#আমার_গল্পে_তুমি
//পর্ব-১২\\
#সাদিয়া
অচেনা লোকটি সাদিয়ার মাথায় সযত্নে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ।
—অতীত খুব আজব তাই না পাখি? আচ্ছা পাখি তুমি কেন অতীতকে ধরে বসে আছো বলো তো? কেন তুমি আদিকে এতো ভালোবাসো? কেন? আদি তোমার জীবনে নেই ছয় বছর,তবুও এতো ভালোবাসা কেন তার জন্য? তুমি জানো না এটা আমার মোটেও সহ্য হয় না? তুমি অন্য কাউকে ভাব্বে তা আমার একদম পছন্দ নয়। তুমি আমার। শুধু আমার। আমি বুঝতে পারি না কেন তুমি আদিকে এতো ভালোবাসো। আদির মৃত্যুর সময় তো তুমি নিতান্তই একজন কিশোরী ছিলে। তহলে এতো কিসের টান তোমার? আচ্ছা এটা কি শুধু আদির ভালোবাসার জোর? ভালোবাসার জোর অনেক! সব করা যায় ভালোবাসার জন্য। যেমন আমি করছি।কি কি করি নি বলো তো ভালোবাসার জন্য? নিজেকে আড়াল করেছি তোমার থেকে সবার থেকে। যে বা যারা তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে সবাইকে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছি।
অচেনা লোকটি কিছুক্ষণ থামলো। একটা গভীর নিশ্বাস নিলো সে তারপর আবার শুরু করলো,
—আচ্ছা পাখি তুমি কি আমার ভালোবাসা দেখতে পাও না। আমি যে তোমাকে এতো ভালোবাসি তা কি তোমার চোখে পড়ে না। এতো অবহেলা কেন পাখি? কেন এতো অবহেলা? তোমার এতো অবহেলা যে আমি নিতে পারি না। কষ্ট হয়। এই যে এইখানটায় (বুকের বা পাশে হাত রেখে) এইখানটায় ভীষণ কষ্ট হয়। আমি তোমায় খুব ভালোবাসি আর আমি আমার ভালোবাসার ভাগ কাউকে দেবো না কাউকে না।
শেষ কথাটা বেশ শক্ত কণ্ঠেই বললো সে।আরো কিছুক্ষণ সাদিয়ার পাশে থেকে লোকটা চলে গেলো।
.
আজকে শান্তর গায়ে হলুদ। সকাল থেকে চলছে তুমুল ব্যস্ততা। বাড়িতে মানুষের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। সাদিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডেকোরেশন করাচ্ছে। একটু এদিক ওদিক হলেই লঙ্কা কান্ড বাঁধাচ্ছে।
—ওই লাল ফুলটা আরেকটু ডানে লাগা। একটা কাজ ও ঠিক করে করতে পারে না এ নাকি আবার ইভেন্ট প্ল্যানার হবে।
সাদিয়ার কথায় জুনাইদ ঢুল থেকে নেমে আসে।
— কিরে নেমে আসলি কেন? ডেকোরেশন তো শেষ হয়নি এখনো।
—আমি আর পারবো না। তুমি গিয়ে কর ডেকোরেশন।
—আমি করবো মানে? আমি কেন করবো! তুুই করবি।
— আমি তো করছিলাম-ই কিন্তু তুমি তো শান্তিতে করতে দিচ্ছো না।
সাদিয়া ইনোসেন্ট ফেস করে বললো,
—আমি আবার কি করলাম।
—সেটাই তো তুমি আবার কি করবে। বকবক করে তো ওই শেওড়া গাছের পেত্নীটা আমার মাথা খাচ্ছিলো তাই না!
জুনাইদের কথায় সাদিয়া তার দিকে তেড়ে আসতেই জুনাইদ দিলো ভোঁ দৌড়।
—কিরে দিয়ু হলো তোদের ডেকোরেশন করা?
—হবে কি করে তোমার বোনের ছেলে তো সব ফেলে পালিয়েছে। বজ্জাত ছেলে একটা।
—কেন পালিয়েছে কেন?
সাদিয়া নাক ফুলিয়ে বললো,
—আমি নাকি বকবক করে তার মাথা খাই।
—তো তুই ওকে জ্বালাচ্ছিস কেন?
সাদিয়া অবাক হয়ে বলে,
—আমি কোথায় ওকে জ্বালাতন করলাম আম্মু? আমি তো শুধু ওর ভুল ধরিয়ে দিচ্ছিলাম।
—তোমার ভুল ধরিয়ে দেওয়া মানেই তো ধমকা ধমকি করা।
বলেই তিনি এক দিকে চলে গেলেন।আর।সাদিয়া গাল ফুলিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।রুমে এসে আদিবের মায়ের ফোনে কল লাগায় সাদিয়া। ফোন রিসিভ করতেই সাদিয়া বলে উঠে,
—আন্টি তোমরা এখনো আসছো না কেন?।কত বেলা হয়ে গেছে খবর আছে কিছু?তাড়াতাড়ি আসো।
ফোনের অপর পাশ থেকে আদিবের মায়ের জবাব ভেসে আসে,
—এই তো মা আমরা চলে এসেছি। আর দশ মিনিট লাগবে।
—হু তাড়াতাড়ি আসো।
ফোন রেখে সাদিয়া মায়ের কাছে গেলো। আদিবের মায়েরা চলে এসেছে। তাদের তো অপ্যায়ন করতে হবে। তাছাড়া আদিবের বোন আর তার স্বামী আজ প্রথমবার এই বাড়িতে আসছে। তাদের খাতিরযত্নের কোনো ত্রুটি তো আর রাখা যায় না।
দশ মিনিট যেতেই কলিং বেল বেজে উঠে। সাদিয়া নাচতে নাচতে চলে যায় দরজা খুলতে। দরজার অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখে সাদিয়ার মুখের রঙ পাল্টে যায়।
—কি হলো এভাবে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? ঢুকতে দেবে না?
—আপনি এখানে কি করছেন?
—কি করছি মানে? বন্ধুর বিয়ে আর আমি আসবো না? আজব ব্যাপার স্যাপার।
আরনাফের কথায় কপালে ভাজ পড়ে সাদিয়ার।
—বন্ধু? এই বাড়িতে আপনার বন্ধু? কে আপনার বন্ধু?
আরনাফ কিছু বলতে যাবে তার আগেই আগমন ঘটে শান্তর।
—সাদু তুই আরনাফকে এখানে দাড় করিয়ে রেখেছিস কেন? ঢুকতে দে। দেখি সর সামনে থেকে।
—ভাই তুমি এনাকে চেনো?
—চিনবো না কেন? আরে আমরা তো আগে এক হাসপাতালেই কাজ করতাম। কয়েকদিন আগে ও তোদের ওইখানে শিফট হয়েছো। তোর তো ওকে চেনার কথা। চিনিস না?
সাদিয়া একটা অসহায় মার্কা হাসি দিয়ে বললো,
—চিনি। খুব ভালো ভাবে চিনি।
—ওহ্ ভালো।
এবারআরনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,
—আরনাফ ভোতরে আয়।
বলেই শান্ত ভেতরে চলে যায়।শান্ত চলে যেতেই আরনাফ সাদিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
—আমাকে এখানে দেখে আপনি খুশি হননি মিস ডাক্তার সাহেবা।
সাদিয়া কিছুটা রাগিদৃষ্টিতে আরনাফের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে প্রস্থান করে। সাদিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আরনাফ আলতো হাসে।
—সবসময় শুধু পালাই পালাই !পালানোতে এতো এক্সপার্ট কেন এই মেয়ে? চোর টোর ছিলো নাকি? হু চুরি করেছে তো! আমার মনটা চুরি করে পালিয়েছে! মন চুরি করার শাস্তি কি আপনি জানেন কাজললতা? মন চুরি করা জঘন্য একটা অপরাধ সেটা কি জানেন? আমার মন চুরি করে পালানোর শাস্তিটা তোলা থাকলো। সময়মতো শাস্তিটা শুধে আসলে পরিশোধ করে দিবোক্ষণ!
—কিরে আরনাফ এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিস কেন?
—নাহ্ কিছু না। চল আন্টির সাথে দেখা করে আসি।
—আয়।
আরনাফ শান্তর সাথে চলে মিসেস আফরোজার সাথে দেখা করতে।
.
রুমে এসে আপন মনে বকবক করে চলেছে সাদিয়া। মূলত বকবক নয় সে আসলে আরনাফের গোষ্ঠী উদ্ধার করতে ব্যস্ত।
—এই নষ্ট চোখওয়ালা স্যার ভাইয়ার বন্ধু? এটা কিভাবে সম্ভব? হাও? ভাইয়ার তো বন্ধু থাকার কথা না? মানলাম নষ্ট চোখওয়ালা স্যার একটু মিশুক প্রকৃতির কিন্তু ভাইয়া? ভাইয়া তো সহজে কারো সাথে বন্ধুত্ব করে না। তাহলে স্যার ভাইয়ার বন্ধু হলো কিভাবে? আর বন্ধু বানিয়েছে তো বানিয়েছে একেবারে নিজের বিয়েতেও নিয়ে এসেছে। ইম্প্রেসিভ!
সাদিয়া যখন আগডুম বাগডুম চিন্তায় ব্যস্ত তখনই কেউ তাকে জরিয়ে ধরে। সাদিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠে।
—আরশি আপু!
—কেমন আছিস?
—আলহামদুলিল্লাহ আমি অনেক ভালো আছি।তুমি কেমন আছো?
—আমিও আলহামদুলিল্লাহ।
—আন্টি-আঙ্কেল ওরা কোথায়?
—আসলে ওদের গাড়িটা মাঝ রাস্তায় খারাপ হয়ে গেছে তাই ওদের আসতে দেরি হচ্ছে। আমি আর শিশির তো আলাদা গাড়ি করে এসেছি।
—ওহ্ আচ্ছা। কিন্তু তোমার সাথে আমি রাগ করেছি। তুমি আমাকে একদম ভুলে গেছো।
শেষের কথাটা মুখ গোমড়া করে বললো সাদিয়া। সাদিয়াকে মুখ গোমড়া করতে দেখে হেসে উঠে আরশি। সাদিয়ার গাল টিপে দিয়ে বলে,
—আমি ভুলে গেছি না তুই ভুলে গেছিস? তুই তো ফোনও দিস না একটা।
—তুমিও তো দাও না!
—বুঝিসি তো কতো ব্যস্ত থাকি।
এমন আরো নানান কথায় দুজনে আড্ডায় মেতে উঠে। কতো দিন পর দেখা তাদের। আরশির কোনো ছোট বোন নেই আর সাদিয়ারো কোনো বড় নেই। তাই তারা একে অপরকে দিয়ে নিজেদের অভাব পূরণ করে!
আস্তে আস্তে সকল মেহমান এসে হাজির। বাড়ি গিজগিজ করছে মানুষে। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হতে বেশি দেরি নেই। আরনাফ স্টেজের সামনে অসহায়ের মতো বসে আছে।বেচারা না পারছে এখানে বসে থাকতে আর না পারছে এখান থেকে উঠতে। কারণ তাকে ঘিরে বসে আছে বিয়ে বাড়ির সকল যুবতী-কিশোরী মেয়ে! সাদিয়াদের বংশে শুধু শান্তই একমাত্র ছেলে। সাদিয়ার মেজো কাকার দুই মেয়ে ছোট কাকার দুই মেয়ে। তারা সবাই এখন আরনাফকে ঘিরে বসে আছে। তাদের মধ্যে তিনজন আবার ডাক্তার হতে চায়। ডাক্তার হতে গেলে কি কি করতে হবে তা জানতেই এই আসর!
আসর সমাপ্ত করে আরনাফ প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। স্টেজের পাশ থেকে উঠে বাগানের দিকে পা যায়। বাগানে এসে আরনাফ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। খুব কাছে থেকে ভেসে আসা কান্নার শব্দে ভ্রু কুঁচকে আসে আরনাফের। শব্দ অনুসরণ করে এগিয়ে যেতেই সে দেখতে পেলো হলুদ শাড়ি পরিহিত এক রমণী বাগানে থাকা দোলনায় বসে দু হাতে মুখ ঢেকে কাদঁছে। দূর থেকে আসা হালকা আলোয় আরনাফ রমণীটির চোখ দুটো দেখতে সক্ষম হলো। আরনাফ অবাক দৃষ্টিতে তাকালো হলুদ শাড়ি পরিহিত হলুদ পরীটির দিকে।
চলবে….ইনশাআল্লাহ
পরবর্তী পার্ট পড়তে পেজে Follow দিয়ে রাখুন!
👉👉 সাহিত্যের ছোঁয়া