#আনন্দ_অশ্রু
পর্ব_২
#তাহসিনা_ইসলাম_অর্শা
বিন্দু বিন্দ পানি ঝরছে তীব্রতার চুল থেকে।
রাযিন উঠে বসতেই তীব্রতা একটা কাগজ সামনে এগিয়ে দিয়ে
‘ আমাদের ডিভোর্স পেপার সাইন করে দিন।
আকস্মিক তীব্রতার এমন কথায় রাযিন কিছু বুঝে উঠতে না পেরে থম মেরে বসে থাকে। ভীষণ রকমের আশ্চর্য কিছু হলে যেমনটা হয় ঠিক তেমন। ভাবলেশহীন ভাব দেখে তীব্রতা রাযিনকে উদ্দেশ্য করে
‘ কি হলো রাযিন কি ভাবছেন?
রাযিন এবার ঈষৎ রক্তাভ চোখ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে,
‘ কি বলছো এই সব তীব্রতা, ডিভোর্স মানে? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কিসব আবোল তাবোল বকছো?
তীব্রতাও উঠে দাঁড়িয়ে
‘ আবোল তাবোল কেন হবে রাযিন? আমি ডিভোর্স চাইছি অন্যায় কোন কিছু তো করছি না। আমি মুক্তি চাই আপনার থেকে, থাকতে চাই না আর এইখানে।
রাযিনের ভীষণ রাগ হচ্ছে কিন্তু নিজের রাগকে যথাসাধ্য আয়ত্ত করে
‘ গত ছয় মাস আমি কিছু বলিনি তীব্রতা তোমায়। তুমি যেমন ইচ্ছে তেমনই আচরণ করেছো আমার সাথে তারপরও কিছু বলিনি। কিন্তু এটা বারাবাড়ি হয়ে যাচ্ছে এখন। যদি তোমার এমন উদ্দেশ্যই থাকবে তাহলে গতরাত? গতরাত কেন এসেছে আমাদের জীবনে তীব্রতা? গতরাতটা তাহলে কি ছিলো?
তীব্রতা একটু এগিয়ে গিয়ে জানালার হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বাহিরে তাকায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে
‘ গতরাতে যা হয়েছে ভুলে যান।
‘ ভুলে যাবো মানে? কোন কোন কথা ভুলে যাবো আমি তীব্রতা? ছয় মাসের প্রতিটি দিনই আমি তোমায় ভালোবেসে কাটিয়েছি। ভাবিনি এই ভাবে ভালোবেসে ফেলবো আমি তোমায়।
তীব্রতা তোমার কি হয়েছে আমায় খুলে বলো।
আমি তো ভেবেছিলাম গতরাতে সব ঠিক হয়ে গেছে। ( মাথায় দুহাতে ধরে)
তীব্রতার চোখে একফোটা পানি জমা হয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ল। নরম সুর রুক্ষ করার চেষ্টা করে তাকালো রাযিনের দিকে, নিজের দৃষ্টি রাযিনের চোখে আটকে
‘ আপনার প্রথম বিয়ের কথা আমায় বা আমাদের কেন জানাননি? কেন লুকিয়েছেন আপনি আগেও একটি বিয়ে করেছিলেন? আপনার ভালোবাসা অন্য কারো জন্য আমার জন্য নয়। তাই আমি ডিভোর্স চাই।
রাযিন কথা গুলো শুনে হতভম্ব হয়ে যায়। এই গুলো কোথায় থেকে জেনেছে তীব্রতা? কেমন করে জেনেছে এসব? কিন্তু সবটুকু জানা দরকার তীব্রতার সে সবটুকু জানে না নিশ্চয়। একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে তীব্রতাকে কিছু বলতে যাবে তখনি মাথা চক্কর দিয়ে উঠে রাযিনের। পড়ে যেতে নিলেই তীব্রতা সহসা ধরে ফেলে রাযিনকে। রাযিনের গায়ে হাত দিয়ে তীব্রতা চমকে যায়। শরীর পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে তাঁর।
তীব্রতা তারাতাড়ি করে রাযিনকে খাটে শুইয়ে দেয়। মাথায় পানি ঢালার জন্য উঠে পানি নিয়ে আসতে যাবে তখনি রাযিন হাত ধরে নেয় তীব্রতার, জ্বরের ঘোরেই
‘ প্লিজ তীব্রতা আমায় ছেড়ে যেও না। কেন এমন করছো বল!
তীব্রতা কিছু না বলে হাত সরিয়ে পানি নিয়ে আসে। তারপর রাযিনের মাথায় বেশখানিকটা সময় পানি ঢেলে মাথা শরীর মুছে দেয়৷ অল্প খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দেয়।
প্রায় দুপুর বেলায় রাযিনের জ্বর অনেকটা কমে যায়। রাযিনের পাশেই তীব্রতা ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।
রাযিনও নীরবে তাকিয়ে আছে তীব্রতার দিকে।তীব্রতা রাযিনের তীব্রতম ভালোবাসা কেন বুঝতে পারছে না? রাযিন এইটুকুই তো চেয়েছিলো কেউ তাকে ভীষণ ভালোবাসবে। সেই মানুষটি শুধু একান্তই তার মানে তারই থাকবে । যেখানে অন্য কারো একাংশও ভাগ থাকবে না। যে মানুষটির শুধু আপন মানুষটা সেই থাকবে। যার সাথে তার তিক্ত অভিজ্ঞতার অতীত শরিক করবে। নীরবে দুইজোড়া চোখ একে অপরকে বলবে
‘ তো কি হয়েছে আমি তো আছিই। ভুলে যাও বাকি সব।
তীব্রতা বুঝতে পারছে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাই অস্বস্তি নিয়ে চোখ খুলে তাকায় রাযিনের দিকে। কিছু না বলে উঠে চলে যেতে নেবে তখনি রাযিন ওর হাত ধরে
‘ পাশেই একটু বস।
তীব্রতার ডানহাত রাযিন তার গালের নিচে দিয়ে হাতটাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে। ফলে তীব্রতা ঝুকে রাযিনের আরো কাছে চলে যায়। তীব্রতার গরম নিঃশ্বাস রাযিনের বাম কানে পড়ছে। রাযিন চোখ বন্ধ করে,
‘ আমি খুব ভালোবাসতাম তারিনকে। আমি ঠিক যেমন মেয়ে চাইতাম কল্পনা করতাম তারিন ঠিক তেমন মেয়েই ছিলো। জানো ও জানতো আমি ঠিকঠাক রান্না করতে পারতাম না তাই প্রতিদিন ওর জন্য আনা খাবার আমায় খাওয়াতো। ভালোবাসতো আমায় ভীষণ মেয়েটা।
‘ তাহলে চলে গেলো কেন? এখন কোথায় সে? ( নরম সুরে ঝুকেই )
রাযিনের গাল বেয়ে পানি তীব্রতার ডানহাতে পড়লো। একটু চুপ থেকে বলা শুরু করলো
‘ তারিন আর আমি তখন একই ক্লাসে পড়ি। দুজনেই অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ। আমার কথা তারিন অনেকের কাছ থেকেই শুনতো। ক্লাসে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। আমার ব্যপারে সে সবই জানতো। আমারো তারিনকে ভালোলাগতো ভীষণ। একদিন আমার ভালোবাসার কথা ওকে জানাই। তারিনও সেদিনই আমার ভালোবাসা গ্রহণ করে। তারিন আমার জীবনে আসার পর সব কিছু কেমন পালটে গিয়েছিলো জানো। আমার খুব খেয়াল রাখতো । মাঝে মাঝে এই খানে এসে রান্নাও করে দিয়ে যেতো। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এদিক সেদিক অনেক ঘুরে বেড়িয়েছি ওকে নিয়ে অনেক। বলতে পারো ওকে ছাড়া আমি নিজেকে কল্পনাই করতে পারতাম না। প্রায় এক বছর পর ওর বিয়ের জন্য বাড়ি থেকে অনেক প্রেশার দিচ্ছিলো আর আমাদের কথাও জেনে গিয়েছিলো তাই প্রেশারটাও বেড়ে গিয়েছিলো। তারপর একদিন তারিন আমার বাসায় এসে হাজির হয় এখনি ওকে বিয়ে করতে নয়তো আমি তাকে সারাজীবনের জন্য হারাবো। আমিও দ্বিতীয় কিছু না ভেবে ওকে নিয়ে কাজী অফিসে চলে যায় আমার কয়েকটা বন্ধুকে নিয়ে। বিয়ে শেষ করে তারিন ওর বাসায় চলে যায়। বলে গিয়েছিলো বাসায় কেউ মেনে না নিলে বেশি জোর করলে ও আমাদের বিয়ের কথা সবাইকে বলবে। আমিও তার কথা মেনে নিয়েছিলাম।
এইটুকু বলেই রাযিন থেমে যায়, ঢোক গিলে।
তীব্রতা অস্পষ্ট ভাবে
‘ তারপর কি হয়েছিলো?
রাযিন এই বার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তীব্রতার কোমড়। মনে হচ্ছে তীব্রতা কোথাও পালিয়ে যাবে। তারপর আবার বলতে শুরু করলো,
‘ আমারই এক বন্ধ ওর ফেমিলিতে জানিয়ে দেয় আমার আর তারিনের বিয়ের কথা। তারপর তারিনকে জোর করেই আবার বিয়ে দিতে চায়। বিয়ের একদিন আগেই পালিয়ে আসে তারিন। আমরা ঠিক করি কক্সবাজারে কয়দিন পালিয়ে থাকবো। আমার বাসা থেকে ব্যাগ গুছিয়ে বের হয় আমরা। তারিনকে দাঁড়া করিয়ে আমি রাস্তার অপর পাশে একটা দোকানে কিছু খাবার কিনতে যায়। সেই মুহুর্তেই তারিনকে তারিনের ভাই আর তার কয়েকজন ফ্রেন্ড ধরে নিয়ে যেতে আসে। তারিন দৌড়ে আমার কাছে যেতে নিলেই….
‘ তারপর, তারপর কি হয়েছিল?
‘ ধাক্কা খায় একটা গাড়ির সাথে। আমি দৌড়ে আসি, আমায় আটকে রেখে তারিনের ভাই ওকে হাসপাতাল নিয়ে যায়। আর আমায় পুলিশে দেয়। আমায় তারিনকে শেষ বারের মতোও দেখতে দেয়নি ওরা তীব্রতা। এই একজনই ছিলো পৃথিবীতে আমার, যে আমায় ভালোবাসতো৷ সেও আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিলো।
আর কিছু বলার আগেই রাযিন বমি করে দেয় তীব্রতার শরীরে আর ফ্লোরে। তীব্রতা চেপে ধরে রাযিনকে। বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় একদম। রাযিনও চেপে ধরে তীব্রতাকে। জ্বর আবার বাড়ছে তার। সাথে হারানোর যন্ত্রণা চেপে ধরেছে দুজনকেই।
তীব্রতা দু-হাত মুষ্টি করে ধরে রেখেছে রাযিনের পিঠ, আর মনে মনে বলছে,
‘ কিন্তু আমার যে ডিভোর্স নিতেই হবে রাযিন।
চলবে…..
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। দেরি হবার জন্য দুঃখিত।