আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -৪৯

0
1426

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৪৯
———————————————–
কয়েক সেকেন্ড পিন পতন নিরবতা। মুহুর্তে নিরবতা কে ভেঙ্গে দিয়ে করতালি তে চারদিকে মুখরিত হয়ে উঠলো। লিও লাফিয়ে উঠে আংটি টা আমার অনামিকায় পড়িয়ে দিল। তারপর একটু নিচু হয়ে হাটু জড়িয়ে ধরে আমাকে উপরে তুলে ফেলল। হুট করে তুলে ফেলায় একটু চমকে গেলাম। শক্ত করে লিওর কাঁধ ধরে ফেললাম। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল আমি আকাশে উড়ছি। চারদিকে হৈ হুল্লোর আর অভিনন্দনের ঝড় বইছে। মুহুর্তে আমার মন ভালো হয়ে গেল। রঙিন প্রজাপ্রতিরা পুরো শরীর জুড়ে উড়াউড়ি করতে লাগলো। মনের আনন্দে দু হাত উপরে তুলে দিলাম। যেন আমি আকাশ ছুতে চাইছি।
.
ধীরে ধীরে নেমে এলাম। আসমান থেকে জমীনে। লিও আমার হাত দুটো ধরলো। ঘোলাটে চোখ দুটো জ্বল জ্বল জ্বলছে। যেন আনন্দ উপচে পড়ছে। চেহারায় ভেসে উঠেছে উচ্ছাস। গিরিখাদ দুটো কে মনে হল সদ্য খোড়া ভালোবাসা। সেখানে প্রেমের জল যেন উপচে পড়ছে। সে একরাশ উষ্ণ ভালোবাসা নিয়ে বললো
“Thank you mira. Thank you so much! And you know what? Today I am the most happiest man in the world.”
আমার গাল এমনিতেই লাল টমেটো হয়েছিলো। লিওর কথা শুনে পুরো শরীর টা মৃদু কাঁপতে লাগলো। ওর হাতের পিঠে আলতো করে চুমু দিয়ে ফিস ফিস করে বললাম
“And I am the most happiest woman in the world… ha ha ha!”

.
গাড়ি অটোয়া কে পিছনে ফেলেছে অনেক আগে। উইনিপেগ থেকে আমরা বেশি দূরে নেই। চারদিকে হালকা সোনালি রোদ দেখা যাচ্ছে। শীত এসেছে পর্যন্ত আমি সোয়ালো পাখির দেখা পাই নি। তবে দূরে একটা গাছে বাল নাকুটি পাখি দেখলাম। হয়ত দেশ ছেড়ে, নিজের ঘর সে ছেড়ে কোথাও যেতে চায় নি।
লিও এক মনে ড্রাইভিং করছে। চোখে মুখে উজ্জ্বল দ্যুতি। আর আমি বাইরের প্রকৃতি দেখছি। আজ কে সূর্য উঠায় চারদিকে যেন আনন্দের ঝিলিক। সবাই এক সাথে বেড়িয়েছে। কেউ বাড়ি ঘর পরিষ্কার করছে, কেউ তাদের গাড়ি পরিষ্কার করছে। কোথাও কোথাও মিউনিসিপ্যালিটি থেকে লোক এসে রাস্তা পরিষ্কার করছে। আমি লিও কে ডাকলাম
“লিও?”
“হুম?”
লিও আমার দিকে না তাকিয়ে জবাব দিল
“আমার ওই গান টা শুনতে খুব ইচ্ছা করছে।”
“কোন গান টা?”
“যে গান টা আমরা প্রথম এক সাথে শুনেছিলাম!”
“ব্রোকেন এঞ্জেলের?”
“নাহ্!”
“ফল ইন নাইট?”
“নাহ্! ভালো করে ভেবে দেখ।”
লিও কিছুক্ষন ভাবল। কিন্তু পরক্ষনেই তার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। বলল
“I know what is it!”
এরপর সে নিজের ফোনেই কিছু একটা স্ক্রল করে লাউড স্পিকারে গান টা দিল।
.
You’re the light, you’re the night
you’re the color of my blood
you’re the cure, you’re the pain
you’re the only thing I wanna
touch

You’re the fear, I don’t care
cause I’ve never been so high
follow me to the dark
let me take you past our
satellite

You can see the world
you brought to life
to life

So love me like you do
Love love love me like you do
Touch me like you do
Touch touch touch me like you do
What are you waiting for
.
আমি আবার কোথাও হারিয়ে গেলাম। সে একই ইংলিশ গান টা বাজছে। আমার পুরো মুখস্ত হয়ে গেছে সেটা। মুখে মুখে গান টা আওড়াচ্ছি। আর বাইরে তাকাচ্ছি।
সোয়ান লেক ফেলে এসেছি কিছুক্ষন আগে। এখন ঝিকঝাকিং মহাসড়ক দিয়ে ঘন উত্তরীয় বনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। সামনেই সিগনেট লেক রোড মিলিত হয়েছে। এ রোড দিয়ে ক্যারিবু জল প্রপাত বা হোয়াইট ডগও যাওয়া যায়।
সিগনেট লেক রোডের দিকে একটা মোড় আসায় লিও গাড়ি স্লো ডাউন করলো। একটা পার্ক দেখা গেল। পার্কে দুজন বাচ্চা কে দেখলাম। তারা দুজনে খেলছে। কিন্তু আমার কেমন যেন চেনা চেনা মনে হল। এরা….!
কিছুক্ষন মাথা খাটাতেই চিনতে পারলাম। জ্যাক আর জিল!
আমি লিওর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলাম
“স্টপ…স্টপ!”
লিও চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি গাড়ি ব্রেক করে জিজ্ঞেস করল
“কি হলো?”
আমি চিৎকার দিয়ে বাইরে ইশারা করে বললাম
“জ্যাক আর জিল!”
এ বলে দরজা খুলে বেড়িয়ে এলাম। লিওর জবাবের জন্য অপেক্ষা করলাম না। কিন্তু সে কয়েকবার পিছন থেকে ডাক দিল। শুনতে পেয়েও পিছনে তাকালাম না। দৌড়ে পার্কের দিকে ছুটে গেলাম। গিয়ে জ্যাক আর জিল থেকে একটু দূরে থামলাম। ওরা তুষার দিয়ে কিছু একটা বানানোর চেষ্টা করছে। আমি ডাক দিলাম
“জ্যাক!”
ডাক দিতেই দু ভাই বোন আমার দিকে তাকালো। তারপর তারা একে অপরের দিকে তাকালো। বোধ হয় আমাকে চেনার চেষ্টা করছে। জিল আগে চিনতে পারলো। সে চিনেই চিৎকার দিল
“মিইনা!”
আমি হেসে দিলাম। দু ভাই বোন এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
“কেমন আছো তোমরা?”
“ভালো তুমি!”
“ভালো তবে তোমাদের বেশ মিস করেছি! আমি গিয়েছিলাম তোমাদের ওখানে। তোমরা নাকি কোথাও গিয়েছো। সে জন্য আর দেখা হয় নি।”
জ্যাক আর জিল বেশ বড় হয়েছে। জ্যাক কে দেখে মনে হয় বড় হলে বেশ সুদর্শন পুরুষ হবে।
এরই মধ্যে লিও দৌড়ে পিছনে এসে দাড়ালো। হাঁপিয়ে উঠেছে সে। বলল
“এরা কারা?”
“লিও… তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিই। এরা আমার বন্ধু। এ জ্যাক।”
জ্যাক হাই বলল।
“আর এ হচ্ছে জিল!”
“হ্যালো!”
লিও বলল
“তোমাদের সাথে পরিচিত হতে পেরে ভালো লাগলো জিল আর জ্যাক!”
.
আমরা বেশ খানিকক্ষন সময় জ্যাক আর জিলের সাথে কাটালাম। ওদের পিতা মাতা দুজনে এখানে ছিল। তাদের সাথেও দেখা করলাম। আবহাওয়া ভালো থাকলে তারা মাঝে মাঝেই এ পার্কে চলে আসে। পার্কের পাশেই তাদের শীতকালীন বাড়িটা আছে।
জ্যাক আর জিলের সাথে বড় বড় কয়েকটা পুতুল তৈরি করলাম, তুষার ছোড়াছুঁড়ি করলাম। বড় বড় কয়েকটা ঘরও তুললাম। এত মজা করলাম যে আমার মনে হল এটা আমার জীবনের সেরা একটা দিন হিসেবে স্মৃতি হয়ে থাকবে। লিও অবশ্য এসব পাগলামী তে অংশ গ্রহন করেনি। সে পার্কের বেঞ্চিতে বসেই ছিল। আর এসব দেখছিলো।
আসার সময় আমার একটু কষ্ট হচ্ছিল। কারন আমার জানা ছিল না ওদের সাথে আর কখনো দেখা হবে কিনা। কারন আমার গ্র্যাজুয়েশন সমাপ্তির দিকে। দ্রুত আমাকে বাংলাদেশে ফিরতে হবে।
সেটা ভাবতেই কলিজায় তীক্ষ্ণ একটা ব্যাথা অনুভব করলাম। সজল চোখে বিদায় জানালাম জ্যাক আর জিল কে। জ্যাকও মুখ কালো করে ছিল। তবে জিল ভেউ ভেউ করে কেঁদে দিল। আমার যেতে ইচ্ছা করলো না। তবে যেতে যেতে সন্ধা হয়ে আসবে সে ভয়ে লিও আমাকে টেনে নিয়ে আসলো।
.
খারাপ লাগছিলো অনেক। সেই সাথে ক্লান্তি ভর করলো পুরো শরীরে। লিও আমার সাথে কথা বলারও চেষ্টা করলো। কিন্তু আমার ভালো লাগছিল না। মাথা এলিয়ে দিলাম সিটে। আমাকে মাথা এলিয়ে দিতে দেখে গাড়ি থামিয়ে দিল। একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে বললো
“তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? ডাক্তারের কাছে যাবে?”
“নাহ্! তেমন খারাপ লাগছে না। শুধু একটু মাথা ধরেছে।”
“কফি নিবে? আনবো?”
“নাহ্!”
“তোমার কি চাই? কিছু তো বলো!”
আমি লিওর দিকে তাকালাম। না জানি ভবিষ্যৎ কেমন হতে চলেছে? যেরকমই হোক ভবিষ্যত! আমি চাই না লিও কখনো কষ্ট পাক। সে আমাকে খুব ভালোবাসে। এ কয়েক বছরে আমি বহু প্রমাণ পেয়েছি।
একটু স্মিত হেসে বললাম
“লিও আমার কিছু চাই না। শুধু দ্রুত ফিরতে চাই। তুমি চলো।”
সে বিশ্বাস করতে চাইলো না। তবুও আমার জোড়াজুড়ি তে সে গাড়ি স্টার্ট দিল।
আমি আবার বাইরে তাকালাম। লিও শার্সি টা তুলে দিল। আমি কিছু বললাম না। সারা শরীর কেমন যেন বিশ্রাম চাইছে। স্কেটিং করায় পায়েও হালকা ব্যাথা ছিল। গাড়ির দুলুনিতে চোখে তন্দ্রা নেমে এলো। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
.
আমার মাথায় কেউ আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বুড়ো আঙ্গুলের স্পর্শ টা কপালে অনুভব করছি। ক্যামেলিয়ার একটা হালকা সুবাস চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে। চারদিকে একটা উষ্ণতা আমাকে ঘিরে আছে। মনে হচ্ছে একটা উষ্ণ আবেষ্টনী আমাকে ঘিরে আছে। একটু নড়াচড়া করলেই যেন সেটা ছুটে যাবে। তাই নড়াচড়া না করে আস্তে করে চোখ খুললাম। খুলতেই এক জোড়া ধুসর ঘোলাটে চোখ নজরে এলো।
“Good evening mira!”
ঘুম জড়ানো কন্ঠে একটু হেসে আস্তে করে বললাম
“আমরা কি এসে গেছি?”
“হুম!”
পিন পতন নিরবতা নেমে এলো আমাদের দুজনের মাঝে। কেউ কোনো কথা বলছে না। আমি লিওর বুকের শব্দটা বেশ স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছি। দুপ দুপ… দুপ দুপ। কেমন একটা ছন্দে বাজছে। ও আমার মাথার পিছন সিটে ভর দিয়ে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আর বাতাসে বাতাসে হৃদয়ের ভাষা গুলো প্রকাশ পাচ্ছিল। গুন গুন করে মনের প্রজাপ্রতিরা কি যেন কানাকানি করছে।
সন্ধা নেমে এসেছে চারদিকে। সেই সন্ধা সুন্দরী গাড়ির দরজায় ঠোকা মেরে বলছে
“উঠো প্রেমিক যুগল, আমি সন্ধা নেমে এসেছি। এটা আমার সময়। তোমাদের না।”
আমরা সন্ধার কথা কানে নিলাম না। তাই সন্ধা বাইরে ধোয়াসা অন্ধকার নামাতে পারলেও আমাদের মাঝে সন্ধা স্থান নিতে পারলো না। অনুভব করছিলাম। একে অপরের অস্তিত্ব কে।
লিও আমার বাম হাত টা তার হাতের মুটোয় ধরেছিল। সেটা আলতো করে তুলে চুমু খেল। আমি একটু করে হাসলাম। শুদ্ধ বাংলায় ফিস ফিস করে বললাম
“তুমি আমার তারা। ভিনদেশি তারা!”
লিও না বুঝেও যেন বুঝে নিল। কি বলছি আমি।
.
(চলবে)
.
আর বেশি পর্ব নেই। দ্রুত শেষ হয়ে যাবে #আমার_ভিনদেশি_তারা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here