আমার ভিনদেশি তারা পর্ব-৬১

0
3022

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৬১
—————————————
ছাদের সিড়ি টা যেন বেশ দীর্ঘ মনে হচ্ছে। অথচ ছাদে উঠতে এত সময় লাগার কথা না। ছাদে উঠে আমি অবাক চোখে চারদিকে তাকালাম। স্টেজ টাকে নতুন করে সাজানো হয়েছে। সব কাঁচা ফুল। কোনো কৃত্রিম ফুল নেই। সেখানে আরো সাজিয়ে লেখা হয়েছে আমার আর জাওয়াদের নাম। তাও ইংরেজিতে। চোরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যদিকে তাকালাম। ভোলা আর তৈয়ব চাচু স্টেজ সাজাচ্ছে। এক পাল বাচ্চা কাচ্চা ছাদে। সাথে মুরুব্বী গোছের কয়েকজন আত্মীয়। তারপরও যেন কোনো শোরগোল নেই। কেমন যেন নিষ্প্রাণ নিস্তব্ধতা। বেশ অস্বস্তিকর। বরপক্ষ কি চলে এসেছে?
এমন সময় সাই করে কিছু একটা পাশ কাটিয়ে গেল। এতটা দ্রুত গেল যে শুধু বাতাস টাই পেলাম। শোরগোল বেড়ে গেল। যেটা এতক্ষণ ছিল। কি হয়েছে?
সামনে তাকাতেই আতঁকে উঠলাম।
লিও চিৎকার করে সমস্ত কিছু ভেঙে ফেলছে। এতক্ষন ধরে সাজানো স্টেজের সব ফুল ছিড়ে ছিড়ে ফেলে দিচ্ছে। যেন জমে থাকা প্রচণ্ড ক্ষোভ সব বের করে দিচ্ছে। ইংরেজিতে লেখা জাওয়াদের নাম টা টুকরো টুকরো করে ফেললো। চেয়ার রাখা ছিল ছাদে। সব গুলো নিয়ে ছুড়ে ছুড়ে ফেলে দিতে লাগলো। স্টেজের অবস্থা একদম নাজেহাল। আমার বুক ধর ফর করছে। দৌড়ে এগিয়ে গেলাম লিওর দিকে। সে তখন প্যান্ডেলের কাপড় টানছিল ছিড়ে ফেলার জন্য। আমি তার হাত ধরে ফেললাম। তাকে ডাকলাম
“লিও!”
তার হাত নরম হয়ে এল। প্যান্ডেলের কাপড় টা ছেড়ে দিল। চেহারায় ফুটে উঠলো একরাশ কাকুতি। ক্রুদ্ধ মূর্তিটা ধীরে ধীরে মোমে পরিণত হল। ঘোলা চোখ দুটো টল টল করছে। উসকো খুসকো চুলে উদভ্রান্তের মত হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে ওর চোখে মুখে চুমু দিয়ে সব চিন্তা দূর করে দিই। কি হয়েছে ওর?
লিও খুব কষ্টে আমাকে ডাকলো। জড়ানো কণ্ঠে
“মি-মি-মিইইরা!”
আমি উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়লাম।
“কি হয়েছে তোমার? এ-এমন করছো কেন?”
লিও ঠোঁটের সাথে ঠোঁট চেপে ধরে নিচের দিকে তাকালো। যেন নিজেকে নিয়ন্ত্রন করছে। আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলল
“আ-আমি তোমাকে ভালোবাসি। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না।”
আমি হা করে তাকালাম। সে স্টেজের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বলল
“এ-এখানে শুধু আ-আমার নাম থাকবে। আর কারো না। আর কারো নাম থাকতে পারবে না।”
“লি-লিও…!”
এসময় কেউ যেন ওকে হেচকা টান দিল। আমি চমকে উঠলাম। চার/পাঁচ জন ছেলে ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আর অদূরে আমার আব্বা দাড়িয়ে দেখছে। লিও ছেড়ে দেবার জন্য তাদের সাথে লড়াই করছে। কিন্তু চার/পাঁচ জনের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছে না।
আমি পিছন থেকে চিৎকার করে উঠলাম
“ওকে তোমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? ছেড়ে দাও ওকে।”
কিন্তু কেউ আমার কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। ওরা ওকে হিচড়ে নিয়ে যেতেই লাগলো। পিছন পিছন আব্বা। আমি মূক হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। কি হচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না। ওরা কেন লিও কে নিয়ে গেল? ওর কি কোনো ক্ষতি করবে? ভাবতেই বুক টা ধক করে উঠলো। দ্রুত দৌড়াতে লাগলাম। নামতে নামতে কত অবাস্তব কল্পনা করছি তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু সিড়ি টা ফুরাচ্ছে না। অবশেষে সিড়ি শেষ হল। আমি নিচে নেমে থমকে দাড়ালাম। উঠানে সবাই বেধরক পিটাচ্ছে। আ-আমার লিও কে। স্তব্ধ হয়ে গেলাম কয়েক সেকেন্ডের জন্য। এরপর গগনবিদারী চিৎকারে আমি ফেটে পড়লাম।
মৃদু ভাবে শরীর কাঁপছে। পুরো শরীর ঘেমে গেছে। মাথাটা ভারী হয়ে আছে। কি দেখেছি এটা আমি? এটা কি স্বপ্ন ছিল? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। দ্রুত পায়ে বিছানা থেকে নেমে গেলাম। দরজায় সজোরে আঘাত করতে লাগলাম খুলে দেওয়ার জন্য। চিৎকার করছিলাম। মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়ে যাচ্ছে আর আমি জানি না। প্রায় আধা ঘন্টা গলা ফাটানোর পর দরজা খোলা হল। দরজা খুললেন মামী। থমথমে চেহারা উনার। আমি উনাকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই রুদ্ধ শ্বাসে দৌড় মারলাম। উঠানে চলে আসলাম। উঠানে আসতেই আরেক বার থমকে দাড়াতে হল। এত নিস্তব্ধতা কেন? আর সবকিছুই কেন এত এলোমেলো? কি হয়েছে এখানে? কাউকে দেখা যাচ্ছে না কেন?
এমন অস্থির নিরবতা দেখে আমার বুক কাঁপছিল। পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে কিছু খুজছিলাম। আর সবাই আমার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছিল।
অবশেষে কামলা ঘরে এসে আমি থামলাম। জনাকয়েক লোক এখানে দাড়িয়ে আছে। এদের কয়েক জন কে আমি চিনি। এরা আমার আব্বার কর্মী। অনেক টা বেতন ভুক্ত সরকারী চাকুরি জীবির মতই। কিন্তু এখানে ওরা কি করছে?
আমি ঢোক গিলে সামনে এগিয়ে গেলাম দেখার জন্য। কিন্তু যা দেখলাম তা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিল না। লিওর গায়ে সাদা শার্ট ছিল। কিন্তু বোঝায় যাচ্ছে না সেটা সাদা শার্ট। লাল রক্তে সেটা পুরো রক্তিম হয়ে আছে। আধ বোজা চোখ দুটো চুলের কারনে দেখা যাচ্ছে না। লাল কিছু ছুইয়ে ছুইয়ে পড়ছে চুল থেকে। হাত দুটো কে সামনে এনে বাধা হয়েছে। হাটু মুড়ে সে নিচের দিকে বসে আছে। হুশ আছে কিনা বুঝতে পারলাম না। কিছুক্ষন বাদে বাদে দু-একজন মিলে তাকে বেধরক পিটাচ্ছে। আর আমার আব্বা সদূরে দাড়িয়ে তাকিয়ে আছে।

আবারো ওকে আঘাত করতে এলে আমি চিৎকার করে উঠলাম। আমার চিৎকার শুনে লোকটি থেমে গেল। আমি দৌড়ে লিওর সামনে দুপ করে বসে গেলাম। ডাকলাম বেশ কয়েক বার। কিন্তু সে সাড়া দিল না। শুধু হালকা করে ভ্রু কুচকে উঠলো। আমি আরেক বার ডাকতে গিয়েও পারলাম না। আব্বা আমাকে টেনে নিয়ে আসলেন।
আর ইশারা করলেন সেই লোকটার দিকে। লোকটা যখন আবার পিটানো আড়ম্ভ করলো তখন আমি কাটা মুরগীর মত তড়পাতে লাগলাম।
“আব্বা ওকে ছেড়ে দাও। ও মরে যাবে। সে এসব সহ্য করতে পারবেনা আব্বা! ওকে ছেড়ে দাও।”
হাত জোড় করে অনুরোধ করছিলাম আব্বা কে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। অনুশোচনা করছিলাম কেন প্রেমের বিষাক্ত পেয়ালা পান করলাম। যে যাতনা প্রাণে সয় না, সে যাতনা চোখে কিভাবে সয়? বলো সখি যাতনা কাহারে কয়? কিন্তু আব্বার হৃদয়ের কঠিন পাথর বিন্দু মাত্র গলল না। শেষে পাগলের মত ছন্নছাড়া হয়ে এক অদ্ভুদ কাণ্ড করে বসলাম। চিৎকার করে উঠলাম উচ্চস্বরে। কান্না জড়িত কন্ঠে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললাম
“ঘৃনা করি সেই ঔরশ কে। যে ঔরশ থেকে আমার জন্ম হয়েছে। আমি এখন অনুশোচনা করি কেন আমি এতিম হলাম না। কেন পিতৃহারা হলাম না। অন্তত এতটা কষ্ট আজ আমি পেতাম না। ঘৃণা হচ্ছে তোমাকে আব্বা বলতে। আমার ভীষণ ঘৃণা হচ্ছে। তুমি বাবা নামের জানোয়ার। কোনো মানুষ না।”
“তাহমিনা…!”
আব্বা প্রচন্ড জোরে ধমক দিয়ে উঠলেন। হাত পা কাঁপছে উনার। আর কথা বলতে পারলেন না। মুখে আটকে গেল। সবাই হা করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আবার আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলাম। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে উনার রক্ত চক্ষু বরাবর তাকিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বললাম
“ঘৃণা করি তোমাকে!”
এবার হয়তো এ অপমান টা সহ্য করলেন না। সরাসরি গায়ের সর্ব শক্তি দিয়ে আমাকে থাপ্পড় মেরে দিলেন। আমার মাথা ঘুরে গেল। পড়ে গেলাম মাটিতে। আমি তখনো জানি না আমি কি করছি। মনে হচ্ছে এটা করি। খারাপ কি ভালো সেটা জানি না। তাই করে ফেলছি।
.
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এরপর কেউ লিওর গায়ে ফুলের টোকাও লাগায় নি। আধমরা লিও কে ভোলার সাহায্যে টেনে হিচড়ে আমি আমার রুমে নিয়ে আসলাম। কেউ টু শব্দও করলো না। আর আব্বা?
আমাকে থাপ্পড় দিয়ে বড় জোর উনি এক থেকে দেড় মিনিট মূর্তির মত ওখানে দাড়িয়ে ছিলেন। এরপর দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে গিয়ে খিল আটলেন।
কে কি করলো সেটা আর দেখলাম না। পড়ে রইলাম লিও কে নিয়ে। এতটা শারীরিক আঘাত সে হয়তো সারাজীবনেও পাই নি, যেটা মুহুর্তে পেয়ে গেল।
তৈয়ব চাচু নিরীহ মানুষ। কোনো ভেজালে তাকে কখনো পাওয়া যায় না। এমন কি আব্বার কাছ থেকেও তার মেজাজ গত কারনে শত হাত দূরে থাকেন। কিন্তু করুন স্বরে যখন বলেছিলাম ডাক্তার প্রয়োজন, চাচু তা ফেলেনি। আমার জন্য মোটা অংকের ভিজিট দিয়ে ডাক্তার নিয়ে এসেছিলেন সাথে সাথে।
রাতে আমি তখন লিও কে জ্বর পট্টি দিচ্ছিলাম। ওর শরীর কাপিয়ে জ্বর এসেছে। কিছুক্ষন আগেই তাকে ডাক্তার দেখে গেছে। এরপরও ওর অবস্থা করুন।
আম্মা এলেন আমার রুমে। আম্মা কে ট্রে হাতে নিরবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বললাম
“আম্মা ভিতরে আস। ওখানে দাড়িয়ে আছো কেন?”
আম্মা ভিতরে ঢুকে ট্রে টা সামনে রেখে সোফা তে বসলেন। বললেন
“এবার কিছু খেয়ে যা। আর উপোস থাকিস না।”
“থাকব না উপোস মা। এই তো হয়ে গেছে।”
খাওয়ার সময় আম্মা একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেটা দেখে বললাম
“কিছু বলবে মা?”
“তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস।”
আমি একটু হেসে বললাম
“কিন্তু তুমি বুড়ি হও নি।”
আম্মা হেসে দিলেন। তারপর একটু চুপ থেকে বললেন
“এত সাহস কোথ থেকে পাস?”
খেতে খেতে বললাম
“কিসের সাহস?”
“এই যে আজ যে কাজ টা করলি! সবার সামনে তোর আব্বা কে এত বড় অপমান টা করলি!”
আমি থমকে গেলাম। বললাম
“আব্বা কি করেছিল সেটা জানো?”
“জানি। তোর আব্বা তোকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। লোকের মুখ বন্ধ করতে। যে মুখ টা সেদিনই আমাদের কারণে চালু হয়েছিল। সেটা কি অনেক বড় দোষ ছিল?”
“বিয়ে দেওয়া দোষ না মা। শুনেছিলাম তোমাকে ও নানাজান জোর করে বিয়ে দিয়েছিল। আজ আমার আব্বা দিচ্ছে। হয়তো মেনে নিতাম। কিন্তু পারি নি। কারণ টা তোমার সামনে মা।”
লিওর দিকে ইশারা করে বললাম
“ও কারো না কারো সন্তান। যার বাবা মা তাকে পাগলের মত তাকে ভালোবাসে। তাদের কি জবাব দিতে? এটাই বলতে যে তোমাদের পুত্র ধন কে আমরা মেরে ফেলেছি। সহজ ছিল কথা টা বলা? পারবে মা তুমি বলতে? ওর কি দোষ? ও শুধু আমাকে ভালোবেসেছে। আমিও মা একই পাপ টা করেছি। তাকে ভালোবেসেছি। দোষী আমরা দুজনেই। এজন্য আব্বার কথা মেনে নিতে পারি নি। এর চেয়ে মৃত্যু শ্রেয় মা। অন্তত মরে যাব। কিন্তু জিন্দা লাশ হয়ে বেঁচে থাকতে পারব না।”
আম্মা আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। কি দেখছেন এভাবে বুঝতে পারছি না। তিনি নিঃশব্দে বেড়িয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে লিওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেলেন।
.
লিও এখন অনেক টা সুস্থ। সামান্য কিছু কাটা ছেড়া ছাড়া তেমন আঘাত নেই। তবে হাতে একটু ফ্যাকচার রয়ে গেছে। হাত টা এখনো ভালো করে নাড়াতে পারে না। মামী খাইয়ে দেয় ওকে। ও চুপচাপ মামীর হাতে খেয়ে নেয়।
এ দুইটা দিন আমি এক দৃষ্টিতে ওই ঘরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। যে ঘরে আব্বা ঢুকে খিল দিয়েছেন। তিনি এখনো বের হননি। বলে দিয়েছেন কেউ যেন বিরক্ত না করে। কিন্তু আমার ভিতরটা অনুশোচনায় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। বড় মামা এ বাড়িতেহস আসা বন্ধ করে দিয়েছে। ছোট মামা কে আগেই বের করে দেওয়া হয়েছে
একমাত্র তৈয়ব চাচু, বড় মামী আর মা ছাড়া কেউ নেই। লিওর বেশির ভাগ দেখা শোনা মামীই করে থাকে। আমি শু্ধু নজর রাখি আর ওই দরজার দিকে তাকিয়ে লুকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি।
.
(চলবে)
.
কি হবে ভাবছেন?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here