আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -১৯

0
1747

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ১৯
———————————————–
ঢিপ ঢিপ একটানা শব্দ আসছে বুকের এক পাশ থেকে। সেই বুকের সাথে সেটে যেতেই ক্যামেলিয়ার উগ্র খুশবু নাকে ধাক্কা মারলো। মনে হচ্ছে ক্যামেলিয়ার বাগান থেকে সদ্য ভ্রমন করে আসছে।
আমি ধীরে ধীরে মাথা তুললাম। উপরে তাকাতেই একটা ঈষৎ গোলাপী ঠোটের মিষ্টি হাসি উপহার পেলাম। এটা তো লিও!! হাসিতে ওর ফোলা গাল দুটোর মাঝখানে দুটো ডিম্পল! সেটা দেখেই আমার মাথা থেকে সমস্ত ভয় দূর হয়ে গেল। ভুলেই গেলাম কোথায় আছি। শুধু হা করে ওর ডিম্পল ওয়ালা হাসির দিকে তাকিয়ে আছি। লিও আমাকে খুব মিষ্টি করে ডাকলো
“মিইইইরা”
“হা!”
“এদিকে দেখো”
আমি তাকালাম লিওর ইশারার দিকে। তাকাতেই ভয়ানক ভাবে চিৎকার দিয়ে আমি লাফিয়ে উঠলাম। লিওর বাহু বন্ধন থেকে জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওর পিছনে চলে গেলাম। বুকটা প্রচুন্ড শব্দে হাতুড়ি পিটছে। দেখলাম সেই লোমশ কালো কুকুর টা সামনের দুপা উপরে তুলে জিহ্বা বের করে হাপাচ্ছে। ঘন ঘন আমার দিকে আসার চেষ্টা করছে। আমার শরীরে কাটা দিয়ে উঠল। কোন ভাবে চাইছিলাম না কুকুরটা আমাকে স্পর্শ করুক।
আমার ব্যবহার দেখে লিও অত্যন্ত হতচকিত হয়ে গেল। সে উদগ্রীব কণ্ঠে বলল
“মিইইইরা দেখ সে তোমার কাছে মাফ চাইছে। প্লিজ তাকে মাফ করে দাও।”
আমি বিন্দু মাত্রও আমার জায়গা থেকে সরলাম না। বরং আরো শক্ত করে লিওর গেঞ্জি ধরে বললাম
“কুকুর টা-টাকে চলে যেতে বলো।”
এ কথা তে কুকুর টা পা দুটো নামিয়ে খানিকটা গোঙানির মত শব্দ করলো। তারপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ফেলল
“কি করছো মিইইইরা! ওর নাম শাকিরা। সে হার্ট হয়েছে। কেননা তুমি তাকে কুকুর বলেছো!”
“কুকুর কে কুকুর বলবো না তো কি মানুষ বলবো!”
শাকিরা এক পাশে গিয়ে মাথা নত করে শুয়ে পড়লো। ইশশ্ কত ঢং! তাও আবার কুকুরের।
“ওর নাম আছে মিইইরা। দেখ শাকিরা কত হার্ট হয়েছে। প্লিজ ওকে মাফ করে দাও।”
.
লিও আমাকে টেনেটুনে ও শাকিরার কাছে নিয়ে যেতে পারলো না। বাধ্য হয়ে শাকিরা কে আমার কাছ থেকে দূরে থাকতে হল।
.
বার্থ ডে রিসেপশন তৈরি করা হয়েছিল বাড়ির সাইড ইয়ার্ডে লিওর রুমের নিচে। সেদিক টা এক ঝাক ক্যামেলিয়া ফুলের বাগান। আমি বুঝতে পারলাম লিওর গায়ে ক্যামেলিয়ার গন্ধ কোথ থেকে এসেছিল।
আকাশ তেমন রোদ ছিল না। তথাপি আলোর কমতি ছিল না। কয়েক টুকরো পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ ইতি উতি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। চঞ্চল বাতাস গুলো নেচে বেড়াচ্ছিল। সেই সাথে ক্যামেলিয়ার সুবাস গুলো বাতাসের সাথে সুর মেলালো। একটু দুরে সারি সারি দেবদারু গাছ। সেখানে একটা পেঁচা ভৌতিক চোখ দিয়ে সমগ্র অনুষ্টান দেখছিল। বাল নাকুটি পাখি গুলো আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছিল। অনুষ্টানে আরো মেহমান হিসেবে উপস্থিত ছিল দুটো সাদা খরগোশ। সেগুলো কিছুক্ষন পর পর ক্যামেলিয়া বাগান থেকে উকি ঝুকি মেরে নিজেদের মধ্যে কিছু একটা শলা পরামর্শ করে আবার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছিল।
চমৎকার একটা পরিবেশ।
বার্থ ডে হিসেবে আমরা গেস্ট হওয়ার কথা। কিন্তু এসে দেখছি পার্টির এরেঞ্জ সবাই মিলে করছে। কেউ গেস্ট দের বসার ডেকোরেশন টা দেখছে। কেউ খাবার এর এ্যারেঞ্জমেন্ট দেখছে। কেউ ওয়েটারের সাথে দৌড়াদৌড়ি করছে। কয়েকজন পেটুক কে দেখলাম ইতোমধ্যে প্লেট চামচ নিয়ে খাবারের কাউন্টারে ভীড় করছে। আবার কয়েক জন লিওর বার্থ ডে উপলক্ষে কোন রঙের ড্রেস পড়বে সেটা নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে। যার বার্থ ডে তার এসব নিয়ে কোনো চিন্তা ভাবনা নেই। কালো হাত কাটা গেঞ্জি আর ধুসর ত্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাথার উপর হেডফোন লাগিয়ে চার দিকে সে ডিরেকশন দিচ্ছে।
কেকের ডেলিভারি আসতে দেরি হচ্ছে কেন সেই চিন্তায় রিচার কার্লি চুল গুলো একদিনে সোজা হবার উপক্রম হয়ে গেল। সে শুধু এদিক থেকে ওদিক দৌড়াচ্ছে। আমি আর কার্ল রিসেপশন টা সাজাচ্ছিলাম ফুল দিয়ে। সব বাগান থেকে তোলা তাজা ফুল। বাগান দেখে আইডিয়া টা আমিই দিয়েছিলাম। শাকিরা মাথায় বার্থ ডে ক্যাপ পড়ে এখনো দূরে ঘুর ঘুর করছে। আমার আশে পাশে আসছে না। কিন্তু লেজ নাড়িয়ে যেন আমাকে কিছু বলছে। শাকিরা কে যখনি দেখছিলাম তখনি নিজেকে আড়াল করছিলাম যাতে ওর নজরে না পড়ি। বিশ্বাস কি ওর? কখন এসে টুটি চেপে ধরে বলায় যায় না। ছোট বেলায় কামড় খাওয়া দাগ টা আরেক বার দেখলাম। একটু একটু চিহ্ন এখনো আছে। আবার নতুন করে কোনো কামড় আমি খেতে চাই না।
.
কিছু একটার প্রয়োজনে আমি এডালিন কে খুজছিলাম। এডালিন কোথায়? ওকে দেখা যাচ্ছে না কেন?
এদিক ওদিক তাকাতেই দেখলাম এডালিন আর রাঘব ক্যামেলিয়ার বাগান ছেড়ে একটু দূরে দেবদারু গাছের সেদিকে সবুজ ঘাসের বুকে হেটে বেড়াচ্ছে। একের হাতের সাথে অপরের হাত মুষ্টিবদ্ধ। বাহ! দারুন তো! এরা তো একেবারে প্রেম করে বেড়াচ্ছে।
একে অপরের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আর লজ্জায় এডালিন নত করে ফেলছে।
আমি হেসে কুটি কুটি হয়ে গেলাম।
.
সব কাজ যখন সম্পন্ন হল তখন প্রায় বিকেল গড়িয়ে এলো। পশ্চিম আকাশে হালকা রংধনু ফুটে উঠেছে। লাল পাখি গুলো প্রস্তুতি নিচ্ছে বাড়ি ফেরার।
আর আমাদের সবাইকে দেখে মনে হচ্ছিল একেক জন একেকটা যুদ্ধের বিধ্বস্থ সৈনিক।
.
গেস্টরা সবে আসা শুরু করছিল। সবাই তৈরি হয়ে নিচে চলে এলো।
রিচা আর এমিলি গেস্ট দের রিসিভ করছিল। আমি আর রাঘব গিফট গুলো নিয়ে রাখছিলাম। বেশ হাপিয়ে উঠেছিলাম গিফট বইতে বইতে। বাব্বাহ! এত্তোগুলো গিফট দিয়ে সে কি করবে?
.
সবাই যখন ঠিকমত বসে গেল। গেস্ট রাও প্রায় এসে গেছে ঠিক তখনি রিচা আমাকে ডাক দিল
“হেই টামিনাহ! কাম হেয়ার!”
আমি গেলাম। রিচার সামনে ফরসা ধবধবে পিঠ দেখিয়ে দাড়িয়ে আছে কেটি পেরির ন্যায় চিকন এক ব্লন্ডি। ব্যাকলেস ড্রেসটি থাই ছুই ছুই করছে। হাই হিল পড়া অবস্থায় যেন আকাশ ছুয়েছে। চুল গুলো হালকা কোকরানো। আমি হাসি মুখেই রিচার দিকে গেলাম। আমাকে খেয়াল করে রিচা বলল
“টামিনা এ এডের কাজিন। তোমার সাথে দেখা করতে চাই।”
“ওহ্ আচ্ছা”
মেয়েটি আমার দিকে ফিরলো। এই প্রথম এখানে কারো চোখের মনি স্বচ্ছ কালো দেখতে পেলাম। দারুন উজ্জল চোখ দুটো। ঠোটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। ঘন পাপড়ি যুগল গুলো যেন শিল্পীর হাতের তুলি। গলায় লকেট ঝুলানো। তাতে ইংরেজি লেটার T ঝুলানো। আমার আন্দাজ যদি মিথ্যা না হয় তাহলে মেয়েটির নাম টি দিয়েই শুরু হবে।
আমাকে তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটি একটু হাসলো। তারপর হাত দিয়ে কোকরানো চুল গুলো পিছনে নিয়ে বলল
“তোমার নাম মীরা তাই না?”
আমি মাথা নাড়লাম
“হুম”
শুদ্ধ ভাবে উচ্চারন করল আমার নাম টা। যাক! কেউ না কেউ আমার নাম টা সঠিক ভাবে উচ্চারন করল।
“মেবি তুমি বাংলাদেশ থেকে এসেছো। ইন্ডিয়ার কাছাকাছি কোন একটা দেশ!”
“জি। কিন্তু দুঃখিত আমি আপনাকে…”
মেয়েটি আবারো হাসলো। বললো
“আমি টিনা, টিনা এন্ডারসন।”
“ওহ্ আচ্ছা।”
.
আমি উসখুস করছিলাম। টিনা একনাগাড়ে বেশ খানিক ক্ষন ধরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন কিছু খুজছে। কিন্তু সেটা আমার জন্য অত্যন্ত অস্বস্তিকর। শেষে আর না পেরে ওকে ডাকলাম
“মিস এন্ডারসন!”
“কল মি টিনা!”
“ঠিক আছে টিনা। আমি কি যেতে পারি এখন?”
টিনা সম্পুর্ন ভাবে অগ্রাহ্য করল আমার কথা কে। যেন নিজের দুনিয়ায় ঘুরছে সে। নিজ থেকেই বলল
“ইয়ু নো মীরা?”
“হোয়াট”
“ইয়ু আর বেরী বিউটিফুল গার্ল!”
আমি নার্ভাস ভাবে হাসলাম।
“থ্যাংকস!”
“কিন্তু!”
“কিন্তু?”
“আমার মত সুন্দরী না!”
আমি ভ্যাবাচাকা খেলাম। মুহুর্তে টিনার কোমল চেহারা শক্ত পাথরের ন্যায় হয়ে গেল। চোখের মনি গুলো তে অদৃশ্য চঞ্চলতা খেলা করতে লাগলো। আমি বুঝতে পারলাম না হঠাৎ করে কি হয়ে গেল?
“আ-আমি বুঝতে পারছিনা তুমি…!”
ঝট করে টিনা আমার কানের কাছাকাছি চলে আসলো। তারপর ফিসফিসিয়ে বলল
“লিভ হিম!”
“হোয়াট?”
কিছু বুঝে উঠার আগেই এনাউন্স মেন্ট কানে এলো। আমি ঘুরে তাকালাম। টিনা দ্রুত গতিতে সেদিকে চলে গেল।
লাইট ফেলা হল সিড়ির মুখোমুখি। দোতালা লিওর রুম থেকে সিড়ি টা নিচে তাক করা। পুরো রিসেপশন সাইলেন্ট হয়ে গেল। তারপর ধীর পায়ে ঠক ঠক বুট জুতার শব্দে কেউ বেড়িয়ে আসতে লাগল। ব্ল্যাক স্যুটে লিও এবং পাশে মধ্য বয়স্ক এক মহিলা হাত ধরাধরি করে নেমে আসছে। নিচে নামতেই সবাই করতালিতে স্বাগত জানালো। এরপর সবাই তাকে ঘিরে ধরলো। ওই মহিলা মাইকটা হাতে নিয়ে ফরাসী ভাষায় কিছু একটা জানালো আর সাথে সাথে সবাই উল্লাসে ফেটে পড়লো। আর আমরা সবাই ক্লাস মেট সবাই এক পাশে দাড়িয়ে ছিলাম। সবার সাথে সাথে ওরাও চিয়ার করে উঠল। আমি রাঘবের দিকে তাকালাম। ইশারা করে জানতে চাইলাম সে কিছু বুঝতেছে কিনা। চোখ দুটো করুন করে তার হাবভাবে জানালো সে কিছুই বুঝতেছেনা। আমি আর রাঘবের জন্য হয়েছে কেয়ামত। ইংরেজি বাদে আর কিছুই বুঝতে পারছিনা।
কিছুক্ষন পর লিও আমাদের কাছে চলে আসলো। দূর থেকে বুঝতে পারি নি। কিন্তু কাছ থেকে দেখে তাকে কোনো স্টুডেন্ট বলে একদম মনে হচ্ছিলো না। পড়নে ব্ল্যাক সুট, টাই হাতে রোলাক্স ঘড়ি, চুল গুলো পরিপাটি করে একপাশে গোছানো। টিপ টপ নাক। মুখে এক টুকরো ঝুলানো হাসি। যাতে ডিম্পল দুটো স্বগৌরভে ফুটে উঠেছে। একটা মন মাতানো সুগন্ধ ভেসে আসছে ওর কাছ থেকে।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here