আমার ভিনদেশি তারা পর্ব-৫৯

0
1996

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৫৯
—————————————
ঘরে ঢুকতেই মামী একচোট লাগালেন আমার সাথে। কিন্তু লিও আসার উত্তেজনায় উনার কথার মাথা মুণ্ডু কোনো কিছুই আমার কানে গেল না। সব মাথার উপর দিয়ে গেল। গোসল করে তাড়াহুড়ো করে আলমারী থেকে একটা সবুজ শাড়ি নিয়ে পড়ে নিলাম। চুল গুলো কে তোয়ালে দিয়ে পেচিয়ে খোঁপা করে নিলাম। পানি নেয়া হয় নি ভালো করে। তাই টপ টপ করে তখন ও চুল থেকে পানি ঝড়ছিল। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দৌড়ে মেহমান ঘরে চলে আসলাম। ইতোমধ্যে সবাই উঁকি ঝুকি মেরে লিও কে দেখছে। লিও কে দেখে তারা নিজেদের ফিস ফিস করছে। আমি জানি হয়ত তারা আমাকে নিয়েও কথা বলছে। কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
টেবিলে হরেক রকমের নাস্তা দেয়া হয়েছে। পিঠা থেকে শুরু করে গরুর দুধের ছানা পর্যন্ত। মামা কোথায়? মামা কে দেখা যাচ্ছে না। আর লিও…?
সে নাস্তার বহর দেখে সোফাতে বসে কুল কুল করে ঘামছে। অথচ সেও গোসল করে এসেছে। গায়ে ধুসর রংয়ের গেঞ্জি আর কালো থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট পরিহিত। হাতে ব্ল্যাক রিস্ট ওয়াচ। কাঁধে তোয়ালে টা এখনো ঝুলছে। কিন্তু নাস্তা দেখে ওটা দিয়ে চুল মুছতে বেমালুম ভুলে গিয়েছে।
আমি এসে দেখলাম সে ডালের তৈরি বড় বড় পাখন পিঠা গুলো হাতে নিয়ে দেখছে আর বড় বড় ঢোক গিলছে। অসস্থি ফুটে আছে চোখে মুখে। আমি ডাকলাম
“লিও?”
আমার দিকে নজর পড়তেই লিওর চোখ মুখ নরম হয়ে এল। যেন বুকে আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস ঝুপ করে বেড়িয়ে গেল। উঠে দাড়ালো ঝট পট। বলে উঠল
“মিইইরা! এখানে…”
কিছু একটা বলতে চেয়েও লিও হুট করে থেমে গেল। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। লিও কি কিছু আঁচ করতে পেরেছে?
“এখানে কি হয়েছে?”
“লিও?”
“কথা বল!”
“লিওওও!”
হালকা ধাক্কা দিলাম। যেন হুশ ফিরল ধাক্কায়।
“কি হয়েছে? চুপ হয়ে আছে কেন?”
লিওর পিট পিট করে কয়েকবার তাকালো। তারপর হতাশার ভঙিতে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল
“বেংলাডেশ এত সুন্দর কেন?”
আমি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। হেসে দিলাম। ভেবেছিলাম সিরিয়াস কিছু হবে।
.
বড় মামী আর আম্মা প্রবেশ করলেন হুড়মুড় করে। তারা খবর পেয়েই ছুটে এসেছেন। আম্মা উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলেন
“এ কেরে তাহমিনা? তোর মামা বলছে তুই নাকি রাস্তার পাশের ডোবা টা থেকে একে ধরে নিয়ে এসেছিস?”
নার্ভাস ভাবে একটু হেসে বললাম
“আম্মা ও আ-আমার বন্ধু। ডোবায় কিভাবে যেন পড়ে গিয়েছিল। বেচারা উঠতে পারছিলো না। তাই ওখান থেকে তুলে এনেছি। আর ও কানাডা থেকে এসেছে। ডোবা থেকে না।”
“বলিস কিরে? তোকে ছেলে দের থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম না। তোর আব্বা জানলে কি বলবে?”
“আ-আম্মা!”
বড় মামী চোখ ছোট ছোট করে বললেন
“এই ছেমড়ার কি কুরুজ ব্যারাম আছে? এত সাদা ক্যান?”
“মামী ওরা এরকমই হয়।”
মামী গভীর মনোযোগে লিও কে দেখতে লাগল। হয়ত ভাবছিল আসলেই মানুষ এরকম ফর্সা হয় কিনা? আমি মাকে টেনে লিওর সামনে নিয়ে গেলাম। মামা এসে তার ব্যাগ গুছিয়ে রাখছিল।
“লিও?”
“হুম!”
লিও তখনো পাখন পিঠার সাইজ টা পরীক্ষণ করছিল। হয়ত ভাবছিল এত বড় সাইজের জিনিস টা কি হতে পারে? আমি ডাকতেই ফিরে তাকালো।
“এ আমার আম্মা আর এ আমার বড় মামী।”
লিও দুজনের দিকে এক মুহুর্তের জন্য তাকালো। তারপর উঠে এসে প্রথমে আম্মা কে পরে মামী কে সালাম করলো। আম্মা হকচকিয়ে গেলেও মামী লিওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
“যুগ যুগ বেঁচে থাকো বাবা। আমার মাথার চুলের সমান হায়াত পাও।”
আমি শিউর লিও কিছু বুঝে নি। কিন্তু মামী কে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দেখে আম্মার দিকেও ফিরল। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার জন্য। মাথা টা একটু নিচু করল। খানিকটা ইতস্থত করে আম্মাও মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
“বেঁ-বেচে থাকো বাবা!”
লিও একটু করে হেসে দিল। বলল
“থ্যাংক ইয়ু আম আম…!
লিও আটকে গেল। আমি ঠিক করে দিলাম
“আম্মা!”
“ইয়েস আমা! থ্যাংক ইয়ু আমা!”
আম্মা হা করে গেল। বড় মামী খুশিতে গদগদ করে বলে ফেললেন
“আহা সোনার টুকরা ছেলে।”
.
মামী নিজেই লিও কে পাশে বসিয়ে খাওয়াতে লাগলেন। আর আম্মা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল এই ভেবে যে আব্বা আসলে কি হবে?
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তাই আমাকে সাজানোর জন্য সবাই জোর করে ধরে নিয়ে গেল। আমাকে সামনে থেকে টেনে নিয়ে যেতে দেখে লিও অসহায় দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। হয়ত মুখে কিছু বলতে পারছিল না। হয়ত চাইছিল এই অস্বস্তিকর মুহুর্তে তাকে ছেড়ে যেন আমি না যায়। আমি স্পষ্ট দেখছিলাম মুখে বির বির করে সে আমাকে ডাকছিল। সেটা দেখে আমার কলিজা টা যেন তীক্ষ্ণ ছুরির আঘাতে ছিড়ে ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছিল। কোন ভাবে লিও কে একা ফেলে যেতে ইচ্ছা করছিল না। তারপরও যেতে হচ্ছিল। আমার বিয়ের সাঁজের জন্য। খুব কষ্ট হচ্ছিল। সাজানোর সময় পাথর হয়ে বসেছিলাম। মনে হচ্ছিল সব ছেড়ে ছুড়ে এখনি লিওর কাছে চলে যাই। আর বলে দিই এ বিয়ে আমার দ্বারা হবে না।
.
তৈরি হয়ে ছাদে যাওয়ার সময় আমি মেহমান ঘরে উকি দিলাম। দেখলাম লিও ঘুমাচ্ছে। হয়ত বেশ ধকল পোহাতে হয়েছে এতটুক আসতে। তাই শরীর মানে নি। ঢলে পড়েছে ঘুমে। আমি কাঁথা টা গায়ের উপর টেনে দিলাম। তারপর মাথার উপর চুল গুলো ঠিক করে দিয়ে দ্রুত চলে আসলাম। পাছে কান্না চলে আসবে তাই। আর এখন কান্না শুরু হলে আমি নিজেকে থামাতে পারবোনা। সবকিছু অসম্ভব হয়ে যাবে আমার জন্য।
.
বেশ কিছুক্ষন পর আব্বা দপ্তর থেকে আসলেন। আর আমার ছটফটানি শুরু হয়ে গেল। না জানি লিওর কথা শুনে তিনি কি করবেন। উসখুস করছিলাম অনেক। আব্বা লিওর কথা শুনে কিছুক্ষন চুপচাপ থাকলেন। কিন্তু বড় মামা অনেক চিল্লালেন। আমি ভয়ে মাথা নিচু করেছিলাম। হাতের মুটোয় হাত চেপে ধরে আল্লাহ কে ডাকছিলাম।
বড় মামা আর আব্বার সামনে এতই ঘাবড়ে ছিলাম যে তাই বার বার ঢোক গিলছিলাম। অবশেষে আব্বা মুখ খুললেন। এত বছর বাইরে পড়াশুনা করে একজন স্বাবলম্বী হয়েও নিজের পিতার সামনে এতটুকুনি হয়ে গেলাম। হাজার বছরের জমে থাকা ভয় কাটাতে পারলাম না। শত চেষ্টায় সাহস সঞ্চয় করি। কিন্তু আব্বার সামনে গেলেই সব সাহস উবে গিয়ে চুপসে যাওয়া বেলুনের মত হয়ে যাই।
.
আব্বা বললেন এ মুহুর্তে তিনি কোনো ধরনের ঝামেলা চান না। তাই আমার ছেলে বন্ধুকে যেন বিয়েতে দেখা না যায়। কারণ ছেলে পক্ষ দেখলে কথা তুলতে পারে। আর সে এখানে থাকতে পারবেনা। তাকে কামলা ঘরে থাকতে হবে। কোনো অজানা অচেনা ছেলেকে তিনি ঘরে ঠাই দিতে পারবেন না। হোক না কোনো বন্ধু। আমি হতাশ হয়ে গেলাম। লিও কামলা ঘরে থাকতে পারবে তো?
.
এখন রাত। কাঁঠালচাঁপার গন্ধ বাতাসের সাথে চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে। বিয়ের গান চলছে বেশ জোরে শোরে। তার চেয়েও বেশি শোরগোল বাচ্চাদের। সবাই খেয়ে দেয়ে উপরে উঠে এসে গেছে। ছাদের উপর ছোট্ট করে হলুদ রাতের আয়োজন করা হয়েছে। গত বারের ন্যায় জাঁকজমক করা হয় নি। আব্বা, বড় মামা, আর তৈয়ব চাচু বেশ খোশ গল্পে মেতেছেন। আম্মাকে ফুপি কোন একটা বিষয়ে এক নাগাড়ে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন। আর আম্মা চুপচাপ শুনে যাচ্ছেন। কয়েকজন আত্মীয় স্বজন ও রয়েছে। আমার ফুপাতো আর মামাতো বোন রা মিলে আমার হাতে মেহেদি দিচ্ছে। আর আমি শুধু লিওর চিন্তা করছি। সে কি ঘুম থেকে উঠেছে? এখনো কি উপোস রয়েছে? খাবার কি তাকে দেওয়া হয়েছে? দিলে সে খেতে পেরেছে? ঝাল হয় নি তো বেশি?
বুক ছিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল। কারণ এগুলো একটারও উত্তর আমার কাছে নেই। ধ্যান ভাঙলো ফুপাতো বোনের কথায়।
“আপু এখানে দুলাভাইয়ের নামের অক্ষর লিখে দিই?”
“হাহ্?”
আমি চমকে গেলাম। আমার ফুপাতো বোন টা আমার দিকে জবাবের আশায় তাকিয়ে আছে। আমি আমার হাতের দিকে তাকালাম। কি জবাব দেব তাকে?
“আপু বলো না!”
“কিছুই দিও না।”
“কি বলো? দুলাভাইয়ের নামের অক্ষর দিবো না?”
“নাহ্!”
সে হয়ত কিছুটা মনঃক্ষুন্ন হলো। কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসে না। উদাস নয়নে তারকাখচিত আকাশের দিকে তাকালাম। পেজা পেজা তুলো মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। চাঁদ কে আরো গভীর রাতে দেখা যাবে।
.
বেশ কযেক ঘণ্টা পর সমস্ত আয়োজন শেষ হল। যে যার যার মত নেমে গেল। কিন্তু আমি হাত ধুয়ে রুমে না ঢোকা পর্যন্ত ছাড়া পেলাম না। রুমে ঢুকতেই বাইরে থেকে দরজা আটকে দেয়া হল। আর আমি রুমের এদিক থেকে ওদিক পায়চারী করছিলাম। বেশ চিন্তা হচ্ছিল। একবার লিওর সাথে দেখা করা প্রয়োজন। সে কেমন আছে সেটা জানতে হবে। কিন্তু কিভাবে?
রুম থেকে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব। ভাবতে ভাবতে জানালার দিকে নজর গেল। বেশ বড় জানালা। সেটা দিয়ে উঠানের এক পাশ পুরো নজরে আসে।
আমি যখন ভাবছিলাম কি করব, কি করব ঠিক তখন ভোলার কণ্ঠ শুনতে পাই। ভোলা আজকে বিয়েতে বাজানো গান টা গাইতে গাইতে গোয়াল ঘর থেকে ফিরছে। হাতে টর্চ লাইট। দ্রুত জানালার পাশে এসে আমি ডাক দিলাম
“ভোলা?”
ভোলা প্রথমে খেয়াল করলো না। আমি আবার ডাকলাম
“ভোলা।”
ভোলা গান থামিয়ে এদিক ওদিক তাকালো। তারপর টর্চ টা আমার জানালা বরাবর পড়তেই আমি তাকে এদিকে আসতে ইশারা করলাম। ও এগিয়ে আসলো। বলল
“কন আপা! কিছু লাগবো?”
“ভোলা আমার একটা উপকার করে দেনা।”
“কি করমু?”
“ঘরে ঢুকে শুধু বাইরে থেকে দরজা টা খুলে দিবি।”
ভোলা কে দ্বিধা গ্রস্থ দেখা গেল। সে ইতস্থত করে বলতে লাগল
“আপা আমি কেমনে…!”
“ভোলা আমি কোথাও যাবো না। শুধু কামলা ঘরে আমার বন্ধুর সাথে দেখা করেই চলে আসবো। প্লিজ ভোলা দেনা।”
ভোলা ক্ষীণ স্বরে বলল
“ঠিক আছে কিন্তু…!”
“তুই টেনশন করিস না। ধরা পড়লে আমি তোর কথা কাউকে কিছু বলবো না।”
ভোলা মাথা নেড়ে চলে গেল। তার কয়েক মিনিট পর দরজায় খুট করে শব্দ হলো। আমি লাফিয়ে উঠলাম। তার মানে ভোলা দরজা খুলে দিয়েছে। তাড়াতাড়ি বাইরে বেড়িয়ে এলাম। কিন্তু ভোলা কে দেখলাম না। সে দরজা খুলে দিয়েই ভেগেছে। আমি আস্তে করে বাইরে থেকে দরজার হুকটা লাগিয়ে দিয়ে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে এলাম।
এখন বেশ গভীর রাত হলেও চাদঁনীর আলো তে সব কিছু ফকফকা হয়ে আছে। তাই পথ চিনতে কষ্ট হলো না। কামলা ঘর টা এখান থেকে দূরে। ঘরের পিছন দিয়ে ঘুরে গোয়াল ঘর ফেলে সামনে এগিয়ে গেলাম। পাশে খড়ের গাদা। তার পাশেই কামলা ঘর। আমি আস্তে করে দরজায় টোকা দিলাম। কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ পাচ্ছি না। আমি আবার টোকা দিলাম। এবারো কোনো শব্দ নেই। তাই আস্তে করে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলাম।
“লিও?”
ভিতর টা খালি। কেউ নেই সেখানে। শুধু ছোট একটা এলইডি বাল্ব একলা আলো ছড়াচ্ছে। আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। লিও কোথায় গেল?
“লিও!”
আমি হালকা স্বরে আশপাশে ডাকতে লাগলাম। বেশি জোরে ও ডাকতে পারছি না। পাছে কেউ শুনে ফেলে।
কিন্তু সাড়া পাচ্ছি না। তাকে খুজতে বেশ অনেক খানি চলে আসলাম। পাশেই উচু খড়ের গাদা। ওখানেও দেখে চলে আসার সময় খড়ের খচ মচ শব্দ শুনলাম।
“লিও?”
আমি আশে পাশে তাকালাম। আবারো শব্দ হচ্ছে।
“লিও তুমি কি এখানে আছো?”
“মিইরা আমি এখানে!”
আওয়াজ শুনে ভড়কে গেলাম। এদিকে ওদিকে তাকাতে লাগলাম। বললাম
“এখানে কোথায়?”
“উপরে!”
“উপরে?”
উপরে তাকাতেই একটা বড় সর ঝটকা লাগল। দেখলাম লিও খড়ের গাদাটার উপর বাঁশ ধরে কোনো রকম দাড়িয়ে। তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম
“তুমি ওখানে কি করছো? তাড়াতাড়ি নেমে আসো?”
“আমি এখানে…!
কথা শেষ হল না। তার আগে লিওর হাত ছুটে গেল। আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আর সাথে সাথে ধুপ করে নিচে একটা শব্দ হলো। শিউরে উঠলাম। দোয়া করছিলাম লিও যেন ঠিক থাকে।
“মিইরা!”
ভয়ে ভয়ে চোখ খুললাম। দেখলাম লিও আমার সামনে দাড়িয়ে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে এমন ভাবে হাসছে যেন ওখান থেকে পড়ে তার কিছুই হয় নি। এসব খুব সাধারন ব্যাপার। তবে ওকে ঠিক দেখে আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। বুক থেকে একটা সুক্ষ নিঃশ্বাস বেড়িয়ে গেল। লিওর কাছে আরেকটু এগিয়ে বললাম
“তুমি ঠিক আছো?”
লিও মুখের হাসি টা আরেকটু চওড়া করে বলল
“একদম।”
ডিম্পল দুটো গালে ভেসে উঠেছে। পুরো শরীরে খড়ের টুকরো জড়িয়ে আছে। কিছুটা চুলে, কিছুটা কাঁধে, কিছুটা গায়ে। আমার খানিক টা রাগ হলো। কি দরকার ছিল এত রাতে বাঁদর হয়ে ওখানে ঝোলার? খড়ের টুকরো গুলো সাফ করতে করতে ওকে বকতে লাগলাম
“পাগল হয়েছো? ওখানে কেন উঠেছো? যদি নিচে এই আটি গুলো না থাকত, তখন কি হত? তোমার হাড় গোড় সব টুকরো টুকরো হয়ে যেত। আর তোমার মা বাবা আমা…”
আমার কথা কেটে গেল। লিও ঠোটের ওপর এক আঙ্গুল চেপে ধরে বলল
“শসসসসহ!”
তারপর আঙ্গুল সরিয়ে মৃদু একটা মিষ্টি হাসিতে বলল
“I am fine Mira… see!”
লিও হাত দুটো দুপাশে ছড়িয়ে আমাকে দেখাতে লাগলো। আমি ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লাম। বললাম
“কি করছিলে ওখানে?”
লিও হাতের মোবাইল টা দেখিয়ে বলল
“নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলাম না। তাই দেখছিলাম কোথায় নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়।”
“তাই বলে ওখানে?”
“হুম!”
“নেটওয়ার্ক পেয়েছো?”
লিও মাথা নেড়ে বলল
“পাই নি।”
“পাবেও না। আচ্ছা বল কিছু খেয়েছো?”
“নাহ্ সব ঝাল। খেতে পারি না।”
সরল স্বগোক্তি। মুখে ভ্যাবলার মত হাসি। ঘোলাটে চঞ্চল চোখ। আর বুকের মধ্যে জমানো একরাশ ভালোবাসা। আমাকে মুহুর্তে বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
তার মাথার চুল গুলো সব এলোমেলো হয়ে আছে। ওগুলো আঙ্গুল দিয়ে আচড়িয়ে দিতে লাগলাম। বললাম
“ক্ষুধা লেগেছে?”
“হুম!”
লিও ফোনের নেটওয়ার্ক চেক করতে করতে মাথা নাড়ল। তার ক্ষুধা লেগেছে। আমি একটু করে হাসলাম। বললাম
“একটু করে বসো। আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।”
“ঠিক আছে।”
.
রান্না ঘরে হরেক রকমের খাবার ছিল। কিন্তু লিওর উপযোগী কিছুই ছিল না। অনেক খোজাখুজির পর কিছু রুটি পেলাম। যেগুলো বড় মামা রাতে খাওয়ার জন্য বানানো হয়েছিল। ডায়াবেটিসের কারণে তিনি একবেলা রুটি খেয়ে থাকেন। সে সাথে কিছু আলুর সবজি। রুটি আর সবজি নেওয়ার সময় হটপটে রাখা পাটিসাপটা পিঠা নজরে এলো। কয়েকটা পাটিসাপটা পিঠা সহ নিয়ে আসলাম কামলা ঘরে। লিও তখনো ফোন এদিক ওদিক ঘুরছে। আমি বললাম
“লিও এখানে নেট পাবেনা। বাদ দাও। আর চলে আসো খেতে।”
শুনে সে বাধ্য ছেলের মত চলে আসলো।
ছোট্ট বিছানা। তার উপর পাটি বিছানো। পাটির উপর ফুলের পাতলা কম্বল। মশা বেশ জোরে শোরে তাদের রক্ত খাওয়া প্রতিযোগিতা চালাচ্ছে। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হলেও সে কিছু বলল না। চুপচাপ খেতে লাগল।
আমি কয়েল এনে ধরিয়ে দিলাম। তারপর ওর খাওয়া দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করলাম
“নিউইয়র্ক থেকে কবে এসেছো?”
খেতে খেতে লিও জবাব দিল
“যেদিন চলে গিয়েছিলে সেদিন রাতে।”
“তুমি তো বাংলাদেশ চিনতে না। তাহলে আমার ঠিকানা কিভাবে বের করলে।”
“গুগল ম্যাপ করেছে। আমি শুধু ঠিকানা দিয়েছি।”
“ব্যস?”
লিও আমার দিকে তাকালো। তার খাওয়া শেষ। পানি পান করেই শেষ ঢেকুর টুকু তুলল। হাত মুছতে মুছতে জবাব দিল
“তুমি কি মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দা? যে তোমাকে খুজতে আমার এত কষ্ট লাগবে?”
“তবুও!”
“মিইইরা একটু কষ্ট হয়েছে বৈকি। এয়ার পোর্ট থেকে নেমে আমি হা করে তাকিয়ে ছিলাম কোন দিকে যাব। উপরন্তু বাংলা ভাষা আমি এখনো রপ্ত করতে পারি নি।”
“তাহলে কিভাবে এলে?”
“গাইড নিতে হয়েছে।”
“ওহ্!
হাত মুছেই লিও হুট করে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। আমি একটু চমকে উঠলাম।
“লিও?”
“আমার ঘুম আসছে মিইইরা। একটু করে মাথায় হাত টা রাখো।”
এই বলে আমার হাত ধরে তার মাথায় রাখলো। আমি ধীরে ধীরে হাত বুলাতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে লিও ঘুম জড়ানো কণ্ঠে আমাকে ডাকলো
“মিইইরা!”
“বলো!”
“তোমাদের এখানে কি কোনো ফাংশন চলছে?”
আমি চুপ হয়ে গেলাম। এ ভয় টা আমাকে বহুক্ষণ ধরে তাড়া করছিল। তাই ঢোক গিলে বললাম
“হ্যা!”
“কিসের ফাংশন?”
আমি চুপ হয়ে গেলাম। কণ্ঠ রোধ হয়ে আসতে লাগলো। বেশ ঝাঝালো মনে হচ্ছে নাক টাকে। লিও কে কি বলা উচিত হবে?
বহুকষ্টে আমি শক্তি অর্জন করলাম। তারপর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম
“আ-আমার বি-বিয়ের!”
.
(চলবে)
.
পরবর্তী পার্ট দ্রুত আসবে। প্লিজ আপনারা অস্থির হবেন না। আমার জন্য খুব কঠিন সময় যাচ্ছে। যত দ্রুত পারি দেবো। হ্যাপি রিডিং ♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here