আমার গল্পে তুমি পর্ব-১১

0
1821

#আমার_গল্পে_তুমি
//পর্ব-১১//
#সাদিয়া_স্নিগ্ধা

বাসায় এসে কোনো কিছুতে মন বসাতে পারছে না আরনাফ।সামনেই চতুর্থ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষার কিছু দরকারী কাগজ পত্র আরনাফকে দেওয়া হয়েছে ঠিক করতে। কিন্তু সে কিছুতেই কাজে মন দিতে পারছে না। বার বার তার মাথায় ক্যান্টিনে ঘটে যাওয়া কথা মাথায় ঘুরছে।

তখন ক্যান্টিনে,
ডা.সিফাতের প্রশ্নে সাদিয়ার হাসি থেমে যায়।চোখ অশ্রুতে ভরে যায় যা আরনাফ কিংবা ডা.সিফাত দুজনের কারোর চোখ এড়ায়নি।তারা দুজনেই অবাক হয়। এতক্ষণে আদিবার ফ্যাচফ্যাচানিও থেমে গেছে।সাদিয়া ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে নিলে আদিবা তাকে আগলে নেয়। সাদিয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকটা জোরে নিশ্বাস নিয়ে ছুটে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আসে।
সাদিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আরনাফ আদিবকে জিজ্ঞেস করে,
—কি হয়েছে ওর?

—অতীত নাড়া দিয়েছে চরম ভাবে।
একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আদিবাও চলে ক্যান্টিন ত্যাগ করে। আরনাফ পাশে তাকিয়ে দেখে ডা.সিফাত অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে।

—আমার প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি।

—তা তো বটেই। তবুও তোমার দোষ নেই। তুমি তো আর জানতে না তাইনা।

—আচ্ছা সাদিয়ার কি অতীত থাকতে পারে? খারাপ কিছু কি?

ডা.সিফাতের কথায় আরবাফের কপালেও ভাঁজের সৃষ্টি হয়। নিজের চিন্তাকে একপাশে রেখে ডা.সিফাতের উদ্দেশ্য বলে,
—সেটাতো মিস সাদিয়া আর আদিবা ভালো বলতে পারবে।

আচ্ছা সত্যিই কি সাদিয়ার কোনো অতীত আছে? বেদনাদায়ক অতীত? ভীষণ বেদনাদায়ক? হবে হয়তো। তা না হলে সাদিয়ার চোখ কেন ভরে উঠবে? কেন তার হাসি কর্পূরের মতো মিলিয়ে যাবে?আচ্ছা সাদিয়া কি কাউকে ভালোবাসে বা ভালোবাসতো যে সাদিয়াকে মাঝরাস্তায় একা করে দিয়ে চলে গেছে? তাকে কি এখনো সাদিয়া ভুলতে পারেনি?তার কথা কি সাদিয়ার এখনও মনে পড়ে? তার স্মৃতি কি এখনো সাদিয়ার চোখে ভাসে?
সাদিয়া কাউকে ভালোবাসে এই কথাটা ভাবতেই আরনাফের বুকের বা’পাশটা কেমন চিনচিন করে উঠলো।তার কপালে ঘামের সরু রেখা দেখা দিলো। এসি রুমেও সে তরতর করে ঘামছে। সাদিয়া অন্য কাউকে ভালোবাসে এটা আরনাফ মানতে পারছে না। কিছুতেই না।
—না না না কিছুতেই না। কাজললতা শুধু আমার। সে শুধু আমাকে ভালোবাসবে। তার উপর শুধু মাত্র আমার অধিকার থাকবে। তার সকল ভাবনা জুরে শুধুমাত্র আমার বিচরণ থাকবে। শুধুমাত্র আমার।
আরনাফ দুই হাতে মাথার চুল টেনে ধরে নিচে বসে যায়। তার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বুকের বাপাশটা ব্যাথা করছে।

🍁
ক্যান্টিন থেকে সাদিয়া সোজা নিজের বাড়িতে এসেছে। শান্তর বিয়ের আগপর্যন্ত সে তাদের বাড়িতেই থাকবে। আজকে কলেজে গিয়ে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এসেছে সে।বাড়িতে এসেই সাদিয়া নিজের রুমের দরজায় খিল দিয়েছে। মিসেস আফরোজা আর শান্ত’র অনেক ডাকাডাকির পরও সে দরজা খুলেনি।কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পরও যখন সাদিয়া দরজা খুলেনি তখন তারাও প্রস্থান করে। যদিও তারা চিন্তিত হয়েই প্রস্থান করে।

—শান্ত? মেয়েটার কি হলো বলতো?

—বুঝতে পারছি না আম্মু। তবে মনে হয় কেউ আদিকে নিয়ে কথা উঠেছিলো। দেখলে না চোখ ফুলে ছিলো।

কিছুক্ষণ নিরব থেকে মিসেস আফরোজা আনমনে বলে,
—মেয়েটার ভবিষ্যৎ কি শান্ত?

মায়ের কথায় শান্তর কপালে চিন্তার রেখা গাঢ় হয়। সে ভাবতে থাকে,
“আম্মু তো ঠিকই বলেছে। ওর ভবিষ্যৎ কি?এভাবে আর কতোদিন চলবে?ছয় বছর!কমতো নয়। আর কতো? ওর কি মুভ অন করা উচিত না? অতীত নিয়ে বসে থাকলে কি জীবন চলবে? ওর ও তো জীবনে এগিয়ে যাওয়ার অধিকার আছে। কি করা যায়? হুম আমি আমার বোনের আবার বিয়ে দেবো।একটা ভালো ছেলে দেখে আমি আমার বোনের আবার বিয়ে দেবো। যে আমার বোনকে অনেক অনেক ভালোবাসবে। আগলে রাখবে। কোনো দিন কষ্ট দেবে না।”

—কিরে কি ভাবছিস?
মায়ের কথায় ধ্যান ভাঙে শান্তর।

—আচ্ছা আম্মু সাদিয়ার আবার বিয়ে দিলে কেমন হয়?

—কি বলছিস এসব?

—ঠিকই তো বলছি আম্মু। এভাবে আর কতো দিন আম্মু? ওরও তো একটা জীবন আছে।এভাবে আর কতো দিন থাকবেও। ওর বয়সী অনেকের তো এখনও বিয়েই হয়নি আরও?ওর-ও তো জীবনে সুখী হওয়ার অধিকার আছে তাই না?

—তা ঠিকই বলেছিস।কিন্তু জানিস তো ও এগুলো বলা পছন্দ করে না। তোর ফুফু বলেছিলো একদিন বিয়ের কথা তারপর ও কি করেছিলো ভুলিসনি আশা করি।

—নিজের ভালোটা এখনো বুঝতো শেখেনি তোমার মেয়ে। তবে চেষ্টা করতে ক্ষতি কি?

—তোর যা ভালো মনে হয় কর। তবে একটা কথা ওর উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দিস না বাবা। মেয়েটা এমনিতেই অনেক কিছু সহ্য করেছে আর এখনো সহ্য চলেছে।

.
বিছানায় মাথা এলিয়ে ফ্লোরে বসে আছে সাদিয়া। শূন্য দৃষ্টিতে সিলিংয়ে ঝুলতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ থেকে তপ্ত অশ্রু কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
অতীত এমন একটা জিনিস যা কখনও আমাদের পিছু ছাড়ে না। আর যদি তা হয় তিক্ত কিছু স্মৃতি তাহলে তা তো একেবারে আঠার মতো লেগে থাকে। কিছু স্মৃতি মানুষ চাইলেও ভুলতে পারে না আবার কিছু স্মৃতি মানুষ ভুলতে চায় না। যেমন সাদিয়া আদির স্মৃতি ভুলতে চায় না। আদির স্মৃতি তাকে ভেতর থেকে ভেঙে গুড়িয়ে দেয় তবুও সে আদির স্মৃতিগুলো মনের মধ্যে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। ভালোবাসার মানুষের স্মৃতি কি এতো সহজে ভুলা যায়? স্মৃতি মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

—কেন? কেন? কেন আমার সাথেই এমন হলো? কি দোষ করেছিলাম আমি? জন্মের আগেই বাবাকে হারিয়েছি মাকেও দেখেনি।একজনকে যখন ভালোবেসেছি সেও আমায় একলা ফেলে চলে গেলো। আমি কেন এতো পোড়াকপালি? কি দোষ করেছিলাম যে সবাই ছেড়ে চলে যায়? আমার কি কারো ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার নেই?
কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে ফ্লোরে বসেই ঘুমিয়ে যায় সাদিয়া।

আজানের মধুর শব্দে ঘুম ভাঙে সাদিয়ার। ঘুম ভেঙে নিজেকে ফ্লোরে দেখেই একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়। ওজু করে এসে নামাজ পড়ে নেয়। নামাজ শেষে রুমের দরজা খুলতেই অবাক হয় সে। দরজার সামনে তার আম্মু আর শান্ত দাঁড়িয়ে আছে। তার আম্মুর এক হাতে ফুচকা অন্য হাতে আইসক্রিম আর শান্তর এক হাতে বার্গার আর পেস্ট্রি অন্য হাতে চকলেট।সাদিয়াকে কি বলার সুযোগ না দিয়ে শান্ত আর মিসেস আফরোজা রুমে প্রবেশ করে।

—আরে দিয়ু ওইখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি এখানেও আসবি?

শান্তর কথায় মুচকি হেঁসে তাদের দিকে এগিয়ে যায় সাদিয়া।

—হাবলার সরি হাবলির মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ও বুঝেছি খাওয়ার মুড নেই। তাহলে তো ভালোই হলো আমি একাই এগুলো খেতে পারবো। আসলে কি হয়েছে জানিস কালকে থেকেই না আমার মনটা কেমন জানি ফুচকা ফুচকা, আইসক্রিম আইসক্রিম , বার্গার বার্গার, পেস্ট্রি পেস্ট্রি করছে। তাই নিয়ে এলাম। একা একা খেলে তো ভালো দেখায় না তাই ভাবলাম তোকে একটু দিয়ে খাই। তাই এখানে নিয়ে এলাম।
ফুচকায় টক দিতে দিতে শান্ত নিজের কথা শেষ করলো। কথা শেষ করে সাদিয়ার দিকে তাকালো সে। তাকিয়ে দেখে ইতি মধ্যে সাদিয়া পেস্ট্রি নিজের পাকস্থলীতে ট্রান্সপার করে দিয়েছে।

—খেয়ে ফেললি? আমাকে একটু দিলিও না।কেমন বোনরে তুই? ভাইয়ের জন্য কোনো দরদ নেই?

—আমি খাওয়ার সময় কথা বলি না।
বলেই শান্তর হাত থেকে ফুচকা নিয়ে মুখে ঢুকিয়ে দেয় সাদিয়া। শান্ত ফুচকায় টক ভরে দিচ্ছে আর সাদিয়া টপাটপ তা মুখে চালান করছে।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছেলে-মেয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে যেন মনে প্রশান্তির হওয়া বয়ে গেলো মিসেস আফরোজার মনে।
—আল্লাহ্ আমার ছেলে মেয়েকে সবসময় এমন হাসিখুশি রাখুক।

রাতে ঘুমের ঘোরে বিভোর সাদিয়া। ঘুমের ঘোরেও সে অনুভব করতে পারছে তার মুখমন্ডলে কারো তপ্ত নিশ্বাস আঁচড়ে পড়ছে।সাদিয়ার ঘুম হালকা হয়। সে কিছুক্ষণ চোখ খোলার ব্যর্থ চেষ্টা করলো।
অচেনা লোকটি সাদিয়ার মাথায় সযত্নে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে।
—অতীত খুব আজব তাই না পাখি?

#চলবে….ইনশাআল্লাহ

আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্যের আশায় রইলাম🖤।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here