১৬ বছর বয়সের চঞ্চল কিশোরী যেন হঠাৎ করেই কেমন যেন শান্ত হয়ে গেলো। পাঁচ মিনিট আগেও যে মেয়ে পুরো বাড়ি মাথায় করে রেখেছিলো পাঁচ মিনিট বাদেই সেই চঞ্চল কিশোরী শান্ত হয়ে গেলো। সবে সবেই সে এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছে। রেজাল্ট দিতে দেরি। সে এখন তার জীবনের উপভোগ্য একটা সময়ে আছে। কিন্তু আজকের পর কি সে জীবনটাকে উপভোগ করতে পারবে? মনে হয় না! একটা ছোট্ট খবর তার জীবনের সব রং উড়িয়ে দিয়েছে। আচ্ছা তার জন্ম কি শুধু হারানোর জন্যই হয়েছে? সে কি সবসময় প্রিয়মানুষ হারাতেই থাকবে? আচ্ছা তার জীবনটা এমন কেন? কেন আর পাঁচা সাধারণ মেয়ের মতো নয় তার জীবন?
কারো কান্নার শব্দে তার চিন্তার ছেদ ঘটে।
কিচ্ছুক্ষণ আগে…
পত্রিকায় খুব মনোযোগ দিয়ে একটা আর্টিকেল পরছিলো সাদিয়া। আজকে পত্রিকায় খেলার পাতায় খুব ইন্টারেস্টিং একটা নিউজ ছেপেছে সেটাই খুব মনোযোগ সহকারে পড়ছিলো সে। তখনই বিশ্রী শব্দে তার ফোনটা বেজে উঠে। হাজারো বিরক্তি নিয়ে ফোনটা হাতে তুলে নেয় সে। ফোনটা কানে দিতেই অপরপাশের একটা বাক্যে সে থমকে যায়।তার কি শুনতে ভুল হয়েছে? সাদিয়া এখন মনে প্রাণে চাইছে এটা স্বপ্ন হোক নতুবা তার শুনতে ভুল হোক। আচ্ছা অপর পাশে থাকা ব্যাক্তিটি কি তার সাথে কোনো প্র্যাঙ্ক করছে? সাদিয়ার রেসপন্স না পেয়ে অপরপাশের লোকটা আবার বলে উঠলো,
–সাদিয়া তোমার আম্মুকে ফোনটা দাও।
সাদিয়া বিনা শব্দে তার ফোনটা তার মায়ের কাছে দিয়ে দিলো।
তার মা ফোনটা কানে ধরতে তিনিও যেন স্তব্ধ হয়ে গেলেন। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়ের মুখপানে তাকালেন। মেয়ের মুখপানে তাকাতেই যেন তার বুকটা ধক করে উঠলো।এতো পোড়াকপালী কেন মেয়েটা? এইটুকু বয়সে তার মেয়েটাকে আর কি কি সহ্য করতে হবে কে জানে।
সাদিয়া কারো দিকে না তাকিয়ে বিনা বাক্যে নিজের রুমে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে আছে।চোখ দুটো বন্ধ করলো সে। চোখ বন্ধ করতেই কারো হাস্যোজ্জল চেহারা ভেসে উঠলো। তখনই চোখ খুলে তাকায় সে।এই হাসি মুখটা সে আর কোনো দিন দেখতে পাবে না। এই মানুষটা অকারণেই তাকে বকাঝকা করবে না আর। তাকে আর কেউ রাত বারোটার পর ফোন জাগিয়ে দিয়ে বলবে না “কিরে পেত্নী এখনো ঘুমাসনি কেন? প্রমিকের সাথে পিরিতের আলাপ করিস নাকি?”
ভাবতেই সাদিয়ার মনটা হু হু করে উঠলো। মনে হচ্ছে তার বুকে কেউ অনবরত ছুড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। তার বুকে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা কেউ দেখতে পাবে না। আচ্ছা কালকে রাতেও তো মানুষটার সাথে তার কথা হয়েছে তখন তো সে ভালোই ছিলো আজ হঠাৎ কেন নেই মানুষটা? কেন সে তাকে একা ফেলে এভাবে চলে গেলো? তার তো সাদিয়ার কাছে আসার কথা ছিলো। দূরে যাওয়ার ওয়াদা তো সে করেনি।তাহলে কেন সে ওয়াদা ভঙ্গ করলো?সে তো সবসময় বলতো “আমি আদি এক কথার মানুষ।জীবন চলে গেলেও কথার নড়চড় হয় না।” আর আজ তিনি নিজেই জীবন দিয়ে কথার খেলাফ করেছেন। তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিলো সাদিয়া।
অনেকক্ষণ সাদিয়া রুমের দরজা না খোলায় তার মায়ের এবার চিন্তা হতে লাগলো।তিনি দরজায় ঠকঠক করে অনবরত সাদিয়া কে ডাকতে থাকলো। কিছু সময় বাদে সাদিয়া জবাব দিলো,’আম্মু আমি ঠিক আছি।তুমি চিন্তা করো না।’
সাদিয়ার কথা শুনে তিনি চিন্তা মুক্ত হলেন কিন্তু সম্পূর্ণ না। এতোক্ষণে সাদিয়ার আব্বুও অফিস থেকে ফিরে এসেছেন।তিনি আবার হাই প্রেশার এর রোগী। এসব শুনে তার বিপি বেড়ে গেছে।
আচ্ছা তার মেয়েটা কেন একে একে সবাই কে হারাচ্ছে? প্রথমে বাবা-মা আর এখন স্বামী! ও কি শুধু হারানোর ভাগ্য নিয়েই পৃথিবীতে এসেছে?
সাদিয়ার বাবা একজন সিআইডি অফিসার ছিলেন।সন্ত্রাসীদের গুলিতে সাদিয়ার জন্মের দুইমাস আগে তিনি মারা যান। তার পর জন্ম হয় সাদিয়ার। তার বাবার কথা অনুযায়ী সদ্য জন্ম নেওয়া নবজাতকের নাম রাখা হয়েছিলো “সাদিয়া”। যার অর্থ সৌভাগ্যবতী! সাদিয়ার জন্মের দুই মাস পর তার মাও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তখন থেকেই সাদিয়া তার কাকা-কাকির কাছে থাকে। তারা কোনো দিন সাদিয়াকে বাবা-মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। সাদিয়ার একজন বড় ভাই আছে নাম শান্ত। সাদিয়ার কাকা-কাকীর কোনো সন্তান না থাকায় তারা শান্ত আর সাদিয়াকে নিজের সন্তানের মতন আগলে নেয়। শান্ত যখন এসএসসি পাশ করে তখনই তার মামা তাকে কানাডায় পাঠিয়ে দেয়। তখন থেকে সে কানাডাতেই থাকে।
আদিব ছিলো শান্তর বেস্টফ্রেন্ড। যার ফলে আদিবের সাদিয়াদের বাসায় প্রায়শই আসা যাওয়া ছিল। আদিব সাদিয়াকে আগে থেকেই পছন্দ করতো। কিন্তু কোনোদিন প্রকাশ করেনি।
দুই বছর আগের কথা,আদিব তখন ডিএমসি তে ভর্তি হয়ে স্কলারশিপের আবেদন করেছিল। আর ভাগ্যক্রমে পেয়েও যায় স্কলারশিপ। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে কানাডা যাওয়ার আগের দিন। সে কানাডা যাওয়ার আগে সাদিয়াকে বিয়ে করে যাবে। বিয়ে না করে সে কিছুতেই যাবে না। তাকে অনেক বুঝিয়েও কোনো লাভ হয়নি। সে তার কথায় অনঢ়।যেহেতু আদিবকে সাদিয়ার পরিবার ছোট থেকেই চেনে তাই তারাও বেশি আপত্তি করেনি। আর সাদিয়াও আপত্তি করেনি কারণ আদিব ছিলো তার কিশোরী বয়সের প্রথম প্রেম! কিশোরী বয়সে আবেগে ভেসে সেও এক প্রকার নাচতে নাচতেই বিয়েতে মত দিয়েছিলো। বিয়ের পর দিনই আদিব কানাডায় চলে যায়। তখন থেকে তাদের ফোনে কথা হতো সপ্তাহে এক বা দুইদিন করে।
সাদিয়ার ছোট্ট কিশোরী মন কতোই না স্বপ্ন বুনেছিলো আদিবকে নিয়ে।কতো ভেবেছিলো তাদের একটা ছোট সংসার হবে। তারা ছোট একটা বাসায় থাকবে। যে বাসার কোণা কোণা ভালোবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ থাকবে।
কিন্তু এখন আর সেসব হওয়ার নেই।সব শেষ হয়ে গেছে শুধু রয়ে গেছে একবুক দীর্ঘশ্বাস।
সাদিয়া আস্তে আস্তে দরজা খুলে বাড়িয়ে আসলো। ইতিমধ্যে সাদিয়ার আব্বু-আম্মু তৈরি হয়েছেন আদিদের বাসায় যেতে।
🍁
আদিবের আম্মু ফ্লোরে বসে সোফায় মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে আর নিরবে চোখের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। তিনি এখনো মানতে পারছেন না তার সোনার টুকরো ছেলে আর বেঁচে নেই। আর আদির বাবা সোফায় কাঠ হয়ে বসে আছেন। এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে তাদের সুখের সংসার ছিলো। মেয়ের বিয়ে হয়েছে সাত মাস হয়ে গেছে।
এরই মধ্যে সাদিয়াদের পরিবারও এসে উপস্থিত হলেন। সাদিয়াকে দেখতেই আদির মায়ের কান্না যেন আরো গাঢ় হলো। এই নিস্পাপ মেয়েটার ভবিষ্যৎ তিনি নিজের হাতে নষ্ট করেছেন। সাদিয়ার বাবা আদিবকে বাঁচাতেই নিজের জীবন দিয়েছিলেন। আর আজকে সেই আদিব আর নেই। চলে গেছে বহু দূরে। যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না।
সাদিয়ার আম্মু এসে আদির মায়ের পাশে বসলেন আর সাদিয়ার বাবা আদির বাবার পাশে।
–লা..লাশ কখন আসবে কিছু বলেছে?
আদির বাবা ভেজা কন্ঠে উত্তর দিলেন,
—ওরা বডি পাঠাবেনা বলেছে।
এটা শোনার পর আদির মায়ের কান্না যেন আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। তার ছেলেটাকে তিনি শেষ বারের মতো দেখতে পাবেন না। একটু শেষ বারের মতো ছুঁতেও পারবেন না। কতো অভাগী মা তিনি।
আদির মা এবার ইশারায় সাদিয়াকে নিজের কাছে ডাকলেন। সাদিয়া কাছে যেতেই তাকে বুকে জরিয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠেন তিনি।
–মারে আমায় ক্ষমা করে দিস। আমি তোর জীবনটা নষ্ট করে দিলাম।
–আপা এমন করে কেন বলছেন।
–না বোন না আমাদের জন্যই আজ ও জীবনে এত বড় একটা ধাক্কা পেলো। যদি আমরা তখন আদির কথায় সায় দিয়ে বিয়েতে রাজি না হতাম তাহলে অন্তত ওর জীবনটা নষ্ট হতো না। ও এই ছোট্ট বয়সে আর কতো ঝড়ের সম্মুখীন হবে বলুন তো। আর কতো সহ্য করবে ও।
বলেই তিনি আবারো কেঁদে চলেছেন।
সাদিয়ার চোখ থেকে শুধু এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। সে আজ বাক্যহারা। শব্দ নেই মুখে। মানুষের জীবন কখন কোন দিকে মোড় নেয় বুঝা বড় মুশকিল।
চলবে….ইনশাআল্লাহ❤️
#আমার_গল্পে_তুমি
//সূচনা পর্ব//
#সাদিয়া
(আস্সালামু আলাইকুম। গল্পটা কেমন হইছে নিজেদের মতামত জানাবেন। আর প্রথম পর্বেই নেগেটিভ মন্তব্য কইরেন না😑।)