরোধ করলো তারা যদি ডিভোর্স নেয় নাতনিটাকে যেন একেবারে আলাদা না করে। তাদের সাথে দেখা করার সুযোগটা যেন দেয় দিশা। দিশা চুপ ছিলো কিন্তু দিশান বলে দিলো আজকের পর তার ভাগ্নি ওই বাড়ির কারো চেহারাই দেখতে পারবে না সে নিজেই সে ব্যবস্থা করবে। কয়েকদিন কেটে গেল দিশা আর আবিরের কেইস নিয়ে। সব ঝামেলার মাঝে দিশান এবার প্রচন্ডরকম তিক্ততা অনুভব করছে নিজের মাঝেই। দিশা সুস্থ হয়েছে সে এখন কাউকে না জানিয়েই নিজের জন্য একটা বাসা খুঁজছে সেই সাথে চাকরি। বাবা, ভাইয়ের কাঁধে মেয়ে নিয়ে পরে থাকাটা তার ঠিক লাগে না। যতোই থাক বাপ ভাইয়ের অর্থবিত্ত।

চাঁদ খানের বনানীর সেই বাড়িটা চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। এডভান্স পঁচিশ লাখ টাকা হাতে এসেছে আরও পঁয়ত্রিশ লাখ পাবে জমি রেজিস্ট্রির দিনে। তাতে সময় লেগে যাবে আরো পনেরোদিন কিন্তু চৈতীকে নিয়ে আর দেরি করাটা ঠিক হচ্ছে না। সুইটিকে অনেক বুঝিয়ে মানানো গেল। চাঁদের সাথে এখন আর রাগ, অভিমান কোনটাই নেই বরং দুজনে এবার মিলে মিশেই মেয়ের পেছনে পরিশ্রম করছে। এ সপ্তাহে চৈতীকে নিয়ে সুইটি আর ডক্টর রাশেদ চলে যাবে সিঙ্গাপুরে এমনটাই ঠিক হলো৷ টিকিট কনফার্ম হয়ে গেছে গোছগাছও শুরু কিন্তু টাকার হিসেবে এসে বিপাকে পড়লো চাঁদ। সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে হবে চৈতীর ট্রিটমেন্ট। সব দিককার খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল বিখ্যাত সেই হাসপাতালে ওয়ান বেডরুম কেবিন খরচ প্রতিদিন প্রায় ছ’শ ইউএস ডলার যা আমাদের দেশে পঞ্চাশ হাজারের ওপর হবে। এদিকে ট্রিটমেন্টে কতদিন লাগবে তার নির্দিষ্ট কোন হিসেব নেই। এছাড়াও সেখানে অন্যান্য খরচ যোগ সুইটির খরচও কিছু আছে। চিন্তায় চিন্তায় ঘাড়ের রগ ফুলে উঠছে চাঁদের। এদিকে মাত্রই দিশাকে নিয়ে মামলা মোকদ্দমায় দিশানের খরচ গেল অনেক আবার বড় আপাকেও ট্রিটমেন্ট এর জন্য বাহিরে নেওয়ার প্ল্যান করছে দিশান। সব মিলিয়ে তাদের কাছে টাকার কথা বলাটাই বেমানান। অনামিকার সাথে যতটা দূরত্ব চাদের বন্ধুত্বের ঠিক ততোটাই নিকটত্ব গড়ে উঠেছে অভিনবের সাথে। চাঁদ কথায় কথায় একদিন অভিনবকে বলল লাখ পঞ্চাশের মধ্যে হয়ে যাবে কিনা! অভি হেসে বলল, “এতেই অনেক আঙ্কেল আপনি অত ভাবছেন কেন? চৈতীর ব্রেণের সমস্যাটা আশা করছি দ্রুতই ঠিক হবে আর আমরা যা ভয় পাচ্ছি তা হবে না।” অভি মুখে বললেও নিজের মনকে সে বোঝাতে পারছে না। এই তো দু দিন ধরে চৈতী চোখের পলক ফেলে অনবরত কিন্তু কাউকে দেখেই তার কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি সে তার ঠোঁটটাও নাড়ছে না। অভি খুব একটা যায় না চৈতীর কেবিনে। আর যখন যায় তখন চৈতীর চোখ বোজা থাকে৷ সে ঘুমিয়ে আছে কি জোগে বোঝার উপায় নেই। এরপর কাটলো আরো কিছুদিন। চৈতীর যাবার দিন খুব সকালে অভিনব ঘুম থেকে উঠে দ্রুতই তৈরি হচ্ছিলো। অনামিকা সবে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। সে গাড়ি থেকে নামতেই মুখোমুখি হলো মা ছেলে। অভিনব মা’কে সালাম দিতেই মা প্রশ্ন করলো, “সকালেই ডিউটি আজ?”

“না, চৈতীকে নিয়ে আজ সিঙ্গাপুরে যাচ্ছে রাশেদ স্যার তাই যাচ্ছিলাম এয়ারপোর্টে।”

“ওহ, যেভাবে বের হচ্ছো আমি ভাবলাম তুমিই যাচ্ছো সাথে৷ চৈতীর অভিভাবক তো হাসপাতালের খাতায় তুমিই।”

অভি বুঝতে পারলো মায়ের ব্যঙ্গাত্বক কথা।তাই সেও হাসি মুখে মায়ের আরেকটু কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো মাকে৷

“হু, দূর্ভাগ্য আমার ভালোবাসার মানুষটার শুধু হাসপাতালের খাতাতেই অভিভাবক আমি। আব্বুর মত সৌভাগ্যবান হয়ে ভালোবাসার মানুষের স্বামীর খাতাতে নাম লিখাতে পারলাম না।”

অনামিকা কেঁপে উঠল ক্ষনিকের জন্য; ছেলেটা তাকে কি বলল!

অভি চলে গেল নিজের গাড়িটা নিয়ে৷ অনামিকা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো আগের জায়গায়। তার চোখ ঝাপসা হলো। সত্যিই তার বাবার সৌভাগ্য অনামিকাকে ভালোবাসতো এবং যে করেই হোক শেষ পর্যন্ত অনামিকাকেই জীবনসঙ্গী করেছে। কিন্তু দূর্ভাগ্য তো অনামিকার সে ভালো বাসতো ওই দীর্ঘকায়, গম্ভীর মানুষটাকে। কিন্তু কিছুতেই সেই ভালোবাসা পূর্ণতা পায়নি। পাওয়ার কথাও না ভালোবাসাটা তো এক তরফা ছিলো। সেই মানুষটা তো প্রথমে দেশ পরে সুইটিকে ভালোবাসলো৷ তবে কি তার ছেলেটাও তার মত দূর্ভাগ্য পেল! নাহ, তার দূর্ভাগ্য না চাঁদকে না পাওয়াটা। বরং সৌভাগ্য সে তার জীবনে অভিনবের বাবার মত একটা অতি সাধারণ হাস্যমুখ মানুষটাকে পেয়েছে। চাঁদ খানের মতোই তার মেয়ে চৈতীও দুর্লভ। তাই চৈতী নয় অভি নিশ্চয়ই কাউকে পাবে যে অভিকে ভুলিয়ে দিবে চৈতীকে না পাওয়ার কষ্টগুলো।

দুপুর দুইটা,
বিশ্বের সেরা এয়ারপোর্ট গুলোর একটা হলো চাঙ্গি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। মাথার ওপর সূর্য যখন হাসিতে উদ্ভাসিত তখন সুইটিরা খুঁজছে তাদের জন্য অপেক্ষাকৃত হাসপাতালের একজন স্টাফকে। আগে থেকেই যোগাযোগ রাখা হয়েছিলো তাদের সাথে। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে কাঙ্ক্ষিত একজনকে পাওয়া গেল এবং আধ ঘন্টার মধ্যেই পেশেন্ট নিয়ে তারা হাসপাতালেও পৌঁছে গেছে। নির্দিষ্ট একজন লোক ঠিক করা হয়েছে তাদের জন্য যিনি চৈতীর ট্রিটমেন্ট চলাকালীন পুরো সময় সবরকম সহায়তায় নিযুক্ত থাকবেন। সময়ের পরিক্রমায় সবটাই শুরু হলো যথাসময়ে৷ দেশে থাকা চাঁদ খবর পেলেন মেয়েকে নিয়ে সুইটি হাসপাতালেই আছে। আরো জানা গেল তারা একবেডের কামরা নয় বরং চার বেডের ওয়ার্ডে সিট পেয়েছে। আর সবটাই হয়েছে অভিনবের তত্ত্বাবধানে। এতে দৈনিক খরচ অনেকটাই কমে যাবে। দিন চলছে নিজের মত। দিশান তার মামার সাথে রাগে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। চাঁদ একা থাকবে বাড়িতে তা ভেবেই তার ছোট বোন দিথি এসে হাজির হলো। দিশান সরাসরি না বললেও খালার মাধ্যমেই বলেছিলো চাঁদ যেন তাদের বাড়ি থাকে কিন্তু চাঁদ খান রাজী হয়নি৷ সে আপাতত নিজের একটা কাজ খুঁজছে৷ নিজের নামে দুটো দোকান ছিলো সেগুলোও তো ভাড়ায় দেওয়া অনেক বছর ধরে। এখন হুট করেই তো ভাড়া তাড়ানো যায় না। নইলে সে নিজেই কিছু একটার ব্যবসা শুরু করতো৷ এরই মাঝে আবার ঘটলো আরেক ঘটনা, ঐশী প্রেগন্যান্ট বাড়িতে সবাই জানলো৷ দিশান নিজে ঐশীকে নিয়ে দিলশাদের কাছে বসলো। তার মনে হলো হয়তো এই খুশির সংবাদটা মাকে দিলে পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু ঘটলো তার বিপরীত৷ যখন দিলশাদকে বলা হলো ঐশী প্রেগন্যান্ট তখন থেকেই সে ঐশীকে দেখলে লুকিয়ে যায়। ঐশীর ধারে কাছেও যায় না এমনকি দিশানকে দেখলেও সে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এতোটা অবনতি দিলশাদের মস্তিষ্কের যা দেখে আজকাল দিহানের বাবারও মন বিক্ষিপ্ত থাকে৷ দিশাও মায়ের অবস্থা বুঝতে পেরে একদিন খুব যত্ন করে পাশে বসালো। ইশারায় ঐশীকেও কাছে ডাকলো৷ তারপর মাকে বুঝিয়ে বলল, “এটা তো তোমার দিশানের সন্তান মা। তুমি কেন তাদের থেকে দূরে থাকো?” ঐশীর পেটে দিলশাদের হাত ছোঁয়ালো দিশা। কিন্তু এই কথাটাই ছিলো দিলশাদের কান্নার পথ। কান্নার সাথে সাথেই মুখও খুলল সেদিন দিলশাদ। স্পষ্ট উচ্চারণেই বলল, “আমার কারণেই আমার দিহান চলে গেছে। তার সন্তান চলে গেছে। আমার মুখ অভিশপ্ত আমি থাকলে ওরাও চলে যাবে।” কাঁদতে কাঁদতে ঐশীকে দেখিয়ে বলল দিলশাদ। তারা বুঝতে পারলো মানুষটার মনে গেঁথে গেছে তার অভিশাপেই দিহান মারা গেছে যেন তার সন্তানের মুখ না দেখতে পারে। ঐশী খুব করে বোঝালো এমন কিছুই হয়নি৷ তার অভিশাপ কি করে লাগবে দিহান তো তার আদরের সন্তান। যা হয়েছে সবটা ওপরওয়ালার ঠিক করে রাখা। কিন্তু মনটা দিলশাদের কিছুতেই মানলো না সে কথা।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here