আনন্দ_অশ্রু পর্ব_৬ (শেষ পর্ব)

আনন্দ_অশ্রু
পর্ব_৬ (শেষ পর্ব)
#তাহসিনা_ইসলাম_অর্শা

ভিতর থেকে সব কষ্ট নিঃসৃত হয়ে তার অবসান ঘটছে। অনুরক্ত বারিধারা দমনের নাম নেই। নেপথ্যে প্রসন্ন হচ্ছে হৃদয়। বিশ্বস্ত হাত, এই বিশ্বস্ত হাত ধরে একজীবন কেন যেন খুব ছোটই লাগছে তীব্রতার। এই হাত ধরে একজীবন কেন এমন সহস্রাধিক জীবনও কম মনে হবে তাঁর। এই হাত ধরে কত চড়াই-উৎরাই উসুল করা বাকি। আর সে কিনা এই হাত ছেড়ে দিতে চেয়েছিলো, গূঢ় করে রেখেছিলো বেহায়া হৃদয়।
তীব্রতার আবার আফসোস হচ্ছে কি বোকামিটাই না সে করতে যাচ্ছিলো। তার প্রিয় থেকে প্রিয়তম মানুষকে অন্যের হতে দিতে চেয়েছিলো।

আসলে মানুষ সুখ দিয়ে ভালোবাসা নির্ণয় করতে যায়। তারা ভুলে যায় সুখ দিয়ে ভালোবাসা পরিমাপ করা যায় না। ভালোবাসায় সুখ- দুঃখ দুটোই থাকে, দুটোরই প্রয়োজন। শুধু পাশে থাকাটা জরুরী।

তীব্রতা রাযিনের দু’হাত শক্ত করে মুষ্টি ভরে রাযিনের দিকে তাকিয়ে
‘ আপনার মা।

রাযিন বসা থেকে চমকে উঠে দাঁড়ায়
‘ আমার মা?

তীব্রতাও রাযিনের পাশাপাশি উঠে দাঁড়িয়ে
‘ হ্যা আপনার মা। আপনার আপন মা। আপনার খুব প্রিয় জিনিস যে কিনা আপনার কাছে পৃথিবী সমতুল্য দামী, সাথে আমারো।

রাযিনের মাথা ঝিমঝিম করছে
‘ কি আবোল তাবোল বকছো তীব্রতা! আমার মা মারা গিয়েছে আমার জন্মের সময়। আমি নিজেই তাকে কখনো দেখিনি। উনি কোথায় থেকে আসবে?

তীব্রতা রাযিনের বুকে আস্তে করে মাথা রেখে
‘ আপনার মা মারা যায়নি। তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো রাযিন। তারিনের মতোই উনিও বেঁচে আছে। তবে তারিন আপনায় স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছিলো আর আপনার মাকে ওরা বাধ্য করেছিলো।

আপনার বাবা আপনার মা মারা যাবার পর বিয়ে করেনি। আপনি যখন পেটে ছিলেন তখন দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলো। আপনি পেটে থাকায় তখন ছাড়তে পারেনি আপনার মাকে। তাই আপনি হবার পর আপনার মাকে উনি ডিভোর্স দেন। আপনার দাদুও আপনাকে কখনো সত্যিটা বলেনি। হয়তো আপনি কষ্ট পাবেন ভেবে নয়তো নিজের ছেলের দোষ ঢাকার জন্য।
আর সবাই আপনাকে তাই বলেছে যে আপনার মা আপনার জন্মের সময়ই মারা গেছেন। আপনার মাকে আপনার বাবা আর সৎ মা উনারা ভয় দেখিয়েছিলো উনি যদি আপনার সাথে যোগাযোগ করতে চাই তাহলে আপনাকে মেরে ফেলবে। সেই ভয়ে উনি আপনার কাছে কখনো আসেনি। হয়তো লুকিয়ে এসেছিলো আপনি কিংবা আমি জানি না।

তারিন নাকি আপনার মায়ের খোঁজ জেনেছিলো উনি কোথায় আছে। তারপর তারিন আপনার মাকে তার কাছে নিয়ে আসে।
আমি যদি আপনায় ডিভোর্স দেই তাহলে আপনার মাকে তারা আমার কাছে ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু শর্ত আপনাকে জানাতে পারবো না আপনার মায়ের কথা। আমি ভেবেছিলাম একবার আপনার মাকে আমি পেয়ে গেলে সব বলে দেবো আপনায়। আপনাকে উনার কাছে নিয়ে যাবো আমি।

রাযিনের চোখের পানি টিপ টিপ করে তীব্রতার মুখে পড়ছে। তীব্রতা মুখ উঁচিয়ে দেখে রাযিন কান্না করছে। চোখ দিয়ে বেগতিক পানি বের হচ্ছে। তীব্রতা দুই হাত চেপে ধরে রাযিনের গালে। চোখের পানি মুছে
‘ আমি কি করতাম বলুন? আপনার মা বেঁচে আছে শুনে আমি খুব খুশির সাথে বিস্মিত হয়েছিলাম। চেয়েছিলাম যে করেই হোক তাকে আপনার কাছে ফিরিয়ে দেবো। আর তাই আপনার কাছে আসা আমাদের দূরত্ব বাড়ানোর জন্যই।

রাযিন তীব্রতার হাত ধরে
‘ জানো আমি কখনো মা’কে ছবি ছাড়া দেখিনি। মায়ের মমতা কি অনুভব করিনি। কেন করলো এমন তারা আমার সাথে? কত কষ্টে আমি বড় হয়েছি জানো? একটু ভালোবাসার জন্য মানুষের ধারে ধারে আমি ঘুরেছি৷ আমি ওই লোককে ছাড়বো না তীব্রতা। যে আমার মায়ের সাথে এমনটা করেছে। আমি এখনি যাবো তারিনের সাথে দেখা কর‍তে। আমার মাকে আমায় ফেরত দিতে বলবো।

তীব্রতা রাযিনের হাত ধরে
‘ এমন করবেন না প্লিজ। এমন করলে সব ভেস্তে যাবে আপনার মাকে আর কখনোই পাবেন না। শান্ত হোন প্লিজ৷

রাযিন শক্ত করে জড়িয়ে নেয় তীব্রতাকে। কিছু জিনিস পেতে হলে তো কিছু হারাতেই হয়। প্রিয় জিনিস পাবে বদলে প্রিয় জিনিস হারাবে। রাযিন শুধু তার মায়ের ছবি দেখেছিলো কখনো মাকে ছুঁয়ে দেখিনি। তার ভালোবাসা কি বুঝে উঠেনি, রাযিন তীব্রতাকে মাথায় চুমু দিয়ে
‘ আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দেবো তীব্রতা। আমি আমার মাকে দেখতে চাই।

🍁🍁🍁🍁🍁

তীব্রতার ভিতরে ঝড়। বাহিরে সুন্দর হাসি নিয়ে বসে আছে একটা রেস্টুরেন্টে। সামনেই বসে আছে রাযিনের বাবা নামক অমানবিক লোক সাথে তার স্ত্রী। তারিন রাযিনের মাকে নিয়ে আসবে তাই দেরি হচ্ছে। কিন্তু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না তাদের। তারিন রাযিনের মাকে নিয়ে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই উপস্থিত হয় সেখানে৷ তীব্রতা ছবিতে দেখেছে রাযিনের মাকে তাই চিন্তে খুব একটা অসুবিধে হয়নি। তীব্রতার চোখে খুশির পানি রাযিনের মাকে দেখে। তীব্রতা উঠে উনাকে জড়িয়ে ধরতে গেলেই তারিন বাধা দেয়। বাধা দিয়ে।

‘ আগে সাইন করা ডিভোর্স পেপারটা হাতে দাও তারপর উনাকে নিয়ে এই শহর থেকে বিদায় হও। আর ভুল করেও রাযিনের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। রাযিন শুধু আমার আর আজীবন আমারই থাকবে।

তীব্রতা আর রাযিনের সাইন করা ডিভোর্স পেপারটা তারিনের সামনে এগিয়ে দিতেই তারিন তীব্রতার হাত থেকে খপ করে পেপারটা নিয়ে যায়। তীব্রতা আর রাযিনের সাইন দেখে তারিনের চোখ আনন্দে ঝলমল করছে৷

তারিন পেপার উল্টাতে উল্টাতে
‘ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না তোমরা ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছে….

তারিনের পিছন থেকে হঠাৎ কেউ একজন বলে উঠলো
‘ হ্যা সাইন করেছি তবে ওটা আসল ডিভোর্স পেপার নয়, আসলটা ডাস্টবিনে পড়ে আছে। এটা শুধু কিছু নকল কাগজ যেটা কিনা ডিভোর্স পেপারের মতোই দেখতে।

তারিন সহ সবাই পিছনে ফিরে দেখে রাযিন দাঁড়িয়ে আছে ওদের পিছনে। সবাই চরম অবাক হয়। তীব্রতার মুখে উজ্জ্বল হাসি। তীব্রতা রাযিনের মাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে দাঁড়ায়। রাযিন এগিয়ে এসে তারিনের গালে সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে
‘ তোমায় আমি ভালোবেসেছিলাম ভাবতেই পারছিনা। ভাবতে গেলেই ঘৃণা লাগছে। এতো কিছু কি ভাবে করতে পারলে ওদের সাথে মিলে?

তারিন কান্না করে
‘ তুমি ওইদিন আমার কথায় রাজি হওনি বলেই তোমার সৎ মা বাবার কাছে আমার যেতে হয়েছিলো, না হয় যেতাম না আমি রাযিন। ওদের কাছে গিয়ে শুনি তীব্রতা ওদের কাছে দু’দিন আগে এসেছিলো, তোমায় ওরা মেনে নিতে৷ আর তোমার মায়ের কথাও আমায় বলে। তারপরই আমি তোমার মাকে আমার কাছে আনার ব্যবস্থা করি আর ওদের টাকা দেই আমার কাজ করে দিতে। বিশ্বাস করো রাযিন আমি সব কিছু শুধু তোমায় ভালোবেসে তোমায় পাবার জন্য করেছি।

রাযিন রাগে গজ গজ করে
‘ যা করেছো ভালোই করেছো নয়তো আমার মাকে আমি কখনো পেতাম না৷ কিন্তু তোমার প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই নেই আমার। আমি শুধু আমার স্ত্রী তীব্রতাকেই ভালোবাসি।

রাযিন দু’কদম এগিয়ে তার বাবার কাছে গিয়ে
‘ শুধু জন্মদাতা বলে হাত তুললাম না আজ। তবে সব হিসেব আমি চুকিয়ে দেবো। অপেক্ষা করুন ওপরওয়ালার মারের জন্য। উনি সব হিসেব করে রেখেছে।

রাযিন তার মায়ের দিকে ফিরতেই উনি এসে রাযিনকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে শুরু করে। মাকে তার ছেলেকে চিনিয়ে দিতে হয়নি। এক অদ্ভুত ক্ষমতা মা ছেলের, সন্তানের সাথে মায়ের। দু’জন দুজনকে আপন করে নিয়েছে। এ যে নাড়ির টান, রক্তের সাথে রক্তের টান। এই সম্পর্ক পৃথিবীর সব সম্পর্কের ঊর্ধ্বে। মা ছেলে কাঁদছে খুব কিন্তু এই অশ্রু ‘ আনন্দ অশ্রু ‘ এই অশ্রু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা কাছে পাওয়ার অশ্রু৷ এমন দৃশ্য দেখে তীব্রতাও কান্না করছে। খুশিতে কান্না করছে সে। মা ছেলেকে, ছেলে মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। পিছন থেকে তীব্রতাও রাযিনের পিছনে গিয়ে রাযিনের পিঠে মাথা ঠেকিয়ে রাযিনকে জড়িয়ে ধরে।

একবছর পর

রাযিনের কোলে সদ্য জন্ম নেওয়া ছোট্ট পুতুলের মতো একটা মেয়ে আর রাযিনের মায়ের কোলে পুতুলের মতো একটা ছেলে। তীব্রতা বেডে শুয়ে আছে। চোখ খুলে দেখে দুজনের কোলে দুটো বাচ্ছা। জোড়া বাচ্চা হয়েছে তাদের।

তীব্রতা মুচকি হেসে
‘ হলো তো আপনার ফেমিলি? এই এই আপনার চোখে ওটা কি? অশ্রু? কিন্তু অশ্রু কেন? এ বুঝি “আনন্দ অশ্রু”।

রাযিন মুচকি হেসে চোখের অশ্রু মুছে নেই।

সমাপ্ত

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। অবশেষে শেষ হলো গল্পটা। কেমন হয়েছে একটু ভালো করে জানাবেন সবাই। আমার নতুন গল্প শীঘ্রই আসবে। আর এই গল্পের সিজন ২ চাইলে অবশ্যই জানাবেন। সবাই ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here