আনকোরা পর্ব-৩৪

0
1532

#আনকোরা
#রূবাইবা_মেহউইশ
৩৪.

ছেলেটা চৈতীর ডাক শুনলো না। চলে গেছে গাড়ি নিয়ে। আশপাশের সকলের দিকে তাকিয়ে চৈতী খেয়াল করলো বেশিরভাগেই তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু কিছু মানুষ অবশ্য তাকে একপলক দেখেই চোখ সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু অনেকের চোখে মুখেই কৌতূহল। কারণটা কি! হঠাৎই তার মনে হলো, এই যে তার গালে কাটা দাগ তার জীর্ণ মুখশ্রী এগুলোই হয়তো কৌতূহলের কারণ। আবার মনে হলো মাথার চুলও হতে পারে ঠিক তখনি খেয়াল করলো সিগারেট হাতে একটি মেয়ে দুজন ছেলের সাথে ফুটপাতে হেটে যাচ্ছে। মেয়েটির মাথায়ও ছোট ছোট চুল, হাতে দুটো বই। ওই মেয়েটির দিকে তো কেউ সেভাবে তাকাচ্ছে না। তারমানে এই শরীরের ক্ষত চিহ্নগুলোই তাকে এতটা দৃষ্টিগোচর করাচ্ছে সবার। হতাশ দৃষ্টিতে সেও এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো তখনি হাতের ফোনটা বেজে উঠলো।

অচেনা নাম্বার; রিসিভ করতেই বাবার কন্ঠ ভেসে এলো, “কোথায় আছো চৈতী? আমরা ফিরবো এখন।”

“আমি আসছি।” বলেই চৈতী ফিরে গেল যেখানে বাবা আর সেই আঙ্কেল বসেছিলেন।

বাড়ি ফিরে চাঁদ সুইটিকে ডাকলেন। চৈতী ক্লান্ত শরীরে নিজের ঘরে গিয়েই শুয়ে পড়লো। সুইটি এক কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো।

“এখন চা খাবেন বলছেন তাহলে ভাতটা কখন খাবেন?”

“একেবারে রাতে খাব। আমার খিদে নেই এখন আর। চৈতীকে খাইয়ে দাও।”

“আচ্ছা! ডেকেছিলেন কি যেন বলবেন!”

“ওহ হ্যাঁ, আমি আজকে আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।”

“বলেছিলেন, চৈতীর ইউনিভার্সিটির লেকচারার সম্ভবত উনি!”

“হ্যাঁ আফতাব সেই ভার্সিটিতেই লেকচারার। চৈতী যেতে চাইছে বলে নিয়ে গেছি কিন্তু গিয়ে একটা লাভ হলো।”

সুইটি আগ্রহী চোখে তাকালো চাঁদের দিকে।

“আফতাবকে দেখেই চৈতী প্রথমে সালাম দিলো। এমনকি নিজেই প্রশ্ন করলো স্যার কেমন আছেন? আফতাব তো সবটা জানতো আর চৈতীর আচরণে কয়েক সেকেন্ড এর জন্য মনে হয়েছিলো তার বুঝি সবটাই মনে পড়ে গেছে।”

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো চাঁদ কথাটা বলে। সুইটিও হতাশ হলো কারণ সেও জানে চৈতী ইদানীং পরিচিত মুখ দেখলেই চিনতে পারে। কিন্তু তার সমস্যা একটাই সে পরিচিত মুখগুলোর সাথে তার সম্পর্কটা কি কিছুতেই মনে করতে পারে না। তবুও অনেক ভেবে চাঁদ সিদ্ধান্ত নিলো চৈতীকে নতুন করে ভর্তি করিয়ে দিবে। আগের ইাউনিভার্সিটিতেই তাই বন্ধুর সাথে আলাপ করে এসেছেন। চৈতী সুস্থ হচ্ছে কিন্তু তার জীবনের একটা অংশই হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। প্রাকৃতিকভাবেই মানুষ একটা সময় পর্যন্ত পড়াশোনা করে, তারপর চাকরি-বাকরি, বিয়ে কিন্তু চৈতীর জীবনে সবটাই এসে অধরা রয়ে গেল। মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতেই গেলে রক্তশূণ্য হয়ে পড়ে মস্তিষ্ক। চৈতীকে পড়া কথা বলতেই চৈতী অমত করেনি।

দিশার একটা হাই স্কুলে চাকরি হয়েছে। গ্রাজুয়েশনটা কমপ্লিট করা থাকলে ভালো কোন অফিশিয়াল জবও পাওয়া যেত হয়তো কিন্তু দিশা অনার্স তৃতীয় বর্ষেই আবিরকে বিয়ে করে পড়াশোনা ছেড়েছে। দিশান প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত বোনের এই চাকরি নেওয়ায়। বলতে নেই সে বারংবার বলে গেছে একটা বোন, ভাগ্নিকে লালন পালন করার ক্ষমতা তার আছে সেই সাথে বাবার ইনকামও এখনো কম নয়। কিন্তু দিশার এক কথা ভুল করেও সে কারো কাঁধে বোঝা হতে চায় না। ভাই হয়তো বোনের প্রতি ভালোবাসায় এমন করে বলছে। কিন্তু কোন একটা সময় এমনও দিন আসতে পারে যখন ভাইয়ের বাচ্চা, বউ ব্যপারটা পছন্দ করবে না। হয়তো মুখে বলবে না কিন্তু আচরণে কখনো প্রকাশ করে তবে তার মেয়েটা কষ্ট পাবে। নিজের সাধ্যে সম্ভব হলে কেন ভাইয়ের ওপর ভরসা করা! স্বাবলম্বী হওয়াটা মন্দ কিছু নয় বরং তার সন্তান কারো কাছে ছোট হয়ে থাকবে না আর না সে। ঐশীও প্রথম প্রথম বাঁধা দিলেও সে দিশার চিন্তাধারাকে সম্মান জানায়। সে নিজেও এত শিক্ষিত হয়ে ঘরে বসে আছে সেটা নিয়ে ভাবছে এখন। দিশার জন্য একজন কাজের লোক ঠিক করা হয়েছে যে কিনা তার অনুপস্থিতিতে আয়শাকে দেখবে আবার বাড়িতে ময়না খালা আর ঐশীও খেয়াল রাখতে পারবে। কারণ সে এই বাড়িতেই থাকবে দোতলায় একটা ফ্ল্যাটে। দিলশাদের ভালো উন্নতি হচ্ছে মানসিক সমস্যার, ঐশীও হাসিখুশি থাকছে খুব সবাইকে সাথে নিয়ে। দিশানের মনে হলো বহু বছর পর বুঝি বাড়িটা স্বাভাবিক হচ্ছে অথচ মাত্র তো কয়েক মাস আগেই সব ঠিক ছিলো! ভাইয়া নেই, চৈতীও নেই এখানে কিন্তু এই দুজনের না থাকাটা হুটহাট মনের ভেতর এক তুফানের সৃষ্টি করে। দিহানের বাবা বদলে গেছেন খুব। আগে প্রায় প্রত্যেকটা কথাতেই যেই মানুষটা হাসতেন সেই মানুষটা এখন হাসতেই ভুলে গেছেন। দিহানের ঘরে ঢুকে মাঝেমধ্যে লুকিয়ে চোখের জলও বিসর্জন দেন। যে বয়সে নিজের মৃত্যু নিয়ে ভাবতেন সে বয়সে সন্তানের লাশ কাঁধে তুলেছেন। বংশের প্রথম প্রদীপকেও দুনিয়ার আলো দেখার আগেই মাটিচাপা দিতে হয়েছে। মনে পড়ে তাঁর দিহানের সন্তানের মুখটা। কি দারুণ নাক, মুখ ছিলো বাচ্চাটার। আর তো মাস খানেক সময় ছিলো তার এ ধরনীর আলো দেখার অথচ সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল বাবা ছেলে।দিহানের বাবা মনে করেন চৈতী স্মৃতি হারিয়ে ভালোই হয়েছে। স্বামী সন্তান হারানোর যন্ত্রণা ভোগ করা থেকে তো বেঁচে গেল! ভালো হতো যদি তারাও ভুলে যেত সবটা, স্মৃতির পাতা ছিঁড়ে জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করে খুব। প্রথম সন্তান তাঁর প্রথম আব্বু বলে ডাকা সন্তানটা আগেই চলে গেছে। বুকটা খা খা করে দিহানের জন্য অথচ দিশানকে দেখলেই সেই চৌচির বুকে আবার ভয়ংকর ঝড় উঠে। দিলশাদ মাঝেমধ্যে দেখেন স্বামীর কান্না কিন্তু তার বোধগম্য হয় না মানুষটা এভাবে কেন কাঁদে! সে তার নিজ জগতেই গুম মেরে থাকে সারাক্ষণ।

অনেকগুলো দিন পরের ঘটনা, চৈতীকে নতুন করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেওয়ায় সে নিয়মিত ক্লাশে যায়। প্রথম প্রথম চাঁদ দিয়ে আসতো আবার ছুটির পর নিয়েও আসতো। কয়েকদিন হলো চৈতী জেদ ধরলো সে বান্ধবীদের সাথে আসবে- যাবে। বান্ধবী বলতে এই প্রথম সে ক্লাসের দুটো মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করলো। তার অবচেতন মন তাকে আবছা আবছা স্মরণ করায় তার কোন বন্ধু-বান্ধব ছিলো না এ জীবনে৷ কিন্তু বর্তমান মনটা সেসবে খেয়াল দিতে পারে না। সে মাকেও জিজ্ঞেস করেছিলো তার কি কোন বান্ধবী নেই, তারা কি খোঁজ নেয়নি তার! সুইটি জবাবে বলেছে তোর বান্ধবী আমি আর তোর দাদুই ছিলাম। দাদু তো বেঁচে নেই আর আমি সামনেই। তার মনে পড়ে না বাবা তাকে কতোটা কঠোরভাবে বড় করেছে, বাড়ির বাইরে তার দিকে নজর রাখার জন্য বাবার ঠিক করা গার্ডও ছিলো সেসবের কিছুই মনে নেই। আর তাই তো তার স্বভাবের বিপরীতে এবার দুটো বান্ধবী হয়েছে। একজন আহানা, দিথি। দিথিকে অবশ্য সে মজা করে ফুপি ডাকে কারণ তার ছোট ফুপির নামও দিথি। আজকে ক্লাস ছিলো একটাই আর আহানাও আসনি তাই দিথি বলল, “চলো চৈতী আমরা আজকে বার্গার খাই।”

“বার্গার!”

“হু, ফুপাতের দোকানগুলোর বা দিকেই দুটো ফুড কর্ণার আছে। তারা কিন্তু একে অপরকে টেক্কা দিতে প্রায়ই অফার দেয় কম টাকায় বেশি খাবারের।”

চৈতী জানে তাদের ভার্সিটির সামনেই ফুটপাতের একটা মার্কেট আছে। এখানে সস্তায় কাপড় আর জুতো পাওয়া যায় শুনেছে কিন্তু এতদিন বাবার সাথে আসায় সুযোগ হয়নি এদিকটায় যাওয়ার। বান্ধবী দুটো প্রায়ই বলে চল ঢুকি একটু ঘোরাঘুরি করি কিন্তু চৈতীর ভালো লাগে না। আজকে হঠাৎ বার্গারের কথা শুনে মনে পড়লো বার্গার খাবারটা খুব মজার। সেদিন তার ফুপাতো ভাই নিয়ে এসেছিলো বাসায়। আগেও হয়তো খেয়েছে অনেক কিনএ তার স্মৃতিতে বার্গার নামটার অস্তিত্ব নেই। তাই আজ খুশি খুশিই বলল, “চলো যাই। পকেটে টাকা আছে অনেকগুলো।”

দুজনে একটা শপে ঢুকে মেন্যু কার্ড চেক করলো। সব রকম ফাস্টফুডের সমাহার এতে। অনেক দেখে চৈতী ঠিক করলো বার্গার না চিকেন বল খাবে। দু বান্ধবী মিলে তাই খেল টাকাটা সম্পূর্ণ চৈতীই দিলো। খাওয়া শেষে দুজন বের হতেই দেখলো রাস্তার কিনারায় একটা লাল রঙের গাড়ি। গাড়ির সামনের চাকা চাকা একটা খোলা। টি শার্ট পরা একটা ছেলে চাকা চেঞ্জ করছে সম্ভবত। চৈতী থমকে দাঁড়ালো ছেলেটার একপাশ দেখে। দিথি ডাকলো, “থামলে কেন?”

“দিথি দ্যাখো ছেলেটাকে।”

“কোন ছেলে?”

“ওই যে চাকা লাগাচ্ছে।”

দিথি খেয়াল করলো দেখতে হ্যান্ডসাম, সুদর্শন একটা ছেলে গাড়ির চাকা লাগাচ্ছে।”

“দেখলাম।”

“আমার না এই ছেলেটাকে খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। আমি আগেও হয়তো দেখেছি তাকে।” দ্বিধান্বিত চোখে চৈতী ভাবছে অনেক কিছু। দিথিসহ তাদের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র এমনকি ভার্সিটিতে প্রায় সবাই কমবেশি জানে চৈতীর দূর্ঘটনার কথা। তার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে মোটামুটি সবাই অবগত। তাই দিথির মনে হলো ছেলেটা চৈতীদের কোন আত্মীয়, বা মুখ পরিচিত কেউ। সে নিজেই একটু এগিয়ে ডাকলো, “এই যে শুনুন!”

চৈতী তাকিয়ে দেখছে দিথির কান্ড। দিথি ডাকতেই ছেলেটা ফিরে তাকালো। এক গাল ভর্তি কালি সেই সাথে দুটো হাতেও। অতি ফর্সা মুখাবয়বের মানুষটার এক গাল ঢাকা পড়েছে কালিতে। চৈতী সত্যিই থমকে গেল আবারও। এই চোখ-মুখ তার চেনা লাগছে। স্পষ্ট নয় খুব ঝাপসা চোখের তারায় এই মুখ। কিন্তু কোথায় দেখেছিলো! ছেলেটিও চৈতীকে দেখে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো। সেও অপেক্ষায় আছে মেয়ে দুটো কি বলে তা জানার।

দিথিই প্রশ্ন করলো, “আপনি কি এই মেয়েটিকে চেনেন?”

ছেলেটি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকেই মুখ খুলল, “না।”

“ওহ!”

চৈতী শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে তার মন বলছে সে চেনে ছেলেটিকে। কিন্তু দিথি একটু বেশিই কৌতূহলী আচরণ করতে লাগল।

“আপনার নামটা কি?”

“অভি।”

নাম শুনে ভ্রু কুঁচকালো চৈতী। মায়ের মুখে সবসময় এক ডাক্তারের নাম শোনে সে। ডাক্তার অভিনব কিন্তু এই ছেলে তো তাকে চেনেই না।

দিথিই আবারও প্রশ্ন করলো, “এই গাড়ি আপনার।”

অভি ঝটকা খেল। মেয়েটি কি তার প্রতি অন্যরকম আগ্রহ দেখাচ্ছে! খেয়াল করলো মেয়েটির চোখ কিছু বলছে
তার ধারণা ভুল না হলে মেয়েটি নিশ্চিত তাকে পাত্তা দিতে চাইছে। কিন্তু চৈতীর চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে যারপরনাই বিরক্ত। অভি বাঁকা হেসে জবাব দিলো, “না, এটা আমার মালিকের গাড়ি।”

“আপনি ড্রাইভারী করেন?”

“হ্যাঁ।

মেয়েটি এবার একটু নিভলো মনে হয়। একটা ড্রাইভারের সাথে যেচেপরে এত কথা বলা গায়ে লাগছে বোধহয়। তাই চৈতীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার জি এখনও পরিচিত মনে হচ্ছে? না মানে তুমি যেই ফ্যামিলির তাতে তো মনে হয় না এটা তোমার আত্মীয় হতে পারে বলে!”

দিথির কথা শেষ হতেই চৈতী কিছু বা বলে এগিয়ে গেল নিজের গন্তব্যের দিকে। আর অভি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে রইলো চৈতীর যাওয়ার পথে। চৈতী তাকে কখনোই দ্যাখেনি স্পষ্টভাবে৷ দেখার কথাও না অভিনব কখনো এভাবে চেতনা থাকা চৈতীর সামনেই তো যায়নি আজকের আগে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here