#আমার_গল্পে_তুমি
//পর্ব_১৩//
#সাদিয়া
.
বাগানের দোলনায় বসে অনেকক্ষণ যাবত কেঁদে চলেছে সাদিয়া। হঠাৎ সে অনুভব করলো তার পাশে এসে কেউ বসেছে। সাদিয়া নিজের কান্নাটা কোনো রকম থামিয়ে চোখ মুখ মুছে পাশে তাকাতেই আরনাফের মুখটা দেখতে পেলো। আরনাফ কেমন করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সাদিয়াকে মাথা তুলে তাকাতে দেখে আরনাফ শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—এখানে বসে এভাবে কাঁদছিলে কেন ডাক্তার সাহেবা?
আরনাফের কথায় সাদিয়ার থেমে যাওয়া কান্না এখন হিচকির রূপ নিয়েছে। সে উত্তর দিলো না। আরনাফ আবার বললো,
—আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি তোমাকে ডাক্তার সাহেবা। শুনতে পাচ্ছো না?
—আমি অপয়া নই! আমি অলক্ষী নই! মানুষ কেন বুঝে না আমার কতো কষ্ট হয়। আমার কষ্ট কেন তারা বাড়িয়ে দেয়। কেন তারা আমার কষ্টটা অনুভব করতে পারে না? কেন পারে না?
সাদিয়া কথাগুলো অস্পষ্ট সুরে বললেও আরনাফ তা শুনতে পেলো। আরনাফ অনেকটা অবাক হলো। কিয়ৎক্ষণ সাদিয়ার দিকে নিরবে তাকিয়ে থাকলো সে। আরনাফ বুঝতে পারছে না সাদিয়াকে কে অপয়া আর অলক্ষী বলেছে। আর কেন-ই বা বলেছে।
আরনাফ সাদিয়ার উদ্দেশ্য কিছু বলতে যাবে তার আগেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে শান্ত।
—বোন!
শান্তর কণ্ঠস্বর শুনে সাদিয়া কোনোদিকে না তাকিয়ে শান্তর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। শান্তও পরম যত্নে বোনকে আগলে নেয়। সাদিয়ার কান্নার বেগ বেড়ে যায়। আরনাফ আগের তুলনায় দ্বিগুন অবাক হয়। সে বুঝতে পারছে না বিয়ে বাড়িতে সাদিয়াকে কে কি বলেছে যার জন্য সবসময় হাসতে থাকা মেয়েটা আজ এভাবে কাঁদছে! আরনাফ এবার ইশারায় শান্তকে জিজ্ঞেস করলো সাদিয়ার কি হয়েছে। শান্তও তাকে চোখের ইশারায় তাকে বললো পরে বুঝিয়ে বলবে।
আরো বেশ কিছুক্ষণ পর সাদিয়ার কান্না থামে। সাদিয়ার কান্না থামতেই শান্ত সাদিয়ার হাত ধরে বাড়ির ভেতর চলে। শান্ত আর সাদিয়াকে অনুসরণ করে আরনাফও সে পথ ধরে। বাড়ির ভিতর আসতেই শান্ত চেঁচিয়ে তার ফুফুকে ডাকে।
—ফুপি! ফুপি!
শান্তর চিৎকারে মিসেস আফরোজা, আদিবের মা মিসেস আয়শা সহ সবাই বেরিয়ে আসে।
—কি হয়েছে শান্ত? এভাবে চেচাচ্ছিস কেন?
—বলছি। আগে তোমার আদরের ননদকে আসতে দাও।
এর মধ্যেই ফুফু বেরিয়ে আসলেন।
—কি হয়েছে শান্ত? এতো চেচাচ্ছিস কেন?
ফুফুকে দেখেই শান্ত বেশ শান্ত কণ্ঠে বললো,
—আমার বোনকে তুমি কি বলেছো ফুপি?
—যা বলেছি ভুল তো কিছু বলিনি! ও যা তাই বলেছি ওকে।
ফুফুর কথায় শান্তর রাগ আকাশচুম্বী! সে রেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সাদিয়ার দাদা আকরাম আহমেদের গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে আসে।
—বেরিয়ে যাও এই বাড়ি থেকে।
আকরাম সাহেবের কথায় সবাই অবাক।
—কি বলছেন বাবা?
—আমি ঠিক বলছি বউমা। ও কোন সাহসে আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমার বাড়ির আলো আমার বাড়ির লক্ষীকে অপয়া বলে? আমার নাতনী আমার কলিজার একটা অংশ! এই দু’হাতে ওকে মানুষ করেছি আমি। আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে কেউ ওকে কথা শুনাবে ওকে অপমান করবে তা তো আমি মেনে নিবো না। কখনোই না।
শেষ কথাটা তিনি শক্ত কণ্ঠে বললেন। সাদিয়ার প্রতি মায়া ভালোবাসা তার কিছুটা বেশিই। তিনি সাদিয়ার মাঝে তার ছেলের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান! সাদিয়া যখন হাসে তখন মনে হয় তার ছেলে সানোয়ার হাসছে! ইশশ কতো দিন হলো তার ছেলেটা নেই। ছেলের অকালে চলে যাওয়ায় তিনি একটুও কষ্ট পাননি। বরং তার গর্ব হয়েছিলো। তিনি বুক ফুলিয়ে বলতে পারেন তার বড় ছেলে সন্ত্রাস নির্মূল করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন! ছেলের জন্যে গর্বে যেন তার বুকটা ভরে আসে।
—কি হলো তোর বাবা কি বললো শুতে পাসনি? চলে যা।
—মা তুমিও এসব বলছো?
সাদিয়ার দাদী বেশ শক্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন,
—হ্যাঁ বলছি। তুই এখানে থাকলে সবার সব আনন্দ মাটি করে দিবি। তাই এই আনন্দের দিনে তোকে আমরা কেউ এখানে চাইছি না।
ফুফু এতো অপমান সহ্য করতে পারেনি। চলে গেলেন। যাওয়ার আগে সাদিয়াকে চোখ দিয়ে ভস্ম করে যেতে ভুলেননি। ফুফু চলে যেতেই দাদী এসে সাদিয়ার মাথায় হাত রাগ। সাদিয়া কিছুটা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় দাদীর দিকে।
—তুই কি কথা বলতে পারিস না মেয়ে? সবসময় সবার কথা নিরবে সহ্য করিস? যোগ্য জবাব দিতে পারিস না? কেন তাদের সামনে নিজেকে দূর্বল প্রমাণ করিস বারবার?
দাদীর কথায় সাদিয়া কিছু বললো না। নিরব রইলো।
—এই দিয়ু যা ফ্রেশ হয়ে আয়। এখনি অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে।
—হ্যাঁ বোন গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। দেখ কেঁদে নিজেকে পুরো পেত্নী বানিয়ে ফেলেছিস।
—ভাইয়া..
শান্ত সব কয়টা দাঁত বের করে হাসলো। তা দেখে সাদিয়াও আলতো হেসে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
.
সাদিয়া আবার শাড়িটা ঠিক করে পরিধান করে চোখে গাঢ়ো কাজল দিলো। চুল গুলো এক সাইডে সিঁথি কেটে খোলা রাখলো। সাদিয়া এক নজর আয়নার দিকে তাকালো। আদিব একবার বলেছিলো গাঢ়ো কাজলে তাকে নাকি অনেক মায়াবতী দেখতে লাগে। আদিবের কথা ভাবতেই সাদিয়ার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। কিয়ৎক্ষণ পরেই হাসিটা যেনো কর্পূরের মতো উবে গেলো। মুখে ছেয়ে আসলো ঘোর অমাবস্যা।
—কেন এভাবে আমায় একা করে চলে গেলেন আদিব ভাই? কি দোষ করেছিলাম আমি? আপনাকে ভালোবেসেছিলাম এটাই কি আমার অপরাধ ছিলো? আপনি কেন আমাকে একা করে দিলেন আদিব ভাইয়া? কেন? কেন?
নিজের চোখের অশ্রু যত্ন করে মুছে নিলো সাদিয়া। ঠোঁটের কোনে এক টুকরো মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে রুমের বাহিরে পা রাখলো সাদিয়া।
ইট আর সিমেন্টের সাহায্যে তৈরি পিলারের সাথে হেলান দিয়ে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত আরনাফ। কথা বলার এক পর্যায়ে আরনাফের কানে নূপুরের অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে এলো। নূপুরের অস্পষ্ট আওয়াজে আরনাফ যেনো সম্মোহিত হয়ে গেলো। সে ধীর পায়ে আওয়াজ অনুসরণ করে এগিয়ে গেলো।
আদিবা কখন থেকে এটা ওটা বলে যাচ্ছে আর সাদিয়া হু হা তে উত্তর দিচ্ছে। আদিবার অযথা বকরবকরে সাদিয়া রীতিমতো বিরক্ত। এতো কথা কিভাবে বলে এই মেয়ে? তা-ই মাথায় ঢুকে না সাদিয়ার।
—আদিবা বোন আমার এবার একটু চুপ কর।
আদিবা চোখ ছোট ছোট করে বললো,
—কেন?
—এক ঘন্টা যাবত তুই বকবক করছিস! ক্লান্ত হোস না তুই?
আদিবা দাঁত কেলিয়ে বললো,
—একদম না।
—এবার কোনো কথা না বলে চল স্টেজের কাছে যাই।
তারা উঠে দাঁড়াতেই আদিবার ফোনটা বেজে উঠলো। আদিত্যর ফোন।
—সাদি তুই যা আমি একটু পর আসছি।
সাদিয়া কিছু না বলে মুচকি হেঁসে চলে গেলো। স্টেজের কাছে আাতেই শাড়িতে পা বেজে পড়ে যেতে নিলো সাদিয়া। কিন্তু পরে যাওয়ার আগেই একজোড়া পুরুষালী হাত তাকে পরম যত্নে আকড়ে ধরলো। কিয়ৎক্ষণ পর পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো সাদিয়া। চোখ খুলতেই চমকে উঠলো সাদিয়া। সে আরনাফের বাহুডোরে বন্দী! সাদিয়া তাড়াহুড়ো করে সরে আসতে গেলে আবারো পড়ে যাওয়া ধরলো। আরনাফ আবারো সযত্নে আগলে নিলো তাকে। আরনাফ এক ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাদিয়ার দিকে। সে এর আগে কখনো সাদিয়াকে এরূপে দেখেনি। আজকে যেনো সাদিয়াকে একটু বেশিই মায়াবতী লাগছে। আরনাফের এমন দৃষ্টিতে সাদিয়া চরম অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
—স..স্যার?
আরনাফ ঘোর লাগা কণ্ঠে জবাব দিলো,
—হুম!
সাদিয়ার ভুরু কুঁচকে এলো। সে একটু জোরে বললো,
—স্যার ছাড়ুন এবার। কেউ এসে যাবে।
এবার ঘোর কাটে আরনাফের। সে সাবধানে সাদিয়াকে দাঁড় করায়। ছাড়া পেতেই সাদিয়া স্টেজের দিলে ছুট লাগায়। সাদিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আরনাফ আনমনে বলে উঠে,
—শ্যামবতীরা সবসময় মায়াবতী!
চলবে……ইনশাআল্লাহ
(আস্সলামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটা কেমন হইছে জানাবেন। ধন্যবাদ)