আমার গল্পে তুমি পর্ব-১৪

0
1714

#আমার_গল্পে_তুমি
//পর্ব-১৪//
#সাদিয়া।

গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান জমজমাট! শান্তকে সবাই মিলে হলুদের সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছে। তাকে এখন চেনার কোনো উপায় নেই। শান্ত এসবে চরম বিরক্ত। সে নিজের বিরক্তিকে এক পাশে রেখে বললো,
— তোমাদের কি আমাকে হলুদে মাখানো শেষ হয়েছে? শেষ হলে বলো আমি ফ্রেশ হতে যাই।

—হ্যাঁ হ্যাঁ বলদ ভাইয়া শেষ হয়েছে। তুমি এবার যেতে পারো।

আদিবার কথায় শান্ত একটা রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেলো।

—দিয়ু আপু তোমাকে কাকি ডাকছে?

—কাকি কোথায়?

নিতু হাতের ইশারায় ‘ওখানে’ দেখিয়ে চলে গেলো নিজের কাজে।

সাদিয়া সিরিতে পা রাখতেই কেউ তাকে টেনে সিরির নিচের রুমে নিয়ে গেলো। পুরো রুম অন্ধকারাচ্ছন্ন। সাদিয়া ঘাবড়ে গেলো। যেই না চিৎকার করতে যাবে ওমনি কেউ তার মুখ চেপে ধরে। সাদিয়া নড়াচড়া করতে শুরু করে।
—হুস চিৎকার করো না। ইট’স মি!

কারো আওয়াজ পেয়ে সাদিয়া নড়াচড়া থামিয়ে দিলেও মুখ দিয়ে সে অনবরত অস্পষ্ট ‘উম উম’ শব্দ করতে থাকে।

—আমাকে এভাবে পাগল করে কি মজা পাও বলো তো পাখি? আমাকে এভাবে পাগল করতে তোমার খুব ভালো লাগে তাই না? এই রূপে কেন আমার সামনে এলে তুমি? সব আমাকে খুন করার ধান্দা তাই না? তুমি কি জানো না তোমার ওই কাজলটানা চোখের দিকে তাকালে আমার চোখ পলক ফেলতে ভুলে যায়? তুমি কি জানো না তোমার হাসির শব্দে আমার হৃৎস্পন্দন থেমে যায়? উফ আর দূরে থাকা সম্ভব না। তোমাকে খুব তাড়াতাড়ি নিজের করে চাই। খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে নিজের বাহুডোরে চাই! এই শ্যামবতীকে ছাড়া যে আমি খুব আসহায়!

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো অচেনা ব্যক্তিটি। সাদিয়া অবাক চোখে তার পানে তাকালো। যদিও অন্ধকারে লোকটিকে সে স্পষ্ট দেখতে পেলো না। হঠাৎ সে নিজের কপালে লোকটির ছোঁয়া অনুভব করলো। সে ফ্রিজড হয়ে গেলো। এর আগে কেউ তাকে এতো গভীরভাবে ছোঁয় নি। অচেনা লোকের এমন গভীর ছোঁয়ায় সাদিয়ার শীরদাড়া বেয়ে এক শিহরণ বয়ে গেলো। আচমকা সাদিয়াকে ছেড়ে দিয়ে লোকটি হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো। সাদিয়া এখনো আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। এর আগে সে নিজের আশেপাশে অচেনা লোকেটার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারতো। আর আজকে তো লোকটা একেবারে তাকে মিনি কিডন্যাপ করে ফেলেছিলে। সাদিয়া বুঝতে পারছে না কে এই লোক? কি চাই তার? আর অনুষ্ঠানে কিভাবে এলো সে?

.
এখান গানের আসর বসেছে। সবাই একে একে গান গাইছে।
—এই আরনাফ এবার তুই একটা গান শোনা।

—আমি!

—হু তুই। আমি জানি তোর গানের গলা খুব একটা খারাপ না।

আরনাফ আলতো হাসলো শান্তর কথায়। চোখ বন্ধ করে একটা গভীর নিশ্বাস নিয়ে গান শুরু করলো,

Tadpaye mujhe theri sabhi baatein
Ek baar Ae deewani
Jhootha hi sahi…
payr to kar
Main bhoola nahi haseen mulakaatein
Bechain karke mujhko
Mujhse yua Na…
pher Nazar
Roothega na mujhse
Mere Saathiya ye Wada kar
Tere Bina Mushkil Hai
Jeena Mera Mere Dilbar
Zara Zara Behekta Hai
Mehekta Hai
Aj To Mera
Tan Badan
Mein Pyasa Hun
Mujhe Bha Le
Apni Baahan Mein.

আরনাফ গান গাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সাদিয়ার দিকে তাকাচ্ছিলো যা কেউ খেয়াল না করলেও আদিবা ঠিকই খেয়াল করলো। এবং যথেষ্ট অবাকও হলো। ডা.সিফাত সাদিয়ার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তা আদিবার বোধগম্য হয় কিন্তু আরনাফের তাকানো তার বোধগম্য হলো না।

আদিবের মা মিসেস আয়শা আহমেদ বাহিরে পায়চারি করছেন। তার মনটা আজকে কেমন যেন খচখচ করছে। তিনি কেন যেন কিছুতেই শান্ত থাকতে পারছেন না। তার বুকটা কেমন চিনচিন ব্যাথা করছে। তিনি তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিলে কেউ তাকে আগলে নেয়। মিসেস আয়শা গভীর নিশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তাকে কে ধরলো তা দেখার জন্য মাথা তুলে তাকাতেই তিনি পলক ফেলতে ভুলে গেলেন। এই চোখগুলো তার ভীষণ পরিচিত। এই গায়ের গন্ধটাও তার ভীষণ পরিচিত। আচমকা তার চোখ আশ্রুতে ভরে উঠলো।

মিসেস আয়শাকে আচমকা কান্না করতে দেখে আরনাফ কিছুটা নয় বরং বেশ খানিকটা অবাক হলো। সে গান শেষ করেই আসর থেকে উঠে এসেছিলো। ওখানে থাকতে তার অস্থির অস্থির লাগছিলো। সে সাদিয়ার সামনে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। তার বুকের মধ্যে কেমন একটা করে। তার কাজললাকে একটু ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। কাজললতার লেপ্টে যাওয়া কাজল মুছে দিতে ইচ্ছে হয়!
বাগানে এসে সে একজনকে দেখতে পেলো একটা একটা পায়চারি করতে। কৌতূহল নিয়ে সামনে যেতেই ব্যক্তিটি পড়ে যেতে নিলে আরনাফ তাকে আগলে নেয়।

—একি আন্টি আপনি কাঁদছেন কেন? আপনি কি ব্যাথা পেয়েছেন? কোথায় ব্যাথা পেয়েছেন আন্টি? ব্যাথা কি বেশি পেয়েছেন আন্টি?

আরনাফের কথার মাঝেই মিসেস আয়শা তাকে আচমকা জরিয়ে ধরে। আরনাফ অবাক হলো। প্রথমে তার কিছুটা অস্বস্তি লাগলেও সে কিছু না বলে চুপ করে রইলো। কিয়ৎক্ষণ পর আরনাফ নিজের পিঠে তরল কিছু অনুভব করলো। সে কিঞ্চিৎ অবাক হলো সাথে কিঞ্চিৎ ঘাবড়েও গেলো। সে তড়িঘড়ি করে মিসেস আয়শাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—আন্টি কি হয়েছে আপনার? আপনি কাঁদছেন কেন আন্টি? আন্টি আমার এখন অনেক চিন্তা হচ্ছে। বলুন না আন্টি কি হয়েছে আপনার? এভাবে কাঁদছেন কেন আপনি?

মিসেস আয়শা কোনো শব্দ উচ্চারণ না করে আরনাফের পুরো মুখে হাত বুলালো। তিনি তৃষ্ণার্থ দৃষ্টিতে আরনাফের দিকে তাকিয়ে আছেন।
মিসেস আয়শার এমন দৃষ্টি আরনাফের বোধগম্য হলো না। সে শান্ত কণ্ঠে বললো,
—আন্টি? আর ইউ ওকে?

মিসেস আয়শা চোখের পানি মুছে নিঃশব্দে প্রস্থান করলো। মিসেস আয়শার যাওয়ার দিকে আরনাফ অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগেই সে তা মুছে নিলো এবং গেইটের বাহিরে চলে গেলো।

.
অন্ধকার রুমে কালো হুটি পরে চেয়ারে
বসে আছে এক লোক। তার সামনের চেয়ারে অজ্ঞান অবস্থা বসে আছে এক যুবক। হুডি পরা লোকটি একজনকে ইশারা করতেই সে এক বালতি পানি অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকা যুবকের দিকে ছুড়ে দেয়। তীব্র পানির ঝাপটায় হুড়মুড়িয়ে উঠে যুবকটি। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে সামনে থাকা লোকটির দিকে তাকিয়ে সে কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললো।

—আ…আপনি কে?

যুবকের প্রশ্নে লোকটি স্ব-শব্দে হেঁসে উঠে। অন্ধকারে বসে থাকা লাখ লোকটির হাসির শব্দে যুবক ঘাবড়ে যায়।

—এতোগুলো বছরে তুই একটুও বদলাসনি শিহাব। সেই আগের মতোই রয়ে গেছিস।

হুডি পরিহিত অচেনা লোকের মুখে নিজের নাম শুনে আরো অবাক হয় শিহাব।

—কে আপনি? আমাকে এখানে কেন এনেছেন?

—উমম গুড কুয়েশ্চন! কেন আনলাম বলতো তোকে এখানে? ওহ্ মনে পরেছে। তোকে তো তোর কৃতকর্মের শাস্তি দিতে এনেছি এখানে।

আগন্তুকের কথায় কেঁপে ওঠে শিহাব।
—শা…শাস্তি মানে? ক…কিসের শাস্তি?

আগন্তুক কিছুটা অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
—এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি? আমার জানা মতে তোর স্মৃতি শক্তি এতোটাও কামজোর না যে তুই সবকিছু ভুলে যাবি।

—আপনাকে আমি চিনি পর্যন্ত না। তাহলে আপনি আমাকে কোন কৃতকর্মের শাস্তি দেবেন? কি ক্ষতি করেছি আমি আপনার?

—কারেকশন প্লিজ! অপরাধী শুধু তুই না শিহাব। সমান অপরাধী তোর প্রাণ প্রিয় আম্মাজান মিসেস আনোয়ারা আহমেদও।
নিজের মায়ের নাম শুনে অবাকের শেষ পর্যায়ে চলে যায় শিহাব।
—আ..আমার মা? কি করেছে আমার মা? আর কি করেছি আমি?

—কি করেছিস তোরা? কি করিসনি তাই বল! আমার অস্তিত্ব বিলিন করে দিয়েছিস তুই আর তোর মা। আজ শুধু মাত্র তোর আর তোর মায়ের জন্য আমি আমার অপন মানুষের কাছে থেকেও দূরে। তাদের আমি ইচ্ছে করলেও জরিয়ে ধরতে পারি না। ইচ্ছে করলেও নিজের মা কে মা আর বাবাকে বাবা বলে ডাকতে পারি না। ইচ্ছে করলেও মায়ের কোলে মাথা রাখতে পারি না। ইচ্ছে করলেও নিজের ভালোবাসার মানুষের সামনে ভালোবাসার দাবি নিয়ে দাঁড়াতে পারি না। কেমন করে পারবো বল তো? তোরা তো আমার অস্তিত্বটাকেই বিলিন করে দিয়েছিস। শুধু আমার অস্তিত্ব বিলীন করেই তো তুই ক্ষান্ত হোস নি। তুই আমার কলিজার দিকে হাত বাড়িয়েছিস। তার দিকে কুনজরে তাকিয়েছিস। এর শাস্তি তো তোকে পেতেই হবে তাই না!

শিহাব খুব মন দিয়ে আগন্তুকের কথা গুলে শুনলো। কিন্তু কিছুই বুঝলো না।

—আপনি আসলে কে?
এবার আগন্তুকটি অন্ধকার থেকে আলোতে আসলো তবে পুরোপুরি না। আগন্তুকের মুখের অর্ধেক পাশ চোখের সামনে দৃশ্যমান হতেই শিহাবের কলিজা শুকিয়ে গেছে। তার শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। শিহাব অস্পষ্ট সুরে কিছু উচ্চারণ করলো। আর কিছু বলার সময় সে পেলো না। তার আগেই তলিয়ে গেলো গভীর ঘুমে! যা আর ইহকালে ভাঙার নয়!

#চলবে….ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here