#আমার_গল্পে_তুমি
//১৭//
#সাদিয়া
.
দেখতে দেখতে চলে গেলো অনেকদিন। সাদিয়াও ফাইনাল ইয়ারে উঠে এলো। এর মধ্যে আদিবা আর আদিত্যর বিয়ের তারিখও ঠিক হয়ে গেলো। ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হলে বিয়েটা হবে। প্রথমে এই বিয়েতে আদিবার বাবা মত না দিলেও পরে মেয়ের হাসিমুখের কথা চিন্তা করে রাজি হয়ে গেলেন।
সাদিয়াদের কলেজে থেকে একটা মেডিক্যাল ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছে। ক্যাম্প থেকে ফাইনাল ইয়ারের মোট পঞ্চাশ জন স্টুডেন্ট নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে আদিবা-সাদিয়াও আছে। সাথে আজে ডা.সিফাত, ডা.আরনাফ, ডা.রিয়া ডা.কিবরিয়া আর একজন সিনিয়র ডাক্তার।
.
আধঘন্টা হলো তারা সবাই ক্যাম্পে পৌছালো। যে যার তাবুতে এখন আপাতত বিশ্রাম নিচ্ছে। আদিবা গভীর ঘুমে মগ্ন। বেচারির কালকে আদিত্যর সাথে ব্রেকআপ হয়েছে তাই এখন পরে পরে ঘুমাচ্ছে। এই এক অভ্যাস আদিবার! ঘুমন্ত আদিবার মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে সাদিয়া তাবুর বাইরে যায়।
হাটঁতে হাঁটতে সাদিয়া কিছুটা সামনে চলে আসে। অদূরেই সাদিয়া একটা পরিচিত অবয় দেখতে পায়। ভ্রু কুঁচকে আসে তার। সাদিয়া গুটিগুটি পায়ে তার কাছে এগিয়ে যায়।
আরনাফ নিজের পাশে কারো অস্তিত্ব টের পেলেও চোখ মেললো না। কারণ সে জানে এটা তার কাজললতা! কাজললতার শরীরের ঘ্রাণ তার খুব পরিচিত। আরনাফ চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই বলে উঠে,
—এখানে কি করছেন ডাক্তার সাহেবা?
সাদিয়া অবাক হলো। কারণ আরনাফ একবারের জন্যও চোখ মেলে তাকায়নি।
—কি হলো কথা বলছেন না যে?
—আপনি কি করে জানলেন আমি এসেছি?
আরনাফ আলতো হেসে জবাব দেয়,
—বলা যাবে না টপ সিক্রেট!
সাদিয়া চুপ রইলো। আরনাফের দুচোখ এখনো বন্ধ। কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে বললো,
—আপনার কি মন খারাপ স্যার?
আরনাফ জবাব দিলো না। সাদিয়াও আর কিছু বললো না। দুজনের মধ্যে বিরাজ করছে পিন পতন নিরবতা!
—জানো ডাক্তার সাহেবা ভালোবাসার এক অদ্ভুত নেশা! এই নেশায় একবার জরালে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া নামোমকিন!
আরনাফের কথায় সাদিয়ার বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো। সে ভাবছে “স্যার কি অন্য কাউকে ভালোবাসে?” কথাটা মনে হতেই সাদিয়ার মুখশ্রীতে নেমে আসে অমাবস্যা! সাদিয়া বিরস মুখে আরনাফকে জিজ্ঞেস করে,
—আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন স্যার?
আরনাফ সাদিয়ার প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে নিজের মতো করে বললো,
—কখনো কাউকে ভালোবাসেছো ডাক্তার সাহেবা? কারো ভালোবাসার দহনে পুড়েছো? আচ্ছা বলোতো ভালোবাসায় এতো দহন কেন? ভালোবাসায় কেন এতো পুড়তে হয়?
আরনাফের কথায় সাদিয়া স্তব্ধ! ভালোবাসার দহন কেমন সেটা সাদিয়ার চাইতে ভালো কে বুঝে? সে তো পুড়ছে সেই কবে থেকে পুড়ছে!
—প্রণয় দহন যে বড্ড পোড়ায়! আমি পুড়ছি সেই আট বছর থেকে! এখনও নিজের মঞ্জিলে পৌঁছাতে পারলাম না।
শেষ কথাটা আরনাফ তাচ্ছিল্যের সুরেই বললে।
সাদিয়া কিছু বলবে তার আগেই পেছন থেকে ডা.রিয়া আরনাফকে ডেকে উঠে।
—এখানে কি করছেন ডা.আরনাফ?
এবার চোখ খোলে তাকায় আরনাফ।
—আরে ডা.রিয়া যে।
—এখানে কি করছেন?
—দাঁড়িয়ে একাকিত্বের আনন্দ নিচ্ছিলাম।
—এতো একাকিত্ব কেন আপনার বলুন তো?
ডা.রিয়ার কথায় আরনাফ মুচকি হেঁসে সাদিয়ার দিকে তাকায়। সাদিয়া নিজের ভ্রূদ্বয় যথাসম্ভব কুঁচকে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। আরনাফ মনে মনে হাসলো খানিকটা। এবার ডা.রিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—সবকথা সবাইকে বলা যায় না মিস রিয়া।
আরনাফের কথায় রিয়া কিছুটা অপমানিত হলো। কিন্তু তা প্রকাশ করলো না।
—আমরা তো বন্ধুই তাহলে আমাকে বলতে সমস্যা কোথায়?
—আমার তো মনে পরছে না আমি আপনার সাথে কখনো বন্ধুত্ব করেছি বলে।
রিয়া এবার আর কিছু বললো না। তার আবার আত্মসম্মানবোধ বেশি। ঠিক আত্মসম্মানবোধ নয় ইগো! ইগো তার অনেক বেশি।
আরনাফ স্ট্রেট কথায় সাদিয়া মুখ টিপে টিপে হাসছে। ডা.রিয়া সাদিয়ার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওখান থেকে প্রস্থান করে।
—বেশ হয়েছে। আরো আয় আদিক্ষ্যােতা দেখাতে। হুহহহ বজ্জাত মহিলা মানুষ। সুন্দর ছেলে দেখলো আর ছোক ছোক করা শুরু।
—ডা.রিয়া তোমার সিনিয়র হয় ডাক্তার সাহেবা। তাই তাকে বকাঝকা করা তোমার শোভা পায় না।
সাদিয়া ঘাবড়ে গেলো। সে আমতা আমতা করে বললো,
—আ..আমি ক..খন বকাঝকা করলাম তাকে?
আরনাফ শব্দ করে হাসলো। কিন্তু কিছু বললো না। আজকে কেন যেন আরনাফের কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। চুপচাপ মূহুর্তটা অনুভব করতে মন চাইছে। সাদিয়া কোনো কথা না বলে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
—সাদিয়া।
আরনাফের শীতল কণ্ঠে থমকে যায় সাদিয়া। এর আগে আরনাফ কখনো সাদিয়া বলে সম্বোধন করেনি। হয় তো ডাক্তার সাহেবা আর নয় তো মিস সাদিয়া। আরনাফের ডাকে যেন সাদিয়ার শরীরে মৃদু হাওয়া খেলে গেলো।
এবার সাদিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে আরনাফের দিকে তাকালো। আরনাফ আগের মতোই আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
—তোমার জীবনের অতিগুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোর মধ্যে পাঁচটা মিনিট কি আমাকে দেওয়া যাবে? বেশি না জাস্ট পাঁচ মিনিট চাইছি। কঅ দিচ্ছে পাঁচ মিনিটের বেশি এক সেকেন্ডও তোমার ব্যায় করবো না। তুমি কি দেবে তোমার জীবনের পরবর্তী পাঁচটা মিনিট?
আরনাফের কণ্ঠে স্পষ্ট কাতরতা! সাদিয়া অবাক হলো। ভীষণ অবাক হলো। এর আগে আরনাফ কখনো এমন করে বলেনি। আচ্ছা আজকে কি তার মন খারাপ? কে খারাপ? কি হয়েছে তার? সে কি অসুস্থ? আর একটু আগে সে কি বলেছিলে? সে কারো প্রণয় বিরহে পুড়ছে? সে কি কাওকে ভালোবাসে?
এই কথাটা যেন সাদিয়া মেনে নিতে পারলো না। কে সে কাউকে ভালোবাসবে? কি দরকার কাউকে ভালোবাসার? না সে কাউকে ভালোবাসতে পারে না!
—কি হলো চুপ করে আছেন কেন? দেবেন না পাঁচ মিনিট?
সাদিয়া নিঃশব্দে দুকদম এগিয়ে গিয়ে আরনাফের পাশাপাশি দাঁড়ায়। সাদিয়া এক দৃষ্টিতে আরনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আসলে সে বুঝতে চেষ্টা করছে আরনাফকে! কি সে ব্যর্থ হলো। এবার সাদিয়া এক বুক সাহস সঞ্চয় করে আরনাফকে প্রশ্ন করলো,
—আর ইউ ওকে স্যার?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরনাফ উত্তর দিলে,
—আমি ক্লান্ত! ভীষণ ক্লান্ত আমি। এই লুকোচুরি খেলায় আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। আর পারছি না সব সামলাতে। একটু শান্তি পেতে চাই। একটু বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই। একটু শান্তিতে ঘুমাতে চাই।
সাদিয়া কোনো কথা না আরনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটাকে সে এভাবে দেখে অভ্যস্ত নয়। সে যে আরনাফকে চেনে সে আরনাফ একজন হাসিখুশি মানুষ। এই আরনাফ সেই আরনাফ নয়।
আরনাফ এক বারের জন্যও সাদিয়ার দিকে তাকালো না। পাঁচ মিনিট শেষ হতেই আরনাফ উল্টো দিকে পা বাড়ায়। কিছুটা যাওয়ার পর পেছনে না তাকিয়ে সাদিয়ার উদ্দেশ্য বলে উঠে,
—ধন্যবাদ ডাক্তার সাহেবা আমাকে সময় দেওয়ার জন্য। আর দুঃখিত আপনার মূল্যবান পাঁচ মিনিট নষ্ট করার জন্য।
সাদিয়াকে প্রতিত্তোর করার সুযোগ না দিয়ে আরনাফ হনহন করে প্রস্থান করে।
সাদিয়া অবাক চোখে আরনাফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। যে বুঝতে পারছে না ঠিক কি হয়েছে।
—ভারি অদ্ভুত লোক তো।
আরো কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে সাদিয়া তাবুতে চলে যায়।
আজকে প্রথম দিন তাই তাদের বিশেষ কেনো কাজ দেওয়া হলো না। কাজ মানে ভ্যাকসিনেশন কালকে থেকে শুরু হবে।
.
পরদিন সকালে ঘুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যায় সাদিয়া। তাবু থেকে বেরিয়ে সে আশেপাশে কিছুটা হাঁটা-হাঁটি করে আবারো তাবুতে ফিরে আসে।
সকাল আটটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। সবাই লাইন করে তাবুর সাথে দাঁড়িয়ে আছে। সবাইকে আলাদা আলাদা টিমে ভাগ করে দেওয়া হবে। মোট চারটা টিম করা হবে। সাদিয়া, আদিবাসহ আরো চারজন পড়লো আরনাফের আন্ডাররে। সাদিয়া আরনাফের আন্ডারে যাওয়ার ডা.সিফাতের মনঃক্ষুণ্ন হলো। সে চাইছিলো সাদিয়া যাতে তার টিমে আসে। এতে করে সে সাদিয়ার সাথে একাকি একটু সময় কাটাতে পারবে। কিন্তু তা আর হলো না। ডা.সিফাতকে নিরাস করে,দিয়া সাদিয়া চলে গেলো ডা.আরনাফের টিমে।
আরনাফ নিজের টিম নিয়ে ভ্যাকসিনেশনের কাজ শুরু করে দেয়। প্রথমদিনেই তারা প্রায় একশো’র মতো বাচ্চাকে ভ্যাকসিন দিতে সক্ষম হয়।
.
সন্ধ্যার পূর্ববর্তী সময়। সূর্য পশ্চিম আকাশে তার লাল আভা ছড়িয়ে হেলে পড়েছে। সাদিয়া দাঁড়িয়ে এক মনে সেই দৃশ্যই দেখছে।
—ওহে কন্যা আপনি এখানে একা একা দাঁড়িয়ে কি করছেন?
আদিবার কথায় আলতো হাসলো সাদিয়া।
—কি ব্যপার আজ মনটা এতো ভালো কেন?
—কিভাবে বুঝলি আমার মন অনেক ভালো?
—তুই আমাকে “কন্যা” তখনি বলিস যখন তোর মন অনেক ভালো থাকে।
আদিবা সবকয়টি দাঁত বের করে হাসলো।
—জানিস কি হয়েছে ?
—কি হয়েছে?
—আদিত্য আসছে!
সাদিয়া ভ্রু কুঁচকে বলে,
—কোথায়?
—আরে এখানে। আমাদের ক্যাম্পে।
—কেন?
—এমনি আসছে।
—তোকে কতো ভালোবাসে দেখছিস!
আদিবা আর সাদিয়ার কথার মাঝেই সেখানে আগমন ঘটলো আরনাফের। আরনাফকে এদিকে আসতে দেখে আদিবা অদ্ভুত দৃষ্টিতে একবার আরনাফকে তো আরেকবার সাদিয়াকে দেখছে।
—মিস আদিবা আপনি একটু ওইদিকে যান। আমার কাজললতার সাথে কিছু কথা আছে।
আরনাফের কথায় সাদিয়া এবং বিবা দু’জনেরই ভ্রু কুঁচকে এলো।
—কে কাজললতা? এখানে তো আমি আর দিয়ু ছাড়া কেউ নেই?
আরনাফ পড়লো ফেসাদে। সে আমতা আমতা করে বললো,
—না মানে ডাক্তার সাহেবা মানে মিস সাদিয়ার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
—ওর সাথে আপনার কিসের কথা?
এবার আরনাফ কিছুটা রাগী দৃষ্টিতে তাকালো আদিবার দিকে। আদিবা কিছু না বলে দাঁত কেলিয়ে চলে গেলো।
আরনাফ কিছু বলছে না। চুপ করে আছে। আরনাফের নিরবতায় সাদিয়া বললে,
—কিছু বলছেন না কপন স্যার? আপনি না কিছু বলবেন?
আরনাফ কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলে উঠে,
—আমি তোমাকে ভালোবাসি কাজললতা!
চার শব্দের একটা বাক্যে সাদিয়া স্তব্ধ! সে অবাক চোখে তাকায় আরনাফের দিকে। আরনাফের দৃষ্টি পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া সূর্যের দিকে। সে এইমাত্র কি বলেছে তাতে তার কোনো হেলদোল নেই। সাদিয়া কিয়ৎক্ষণ আরনাফের নিরবতা পর্যবেক্ষণ করলো,
—আমি অন্যকাউকে ভালোবাসি স্যার। আমি তাকে খুব ভালোবাসি। আমি তাকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসি। হয়তো সে আমার কাছে নেই আমার পাশে নেই তবুও আমার মনে তার জন্য এক আকাশ পরিমাণ ভালোবাসা রয়েছে।
—কাকে ভালোবাসো? যে ছয় বছর আগে মারা গেছে তাকে?
আরনাফের কথায় সাদিয়া অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছালো। সে চোখ বড় বড় করে আরনাফের দিকে তাকালো।
—এটাই ভাবছো তো আমি কিভাবে জানলাম? জেনেছি কোনো একভাবে তা তোমাকে বলা যাবে না।
এতটুকু বলেই আরনাফ সাদিয়ার প্রতিত্তোরের অপেক্ষা না করে প্রস্থান করে। সাদিয়া এখনও চোখ বড় বড় করে আরনাফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
আরনাফ চলে যেতেই আড়াল থেকে একজন সরে গেলো। তার চোখে মুখে স্পষ্ট রাগের ছাপ। চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্চে। আর সেই আগুনে আরনাফকে এক নিমিষেই ভস্ম করা যায়!
#চলবে….ইনশাআল্লাহ।
(বিশাল বড় পর্ব লেখার পর পর্বটা কেমন হইছে তা জানার প্রবল ইচ্ছা মনের মধ্যে 🙂।)