Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৭
————————————————
পুরো টা দিন নানা ব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেলো। বিকেলে আমি মিসেস হুডের সাথে গ্রোসারি শপ থেকে সবজি সহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করতে সাহায্য করলাম। তার সাহায্যে কানাডিয়ান ছোট খাট রীতি নীতি সম্পর্কে পরিচিত হচ্ছিলাম।
রাতে খাবারের জন্য দারুন একটা বারবিকিউ পার্টির আয়োজন করা হল। তবে সেটা বাড়ির বাইরে। আমার জানা মতে কানাডিয়ান রা সামারের দিন গুলোতে প্রায় বাড়ি বারবিকিউ পার্টির আয়োজন করে থাকে। তবে সেটা এতটা উচ্ছাস পূর্ন হবে সেটা ভাবি নি। প্রফেসর হুড এবং তার স্ত্রীর সাথে এখানে যোগ দিয়েছে তাদের প্রতিবেশি। মানুষ জন বেশি না হলেও আয়োজনে উঠান পুরো টাই জমজমাট হয়ে আছে। মিসেস হুড আমাকে তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তারপরও আমার কেমন যেন অস্বস্থি লাগছিল। কোথাও যেন তাদের সাথে তাল মিলাতে পারছিলাম না।
একটু দূরে সরে এলাম। বাড়িতে একটা ফোন করার দরকার ছিল। তাই সাত পাঁচ না ভেবে আম্মার কাছে ফোন করলাম। কিন্তু কয়েকবার রিং পরার পরেও আম্মা ফোন ধরলেন না। হয়ত কাজে ব্যস্ত। তাই মামা কে করলাম।
“মামা?”
“বাদরী নাকি! কিরে কেমন আছিস? ফোন করতে এত দেরী করলি কেন?
“আমি ভালো আছি মামা। কাজের জন্য ফোন করতে পারি নি। আম্মা কেমন আছে? বাড়িতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে? আম্মাকে ফোন করলাম। কিন্তু ধরল না।”
“না তেমন কোনো সমস্যা হয় নি। আপা হয়ত ব্যস্ত। তুই চিন্তা করিস না। আর বল হুড ফ্যামিলি কেমন?”
“ভালো মামা। ওদের ওখানেই আছি। পরশুই হোস্টেলে যাব।”
“আচ্ছা। তুই বাড়িতে ফোন করিস না। কিছু লাগলে আমাকে করিস। পাঠিয়ে দেব।”
“কেন মামা? বাড়িতে করবোনা কেন? কি হয়েছে?”
“না তেমন কিছু হয় নি বললাম না। তোর আব্বার কথা তো জানিসই। এজন্য বললাম আর কি? তুই চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আচ্ছা”
“ভালো করে পড়”
“হুম”
আমার মন খারাপ হয়ে গেল। বাড়িতে কিছু না কিছু হয়েছে। যেটা মামা আমাকে বলছে না। এখানে এসে একটা দিন হয়েও গেল অথচ আম্মার সাথে কথা বলতে পারি নি। মন টা আকু পাকু করছে মার কন্ঠ টা শোনার জন্য। খুব মিস করছি তাকে। কেমন যেন ভিতর টা জ্বলছে। আমার জন্য আম্মা বিপদে পড়ে গেল নাতো?
নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আম্মার সাথে কথা বলতে না পারলে মনটা শান্তি হবে না। আবারো কল করলাম। কিন্তু কেউই কল ধরল না। হতাশ হয়ে বাইরে বেড়িয়ে এলাম। উঠানের জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড টা আরো বেশি জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। কাঠ গুলোকে পুড়ে পুড়ে আগুনের খাবার যোগাচ্ছে। নিজেকে এখন আগুনের মতই মনে হল। যে কাঠ গুলো কে পুড়িয়ে নিজেকে উজ্জল করছে।
এক কোণে গিয়ে বসে পড়লাম। এই সময় সকালে দেখা বাচ্চা দুটো আমার পাশা পাশি চলে আসল। তাদের চোখে এক রাশি কৌতুহল। তারা হয়ত আগে তাদের চাইতে কালো চামড়ার বাঙালি দেখেনি। আমি একটু হেসে হাত নাড়িয়ে বললাম
“হ্যালো গাইজ”
দুজনে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। এর মধ্যে অপেক্ষা কৃত বয়সে বড় ছেলেটি প্রাপ্ত বয়স্কের মত হাত বাড়িয়ে আমার সাথে কর্মদন করল। তারপর বলল
“হাই। আমি জ্যাক। আর এ আমার বোন জিল।”
“হাই জিল”
জিল ও আমার সাথে কর্মদন করল। ওদের দু ভাই বোনের নাম আমার ছোট বেলায় পড়া একটা ছড়া নাম মনে পড়ে গেল। সেটা ছিল
.
“জ্যাক এন্ড জিল,
ওয়েন্ট আপ হিল।”
.
জিল বলে উঠল
“তোমার নাম কি?”
হাসিমুখেই বললাম
“তাহমিনা”
ওরা দুজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। হয়ত আমার নামের কারনে। স্বাভাবিক। বাংলাদেশেও এরকম হবে আমি জানি। জ্যাক বলল
“টামিনা?”
“নো তাহমিনা”
“নামটা একটু কঠিন। একটু ছোট করা যায় না?”
“করা যায় তো”
“তাহলে প্লিজ করনা। এটা বেশি কঠিন।”
“তোমরাই কর।”
“আমরা?”
“অবশ্যই। করতে পারো।”
জ্যাক আর জিল দুজনে নিরবে খানিকটা নিজেদের মধ্যে শলা পরামর্শ করল। তারপর সোজা হয়ে আমার সামনে দাড়ালো।
“কি ঠিক করলে?”
“তোমার নাম যেহেতু একটু কঠিন। তাই আমার নাম টাকে একটু ছোট করেছি”
“আচ্ছা”
“এখন থেকে আমরা তোমাকে মিনা বলে ডাকবো”
“মিনা?”
“হ্যা। তোমার কোনো সমস্যা আছে?”
“না না ঠিক আছে”
জ্যাক আর জিলের সাথে আমার খুব ভালো বন্ধুত্ব্ হল। যত টা কঠোর দেখাচ্ছিল ঠিক ততটা কঠোর নয় তারা।
বিফ স্টেক এর সুস্বাদু লোভনীয় গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। আমার চরম ক্ষুধা পেয়েছিল। কিন্তু ওদের বিফ স্টেক আমার জন্য হালাল হবে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহে ছিলাম। আর যে জিনিসে সন্দেহ থাকবে তা না খাওয়ায় ভালো। তাই সবার অগোচরে থেকে বিফ স্টেক টা সরিয়ে রাখলাম। রাইস, সবজি এবং সবার শেষে ম্যাপল সিরাপ খেয়ে উদর পূর্তি করলাম। জীবনে প্রথম ম্যাপল সিরাপ খাচ্ছি। খুবই চমৎকার মিষ্টি পানীয়।
সবার শেষে আসলো সিজার। যেটাকে ককটেইল বলা হয়। এটা একরকমের মদ। আমরা যেটাকে সোজা বাংলায় ভদকা বলি। সবাই এক সাথে খাচ্ছে। মিসেস হুড আমাকে আমন্ত্রন জানিয়েছিল। আমি নম্র ভাবে অফার টা ফিরিয়ে দিলাম। তারপর ওখান থেকে একটু দূরে সরে এলাম। জ্যাক আর জিল বেতের সোফা গুলোতে শুয়ে পড়েছে। এতক্ষনে নিশ্চিত তারা ঘুমিয়ে পড়েছে।
আকাশে পূর্ন চন্দ্র উঠেছে। এ সময় টা এখানের জন্য উৎসবের সমান।
বুক ছিড়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো। আম্মা কে খুব মিস করছি। প্লিজ আব্বা, আমার আম্মা কে বেশি কষ্ট দিও না। উনার কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার। আমার মাথায় ভুত চেপে ছিল এখানে আসার।
.
সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেল। তাড়া হুড়া করে তৈরি হয়ে স্কার্ফ টা গলার সাথে পেচিয়ে ব্যাক প্যাক নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। ম্যাক ডারমোটে এভে আসতেই মনে হল না অত দেরী হয় নি। কারন সারি সব স্টুডেন্ট রা এগিয়ে যাচ্ছিল। হাফ ছেড়ে বাচলাম। ঘড়ি দেখা হয়নি। তাই এ সমস্যা। এখান কার সময়ের সাথে এখনো তাল মিলাতে পারছিনা।
ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতেই এডালিন এর সাথে দেখা। খুব খুশি লাগলো ওকে দেখে। সে তার দুজন বন্ধুর সাথেই দাড়িয়ে ছিল। হাই জানালাম তিন জনকেই। এডালিন তার বন্ধু দুজনের সাথে আমাকে পরিচয় দিল। ছেলেটির নাম কার্ল আর কোকরানো চুলের মেয়েটির নাম রিচা। বেশ ভালো লাগল তাদের। মনেই হয় নি তারা আমার সাথে এখন পরিচিত হয়েছি। কোনো সংকোচ ছাড়ায় হাসি খুশি ভাবে তারা আমার সাথে কথা বলতে লাগলো। আমার ভালোই লাগলো ব্যাপার টা। সবার সাথে কথা বলতে বলতে ক্যাম্পাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম তখন সাই করে একটা সাইকেল খুব দ্রুত এগিয়ে গেল। এত টা বিদ্যুৎ গতিতে এগিয়ে গেল যে এর পিছনে আসা বাতাসের সাথে আমার গলার স্কার্ফ টা খুলে গেল, রিচার বাদামী কালচে চুল গুলো বাতাসে উড়তে লাগলো, এডালিনের চোখ বন্ধ হয়ে গেল। আর কার্ল? ও এক চোখের ভ্রু কুচকে বির বির করে কি যেন বলতে লাগলো।
এখানকার সাইকেল প্রিয়তার কথা আমার আগে থেকেই জানা। কিন্তু এভাবে চালানোটা বেশ বিপদ জনক।
“ও এভাবেই চালায়। কারো কথা শোনেনা”
বলতে বলতে রিচা ফু দিয়ে মুখের উপর থেকে চুল গুলো সরালো। ফু দিয়ে মুখের উপর চুল সরানো দারুন একটা আর্ট। মনে হচ্ছে রিচা ভালোই চানে আর্ট টা।
তাকিয়ে দেখলাম রিচা চোখের সান গ্লাস টা এক আঙ্গুলে নিচু করে ওইদিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি বললাম
“কে?”
“কে আবার? দ্য গ্রেট সাইকেল মানব। মেয়েরা সব ওর পিছে পিছে ঘুর ঘুর করে”
কার্ল বলে উঠল
“তুই ও তো ওর পিছনে ঘুর ঘুর করিস”
রিচা উচু গলায় দিয়ে উঠল
“শাট আপ। রিচা কারো পিছনে ঘুর ঘুর করেনা। রিচার পিছনেই সবাই ঘুর ঘুর করে। যেমনটা তুই করিস!”
কার্ল মুখ ভেঙচিয়ে বলে উঠল
“বয়ে গেছে আমার তোর মত মাংকির পিছনে ঘুর ঘুর করতে।”
এ বলে ১০ নম্বর সতর্ক প্রাপ্ত বিপদ সংকুল স্থান থেকে কার্ল নিরাপদ দূরত্বে সরে গেল। আর রিচার মুখ টা দেখার মত হল। একটা নতুন মেয়ের সামনে এরকম একটা অপমান সে হজম করতে পারল না। সে চিৎকার দিয়ে উঠল।
“কি বললি? আমি মাংকি? ওয়েট! তুই আমার জন্য অপেক্ষা কর। তোকে দিয়ে যদি আমি লেডিস বাথরুম পরিষ্কার না করায় তবে আমার নামও রিচা না। মনে রাখিস।”
দূর থেকে কার্ল ও মুখ ভেঙচিয়ে কিছু একটা বলল। তবে বোঝা গেল না। রিচা থম থম মুখ নিয়ে এগিয়ে গেল। আর আমি হা করে এদের দা কুমড়া সম্পর্ক দেখছিলাম।
“এরা এমন কেন?”
“বাদ দাও তো টামিনা। এরা এমনই। এ ঝগড়া হবে, পানিশ মেন্ট হবে, আবার ঠিক হয়ে যাবে।”
“আচ্ছা”
এডালিনের সাথে এগুতে এগুতে সেই সাইকেল মানব কে দেখলাম। কালো টি গেঞ্জি পরিহিত সাইকেল মানব ছোট হেলমেট টা মাথার উপর থেকে খুলে বা হাতে ব্রাউন চুল গুলো কে ঠিক করছিল। যদিও বা আশে পাশে তেমন মেয়ে ছিল না। তবুও আশ পাশের অনেক মেয়ের তীক্ষ্ণ নজর তার উপর। একটু হেসে মনে মনে বললাম… পপুলার পারসন।
.
দুইটা ক্লাস শেষে আবারো চারজন একত্রিত হলাম। তবে রিচা আর কার্ল দুজন ক্লাসের দুই মাথায় বসেছে। আমি আর এডালিন সিট না পেয়ে শেষের দিকে বসেছিলাম। টিচার এখনো ক্লাসে প্রবেশ করে নি। এডালিন ক্লাসের বিভিন্ন স্টুডেন্ট সম্পর্কে ধারনা দিচ্ছিল।
“এ হচ্ছে রিয়ান। ক্লাসের টপ স্টুডেন্ট। কারো সাথে কোনো ভেজালে নেই। সব ধরনের শিট, নোট ওর কাছে থাকবেই। তবে পড়াশুনা বিষয়ক যে কোনো সাহায্য ওর কাছে কখনোই পাবে না। মিস লির অনেক প্রিয় স্টুডেন্ট সে। এ হচ্ছে রাঘব। ও ভারতীয়। এ ও তোমার মত নিউ কামার। তাই ওর সম্পর্কে বেশি বলতে পারছিনা। আর এ হচ্ছে এলিনা। ক্লাসের সেরা সুন্দরী। বলতে গেলে ক্যাম্পাসের বেশির ভাগ ছেলের প্রপোজাল সে পেয়েছে। ডেট ও করছে। কিন্তু আদো কোন ছেলের সাথে রিলেশন শিপে আছে বোঝা মুশকিল। সকালে এর সাথে তো বিকেলে এর সাথে।”
.
(চলবে)