আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -৯

0
2080

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৯
————————————————
পরনের টপস টা হাটু ছুই ছুই করছে। হাতাটা কনুই পর্যন্ত গোটানো। গলায় মোড়ানো স্কার্ফ টা ফাঁসের মত আটকে আছে। কিন্তু কিছু করার নেই। কাঁধে ব্যাক প্যাক, এক হাতে ট্রলি ব্যাগ আর অপর হাতে শিব লিঙ্গের মত সবুজ ছোট্ট ক্যাকটাস টা।
হোস্টেলের সামনে হা করে সামনে দাড়িয়ে আছি। এমন টা না যে আমি সাহস হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু কিছুটা নার্ভাস লাগছে। জানিনা রুম মেটরা আমাকে কিভাবে গ্রহন করবে।
.
অনেক সাহস সঞ্চয় করে ভিতরে প্রবেশ করলাম। ভিতরে প্রবেশ করতেই আমাকে আমার রুম দেখিয়ে দেয়া হল। রুমে মুখে দাড়াতেই একটা উজ্জল আলো চোখে ধাক্কা মারলো। বড় সড় একটা কামরা। গুনে দেখলাম ছয়টা বেড। ৫ জন মেয়ে। একজন সবে মাত্র বাথরুম থেকে বেড়িয়েছে। একজন পড়াশুনা করছে। একজন ফোনে বিজি। বাকি দুজন নিজেদের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে কথা কাটা কাটি করছে।
“হ্যালো!”
কেউ শুনলই না। এমন কি কেউ একজন যে দরজায় দাড়িয়েছে তাতে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। যে যার যার কাজে ব্যস্ত। আমি গলার স্বর আরেকটু বড় করে আবারো বললাম
“হ্যালো! আমি তাহমিনা। এখানে নতুন এসেছি!”
এবার সবাই এক যোগে তাকালো। যেন চিড়িয়াখানায় নতুন আসা কোনো প্রাণী কে দেখছে। একটু গলা খাকড়ি দিয়ে একটু করে হাসলাম।
কিন্তু বিনিময়ে কেউ সৌজন্যতাও প্রকাশ করলো না। যে যার যার কাজে ব্যস্ত রইল। অতপর তাদের উপর ভরসা না করা নিজের বেডের সামনে দাড়ালাম। ভাবতেই কষ্ট লাগছে যে এদের সাথে কি আমাকে কয়েকটা বছর কাটাতে হবে? আমি কি পারবো তাদের সাথে তাল মেলাতে? যদি না পারি তাহলে এপ্লাই করব এই রুমটা থেকে ট্রান্স ফার করার জন্য।
গোসল করে এসেই শুয়ে পড়লাম। প্রচুন্ড ঘুম আসছে। ওই মেয়ে দুটোর ঝগড়া থেমে গেছে। তবে রেশ টুকু এখনো রয়ে গেছে। যেন কোল্ড ওয়ার চলছে।
ব্যাগ থেকে সব কিছু বেরও করলাম। গত কয়েকদিন উৎসাহে ঘরের কথা তেমন মনেও আসেনি, কষ্টও লাগে নি। কিন্তু আজ ঘরের কথা খুব মনে পড়ছে। রাতে এক সাথে বসে ভাত খাওয়ার কথা মনে পড়ছে। খুব মিস করছি সবাই কে।
.
মধ্য রাতে ফোনের বিপ বিপ আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। হাতড়িয়ে ফোন টা কানে দিলাম।
“হ্যালো?”
“তাহমিনা?”
“আম্মা!”
লাফিয়ে উঠলাম। চোখ থেকে ঘুম পালিয়েছে।
“আম্মা তুমি কেমন আছো? বাড়ির অবস্থা কেমন? সবাই কি জেনে গেছে আমি পালিয়ে গেছি?”
“থাম তাহমিনা। সব ঠিক আছে। বাড়িতে ফোন করিস না। তোর আব্বা ফোন নিয়ে নিয়েছে। তাই কল দিতে পারি নি। এখন তোর আব্বা ঘুম। তাই কল দিচ্ছি। তুই কেমন আছিস? তোর ছোট মামার সাথে নাকি কথা হয়েছে?”
“হ্যা আম্মা হয়েছে।”
“ঠিক আছে। মাসে মাসে টাকা পাঠায় দিব। তবে কিছু লাগলে ফোন করে তোর মামা কে বলিস।”
“আচ্ছা।”
“মন দিয়ে পড়িস আর ঘুরে বেড়াস। তবে ছেলে দের কাছ থেকে দূরে থাকিস।”
“হুম”
এত উপদেশ শুনে আমার একটু কান্না আসছিল। পাছে আম্মা শুনে ফেলে তাই হু হা করে জবাব দিচ্ছিলাম।
“আর রান্না নিজ হাতে করিস। কারন ওখানের খাবারে পেট ভরবেনা। বুঝেছিস?”
“হাঁ”
“কি হু হা করছিস? যা বলেছি সব করবি। করতে না পারলে এখানে নিয়ে আসব। বুঝলি?
“আচ্ছা।”
ফোন টা রেখে দিলাম। ঠিক এই জিনিস টাকে আমি খুব মিস করছিলাম। আমার মেহেদির রাতে ঠিক কি হয়েছে বুঝতে পারছিনা। কিন্তু কিছু একটা হয়েছে। যার প্রভাব আম্মার উপরও পড়েছে। এ জন্যে তার সাথে এরকম চোরের মত কথা বলতে হচ্ছে।
দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এল বুক ছিড়ে। চোখ থেকে ঘুম পালিয়েছে। তাই নেমে এসে রুমের একমাত্র জানালাটির কাছে এসে দাড়ালাম। বাইরে হালকা হালকা বাতাস বইছে। রাত হলেও উজ্জল নীলে পুরো আকাশ টা নিজেকে রাঙিয়েছে। কোথাও একটুকরা মেঘ নেই। বিন্দু বিন্দু তারা গুলো সেই নীল রংয়ের উপর হীরার মত জ্বল জ্বল করছে। মনে হচ্ছে কোনো শ্যামলা তরুণী নীল রংয়ের হীরা খচিত শাড়ি পড়েছে। সে এক অনবদ্য শর্বরী। রুপে গুণে অনন্যা।
.
সকালে ভার্সিটির জন্য তাড়াতাড়ি বেরুলাম। একটু লাইব্রেরিতে ও যেতে হবে। কিছু নোটের প্রয়োজন আছে।
ক্যাম্পাসে ঢুকতে রিচা আর এডালিন কে দেখা গেলেও তাদের কে এড়িয়ে ক্লাসে প্রবেশ করলাম। সব গুলো অপরিচিত মুখ। চারদিকে তাকিয়ে আমি ভারতীয় ছেলে রাঘবের পাশে বসলাম। হোক না হোক সেও এশিয়ান। বাকিরা অনেক দূরের। তার দিকে একটু করে হাসি দিলাম। সেও দিল। যত টুক দেখলাম তাতে মনে হল সে ভীষন লাজুক। সমস্যা নেই। ছেলেরা লাজুক হলে সেটা জাদুঘরে সাজিয়ে রেখে দেখার মত।
.
যথা রীতি ৩য় পিরিয়ডে ম্যাথ ক্লাস। ম্যাথ ক্লাসে প্রবেশ করে আমি সিটে বসতেই কোথ থেকে লিও এসে হুর মুড় করে আমার পাশে বসে গেল। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। তার দিকে তাকাতেই সে হেসে বলল
“হাই”
কিছু বলতে গিয়েও এক গালে ডিম্পল ওয়ালা হাসি দেখে কিছু বলতে পারলাম না। ডিম্পল ওয়ালা হাসির উপর আমার চরম একটা দূর্বলতা আছে। ডিম্পল থাকায় ছোট বেলায় আমার এক স্কুল টিচারের দিকে সবসময় হা করে তাকিয়ে থাকতাম। দূর্ভাগ্য জনক ভাবে ওই টিচার টা বিবাহিত ছিল।
.
ক্লাস শুরু হলে মোটামুটি ভাবে আমি সমস্যায় পড়ে গেলাম। আমি কিছুই বুঝতেছিনা। মিস লির কথা সবাই হা করে গিলছে আর নোট করছে।
এমন কি লিও খুব মনোযোগ সহকারে নোট করছে। আর আমি শুধু উনার ঠোট নাড়ানো টাকেই গিলছি।
খানিকক্ষণ ইতস্থত করে লিওর দিকে তাকালাম। তারপর আস্তে করে ডাকলাম
“লিও?”
“হুম”
লিও আমার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো। আমি একটা ঢোক গিলে বললাম
“এই সূত্র টা আমি বুঝতেছিনা। এটা কোথ থেকে এসেছে?”
উত্তর না দিয়ে লিও আমার দিকে হা তরে তাকিয়ে রইল। এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকায় আমার অস্বস্থি হতে লাগলো। অধৈর্য্যর সুরে আবারো ডাকলাম
“লিও? তুমি কি শুনছো?”
লিও কিছু বলার আগেই মিস লি কন্ঠ শোনা গেল।
“সাইলেন্স প্লিজ।”
অগত্য হিজিবিজি রেখার গুলোর দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম।
.
এক দিন আগেও রিচা আর কার্লের মধ্যে ঝগড়া হলেও এখন সব মিট মাট হয়ে গেছে। বোঝায় যাচ্ছে না যে তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ আছে। এডালিন এসে ক্যান্টিনে যাওয়ার জন্য বলল। আমি না করে দিলাম। মূলত আমার মন খারাপ ছিল। সবাই পুরো দস্তুর পড়া লেখা করছে আর আমি এখনো বুঝতে পারছিনা। ক্যাম্পাসের বাগানে বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিলাম। সে সময় লিও এসে ধপ করে আমার পাশে বসে গেল। আমি চমকে উঠলাম। এ ছেলেটা সব সময় এভাবে হুট করে আসে কেন? বুকে থু থু দিতে হয় সব সময়। তার তো এখন ক্যান্টিনে থাকার কথা।
“ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট।”
তার কথায় মনোযোগ না দিয়ে বইয়ে ডুবে থাকলাম।
” হেই মিইইইরা! তোমার সাথে কথা আছে।”
এত পেচিয়ে আমার নাম টা ডাকার জন্য মাথা খারাপ হয়ে গেল। জবাব দিলাম না তার কথার।
“মিইইইরা?”
আমার রেসপন্স না পেয়ে লিও হুট করে আমার হাত থেকে বই টা কেড়ে নিল।
“লিও! কি করছো?”
“এত কিসের স্টাডি করছো? সব ফেলো। কিছুই বুঝবেনা।”
“বুঝতেছিনা তাই তো পড়ার চেষ্টা করছি। এ বলে বই টা নিতে চাইলাম। কিন্তু লিও বইটা আরো উপরে নিয়ে গেল।
“থামো”
আমি থেমে গেলাম।
“তোমার জন্য একটা অফার আছে।”
ভ্রু কুচকে বললাম
“কিসের অফার?”
ধুসর চোখ দুটোতে চঞ্চলতা খেলা করছে। মুখের এক কোনে ডিম্পল ওয়ালা হাসি ফুটে উঠেছে। ইচ্ছা করছে সেই ডিম্পল টাতে আঙ্গুল টা ঢুকিয়ে দিই। কিন্তু নাহ। নিজেকে সংবরন করলাম।
ভ্রু নাচিয়ে লিও বলল
“Be my student.”
.
(চলবে)
.
দুঃখিত 🙁

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here