#আনকোরা
#রূবাইবা_মেহউইশ
৪০.(শেষ)
বৃষ্টি থেমে গেছে ; শহরের গলির রাস্তায় গাড়ি চলাচল এখন শিথিল হয়ে গেছে। এ রাস্তায় বড় কোন গাড়ি চলাচল নেই বলেই অভিনব গাড়িটা এদিকে থামিয়েছিলো। এখানে মাথার ওপর নিয়ন বাতির আলোও আছে রাস্তাজুড়ে। যেমনটা বলেছিলো চৈতী। বৃষ্টিতে তারা আগেই ভিজেছে এখন ভেজা অবস্থায় বসে আছে গাড়ির ভেতর। গা কাঁপুনি দিয়ে আসছে চৈতীর হয়তো জ্বর আসবে। অভিনব গাড়ি স্টার্ট দিতেই চৈতী তাকে বাঁধা দিলো। অভিনবের ভয় হলো এই ভেজা শরীরে বসে থাকলে অসুস্থ না হয়ে পড়ে চৈতী। কিন্তু জেদ ছাড়িয়ে চৈতীকে নিয়ে রওনা হওয়ার সাধ্য হলো না তার। পুনরায় সেই একই প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাকিয়ে আছে অভিনবের মুখের দিকে৷
“আমাকে হয়তো বেহায়া ভাবছেন কিন্তু তবুও আমি জানতে চাই কেন আমাকে বিয়ে করবেন না? আমার মুখের এই বীভৎস দাগ আর অসৌন্দর্যতার জন্য,,,”
“না তুমি অন্য একজনের বিধবা স্ত্রী বলে!”
বজ্রাঘাতের মত কানে লাগলো চৈতীর। কি বলল অভিনব, সে একজনের বিধবা স্ত্রী! তার বিয়ে কবে হলো, স্বামী কবে মরলো? এ কেমন ফাজলামো কথাবার্তা! তার তো এখনো পড়াশোনাই শেষ হয়নি।
“আপনি মজা করছেন আমার সাথে?”
চৈতীর এ কথায় ঘার ফিরিয়ে তাকালো অভিনব। ভেজা শরীরে চৈতীর শীত লাগছে খুব তার কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে। কথা বলতে গিয়ে দাঁতে দাঁত ঠকঠক করছে। আরো কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে নিশ্চয়ই সে অসুস্থ হয়ে পড়বে। চিন্তিত হয়ে অভিনব গাড়ি স্টার্ট দিলো। চৈতী থামলো না সে রেগে গেল।
” আপনি সবসময় আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যান কেন? কে আপনি! কেন আপনার সাথে আমাকে নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিলো আমার পরিবার? আপনি কি লুকাচ্ছেন বলুন তো! আমি বিধবা আমার বিয়ে হয়েছিলো তাহলে আমার পরিবার কেন কখনো বলেনি এ কথা!”
“কারণ, ডাক্তারের অনুমতি ছিলো না তোমাকে এখনই সত্যিটা বলার। তোমার প্রতিটি টেস্ট রিপোর্ট বলে তোমার স্মৃতিভ্রষ্টতা স্রেফ কিছু দিন কিংবা মাসের। তুমি নিজেই তোমার অতীত মনে করতে পারবে কিন্তু তোমার দূর্ভাগ্য নাকি আমার সৌভাগ্য জানি না দীর্ঘ প্রায় ন’মাস পেরিয়ে এখনো তোমার মনেই পড়ছে না তোমার স্বামী সন্ত,,,,”
যতোটা উত্তেজিত হয়ে চৈতী প্রশ্নগুলো করেছিলো ঠিক ততোটাই উত্তেজিত হয়ে অভিনবও জবাব দিচ্ছিলো। কিন্তু চৈতীর সন্তানের কথাটা বলতে গিয়েই যেন তার হুঁশ এলো কি করছে সে। এই জবাব হয়তো চৈতীর মানসিক অবস্থার হিতে বিপরীত ঘটাবে। অভিনব আশ্চর্য হলো নিজের আচরণেও। সে তো কখনো এমন উত্তেজিত হয়ে উঠে না। পরিস্থিতি যেমনই হোক সে পারে নিজেকে সামলে নিতে। সে পারে উত্তেজনাকে চেপে রেখে সামনের মানুষকে শান্ত করতে। তবে আজ এ কেমন আচরণ করছে! ড্রাইভ করতে করতে এতোটা উত্তেিত হওয়া যে কোন বিপদের ডাক দিতে পারে মনে হতেই সে আবারও রাস্তা দেখে গাড়ি থামালো সাইড করে। ফোন বেজে উঠলো তার তখনি। পকেট থেকে ফোন বের করতেই দেখলো চাঁদ খান কল করেছেন। হালকা কেশে কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে ফোন রিসিভ করলো। সালাম দিতেই ওপাশ থেকে প্রশ্ন এলো, “তোমরা কোথায় এখন? ফিরতে কতক্ষণ লাগবে! চৈতী কোথায়?”
অধৈর্য্য আর চিন্তিত শোনালো চাঁদ খানের কন্ঠ। অভিনব আশ্বাস দিয়ে বলল তারা আধ ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসছে। সে কি চৈতীর সাথে কথা বলবে? চাঁদ বলল থাক তবে ধীরে সুস্থে বাড়ি এসো পরেই কথা হবে। ফোন রাখলো অভিনব তারপরই আবার চৈতীর দিকে তাকালো। চমকে উঠলো সে চৈতীর চোখে তাকিয়ে। কি ভয়ানক সেই চাহনি যেন চোখের তারায় এখনি রক্তঝড় বইবে। পরিস্থিতি কেমন বুঝতেই পারছে না অভিনব। সে চৈতীকে কি বলবে খুঁজে পাচ্ছিলো না কিন্তু চৈতী নিজেই সবটা সহজ করে দিলো। সে নিজেই অভিনবকে জোর করতে লাগলো তার অতীত সম্পর্কে জানাতে। বাধ্য হয়েই অভিনব বলল, ” তোমার বিয়ে হয়েছিলো অনেকটা নাটকীয়ভাবে জোর করে। আমি দেখিনি তবে সবটা শুনেছি আঙ্কেলের মুখে। দিহান মানে তোমার ফুপাতো ভাইয়ের সাথেই হয়েছিলো কিন্তু সে আর তুমি দুজনের কেউই রাজী ছিলে না। আমি তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম মায়ের হসপিটালে দিহানের অসুস্থতার সময়। তখন আমি বা আমার আম্মু জানতো না তুমি দিহানের স্ত্রী। তুমি নিশ্চয়ই শুনেছো তোমার বাবা আর আমার বাবা-মা তিনজনে ফ্রেন্ড, ব্যাচমেট। সেই সুবাদেই তোমার পরিবারের সাথে আমার আম্মু আব্বুর পরিচয় আগে থেকেই। আমি যখন আম্মুকে তোমার কথা বলেছিলাম আম্মু বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলো। সেদিনই জানা হলো তুমি দিহানের স্ত্রী। এরপর আমার ভাবনাকে আমি তোমায় নিয়ে বিস্তৃত হতে না দিয়েই দেশ ছেড়েছিলাম। কিন্তু আবার একদিন শুনতে পেলাম একটা দূর্ঘটনার কথা তারপরই জানা হলো তোমার স্বামীর মৃত্যু আর তোমার অবস্থার কথা।”
অভিনব কথাগুলো বলতে বলতে আনমনেই চৈতীর দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখলো। তার ভয় হলো অতীত শুনে চৈতী কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে! সাইকিয়াট্রিস্ট মেহরিমা বারবার করে সাবধান করেছিলো যেন চৈতীকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলা না হয়। কিন্তু এখান তো অভিনবের প্রতিক্রিয়ায় চমকপ্রদ। চৈতী সব শুনছে অথচ তার চোখে কোন দুঃখ নেই, ভয় নেই আর না আছে কষ্টের ছাপ। অভিনব ধীরে ধীরে পরের ঘটনাগুলো বলতে থাকলো চৈতীর দিকে তাকিয়ে। তার এক্সিডেন্ট, দিহানের মৃত্যু, দেশের হাসপাতাল আর বিদেশের হাসপাতালে তার চিকিৎসা সবটা বলতে গিয়ে শুধু লুকিয়ে গেল চৈতীর সন্তানের মৃত্যুর কথাটা। সব ঘটনা শুনে চৈতীর অবশ্য কোন হেলদোল হলো না বরং অভিনবকে অবাক করে দিয়ে সে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।
“আচ্ছা গল্প বলা শেষ হয়ে থাকে ড্রাইভিংয়ে মন দিন বাড়ি ফিরতে হবে।”
নির্বাক হয়ে গেল অভিনব; সে চুপচাপ ড্রাইভ করলো। আধঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেল তারা চৈতীদের বাড়ি। রাত তেমন বেশি হয়নি তবুও সুইটি আজ বিছানায়।জ্বর উঠেছে সন্ধ্যার পর থেকেই। তবে শরীরের জ্বরের মনের জ্বরটাই বোধহয় বেশি। একটু আগেই চাঁদের সাথে তার কথা কাটাকাটি হয়েছে খুব। চৈতীর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে করতেই শুরু হয়েছিলো এই ছোটখাটো ঝগড়ার সূত্রপাত। প্রথম প্রথম সুইটি চাইতো চৈতীর মনে পড়ুক সবটা। আজ কয়েকদিন হলো তার মন ভাবছে অন্য ভাবনা। অভিনব ভালো ছেলে আর চৈতীরও একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ কাম্য। চাঁদকে সে কথা বলতেই চাঁদ খান প্রথমে খুব সুন্দর করে বোঝালেন এ সম্পর্ক এখন ভুল সিদ্ধান্ত হবে। একটাই মেয়ে তাদের কেন বারবার তার জন্য ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন। সুইটি মানতে নারাজ সে কথা। সে আবেগি সন্তানের মঙ্গল ভাবতে গিয়ে মঙ্গলের আড়ালের অমঙ্গল কিছুতেই দেখতে পারছে না। চাঁদ খান আবেগি বাস্তববাদী মানুষ। একবার যে ভুল করেছেন তার পুনরাবৃত্তি করতে চান বললেন খুব সতর্কতার সাথেই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অভিনবের বাবাকে।
অভিনব বাড়ির গেইটেই চৈতীকে নামিয়ে সে ফিরে গেল। ভেজা শরীরে তার হঠাৎ করেই হাঁচি উঠছে। চৈতী একবার বলেছিলো ভেতরে আসতে অভিনব এলো না। চৈতীর অসুস্থতার কথা ভাবতে ভাবতে আসছিলো সে এখন মনে হচ্ছে নিজেই অসুস্থ হয়ে যাবে। হোক সমস্যা নেই কাল সে যাবে না মিষ্টার আহমেদের বিয়েতে।
চৈতী ঘরে ঢুকলো। চাঁদ খান গাড়ির আওয়াজ আগেই পেয়েছিলেন তাই অপেক্ষা করছিলেন বসার ঘরে। বৃষ্টির রাত তাই ভেবেছেন অভিনবকে কফি অফার করবেন। কিন্তু চৈতী তো ঘরে একা ঢুকলো।
“তুমি একা!”
“ডক্টর অভিনব চলে গেছে। আমার ঘুম পেয়েছে ঘরে যাচ্ছি। মা কোথায়?” বলতে বলতেই চৈতী নিজের ঘরের দিকে এগোলো।
চাঁদ খান বললেন, ” তুমি তো ভিজে গেছো দেখছি। জামা কাপড় বদলে শুয়ে পড়ো। তোমার মায়ের জ্বর হয়েছে।”
চৈতী মাত্রই তার ঘরের দরজায় পা রেখেছিলো। বাবার কথা শুনে উল্টো ফিরে মাকে দেখতে যাচ্ছিলো। চাঁদ বাধ সাধলেন এখন যেতে হবে না সে ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছে। চৈতীও আর জোর করেনি। নিজের ঘরে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। ঘরের বাতি বন্ধ করতেই তার দমবন্ধ লাগলো। অভিনবের কথাগুলো কতোটা সত্যি তা ভাবতে গিয়েও ভাবলো না। আপাতত মস্তিষ্কে কোন জোর দিতে চায় না সে।
পরেরদিন দুপুরের দিকে চৈতী বাবা আর মাকে জিজ্ঞেস করেই তৈরি হলো বিয়েতে যাওয়ার জন্য। সুইটির জ্বর সেরে গেছে এক রাতেই। সে খুশি মনেই চৈতীকে সাজাতে বসলো। চৈতী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করছিলো এত সেজে সে যাবে না। মাথায় তো মাত্র দু ইঞ্চ লম্বা চুল এগোলোর সাথে এত সাজ মানায় নাকি! সুইটি খুব জোর করেই গালে ভালো করে ফাউন্ডেশন আর কনসিলারে দাগ ঢাকতে চেষ্টা করলো। পুরোপুরি না ঢাকলেও কিছুটা হয়েছে। হঠাৎ দেখায় প্রথমেই চোখে পড়বে না দাগগুলো। চাঁদ খান চৈতীকে গাড়ি করে পৌঁছে দিলো অভিনবদের বাড়ির গেইটে। চৈতী বলল তার সাথে ভেতরে যেতে কেন জানি চাঁদের মন বলল ও বাড়িতে সে কখনোই প্রবেশ করবে না। সত্যিই ঢুকলো না। চৈতী বাড়ির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে অবাক হয়ে তাকালো বাড়ির সামনের জায়গাটাতে। কি চমৎকার ফুলের বাগান! চারপাশ ঘিরে রঙ্গনের ঝাড়, বাগানের মধ্যিখানে কয়েক রঙের গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা সেই সাথে বিদেশি কিছু ফুল এমনকি বাগানের দক্ষিণ দিকটাতে নানা ধরনের বিদেশি ফুলের চারাও আছে। অবাক চোখে চারদিকটা দেখতে দেখতেই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো চৈতী। প্রধান দরজা খোলা দরজার সামনেই একটি মেয়ে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়ানো। মেয়েটি হঠাৎ প্রশ্ন করলো, “কারে চান?”
“অভিনব!”
“আপনে কেডা?”
“আমি চৈতী। ডাক্তার অভিনব আমাকে চেনে।”
“ও আপনেই সে। আসেন বসেন ভাইজানের জ্বর চা নিয়া যাইতাছিলাম। আমি গিয়া কইতাছি আপনে আইছেন।” মেয়েটি একদমে বলেই সিঁড়ির দিকে গেল তারপরই আবার থেমপ বলল, দরজা লাগাইতে গিয়া না লাগাইয়া যাইতাছি। আপনে এট্টু খেল (খেয়াল) রাইখেন।”
চৈতী মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। মেয়েটি দোতলায় চলে যেতেই চৈতী এদিক ওদিক তাকালো। বাড়িটা খুব বড় নয় তবে খুব সাজানো গোছানো। চৈতী চারপাশে চোখ বুলাচ্ছিলো তখনি ফোন বাজলো৷ অভিনব ফোন করছে কেন!
রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে প্রশ্ন এলো, “তুমি একাই এসেছো?”
“না।”
“কোন দরকার ছিলো? আমাকে একবার ফোন করে জানিয়ে দিতে।”
“কয়টা বাজে?”
চৈতীর এবারের প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল অভিনব। সে কি বলছে আর মেয়েটা কি জিজ্ঞেস করছে!
“তুমি কি সময় জানতে এখানে এসেছো!”
” আগে বলুন কয়টা বাজে?”
“একটা পনেরো।”
“বরযাত্রী যাবে কখন!”
“বরযাত্রী!”
অভিনব বিষ্ময়ে হা হয়ে গেল৷ রাতে তার ভীষণ জ্বর ছিলো৷ শেষ রাতে জ্বরের ঔষধ খেয়ে ঘুম দিয়েছে তাই মনে তখন চৈতীর ভাবনা আসেনি সে কেমন অবস্থায় আছে। কিন্তু সকাল থেকেই তার ভয় হচ্ছিলো চৈতী ঠিক আছে তো সত্যিটা জেনে! কিন্তু তাকে চমকে দিয়ে মেয়েটা স্বাভাবিকভাবে তার বাড়ি এসে উপস্থিত। অভিনব আর দেরি করলো না সে বাথরুমে ঢুকে গেল গোসলের জন্য। কাজের মেয়েটি চৈতীকে কিছু ফল কেটে দিয়ে গেল। আর বলে গেল এখন তারা বিয়েতে না গেলে সে নিশ্চয়ই চৈতীকে বিরিয়ানি রান্না করে খাওয়াতো। চৈতীও মেয়েটির সাথে গল্প করতে করতে অপেক্ষা করলো অভিনবের। অভিনব একেবারে তৈরি হয়েই নিচে নামলো। চৈতীকে নিয়ে রওনা হলো মিস্টার আহমেদের শ্বশুরবাড়ি। পথে অবশ্য ফোন যোগাযোগ করে নিলো অভিনব। ভেন্যু যথেষ্ট দীর তার ওপর ঢাকার রাস্তার জ্যামে আটকে দেরি হলো অনেকটা সময়। আজও আকাশ মেঘলা তবে এখনো বৃষ্টি নামেনি। বিয়ে বাড়ি পৌঁছুতে পৌঁছুতে অনেক দেরি হয়ে গেল তাদের। বরযাত্রীর খাওয়া দাওয়া শেষ অনেক আগেই এখন বিয়ের পর্ব। অভিনবের ফোন বাজলো পুনরায়। সে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কোন কথা শুনে জবাব দিলো, “আরে না আমরা পৌঁছে গেছি প্রায়। বিয়ের কাজ সেরে ফেলো।”
ফোন রেখে গাড়ি পার্ক করলো৷ বিয়ের জন্য সাজানো গেইট চোখে পড়ছে। অভিনব চৈতীকে নিয়ে গেইট পেরিয়ে প্যান্ডেলে ঢুকে এগিয়ে গেল সোজা বরের স্টেজের দিকে। কনের রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে এবার মিস্টার আহমেদ সাইন করতে হাত বাড়াতেই তার চোখ আটকে গেল সামনে থেকে আসা শুভ্র জামা আর মেরুন ওড়ানার মাঝে ভাসমান মুখটা। অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলো, “চৈতী!”
অভিনব আর চৈতী সামনে এসে দাঁড়াতেই যেন এক ধাক্কা খেল চৈতী। আনমনেই ডেকে উঠলো, “অভ্র!” অভিনব ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো চৈতীর দিকে।
বরের সাজে অভ্রের হাতে থাকা কলমটা গড়িয়ে পড়লো নিচে। এ কি তার ভ্রম নাকি সত্যিই সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা চৈতী! অভ্রের মুখের রঙ বদলে যাচ্ছে মুহুর্তেই আর তা নজর এড়ালো না তার বোনের। অনেক কসরত অনেক বুঝ আর অনেকটা আকুতি মিনতির পর পেরেছে ভাইকে বিয়ের জন্য রাজী করাতে আর আজ শেষ মুহুর্তে এসে কি সবটা পন্ড হবে! ভাইটার ভবিষ্যৎ কি নষ্ট হবে তার অতীত ফিরে আসায়! এমনটা ভাবতেই অভ্রের বোন নিজের স্বামীকে সরিয়ে সে নিজেই এসে বসলো অভ্রের পাশে। কাজী আর অন্যান্য মুরুব্বিরা ব্যপারটা দেখতেই চোখ মুখ কুঁচকালেন কিন্তু সেদিকে খেয়াল করার সময় এটা নয়। অভ্রের কানের কাছাকাছি এসে খুবই ধীর স্বরে তার বোন বলল, “পায়ে পড়ি ভাইয়া কোন ভুল কাজ কোরো না। তুমি এই মুহুর্তে চৈতী আপুর দিকে নিজেকে নিতে চাইলে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে আর তার দাম দিতে হবে তোমার বোনকে।” কথাটা শুনেই যেন সম্বিত ফিরলো অভ্রের। জলে ঝাপসা চোখটা চৈতীর ওপর থেকে সরিয়ে বোনের দিকে চাইলো। তার ভুল সিদ্ধান্তে বোনের জীবন নষ্ট হবে। কথাটা সত্যি কারণ বোনের ননদের সাথে ঠিক হওয়া বিয়েটা বিয়ের আসরে ভাঙলে এর দাম হয়তো তার বোনকেই চুকাতে হবে। কিন্তু চৈতী ডাক্তার অভিনবের পাশে কেন! দিহান! এখানেই সকল ভাবনার ইতি ঘটলো তার। অভিনবের মুখে শোনা চৈতীর জীবনের দুটো বছর তার এখন মুখস্থ। এই চৈতী তার চৈতী নয় এ দিহানের চৈতীও নয়। এ তো অতীতবিহীন এক মানুষ যার জীবনে হয়তো শুধু বর্তমানটারই অস্তিত্ব আছে। সবার অলক্ষ্যে এক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিলো অভ্র কলম তোলার বাহানায়। তারপরই সই করলো বিয়ের দলিলপত্রে। একটা স্বাক্ষরের মাধ্যমে হয়ে গেল অন্যকারো।
“এত রাতে কোথায় যাচ্ছিস চৈতী!”
” আমার বাড়িতে।”
“তোর বাড়িতে!”
“আমার স্বামীর বাড়িতে।”
ভয়ংকর এক বজ্রপাত ঘটে গেল সুইটির বুকের ভেতর। এ কি বলছে চৈতী!
অভ্রের বিয়ের আসরে বেশিক্ষণ দাঁড়ায়নি চৈতী। যে মুহুর্তে সে অভ্রকে দেখলো সেই মুহুর্তেই তার চোখের তারায় সিনেমার পর্দার মতোই ভেসে উঠলো সেই দিনটা৷ যে দিনটা সে আর অভ্র পার্কে বসেছিলো পাশাপাশি। তারপরই দিহান এলো হাতে ব্যাট অভ্রকে মারলো। তাকেও আঘাত করলো তারপরই তো কেমন বাংলা সিনেমার মত জোর করে তাদের বিয়ে হলো। এরপর তো দিহান পালিয়ে গেল প্রিয়ন্তির কাছে। তারপর! সবটা এখনো মনে পড়েনি তার তবে কষ্ট হলো না বুঝতে তার অতীতটাকে। অভিনব তো কালই তাকে বলেছে সবটা আর বুঝতে বাকি নয়৷ তার শুধু বিয়ে নয় একটা সন্তানও হয়েছিলো৷ কোথায় সেই সন্তান? স্মৃতিহীনা চৈতী কয়েক মুহুর্তেই স্মৃতির মুখোমুখি হয়ে গেল। মনে না পড়া ঘটনাগুলোও নিজেই সাজিয়ে গুছিয়ে কল্পনা করে নিয়েছে৷ কিন্তু কষ্টটা তখনো বুকের খাঁচা ছেড়ে চোখের নার্ভ ছুঁতে পারেনি। অসুস্থতার কথা বলেই সে অভিনবকে বলেছিলো বাড়ি পৌঁছে দিতে। বাড়ি ফিরে অভিনবকে বিদায় দিয়ে সে নিজের ঘরে ঢুকলো। সারা ঘর তন্ন তন্ন করে আজও খুঁজলো কিন্তু কিছুই পেল না ঘরে। মন বলল, যা আছে তোর সবটা দিহানের ঘরে। সেখানে বোধহয় এ কারণেই তার শান্তি খুঁজে পায় সে। চাঁদ খান কোন কাজে বাড়ির বাইরে। চৈতী মাকে বলল, “আমি যাচ্ছি।”
“এত রাতে কোথায় যাচ্ছিস চৈতী!”
এরপর আর থামেনি চৈতী। একাই বেরিয়ে পড়লো নিজের গন্তব্যের উদ্দেশে। যেতে যেতে সুইটির আর্তনাদমাখা ডাক শুনলো না সে। আধঘন্টার মধ্যে দিহানদের বাড়ি পৌঁছে কলিংবেল বাজাতেই সম্মুখীন হলো কয়েক জোড়া আতঙ্কিত দৃষ্টির। দিলশাদ স্বাভাবিক হয়েছেন মাত্র কিছুদিনই হলো। দরজায় দাঁড়ানো সেই প্রথমে চৈতীকে বলল, “ভেতরে আয়।”
ঘরভর্তি মানুষ। বাইরের মানুষ নয় সব দিহানের আপনজন। দিহানের মা, বাবা, দিশান, ঐশী, দিশা, দিশার স্বামী, ময়না আর চৈতীর বাবা চাঁদ খান।”
চৈতী এক পলক সবাইকে দেখে নিলো। তারপরই ফুপির সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো, “স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রী কি তার স্বামীর বাড়িতে থাকতে পারে?”
চমকে উঠলো উপস্থিত প্রত্যেকটা মানুষ। সুইটি হয়তো চৈতী বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই ফোন করে জানিয়েছিলো সবটা। তাই সবাই একসাথে জড়ো হয়েছে। চৈতীর সব মনে পড়েছে তা তো আন্দাজ করেছিলো কিন্তু সে এমন কিছু বলতে পারে তা ধারণায় ছিলো না। দিলশাদ একবার সবার দিকে তাকিয়ে চৈতীকে জবাব দিলো, ” অবশ্যই থাকতে পারবে।”
“আজ থেকে আমি আমার স্বামীর ঘরেই থাকতে চাই। তোমাদের কি কারো আপত্তি আছে?” কথাটা বলেই চৈতী প্রথমে ফুপি তারপর ফুপা এরপর দিশান ঐশীর দিকে তাকালো। দিশান এক কদম এগিয়ে চৈতীর মাথায় হাত রেখে বলল, “তোকে অনুমতি চাইতে কে বলেছে?” কান্না সামলে কথা বলল দিশান। তার ভারী কন্ঠস্বর কেঁপে কেঁপে উঠলো। দিহানের বাবা বললেন, “অনেক রাত হয়েছে ঘরে যাও মা।”
আর কেউ মুখ খুলল না। চৈতী সত্যিই চলে গেল তার পুরনো ঘরটায়। বসার ঘরে থম মেরে বসে রইলো সবাই। চৈতী ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলো। বাইরে বাতাস বইছে প্রবল বেগে। হয়তো আজও ঝড় হবে প্রবল বেগে। বাতাসের তান্ডব ছিন্নভিন্ন করবে প্রকৃতিকে সেই সাথে চৈতীও করবে নিজেকে। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো চৈতী। বাতাসে তার গায়ের ওড়নাটা ওড়ে গিয়ে পড়লো ক্যাকটাসের টবের ওপর। আনমনেই হাত তুলে ছুঁয়ে নিলো নিজের গাল আর তারপরই হাত রাখলো তলপেটে ঠিক সেলাইয়ের ওপর। বাঁধ লাগানো কান্নার ঢেউ বাঁধ ভাঙলো। আকাশের বজ্রাঘাতের আওয়াজের চেয়ে তীব্র বেগে ছিটকে এলো কান্নাটা। তুমুল ঝড় বয়ে গেল চৈতীর দেহ,মন আর চোখে। বসার ঘরের প্রত্যেকটা মানুষ শুনতে পেল সেই কান্নার আওয়াজ। স্বামী সন্তান হারানো করুণ সেই কান্না আর শোক চৈতীও পালন করলো দীর্ঘ সময়ের পর।
পরিশিষ্ঠঃ কালের পরিক্রমায় বদলে যায় মানুষ, বদলে যায় সময়ের হিসেব নিকেশও। দিহানের পরিবারে ঘটেছে অসংখ্য পরিবর্তন। চৈতী থাকতে শুরু করেছে তার স্বামীর ঘরেই। দিশানের একটি কন্যা সন্তান জন্মের পরপরই বদলে গেছে ঐশীর মানসিক রুপ। স্বামীর পরিশ্রমের ফসলে অন্যকে ভাগ দিতে জন্মেছে তার হিংসা। পরিবারে ভাগ হয়ে গেছে তিনটে। দিশা চলে গেছে তার স্বামীর পরিবারে৷ তার এক মাত্র মেয়ে আয়শা থাকছে নানা- নানী আর বড় মামী চৈতীর সাথেই। দিশান স্ত্রীর জেদে হার মেনেই নিজের ভাগটুকু আলাদা করেছে তবুও সে তার ভালোবাসার অংশে মা-বাবা আর চৈতীকে কখনোই কম রাখেনি তবে সবটা রেখেছে গোপনেই। ডক্টর অভিনব খন্দকার বিয়ে করেছে, সংসার করেছে তবে সে দেশও ত্যাগ করেছে পুনরায়। যেতে যেতে সে চৈতীকে বলেছিলো, “আমি কোনদিনও আমার স্ত্রীকে বলবো না আমার প্রথম প্রেমের কথা। সে জানবে শুধু সেই একমাত্র উত্তরাধিকারী আমার মনের জমিনের। ”
অভিমানে, গোপন এক আত্ম কষ্ট নিয়েই সেদিন বলেছিলো সে কথাগুলো।
অভিনব আরো বলেছিলো, “তুমি কি কখনো আর কাউকে ভালোবাসবে না চৈতী?”
চৈতী জবাব দিয়েছিলো সেদিন, “নিশ্চয়ই বাসবো, এখনো বাসি।”
“কাকে?”
“আমার সন্তানের বাবাকে।”
_________সমাপ্ত_______
( আপনাদের আর জ্বালাবো না আজকের পর। গল্পটাকে যেভাবে ভেছি সেভাবে লিখতে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে হোচট খেয়েছি শুধু মাত্র তীব্র নেগেটিভ মন্তব্যের জন্য। তবুও চেষ্টা করেছি কোন কিছু মন মস্তিষ্কে না নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার। হয়তো ঠিকঠাক পারিনি। রিচেক করা হয়নি আজও। ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার চোখে দেখবেন আশা করি। ভালো থাকবেন সবাই, আল্লাহ হাফেজ)