Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৪৮
———————————————–
“রিদো ক্যানেল!”
“হুম। রিদো ক্যানেলে প্রতি শীতকালে পানি জমে এরকম টা হয়। পুরো ক্যানেল টা একটা সাদা বরফের রোডে পরিণত হয়। তখন দেশ বিদেশ থেকে পর্যটক রা ভীড় জমায়।”
আমি বিস্ময়ের সাথে আবার সামনে তাকালাম। এটা ক্যানেল? মানে খাল? আমার মাথা ঘুরানোর মত হয়ে গেল। এর আগে আরো কত বার এসে এ খাল টা দেখে গিয়েছি। আর আজ দেখছি পুরোটাই একটা রোড হয়ে আছে। সেটার উপর সবাই খেলছে, দৌড়াচ্ছে, স্কেটিং করছে। ঝাকে ঝাকে লোক আসছে এটা কে দেখার জন্য। এতবড় চমক! আমি আবার লিওর দিকে তাকালাম। তার মুখে এখনো এক টুকরো ঝুলন্ত হাসি। সে আমার বিস্মিত চেহারা কে উপভোগ করছে।
“চলো!”
সে হাত ধরে ধীরে ধীরে ক্যানেল টাতে নামালো। আমি একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম। যদি বরফ ভেঙে নিচে ঢুকে যায়? কিন্তু না! তেমন কিছু হলো না। লিও কার্টনের প্যাকেট গুলো খুলে ফেলল। সেখান থেকে বেরুলো দু জোড়া স্কেটিং বোর্ড! আমি অসহায় চোখে লিওর দিকে তাকালাম। বললাম
“আমি স্কেটিং পারি না।”
“ইটস ওকে। আমি তো আছি।”
সে স্কেটিং বোর্ড গুলো আমার পায়ের সাথে ফিট করিয়ে দিতে লাগল। আমি দেখতে লাগলাম ওর কান্ডকারখানা।
“আমি তো চালাতে পারি না!”
“আমি শিখিয়ে দেব!”
“এটা পড়ে যদি আমি হোচট খাই?”
“আমি ধরে রাখব।”
“তারপরও পড়ে গেলে?”
“আবার উঠতে সাহায্য করব!”
“যদি ব্যাথা পাই, হাটতে না পারি?”
স্কেটিং বোর্ড ফিট করে লিও উঠে দাড়ালো। কোমড়ে হাত চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল
“তাহলে…?”
“বল! তাহলে কি?”
ঠোটের কোনে হাসির আভাস দিয়ে একটু এগিয়ে আসলো।
“তাহলে!”
ঝট করে লিও আমাকে কোলে তুলে ফেলল। আমি চমকে উঠলাম।
“লি-লিও!”
সে হাসতে হাসতে জবাব দিল
“তাহলে কোলে তুলে নিব!”
আমি হেসে দিলাম ওর কথা শুনে। লিও আমাকে ক্যানেলের সুবিধা জনক স্থানে আস্তে করে নামিয়ে দিল। তারপর দু হাত শক্ত করে ধরলো। আমি পায়ের দিকে তাকাতে তাকাতে বললাম
“লি-লিও আমি পড়ে যাব!”
“পড়বে না। সামনে তাকাও। পায়ের দিকে না।”
আমি ভয়ে ভয়ে লিওর দিকে তাকালাম। অমনি সাৎ করে কেউ একজন স্কেটিং বোর্ড চালিয়ে গেল। সে সাথে উইশ জানিয়ে গেল আমাকে। যাতে দ্রুত শিখতে পারি।
“এবার পা টাকে এভাবে নাড়াও!”
আমি লিওর কথা মত করতে লাগলাম। প্রায় আধা ঘন্টা লিও আমার পিছনে ঘাম ঝড়ালো। তারপর টুপ করে ছেড়ে দিয়ে কয়েক ফুট দূরত্বে দাড়িয়ে গেল। এদিকে স্কেটিং বোর্ডে দাড়িয়ে নড়তে পারছিনা। ভয়ে চিল্লাতে চিল্লাতে বললাম
“লিও আমি পড়ে যাব। আমাকে ধর!”
কিন্তু লিও ধরলো না। সে তার জায়গায় দাড়িয়ে বলতে লাগল
“আমি যাব না তোমার কাছে। তুমি আসো!”
“আমি পারবোনা!”
“ঠিক আছে। তাহলে আমি চলে যাচ্ছি।”
এই বলে লিও চলে যেতে লাগলে আমি তাড়াতাড়ি বললাম
“যে-যেও না। আ-আমি আসছি।”
বলে এক পা এগুলাম আর অমনি ধপাস করে নিচে পড়ে গেলাম। লিও হাসতে হাসতে আমাকে তুলল। বললাম
“আমি স্কেটিং শিখবোনা। আমি স্কেটিং শিখবোনা!”
এরপর লিও নিজের পায়ে লাগিয়ে আমাকে দেখালো। আমি বসে বসে দেখতে লাগলাম। সে কি সুন্দর স্কেটিং করতে পারে! খুশিতে হাত তালি দিয়ে উঠলাম।
এবার আবারো আমার পালা। আমি প্রায় কেঁদে কেটে বলছি আমি স্কেটিং শিখবোনা। আমাকে রেহাই দাও। কে শোনে কার কথা। দুপায়ে স্কেটিং বোর্ড লাগিয়ে লিও বলল
“এগুলো তোমার পায়ে বেশি মানান সই। কেমনে না শিখে থাকতে পারবে? শিখতেই হবে।”
আমি তখন ও ফোপাচ্ছি। ফোপানির চোটে কয়েক ফোট অশ্রুও গড়িয়ে পড়লো। পায়ে স্কেটিং বোর্ড গুলো লাগানো। দু হাতে শক্ত করে লিওর হাত ধরে আছি। যাতে এবার আমাকে ধোকা দিয়েও সরে যেতে না পারে।
“লি-লিও আমি পড়ে যাবো!”
“শসসসসহ… পা টা এদিকে ঘোরাও। ঠিক এভাবে।”
লিও তার পায়ের দিকে ইশারা করে দেখাচ্ছিলো। যাতে ওর পা ফলো করে হাটতে পারি।
এক পা দু পা করে হাটছি ফলো করে। এ দুপা এক পা হাটতে আমার ঘাম ঝড়ে যাচ্ছে। শীত পুরোটাই উবে গিয়েছে শরীর থেকে। মনে হচ্ছে নতুন করে হাটা শিখছি। ঠিক যেভাবে বাচ্চারা প্রথম বার হাটা শিখে। লিও বলল
“আরেকটু জোরে হাটো মিইইরা। তুমি জোরে হাটলে বরফ গুলো ব্যাথা পাবে না।”
এবার লিওর কথা শুনে একটু জোরে পা চালালাম। টালমাটাল নিজেকে ধরে রাখতে লিও কে আরো শক্ত করে ধরলাম। কিন্তু জায়গা এতটাই পিছলে ছিল যে আমাকে সামলাতে পারলো না লিও। ধপাস করে লিও পড়লো। তার গায়ের উপর আমি। এ দৃশ্য যাতে দেখতে না হয় তাই দাঁত মুখ খিচে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
দুপ করে কিছু পড়ার আওয়াজ হল। তারপর কয়েক সেকেন্ড পিনপতন নিরবতা। কোন আঘাত পেলাম না। কারন আমি নরম কিছু একটার উপর ভর দিয়ে আছি। কি হয়েছে সেটা দেখার জন্য একটু করে চোখ খুললাম। দেখতেই ছোট খাট একটা ভিরমি খেলাম। আমার কয়েক গাছি বাধ্য চুল অবাধ্য হয়ে স্কার্ফের ভিতর থেকে বেড়িয়ে সোজা লিওর নাকে প্রবেশের আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। আর লিওর নাক বেচারা চুল গুলোকে ভীষন ভাবে বাধা দিচ্ছে। লিওর হাত এখানে কোনো সহায়তা করতে পারছেনা। কারন হাত দুটো আমাকে ধরে রাখার কাজে ব্যস্ত। সুতরাং নাক আমার চুল কে বের করে দেয়ার জন্য হাঁচি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওর ইয়া বড় হা দেখে আমি তাড়াতাড়ি চুল সরিয়ে নিলাম। লিও আর হাঁচি দিল না। চোখ টা খুলল। করুন অবস্থা তার। এ করুন অবস্থার জন্য তার চোখ শোক পালন করছে। প্রায় টলটলে চোখের পানি হয়েছে। আমি কাতর স্বরে বললাম
“জা-জায়গা টা এ-একটু পিছলা। তা-তাই পড়ে গেলাম।”
লিও জবাব দিল না। শুধু নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে মাথা নাড়িয়ে নাকে একটু ঝাঝড়ি দিল। আমি আবার বললাম
“স্যরি!”
“মিইইরা!”
“হা!”
“তুমি কি উঠবে? নাকি সারাদিন আমাকে এভাবে চেপে মেরে ফেলবে?”
“আমি…”
কোথায় আছি চারপাশ টা একটু দেখলাম। দেখে তাড়াতাড়ি উঠে গেলাম।
উঠে আবার বললাম
“স্যরি!”
লিও উঠলো না। ওই খানে শুয়ে নাক টানতে লাগল। আর বেশি অপেক্ষা না করে ঝট করে একটানে লাফিয়ে উঠে গেল। এরপর কোমড়ে হাত দিয়ে এদিক ওদিক হাটতে লাগলো। আমি একটা ঢোক গিলে ওকে মানানোর জন্য বললাম
“আ-আমি ঠিক মত শিখবো।”
লিও জবাব দিল না। আগের মতই হাটতে লাগলো। আমি হাতের মুটোয় হাত নিয়ে মোচরাতে লাগলাম। কি করব? করুন স্বরে লিও কে ডাকলাম
“লি-লিও?”
নো রেসপন্স…
“আমি এবার পারবো। তু-তুমি দেখিও।”
লিও আমার দিকে ফিরলো। কাছে চলে এল। অনূভুতি শূণ্য চেহারা। সেখানে আমার জন্য কোনো রাগ দেখলাম না। শুধু একরাশ চঞ্চলতা খেলা করছিল চোখের মধ্যে। আমি বুঝতে না পেরে তাকে ডাকলাম
“লি-লিও?”
তখনো আমার পায়ে স্কেটিং বোর্ড গুলো ছিল। তাই নিজের ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটু করে ওর গায়ের জ্যাকেট টা আকড়ে ধরলাম।
লিও আমাকে অবাক করে দিয়ে ওর দু হাতের মুটোয় আমার মুখ টা ধরলো। বলল
“মিইইরা!”
অতঃপর ভয়ঙ্কর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল
“আমি কি করবো?”
একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম আমি। ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলাম
“কি-কি হয়েছে? কোন সমস্যা?”
“হ্যা সমস্যা! আর সমস্যার মূলে হচ্ছে তুমি!”
“আ-আমি?”
“কারন আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
এটা বলে লিও হুট করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি ভীষন চমকে গেলাম। তাৎক্ষনিক ভাবে আমার মাথা শূণ্য হয়ে গেল। কি করবো তাও ভেবে পাচ্ছি না। লিও হালকা একটা ঝাকুনি দিল। এর মানে শুধু একটা। তাকেও জড়িয়ে ধরা। আমি আলতো করে ওর পিঠে হাত রাখলাম। ও ফিসফিসিয়ে আমার কানে বলল
“আমি দুঃখিত। অনেক বড় একটা সিগ্ধান্ত আমি নিয়ে ফেলেছি। কিন্তু তোমাকে সেটা মানতে হবে।”
লিও আমাকে ছেড়ে দিয়ে শুধু এক হাত ধরে দাড়ালো। আমি শঙ্কিত চোখে লিওর দিকে তাকালাম। লিও আরেকটু দূরে দাড়ালো। সেখানে এক হাটু গেড়ে বসে গেলো। আমি চমকে গেলাম। সে কি আমাকে প্রপোজ করবে? কিন্তু সে তো আগেই আমাকে প্রপোজ করেছে। এখন কি করতে চাই? চোখে একরাশ কৌতুহল নিয়ে লিও কে দেখছি। ওর ডান হাত পিছন থেকে সামনে বাড়িয়ে ধরলো।
“Will you marry me?”
আমি হা করে লিওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হচ্ছে মাথা হ্যাং হয়ে গেছে। তার হাতে ছোট্ট একটা কৌটা। সেই কৌটায় আরো ছোট্ট একটা আংটি। ভীষণ জ্বলজ্বল করছে সেটা। লিও হাত ধরাবস্থায় হালকা ঝাকুনি দিল।
“Say Yes…!”
ওর হালকা ঝাকুনিতে পা নড়বড়ে হয়ে গেল। আমি ওর বাম হাত কে আরো শক্ত করে ধরলাম। আমি কাপঁছি। শীতে নাকি উত্তেজনায় বুঝতে পারলাম না। এই ছোট্ট একটা বাক্যে এত শক্তি? কেউ একজন চিৎকার করে বলল
“Hey fool girl… say yes!”
আরেক জন বলল
“He wants to marry you… say yes!”
চারদিকে সবাই স্কেটিং বাদ দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আর উৎসাহ দিচ্ছে Say yes বলার জন্য। আমি ঢোক গিললাম। লিও আমাকে বিয়ে করতে চাইছে। এটা মনে করে আবার ঢোক গিললাম। গলাটা শুকিয়ে গেছে। কপালে ঘাম জমে গেছে। আমি নার্ভাস হয়ে পড়লাম। অসহায় চোখে লিওর দিকে তাকালাম। ওর চোখে একরাশ আকুতি। কিছু একটা ফিসফিসিয়ে বলছে। আমি জানি সে আমাকে অনুরোধ করছে yes বলার জন্য। আমি বলে দিলাম। কোন কিছু চিন্তা না করেই। সেই ছোট্ট শব্দটি।
“Yes Leo… I – I will.”
.
(চলবে)
.
আমার আরো একটা প্রিয় পার্ট ♥