আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -২০

0
1869

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ২০
———————————————–
লিও সবাইকে এক সাথে নিয়েই কেক টা কাটলো। প্রথম কেকের টুকরো টা সে তার পাশে দাড়ানো মধ্য বয়স্ক মহিলা কে খাইয়ে দিল। আমার অনুমান মিথ্যা না হলে ওই মহিলা টি লিওর মা হবে। কেননা ভদ্র মহিলার সাথে লিওর চোখ হুবহু মিল। দুজনের চোখই উজ্জ্বল ধুসর। তবে লিওর চোখ কিছুটা ধারালো। ভাবতে ভাবতেই আমার ফোন টা বেজে উঠলো। কথা স্পষ্ট না হওয়ায় শোর গোল থেকে দূরে চলে আসলাম। ইভিলিন কল করেছে হোস্টেল থেকে। ওর সাথে কথা শেষ করে পিছে ফিরতেই একটু চমকে গেলাম। লিও এক টুকরো কেক নিয়ে আমার পিছে দাড়িয়ে আছে। আমাকে চমকাতে দেখে এক টুকরো দুষ্টু হাসি দিল। আমি বুকে থুথু দিলাম।
“লিও! তুমি তো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে!”
সে একই ভাবে হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে বলল
“আমাকে উইশ করবেনা মিইইইরা!”
কিছুক্ষন আগে ইভিলিনের সাথে কথা বলে আমার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু লিওর কথা শুনে সেটা ভালো হয়ে গেল। একটু হেসে বললাম
“হ্যাপি বার্থ ডে লিও। দোয়া করি তুমি আরো বড় হও আর তোমার মনটা যেন এমনি পরিষ্কার থাকে। কোন কিছুই যেন তাকে কলুষিত করতে না পারে।”
আমার কথা শুনে আতঙ্কিত হওয়ার ভান ধরল। তারপর বলল
“ওহ শীট! এত্তো বড় উইশ!”
“লিও!”
আমি চোখ বড় বড় করে ফেললাম। সে হাসতে হাসতে আমার দিকে কেকের টুকরো টা এগিয়ে নিয়ে এলো। আমি ওর হাতেই একটু খেলাম। চকলেটের হওয়ায় বেশি খেলাম না দাঁতের ব্যাথার কারনে। তাই টুকরো টা রেখে দিচ্ছিলাম। কিন্তু লিও ঝট করে আমার হাত ধরে ফেলল। আমি ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকালাম।
“আমাকে খাইয়ে দিবেনা?”
“আমার হাতে? চলো ওখান থেকে নিই!”
“উহু! এই টা দাও!”
“হো-হোয়াট নো লি-লিও! এটা আমার খাওয়া! এটো!’
“তাতে কি?”
এ বলে লিও আমার হাত থেকে জোর করে মুখ লাগিয়ে কেক টা খেয়ে নিলো। ওর ঠোটের স্পর্শ টা আমার আঙ্গুলে পড়তেই আমি কেঁপে উঠলাম। তাড়াতাড়ি হাত নিয়ে ফেললাম। ওর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই এ ব্যাপারে। হয়তো আমি বেশিই ভেবে ফেলছি। আমাকে মাথা থেকে সব ফেলতে হবে।
হাতটা তুলে দেখলাম। এখনো একটু করে চকলেট লেগে আছে। লিও কেক টা খেতে খেতে আমার দিকে তাকালো
“আরে চকলেট তো এখনো লেগে আছে। দাও আমি খেয়ে ফেলি।”
এ বলে সে হাত বাড়িয়ে আমার হাত টা ধরতে চাইলো। ও কি করতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে ঝট করে আমার হাত টা সরিয়ে পিছু সরিয়ে ফেললাম। আমার শরীর টা থর থর করে কাপছে। আর কিছুক্ষন যদি আমি লিওর সামনে থাকি তাহলে নির্ঘাত বেহুশ হয়ে যাবো।
আমাকে হাত নিয়ে নিতে দেখে লিও কিছুটা মনঃক্ষুন্ন হল। সে বলতে লাগল
“দাও না মিইইইরা!”
“আ-আমি হাত ওয়াশ করতে যাচ্ছি”
আর কিছু বলতে পারলাম না। দৌড় দিলাম ওয়াশ রুমের দিকে। শরীর টা এখনো থর থর করে কাপছে। শরীর টা এত কাপছে কেন? কেন এত গরম লাগছে? আগে তো কখনো এমন হয়নি!
ট্যাপ খুলে এক নাগাড়ে পানি শুধু মুখে দিতে লাগলাম।
ওয়াশ রুম থেকে বেড়িয়ে সবার নজরে আড়ালে থাকার চেষ্টা করছি। মাঝে মাঝে এডালিন বা রিচা কে জিজ্ঞেস করছি পার্টি শেষ কখন হবে?
সবাই কত আনন্দ করছে। কেক মেখে একে অপর কে ভাল্লুক, উল্লুক হয়ে আছে। সবাই লাফা লাফি করছে, কেউ ডানস করছে, কেউ বা শুধু মাত্র এক কোনে দাড়িয়ে সিজার পান করছে। আমি বসে আছি একটা সোফাতে। আমার পাশে বসে আছে কয়েকজন বৃদ্ধ কাপল। বয়সের ভারে তারা এখন কিছুই করতে পারে না। তাই বসে বসে সব দেখছে আর হয়ত স্মৃতি চারণ করছে। অদূরে টিনা আর ওই মধ্য বয়স্ক মহিলার সাথে হাসাহাসি করছে।
আমি ম্যাপল সিরাপ হাতে নিয়ে বসে বসে সময় গুনছি। এখান থেকে একা যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই অপেক্ষা করছি কখন পার্টি শেষ হবে।
.
বেশ কিছুক্ষন পর আমার ডান কাঁধে টোকা পড়লো। আমি ডান দিকে তাকাতেই আবার বা কাঁধে টোকা পড়লো। বাঁ কাধে টোকা পড়তেই বাঁ দিকে তাকালাম। কিন্তু কেউ নেই। কি হচ্ছে বুঝতে পেরে দাড়িয়ে গেলাম। পিছন ফিরে দেখলাম লিও দাড়িয়ে আছে। মনে মনে বুঝতে পেরেছিলাম লিওই হবে।
“হোয়াট হ্যাপেনড মিইইইরা? আমি তোমাকে খুজে বেড়াচ্ছি। আর তুমি এখানে বসে আছো?”
একটু হাসার চেষ্টা করলাম
“নাথিং লিও! এ-এমনিই বসে আছি!”
ভ্রু কুচকে সন্দিগ্ন চোখে লিও আমাকে বলল
“তুমি কি কোন রকম ভাবে আমাকে ইগনোর করতে চাইছো মিইইরা?”
“নো নো লি-লিও! আ-আমি তোমাকে ইগনোর করছিনা। শু-শুধু একটু ক্লান্ত হয়ে গেছি।”
“ওহ আচ্ছা ঠিক আছে।”
“হুম”
“মিইইরা তোমাকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। চলো আমার সাথে!”
“কার সাথে?”
কথাটা মনে হয় লিও শুনলো না। সে নিজেই বলে আমার হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগলো। আমার জবাবের অপেক্ষা করলো না। লিও আমাকে নিয়ে গেল সেই মহিলার সামনে। যাকে আমি লিওর মা ভেবেছিলাম।
ওই মহিলার কাছে নিয়ে যেতেই আমি দর দর করে ঘামতে শুরু করলাম।
“মম!”
সত্যিই তাহলে ইনি লিওর মম। আমি একটা ঢোক গিললাম। ভদ্র মহিলা আমাদের দিকে ফিরলেন। দূর থেকে যতটা মধ্য বয়স্ক মনে হচ্ছিলো সামনে থেকে তেমন মনে হচ্ছে না। এ বয়সেও যথেষ্ট ফিট উনি।
“হ্যা-হ্যালো!”
আমি ভদ্রতার খাতিরে হাসার চেষ্টা করলাম।
লিওর মম আগা গোড়া আমাকে দেখলো। উনি এভাবে আমাকে দেখছিলেন যে আমার মনে হচ্ছিলো সবার সামনে আমি ন্যাংটো দাড়িয়ে আছি। নার্ভাস হয়ে গেলাম।
“মম… মিট মিইইরা। যার কথা তোমাকে বলেছিলাম।”
তারপর লিও আমার দিকে তাকিয়ে বলল
“মিইইরা এ আমার মম।”
লিওর মা এখনো কিছু একটা দেখছে। উনার নজর ফলো করতে গিয়ে দেখলাম উনি আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার হাত লিও তখনো মুটো করে ধরে রেখেছিল। আমি তাড়াতাড়ি লিওর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলাম। ভ্রু কুচকে লিওর মম আমার দিকে তাকালো। তারপর একটু করে হাসি দিয়ে বললো
“কেমন আছো মেইইরা?”
এরা আমার নাম টাকে যাচ্ছে তাই বলে গুলিয়ে ফেলছে। তবুও মুখে হাসি টেনে বললাম
“আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
“আমি সবসময় ভালো থাকি!”
“ওহ্ আচ্ছা!”
“তুমিই তাহলে লিওর স্টুডেন্ট?”
“জি!”
“এর বেশি কিছু নাতো!”
“মা-মানে?”
আমি লিওর দিকে তাকালাম। কি বলছে বুঝতেছিনা। লিওর আমার তাকানো দেখে তার মম কে ডাকলো
“মম!”
“আমি একটু মজা করছি মাই ডিয়ার সান।”
.
লিও কে তার এক ফ্রেন্ড ডেকে নিয়ে গেল। আর আমি ফেসে গেলাম লিওর মমের সাথে। উনি থানার দারোগার মত আমাকে প্রশ্ন করতে লাগলো। আমি কোথ থেকে এসেছি, বাবা মা কোথায়, কি করে, এখানে কেন এসেছি, লিওর সাথে কিভাবে পরিচয়, লিও কে কেমন লাগে, কারো সাথে রিলেশন শীপে আছি কিনা?
সোফাতে লিওর মমের পাশে বসে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম আর পানি খেয়ে পেট টাকে ঠাসা করছিলাম। না জানি কখন ছাড়া পাবো?
.
পার্টি যখন শেষ হল প্রায় মাঝ রাতে। বেশির ভাগ গেস্ট চলে গিয়েছিল। হৈ হুল্লোর ঠান্ডা হয়ে এসেছিল। যারা ছিল তারা সবাই আমাদের মতোই। যে যেদিকে পারে শুয়ে যাচ্ছিলো। আমারো প্রচুন্ড ঘুম আসছিলো। লিওর মমের হাত থেকে ছাড়া পাবার পর থেকে ঝিমুচ্ছিলাম। ঘুমানোর জায়গা পাচ্ছিলাম না। বাই চান্স যদি বেড পাইতাম তাহলে শুয়ে পড়তাম। কিন্তু এত গুলো অপরিচিত মানুষের সামনে কিছুই করতে পারছিনা। বার বার হাই তুলছি। মনে করেছিলাম চলে যাবো। কিন্তু রিচা কে এক কোনে শুয়ে পড়তে দেখে আমি অবাক হলাম। তাড়াতাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
“রিচা তুমি ঘুমাচ্ছো কেন? এখান থেকে চলে যাবে না?”
সে ঘুমন্ত স্বরে বলল
“মাঝ রাতে কোথায় যাবে টামিনাহ? ঘুম আসলে এখানে শুয়ে পড়।”
সে তার সামনে সোফা দেখিয়ে দিল।
“আমি এখানে শোব?”
“সমস্যা কি? ঘুমায় পড়। কাল মর্ণিংয়ে কথা হবে। গুড নাইট।”
আমি দমে গেলাম। সত্যি এখানে শুতে হবে?
চারপাশে তাকালাম। এখনো কয়েকজন ফুর্তি করছে। লিও তাদের মধ্যেই আছে। কোনো ক্লান্তির ভাব নেই চেহারা তে।
অনেক গাইগুই করে ঘুমের সাথে যুদ্ধ করে হেরে গেলাম। চুপচাপ গুটিসুটি মেরে সোফা তে বসে পিছনে মাথা এলিয়ে দিলাম। আহ্ কি শান্তি! আসলে নিদ্রার সম্রাটের সাথে যুদ্ধ করাই উচিত না। কোন না কোনো ভাবে সমঝোতা করে ফেলা উত্তম। তাতে নিজেরই মঙ্গল। বিনিময়ে প্রশান্তির একটা ঘুম পাওয়া যাই।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here