Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৫
————————————————
আমি লিও শব্দটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। আর ওদিকে স্বর্গীয় দূত আমাকে এক নাগাড়ে ডেকে যাচ্ছে।
“Excuse me!”
” Hey flower girl!”
“Can you hear me?”
“Hello! What’s wrong with you?”
“Are you ok?”
শেষে জনাব স্বর্গীয় দূত আমার কোন জবাব না পেয়ে হাটুতে ভর দিয়ে খানিকটা নিচু হলেন। তারপর চোখের সামনে চুটকি বাজাতেই আমার হুশ ফিরে আসলো। কিছু না ভেবেই তার দিকে তাকিয়ে বললাম
“একটা লোক আমার পিছু পিছু আসছে।”
“What?”
“বলছি একটা লোক আমার পিছু পিছু আসছে”
“What? What are you saying? What kind of language this?”
এবার আমি সম্পুর্ন ভাবে জাগ্রত হলাম। নিজের দুনিয়ায় ফিরে আসলাম। আমি যে এখন বাংলাদেশে না, কেউ যে আমার ভাষা বুঝবে না তাও বুঝলাম। তাই ওই স্বর্গীয় দূত কে ইংরেজিতে বললাম
“Nothing”
আমি এখান কার স্থানীয় ভাষা জানিনা। যা জানি তা হচ্ছে ইংরেজি। তাও ভাসা ভাসা। মনে হচ্ছে এই ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাষাটাই চালাতে হবে।
অনেক ক্ষন ধরে মাটিতে বসে আছি। তাই হাত ভর দিয়ে উঠার চেষ্টা করতেই স্বর্গীয় দূত আবারো তার স্বর্গীয় হাত খানা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। আমি দ্বিধা গ্রস্ত হয়ে পড়লাম। বাংলাদেশ হলে আমি হাত না ধরলে ও কিছু মনে করতো না। কারন কোনো অপরিচিত পুরুষ চাইলেই কোনো মেয়ের হাত ধরতে পারে না। কিন্তু এখন কি হবে? বিদেশ বিভুয়ে যদি না ধরলে এটা অসৌজন্যতা হয়?
খানিকটা ইতস্থত করছিলাম হাত দিব কি দিবনা। আমি জানি না স্বর্গীয় দূত এত কি ভাবছে। আমি হাত দিতে ইতস্থত করছি দেখে চট করে আমার হাত টা ধরে এক ঝটকা টানে আমাকে টেনে তুললো। চমকে উঠলাম আমি। সেই সাথে হালকা মচকে যাওয়া পায়ে ব্যাথাও পেলাম। তবু ও সেই দূত কে ব্যাথা না দেখানোর জন্য একটু হাসলাম। তারপর পিছনে তাকালাম দেখার জন্য যে ওই লোকটা আর পিছু আসছে কিনা? নাহ! ওই লোকটা কে আর দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় পালিয়েছে। যাক ভালোই হল। সামনে ফিরতেই সেই দূত বলল
“বল আমি তোমাকে কি সাহায্য করতে পারি?”
আমি খানিকটা ইতস্থত বোধ করলাম। আমি চাইছিলাম যে কোনো ভাবেই প্রফেসর হুডের সাথে দেখা করতে। এড্রেস টা ও আমার কাছে আছে। কিন্তু একে বিশ্বাস করা কি ঠিক হবে?
কিছুক্ষন ভেবে বললাম
“আ-আমি প্রফেসর হুডের সাথে দেখা করতে চাই”
“এড্রেস?”
“এড্রেস টা…!”
আমি এদিক ওদিক তাকাতে লাগালাম। কারন এড্রেস টা আমার ব্যাগের মধ্যে। আর আমাকে ফেলে ব্যাগ টা যেন কোথাও লুকিয়েছে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে রাস্তার পাশ থেকে ব্যাগ টাকে উদ্ধার করলাম। সে ঝোপের আড়ালেই লুকিয়ে ছিল। তারপর ওখান থেকে ঠিকানা টা বের করে দিলাম। ঠিকানা দেখে সে কি ভাবলো আমি জানি না। তবে সে আমাকে বলল
“তোমার কি আমার সাথে যেতে কোনো সমস্যা আছে? কোনো কিছু মনে না করলে এ ঠিকানায় আমি তোমাকে নিয়ে যেতে চাই। এখন কোনো ক্যাব ও পাবে বলে মনে হয় না”
“ঠি-ঠিক আছে”
এ মুহুর্তে আমার আর কোনো পথ খোলা ছিল না। তাই যাকে আমি স্বর্গের দূত ভেবেছি তার সাথেই আল্লাহর নাম করে উঠে পড়েলাম।
সিট বেল্ট বেধেই আড়ষ্ট হয়ে বসে আছি। এমন কি ভালো করে তার চেহারার দিকে তাকায় নি পর্যন্ত। শুধু বার বার বাইরে তাকাচ্ছি। হয়ত সে আমার আড়ষ্টতা লক্ষ করেছিল। তাই নিজ থেকেই বলতে লাগল
“হেই আমার নাম উইলিয়াম এডওয়ার্ড। তুমি অবশ্য লিও বলতে পার। ওটা আমার নিক নেম। আর তোমাকে ফরেনার মনে হচ্ছে। কোথা থেকে এসেছো? তোমার নাম কি?”
টানা টানা কন্ঠে শুদ্ধ ইংরেজি তে লিও নামের ছেলেটি আমাকে জিজ্ঞেস করল। আমি জবাব দিলাম সামনের দিকে তাকিয়ে,
“বাংলাদেশ, তানযীব তাহমিনা”
“হোয়াট… ও ও টেনজি! কি বললে নাম?”
“তানযীব তাহমিনা”
“টেনিঝিব টামিনা?
“নো তানযীব…”
“ওয়েট! তোমার কি কোনো নিক নেইম নেই?”
“আছে”
“কি?”
“মীরা”
“মিইইইইরা!”
“নো মীরা”
“মিইইইরা?”
“নো নো মী….রা!”
“ওহ ওকে মিইইরা! নাইস নেইম”
আমি হাল ছেড়ে দিলাম। ওকে আর শুধরে দিলাম না। থাক! সাহায্যের বদলে এত টুকুই সহ্য করতেই পারি।
এরপর আবারো পিন পতন নিরবতা। আমি আবারো বাইরের দিকে দৃষ্টিপাত করলাম। উইনিপেগের রাতের দৃ্শ্যটা মনোমুগ্ধকর বলে মনে হচ্ছে। সুযোগ পেলে রাত দেখতে বেরুবো উইনিপেগের হাই ওয়েতে। আচ্ছা ওদের রাস্তা গুলো কি আমার দেশের রাস্তার মতই? নিশ্চয় না হবে!
ভাবছিলাম অনেক কিছুই। লিও নিঃশব্দ টাকে ভেঙে দিয়ে বলল
“হেই মিইইরা! একটা গান শুনবে? আমার খুবই প্রিয়।”
“তোমার ইচ্ছা”
.
.
You’re light, you’re the night
you’re the color of my blood
you’re the cure, you’re the pain
you’re the only thing I wanna
touch
–
You’re the fear, I don’t care
cause I’ve never been so high
follow me to the dark
let me take you past our
satellite
–
You can see the world
you brought to life
to life
–
So love me like you do
Love love love me like you do
Touch me like you do
Touch touch touch me like you do
What are you waiting for
.
লিও গান ছেড়ে দিল। ইংলিশ গান। কয়েক বার শুনেছি। কিন্তু কখনো ঠিক মত উচ্চারন করতে পারি নি। ইংরেজি তে দূর্বল আমি। তাই টানা ইংলিশে কি গাইছে বুঝতেই পারিনি। শুধু একটা লাইন মাঝ খানে কোন ভাবে বুঝতে পারি। সেটা হচ্ছে love me like you do। কিন্তু লিও গান টার সাথে মুখ নেড়ে নেড়ে গাইছে। যেন খুব উপভোগ করছে। চোখ সরিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিলাম।
দেখতে দেখতেই একটা দোতালা বাড়ির সম্মুখে উপস্থিত হলাম। ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। তবে বাল্বের আলোতে যথেষ্ট আধুনিক বলে মনে হচ্ছে। ছোট একটা গেইট। চারদিকে সুনসান অবস্থায়। ঝি ঝি করে ঝিঝি পোকার একটানে তার স্বরে চিৎকার শোনা যাচ্ছে। আমি লিওর দিকে তাকালাম। সে হাতে ইশারা করল নামতে। গেইটের পাশে নেমেই দেখলাম ছোট খাট একট নেম প্লেট। গোটা গোটা ইংরেজি অক্ষরে লেখা।
Professor Robert Hood
তাহলে এটা রবার্ট হুডের বাড়ি। এটাই তো আমি খুজছিলাম। মনে মনে একটু শান্তি পেলাম। এরই মধ্যে লিও ট্রলি ব্যাগ টা নিয়ে আমার পাশে দাড়ালো।
“এটাই প্রফেসর হুডের বাড়ি। বছরের বেশির ভাগ সময় এখানে থাকেন। আর বাকিটা সময় নিউইয়র্কে”
“আমি এ বাড়িটাই খুজছিলাম”
“আমি জানি। আচ্ছা আমি চলি। তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো।”
“ধন্যবাদ।”
“আশা করি খুব দ্রুত আবারো আমাদের দেখা হবে।”
“হুম”
লিও অস্পষ্ট স্বরে হাসলো। ওর হাসিটা দেখার খুব ইচ্ছা হল আমার। জানিনা আর দেখা হবে কিনা। যদি দেখা হয় তাহলে চিনবো কিনা সন্দেহ। ওর জ্বল জ্বল চোখ দুটো ছাড়া বাকি কিছু আমার চোখে পড়েনি।
হাত নেড়ে বিদায় জানালাম। খুব দ্রুত সে তার গাড়ি সহ অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেল। বুক ছিড়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এল। ট্রলি ব্যাগ টা হাতে আবারো নেম প্লেট টার দিকে তাকালাম। তারপর গেইটের ভিতরেই প্রবেশ করলাম।
রবার্ট হুড এ বাড়িতে স্ত্রী সহ থাকেন। ২ ছেলে মেয়ে আছে কিন্তু তারা আলাদা হয়ে গিয়েছে অনেক আগে। বুড়ো বুড়ি তাই এখন একা।
প্রফেসর হুড আমাকে দেখে খানিকটা চিন্তিত বোধ করলেন বলে আমার মনে হল। আমাকে বার বার জিজ্ঞেস করলেন আমি কি একা এসেছি? উত্তরে জানালাম লিওর কথা। সেই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। লিওর কথা বলাতে খানিকটা হতভম্ব হলেন। কিন্তু কিছু বললেন না।
তবে সাদা চুল ওয়ালা মিসেস হুড আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন। তিনি আমার গোসলের ব্যবস্থা করে খাবার গরম করতে লাগলেন। আমি অভিভূত হয়েছিলাম আতিথেয়তায়। বাংলাদেশে মধ্য রাতে হুট করে মেহমান এলে সবাই যার পরনাই বিরক্ত হয়। কিন্তু এদের চোখে বিরক্তির চাপ টুকুও নেই।
খাওয়া শেষে রুম তৈরি না থাকায় আমার বিছানা ফ্লোরে করা হল। আমার জন্য সেটা অসুবিধা ছিল না। স্বাচ্ছন্দ্যে শুয়েছিলাম আমি। আর পরদিনের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। প্রফেসর হুডও সে কথা বলে গিয়েছেন। বিছানায় মাথা রাখতেই রাজ্যের ঘুম চোখে নেমে এল। এত সহজে একটা অপরিচিত জায়গায় কেমনে ঘুম চলে আসল ঘুমাতে ঘুমাতে সেটাই ভাবলাম অনেকক্ষণ।
.
(চলবে)
.
কি মনে হয় লিওর ব্যাপারে??