আমার বোনু পর্ব-১

0
7090

গতকালের মতো আজও যখন বাসের মধ্যে ঊষার কাঁধ ঘেঁষে মধ্য বয়স্ক লোকটা আরেকটু চেপে দাঁড়ালো তখুনি পাঁচ ভাইয়ের পাঁচ জোড়া চোখ তীক্ষ্ণ থেকে যেনো উত্তপ্ত হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে লোকটাকে চোখের উত্তাপ দিয়ে ভষ্ম করে দিবে। কিন্তু সঠিক সময়ের জন্য পেছন সিট থেকে এক চুলও নড়লো না। বরং আগের থেকে আরো বেশি তীক্ষ্ণ চোখে লোকটার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।ঊষা গুটিসুটি মেরে সিটের সাথে আরেকটু চেপে বসে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে লোকটাকে বললো,

— আঙ্কেল একটু সরে দাঁড়ান না।

লোকটা কপাল কুঁচকে বাজখাঁই গলায় উত্তর দিলো,
— আর কোথায় সাইড চাপবো বলো তো? লোকাল বাসে এরকম চাপাচাপি হবেই। এতটুকু যদি সহ্য করতে না পারো তাহলে লোকাল বাসে উঠো কেন? এসব সহ্য করতে না পারলে বাসে উঠার কোন দরকার নেই। দেখতেই তো পাচ্ছো কি ভীড়। দাঁড়ানোর জায়গা নেই। সেখানে আমাকে সরতে বলো কোন আক্কেলে?

লোকটার বাজখাঁই গলায় আশেপাশে অনেকে উঁকি ঝুঁকি মেরে অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে। কিছু সময় তাদের দিকে তাকিয়ে যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো। এগুলো অহরহ ঘটনা। এসবের মধ্যে না জড়ানোই যেনো সবার জন্য মঙ্গল। ঊষা ভীষণ অস্বস্তিতে পরে গেলো। সামান্য একটা কথার বিনিময়ে লোকটা তাকে কতগুলো কথা শুনিয়ে দিলো। যাতে করে অপমানে তার চোখ দুটোতে নেমে এলো নোনা জল। সে সচারাচর বাসে উঠে না। গতকাল আর আজকে উঠেছে। কাকতালীয়ভাবে গতকালও এই লোকটা এরকম অসভ্যপানা করেছে।গাড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো বলে বাসে উঠেছিলো। সেখানে এই লোকটার দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছে। আজও শুরু করেছে। এই সময় তার ভাইদের ভীষণ মনে পরছে। সাথে চাপা রাগ ও ক্ষোভ কাজ করছে। কেন গতকাল সব জেনেশুনেও আজ তাকে বাসে পাঠালো। আজ বাসায় গিয়ে সে কারো সাথে কথা বলবে না। অথচ সে জানে না তার ভাইরা ইচ্ছে করে আজ তাকে বাসে আসতে বলেছে। যাতে তারা লোকটাকে উত্তমমধ্যম দিতে পারে। এখন পেছনের সিটে বসে তার ভাইরা কিন্তু সবই খেয়াল করছে।

পাশ থেকে ঊষার চোখের পানি মুছে দিয়ে তার একমাত্র প্রিয় বান্ধবী তারিন বললো,

— এই বোকা মেয়ে কান্না করছিস কেনো? একটু অপেক্ষা কর। তোর বান্ধবী তোর সাথে আছে তো। বাস থেকে নামার আগে বেটার কি অবস্থা করি তাই দেখবি। চোখের পানি মোছ বলছি।

শেষের কথাগুলো তারিন দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ে বললো।ঊষা কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু বেশিখন থাকতে পারলো না। লোকটা এবার ঊষার কাঁধের দিকে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছে। ঊষা ঘাবড়ে গিয়ে ভয়ার্ত চোখে লোকটার দিকে তাকাতেই, লোকটা লোলুপ দৃষ্টিতে বিচ্ছিরি একটা হাসি দিলো। যার মধ্যে বাজে কিছুর ইঙ্গিত ছিলো। এবার কিন্তু পেছনের সিটে বসে থাকা পাঁচ ভাইয়ের কেউ শান্ত থাকতে পারলো না। ঊষার সবচেয়ে ছোট যে ভাই, নাম ঈশান সে ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে এসে পেছন থেকে লোকটার ঘাড়ের মধ্যে এক প্রচন্ড ঘুষি বসিয়ে দিলো। লোকটা মুখ থুবড়ে সামনের দিকে হুরমুর করে পরে গেলো। এক মুহূর্তে পুরো বাস স্তব্ধ হয়ে গেলো। ড্রাইভার বাস থামিয়ে দিলো কি হয়েছে তা দেখার জন্য। ঈশান কিন্তু থেমে রইলো না। লোকটার পেটের ওপর বসে শার্টের কলার ধরে ইচ্ছেমতো কিল-ঘুষি দিতে দিতে বললো,

— তোর সাহস কি করে হয় আমার বোনুর গায়ে হাত দেওয়ার? আজ তোকেই মেরেই ফেলবো।

পাশ থেকে ঊষার মেজো ভাই আদিল ঈশানকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— কার বোনের দিকে হাত বাড়িয়েছে তার মর্ম বুঝিয়ে দে শান। পরবর্তীতে যাতে সেইম কাজ না করতে পারে।

নিজের ভাইদের কন্ঠ শুনে ঊষা সাময়িক চমকে উঠলো। পাশ ফিরে তাকিয়ে একসাথে পাঁচ ভাইকে দেখে খুশিতে আবারো কান্না করে দিলো। সিট থেকে উঠে বড় ভাই অর্ণবের বুকে “বড় ভাইয়ু” বলে ঝাপিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। অর্ণব বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে সেজো ভাই ইশাতকে বললো,

— ইশাত তুই তারিন আর বোনু কে নিয়ে বাসায় চলে যা। এর ব্যবস্থা আমরা করছি।

ঈশান লোকটাকে মেরে অবস্থা অর্ধেক খারাপ করে দিয়েছে। ওর মারের স্টাইল দেখে বাসের কেউ লোকটাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসার সাহস করেনি। ঊষা কিছুটা ভয়ও পেয়েছে। সাধারণত সে তার ভাইদের এরকম রূপের সাথে পরিচিত নয়।ইশাত বোনকে ধরে নিচে নেমে গেলো। তারিনও তার পিছুপিছু চললো। আদিল সাথে দাড়িয়ে থাকা পাঁচ নম্বর ভাই অরূপকে বললো,

— একে আমাদের ঠিকানায় নেওয়ার ব্যবস্থা কর।

অরূপ একবার রাগী চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে আদিলকে বললো,

— ওকে মেজো ভাই।

ধীর পায়ে একবার সবার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে বাস থেকে নেমে গেলো অর্ণব,আদিল। ঈশান ও অরূপ লোকটাকে টেনে বাস থেকে নেমে গেলো। যারা এদের চিনতে পেরেছে তারা আপতত বিস্ময়ের ঘোরে আছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো তা তাদের মাথার ওপর দিয়ে গেছে।তাছাড়া মির্জাদের ওপরে আঙুল তোলার সাহস তাদের কারোর নেই।

“ঊষা মির্জা” মির্জা বাড়ির পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র বোন। বড় ভাই অর্ণব মির্জা,মেজো ভাই আদিল মির্জা, সেজো ইশাত মির্জা আর ছোট ঈশান মির্জা। এছাড়া আরেক ভাই আছে সে হলো অরূপ মির্জা। সম্পর্কে অরূপ ওদের আপন ভাই নয়। কিন্তু আপনের থেকে কমও নয়। বোনের জন্য পাঁচ ভাই যেমন জান দিতে পারে তেমনি নিতেও পারে। বাকি সবকিছু চুলোয় যাক। বোন তাদের সবার আগে।পাঁচ ভাইয়ের কেউ বোনকে নাম ধরে ডাকে না। আদর করে বলে বোনু, “আমার বোনু”। ঊষা সবাইকে ভাইয়ু বলে সম্বোধন করে। বড় ভাইয়ু, মেজো ভাইয়ু এরকম। অতি আদরে থাকা মেয়েগুলো যেমন ননীর পুতুল হয়। তেমনি ঊষা। সে নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না। অবশ্য প্রতিবাদ করার জন্য তার ভাইয়েরা আছে। তাই যেনো সে অনেকটা ভীতু স্বভাবের।

ছোট খুপরির মতো চিলেকোঠার মতো জায়গায় উল্টে পরে আছে সে লোকটা। দেখে মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে আছে। তবুও এলোপাতাড়ি লাথি মেরেই যাচ্ছে ঈশান ও অরূপ। মেদবহুল দেহটা জানান দিচ্ছে সে একজন সরকারি চাকুরিজীবী। আসলেই সে একজন সরকারি কর্মকর্তা। প্রতিদিন বাসে করে সে তার চাকরিক্ষেত্রে যায়। বয়স পঞ্চাশের কোঠায় হলেও স্বভাব চরিত্র মোটেও ভালো নয়।বাসের মধ্যে প্রায় সে নানাভাবে মেয়েদের হয়রানি করে।

পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ঈশান সবচেয়ে বেশি রাগী। বোনের ক্ষেত্রে সে ভীষণ পসেসিভ। সামান্য কিছুতে যেখানে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে ফেলে। বোনের ম্যাটার হলে তো সেখানে খু*ন-খা*রাবি হয়ে যাবে। অর্ণব, আদিল দূরে বসে চায়ের কাপে চুমুক মারছে। এই অবেলায় চা একটু বিস্ময়কর ব্যাপারই। কিন্তু তারা দুই ভাই যখন চিন্তায় থাকে তখন তাদের চায়ে ডুবে থাকতে দেখা যায়। তাদের ধ্যান ফিরলো অরূপের কথায়।

— ভাই, এটাকে কি জানে মে*রে ফেলবো?

আদিল ভ্রুকুটি কুঁচকে উত্তর দিলো,
— না।

ভাইয়ের না শব্দ শুনে ঈশান তেজী বাঘের মতো গর্জে উঠলো,

— না মানে? কি বলছো তুমি মেজু ভাইয়া? ও আমাদের বোনের কাঁধে হাত দিয়েছে। ওকে তো আমি জানেই মে*রে ফেল…..

পুরো কথা শেষ হওয়ার আগে আদিল হাত উঠিয়ে ঈশানকে থামিয়ে বললো,

— ওর হাত দুটোর এমন অবস্থা কর যাতে জীবনে আর কোন মেয়ের কাঁধে হাত রাখতে তো দূরে থাক বাড়াতেই না পারে।

ভাইয়ের এমন প্রস্তাবে ঈশান বা অরূপ কেউ খুশি হলো না। তাদের ধারণা মতে এর একমাত্র শাস্তি মৃত্যু। কিন্তু ভাইয়ের হুকুম অমান্য করার সাহসও তাদের নেই। রাগে ফুসতে ফুসতে লোকটাকে নিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। এখন এর দুই হাত কেটে হসপিটালে ভর্তি করে রেখে আসবে। আদিল হাতে থাকা চায়ের কাপ রেখে একবার বড় ভাইয়ের দিকে তাকালো। অর্ণব খুব মনোযোগ সহকারে কিছু একটা ভাবছে। আদিল জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে ভাই?

অর্ণব মুখে কোন কথা বললো না। চোখ উঠিয়ে একবার আদিলের দিকে তাকালো। তারপর চায়ের কাপটা টি-টেবিলে রেখে হনহন করে বের হয়ে গেলো। আদিল ভাইয়ের মতিগতি কিছুই বুঝলো না। ভাইয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিশাল দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

মিনিট পচিশের মধ্যে অর্ণব দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলো। হন্তদন্ত হয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকে উচ্চস্বরে তার স্ত্রী-কে ডাকতে লাগলো,

— জিনিয়া, জিনিয়া!

#চলবে

~~~~ একজন ভাই হিসেবে প্রতিটি ছেলেকে সবসময় তার বোনের জন্য ঢাল হিসেবে রুখে দাঁড়ানো উচিত।

#আমার_বোনু
#Part_01
#Writer_NOVA

পুরো দুই মাস পর লিখলাম। কেমন হয়েছে জানি না। অনেকটা অগোছালো হতে পারে। তার জন্য আমি ক্ষমাপার্থী। এই গল্পে বোনু সিজন ০১ এর সবাই থাকবে।বলতে পারেন এটা বোনু সিজন ০৩। অনেকগুলো চরিত্র থাকবে। তাই বুঝতে একটু সমস্যা হতে পারে। আস্তে আস্তে আমি সব ক্লিয়ার করে দিবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here