আমার বোনু পর্ব-২৫

0
2065

#আমার_বোনু
#Part_25
#Writer_NOVA

জিনিয়া, ঊষা গোল গোল করে ঘুরে নুহাকে দেখছে। নুহা হতভম্ব হয়ে ওদের কাহিনি লক্ষ্য করছে। কখন থেকে ঘুরে ঘুরে ওকে দেখে যাচ্ছে। একে অপরকে ইশারা করে কি জানি বলছে। কিন্তু মুখে কিছু বলছে না। নুহার এখন নিজেকে চিড়িয়াখানার এক বন্য প্রাণী লাগছে। আর জিনিয়া, ঊষাকে চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষের লোক। জিনিয়া এক হাত কোমড়ে রেখে আরেক হাতে ঠোঁটের কোণায় রেখে জিজ্ঞেস করলো,

— নাম কি তোমার?

নুহা চোখ দুটো এদিক সেদিক ঘুরিয়ে উত্তর দিলো,
— নুহা!

ঊষা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু একটা ভাবছিলো। জিনিয়া কথা বলছিলো বলে সে চুপ ছিলো। এখন সে প্রশ্ন করবে।

— শুধু নুহা? সাথে আর কিছু নেই?

নুহা ইতস্তত গলায় বললো,
— জ্বি আছে। নুহা আক্তার।

জিনিয়া এদিক সেদিক তাকিয়ে সাবধানী গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— তা আমার ছোট দেবরকে হাত করলে কিভাবে?

— মানে?

নুহা বেশ জোরে কথাটা জিজ্ঞেস করলো। জিনিয়ার কপাল কুঁচকে এলো। ঊষা ফিক করে হেসে উঠলো। জিনিয়া চোখ সরু করে ঊষাকে বললো,

— হাসি বন্ধ করো ননদিনী। আমাকে পুরো ঘটনা জানতে হবে।

ঊষা মুচকি হেসে বললো,
— তুমি যেমনটা ভাবছো তেমন কিছু না ভাবী। ছোট ভাইয়ু যা পাঁজি। ওর ধারের কাছে কোন মেয়ে যেতে পারবে বলে মনে হয় না। সেবার মনে নেই সেজো ভাইয়ুর এক মেয়ে ক্লাশমেট ওর সাথে সেধে কথা বলতে গিয়েছিল। ওকে বিরক্ত করছিলো বলে যে সবার সামনে যেই চড়টা না মেরেছিলো। একবার কলেজে এক মেয়ে প্রপোজ করছিলো বলে মেয়েটাকে কান ধরে উঠবস করেছিলো। ওর কথা হলো আমি যাকে পছন্দ করবো তাকে নিজে খুঁজে নিবো। আর তাকে নিজের করে ছাড়বো। মনে হয় না এখনো তেমন কোন মেয়ে ওর পছন্দ হয়েছে।ওর ভাষ্যমতে মেয়েরা নাকি ন্যাকামি করে। আর ওর তো ন্যাকামি ভীষণ অপছন্দ।

জিনিয়া মুখ বাঁকিয়ে ভেংচি কেটে বললো,
— এখন তো ন্যাকামি পছন্দ নয় বলে কেটে পরছে। পরে দেখবে সবই পছন্দ। ছেলেরা না এসব অহরহ বলেই। ওদের কথা বিশ্বাস করতে নেই।

ঊষা তার ভাবীর কথায় হাসতে লাগলো। নুহা (😕) এই ইমোজির মতো করে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলো। কি ঘটনাকে কি বানিয়ে ফেললো। সে আমতাআমতা করে বললো,

— আপনারা যা ভাবছেন তেমন কিছু নয়। ঈশান ভাইয়া আমাকে আপনাদের বাসায় কাজ দিয়েছে। এখন থেকে আমি এই বাসায় থেকে রান্নার কাজে সাহায্য করবো।

জিনিয়া ভ্রুকুটি কুঁচকে নুহাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত খেয়াল করলো। হাটু অব্দি টপসের সাথে জিন্স। গলায় একটা স্কার্ফ পেঁচানো। চুলগুলো উঁচু ঝুটি করা। পায়ে স্লিপার। এই মেয়ে নাকি রান্নার কাজে সাহায্য করবে! জিনিয়া অবাক চোখে বললো,

— তুমি রান্নায় সাহায্য করবে?

নুহা মাথা উপর নিচ ঝাকালো। ঊষা বুঝতে পেরেছে এখন জিনিয়া কি বলবে। তাই সেই থেকে নুহাকে বাঁচাতে তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,

— আহ বড় ভাবী কি শুরু করলে? মেয়েটা কতদূর থেকে এসেছে। এখন একটু ফ্রেশ হয়ে নিক। তারপর তোমার যা বলার বলো।

ধীরেসুস্থে কথাগুলো বলে ঊষা নুহার দিকে তাকালো। গলা ঝেড়ে বললো,
—এই নুহা আসো আমার সাথে। তুমি আমার সমবয়সী। তাই নাম ধরে ডাকলাম। কিছু মনে করো না। এসো, তোমার রুম দেখিয়ে দেই।

ঊষা, নুহাকে নিয়ে উপরে চলে গেলো।জিনিয়া কোন কথা বললো না। পুরো বিষয়টা তার কাছে পানির মতো পরিষ্কার। কিছু সময় আগে ঈশান ওকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে তার কাজে চলে গেছে। জিনিয়াকে বলে গেছে আজ থেকে নুহা এখানেই থাকবে। নুহাকে যে ঈশানের মনে ধরেছে তা জিনিয়া ঠাওর করে ফেলছে। নয়তো ঈশান বাসায় মেয়ে আনবে! এটা তো কল্পনা করাও দুষ্কর।

রিমঝিম বৃষ্টির তালে চিকন মিহি আওয়াজের খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে আসছে। সাথে চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে যে কারোর ঘুম উড়িয়ে নিবে। অনেক সময় ধরে চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে মাসফি শেষ অব্দি বিরক্তিতে উঠে গেলো। সবেমাত্র চোখ লেগে এসেছিলো। কাঁচা ঘুমটা ভাঙায় তার মেজাজ এখন তুঙ্গে। কিন্তু এই সময় চুড়ির শব্দ আসবে কোথা থেকে? বাসায় অদিতি ছাড়া আর কোন মেয়ে নেই। যে একজন মহিলা আছে অদিতির দেখাশোনার জন্য। তার বয়স পঞ্চাশর্ধো। নিশ্চয়ই এই বয়সে তার মনে রং লাগেনি যে কাচের চুড়ি পরে ঘুরবে। ঘুম না হওয়ায় কপালের কাছটা চিনচিন করে ব্যাথা করছে মাসফির। মাথা ধরার পূর্ব লক্ষ্মণ।

কাঁথা সরিয়ে নিচে নেমে গেলো। ড্রয়িংরুমে যেতেই দেখলো আরান, জিকু সোফায় বসে কথা বলছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে হালকা করে হাসছেও। মাসফিকে দেখে আরান দাঁড়িয়ে বললো,

— আরে ভাই, তুমি না ঘুমিয়ে ছিলে? তা জাগলে কখন?

মাসফি বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে আরানকে বললো,
— তুই কখন এলি?

আরান হাসিমুখে বললো,
— এই তো বৃষ্টির আগে। আমিও ভেতরে ঢুকলাম বৃষ্টিও নামলো।

— খেয়ে এসেছিস?

— না দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি। সমস্যা নেই আমি বাসায় গিয়ে খেয়ে নিবো।

মাসফি জিকুর দিকে তাকিয়ে বললো,
— ওকে খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করো জিকু।

জিকু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
— জ্বি বস।

আরান ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
— না না তার কোন দরকার নেই জিকু। তুমি বসো, ব্যস্ত হয়ো না।

মাসফি ধমকে উঠলো,
— তুই চুপ করে বস। খাবার নিয়ে যেনো আরেকটা কথাও না বলতে হয়। আমার বাসায় এসেছে আর সে না খেয়ে যাবে। আবার বলে সমস্যা নেই বাসায় গিয়ে খাবে। দিবো এক থাপ্পড়। আমি যেনো একটু পর তোকে খাবারের টেবিলে দেখি।

ভাইয়ের বকা খেয়ে আরান চুপ হয়ে গেলো। ইনোসেন্ট ফেস করে বললো,
— জ্বি ভাইয়া।

মাসফি আবারো চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ পেলো। এতখন আরানকে বকা দিতে ব্যস্ত থাকায় চুড়ির বিষয়টা তো তার মাথা থেকে বেরই হয়েই গিয়েছিলো। আরান বাধ্য ছেলের মতো সোফা থেকে উঠে জিকুর পিছনে খাবারের টেবিলে রওনা দিলো। মাসফি এক পলক আরানকে দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো। তখুনি ওর মাথায় কিছু একটা খেলে গেলো। চট জলদী আরানের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় ডাকলো,

— আরান!

আরান পিছু ফিরে উত্তর দিলো,
— জ্বি ভাই।

— তোর পায়ে কি হয়েছে?

আরান একবার পায়ের দিকে তাকিয়ে হালকা চমকে উঠলো। আরানের মুখের রং নিমিষেই বদলে গেলো। যা মাসফির চোখ এড়ালো না। কিছুটা গম্ভীর কন্ঠে মাসফি বললো,

— কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি। তোর পায়ের কনিষ্ঠ আঙুলে কি হয়েছে? ব্যান্ডেজ কেনো?

আরানের দৃষ্টি এখন পালাই পালাই করছে। সে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে উত্তর দিলো,
— অসাবধানে কেটে গেছে।

— কি দিয়ে?

— এই কাচ জাতীয় কিছু হবে।

— সাবধানে চলাফেরা করতে পারিস না? নিয়মিত মেডিসিন নিস। নয়তো ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে।

মাসফি এক মুহুর্তও দেরী করলো না। চুড়ির আওয়াজের উৎস খুঁজতে চলে গেলো। আরান বড় করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। একটুর জন্য ধরা পরে যাচ্ছিলো। আল্লাহ বাঁচিয়েছে৷

মাসফি, অদিতির রুমে ঢুকে দেখতে পেলো অদিতি রুমে নেই। মাসফি ভয় পেয়ে গেলো। দ্রুত বারান্দায় যেতেই সে বুক ধরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। সেই সাথে সাথে চুড়ির শব্দের উৎসও খুঁজে পেলো। অদিতি দুই হাতে মুঠ ভর্তি চুড়ি পরে বারান্দার গ্রীলের বাইরে হাত দিয়ে রেখেছে। বৃষ্টির পানি তার হাত ছুঁয়ে নিচে পরছে। তা দেখে অদিতি যে কি পরিমাণ খুশি তা মাসফির কল্পনার বাইরে। এই দৃশ্য দেখে নিমিষেই মাসফির মন ভালো হয়ে গেলো। সামনে এগিয়ে গিয়ে বোনকে বললো,

— কি করছিস অদিতি?

অদিতি ভাইয়ের দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিলো,
— দেখতে পাচ্ছো না বৃষ্টি বিলাস করছি।

অদিতি নিজের দুই হাত ভাইয়ের সামনে মেলে ধরে বললো,

— চুড়িগুলো সুন্দর না?

— কে দিয়েছে?

— আরান নিয়ে এসেছে আমার জন্য। জানো ভাইয়া আরান অনেক ভালো। আমার তো মনে হয় আমার দুইটা ভাই। একটা তুমি আরেকটা আরান। তুমি আমার বড় ভাই আর আরান আমার ছোট ভাই।

অদিতির কথা শুনে মাসফির মন আরো ভালো হয়ে গেলো। অদিতি এখন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে। অদিতি ভাইয়ের দিক থেকে সরে আবারো বৃষ্টির পানি দিয়ে খেলতে লাগলো। সেই দৃশ্য দেখে আপনাআপনি মাসফির চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো।

বৈশাখ মাসের একটাই সমস্যা। হুটহাট ঝুপঝাপ বৃষ্টি নেমে যায়। একটু আগে যেখানে ঝলমলে রোদ ছিলো। এখন আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে। সাথে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি তো আছেই। প্রকৃতির এই রূপটার মধ্যেও অন্য রকম একটা ভালো লাগা আছে। তবে সেটা খুঁজে নিতে হয়। শহুরে জীবনে বৃষ্টি যেনো মাঝে মাঝে অভিশাপে পরিণত হয়। রাস্তা ঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়া, ড্রেনের ময়লা চারপাশে ছড়িয়ে যাওয়া, ম্যানহোল বন্ধ হয়ে রাস্তায় পানি জমা হওয়া, কাদামাটির ছড়াছড়িতে একটা বিচ্ছিরি পরিস্থিতি। কিন্তু গ্রামের বৃষ্টি অন্য রকম। বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখার আনন্দই আলাদা। বৃষ্টি তো আর সবার পছন্দ নয়। যারা বৃষ্টি বিলাসী তাদের জন্য হেব্বি একটা ওয়েদার আজ। কিন্তু যারা পছন্দ না করে তাদের কাছে চরম বিরক্তিকর।

—বৃষ্টিটা আসারও সময় পেলো না।

কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো ঊষা। বৃষ্টি তারও পছন্দ। কিন্তু পরিস্থিতিভেদে এখন অসহ্যকর লাগছে৷ কলেজ গেইট থেকে বের হয়ে ছাউনি ওয়ালা দোকানের সামনে দাঁড়াতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে গেলো। সে এখন বাসায় কিভাবে ফিরবে সেই চিন্তায় বিভোর। তারিন আজ কলেজ আসেনি। এই মেয়ে আবার প্রচুর ফাঁকিবাজ। আকাশে মেঘ দেখলেই তার কলেজ আসা বন্ধ।

— ধ্যাত ভালো লাগছে না।

একা দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না ঊষার। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে অরূপের নাম্বারে কল করলো৷ কিন্তু ভাগ্য তার সহায় নয়। বৃষ্টির কারণে এক দাগ নেটওয়ার্কও নেই। এতে যেনো সে আরো ক্ষেপলো। যে বৃষ্টি তার এত পছন্দ সেই বৃষ্টি এখন বিরক্ত লাগছে। বাসায় থাকলে অবশ্য ইচ্ছেমতো ভিজতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বৃষ্টি-বাদলের দিন রাস্তায় এমনিও লোকজন কম থাকে।রিকশা কিংবা অন্য কোন যানবাহনের দেখাও মিলে না। ঊষাকে নিতে যে গাড়ি আসবে তারও খবর নেই। রিকশাও লাপাত্তা। অন্ততপক্ষে একটা রিকশা পেলেও সে চলে যেতো। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতো না।

হঠাৎ একজন রেনকোট পরিহিত লোক এসে ঊষার মুখের সামনে তার ছাতাটা ঝাড়া মারলো। এতে ঊষার মুখে পানির ছিটেফোঁটা এসে বারি খেলো। ঊষা চেচিয়ে বললো,

— হেই চোখে দেখেন না? ছাতাটা কি আমার মুখের ওপর ঝাড়া মারতে হলো? মারলেন তো মারলেন আমার মুখের সামনে কেন? অন্য দিকে মারলে কি হতো?

ঊষার কথায় লোকটা থমকে দাঁড়ালো। না ঘুরে পেছন দিক থেকে কয়েক কদম পিছিয়ে ঊষার পাশাপাশি এসে দাঁড়ালো। ঠান্ডা, হীম শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— কি বললেন মিসেস?

লোকটার দিকে রাগী চোখে তাকালেও ধীরে ধীরে ঊষার মুখটা ভয় ছড়িয়ে গেলো। তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ভয়ে এবার বোধহয় হাত-পা কাপাকাপি শুরু করবে।ঢোক গিলে আমতাআমতা করে বললো,

— কে আ-আপ-আপনি?

~~~ অন্যের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজের ভালো থাকার কারণটা নিজের মধ্যে খুজে নিন।💔

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here