আমি কাউকে বলিনি সে নাম তামান্না জেনিফার পর্ব ১৪

আমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ১৪
__________________________
সকাল সকাল আলেয়া চাচীর সাথে বেশ একটা তর্কযুদ্ধ হয়ে গেছে রূপার ৷ নিপার বৌভাতে আলেয়া বেগম যাচ্ছেন না কারণ সবাই চলে গেলে তার বড় জা সুফিয়া বেগমকে দেখে রাখার জন্য আপন কেউ থাকবে না ৷ তা তিনি যাবেন না বেশ ভালো কথা , না যাক ৷ সমস্যাটা হলো তিনি যাবেন না জন্য রূপাকেও তিনি পাঠাবেন না ৷ ভাবীরা তো যাচ্ছে , রূপা তো তাদের সাথেই যেতে পারতো ! কিন্তু চাচীর এক কথা “একলা ছাড়ুম না সেয়ান মাইয়্যা ” … এতগুলো লোক যাচ্ছে , তাহলে সে একলা হয় কিভাবে ! রূপা কত কিছু ভেবে রেখেছে , নিপা আপার শ্বশুরবাড়িটা কেমন এটা জানার জন্য ভেতরটা অস্থির হয়ে আছে ! শুনেছে আশেপাশের দশগ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বড় বাড়ি তাদের ৷ বাড়ির সামনে না কী একটা ফোয়ারা আছে! ফোয়ারা জিনিসটা কী কে জানে .. সে যে কত সাধ করে আছে ফোয়ারা দেখবে সে কথা কী আলেয়া চাচী বোঝে না ! আসলে সবই বোঝে , ইচ্ছে করে তাকে যন্ত্রনা দেয় !

রূপার দুচোখ জলে ভরে যায় ৷ ওবাড়ি যাবার আগে মানিক চাচা একবার আলেয়া বেগমকে বলেছিলেন “বউ , যাইতে দেও না রূপারে ৷ আমি দেইখ্যা রাখুম ৷ ওর হাত ধইরা রাখুম ৷ ” জবাবে আলেয়া বেগম এমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাঁকিয়েছে যে মানিক মিয়া আর কথা বলার সাহস পায়নি ৷ বিবাদহীন জীবন তার পছন্দ , বউয়ের সাথে বিবাদে যান না তিনি কখনই ৷

দুপুর বেলা আলেয়া চাচী রূপাকে খেতে ডাকলেন , যেন কিছুই হয়নি এমন ভাবে ! অথচ সকালেই বলেছেন “বেসাইস্তা লবলবি , একলা একলা যাইতে চায় সাহস কত বড় ! এমুন বেহায়া মাইয়্যা জীবনে দেখি নাই ৷ আমার গলায় আল্লাহ এই বিষের মালা ঝুলায়ে দিছে , জীবনডা শ্যাষ করে দিলো আমার …আর একবার যাইতে চাইলে এই ঘরের বাঁশ খুইলা তর পিঠে ভাঙমু লবলবি কুনহানকার ! ” মনে হচ্ছে সকালে বলা গালিগুলো এখন সব ভুলে গেছেন আলেয়া বেগম ৷ কিন্তু রূপা কিছুই ভোলেনি ৷ রাগ করে সে বসেই থাকলো বারান্দায় ৷ আজ তার বাসী বিয়ের খাবার কথা , সেটাই যখন হলো না দরকার নেই আর খাওয়ার ৷

আলেয়া বেগম ভাত নিয়ে রূপার কাছে এসে বসলেন ৷ রূপার উস্কখুস্ক চুলে হাত দিয়ে বললেন

— খালি বকাবকি করি সেইটাই দেখলি ! তরে নিয়া আমি সারাক্ষন চিন্তা মধ্যে থাকি এইটা দেখলি না ! মা রে তুই বড় হইতাছোস ! এখনও বাচ্চাদের মত ব্যবহার করলে হইবো ? নিজের কোনো যত্ন নেস না , সুযোগ পাইলেই বাড়ির বাইরে যাস … আমার ভয় করে !

—আমারে নিয়া কারো চিন্তা করনের দরকার নাই

—তুই আমার দায়িত্ব , ছুটোকাল থেইকা তরে আমি পালতাছি , আমি চিন্তা না করলে কে করবো ? রাগ করিস না , খাইয়া ল ! সকালেও খাস নাই ৷ তরে খাবার দিয়া তর বড়চাচীরে খাওয়ামু ৷ বইসা থাকনের কপাল কী আমার আছে ?

—আমি কী ছুটো বাচ্চা যে হারায়া যামু ? ক্যান আমারে বাইন্ধা রাখো চাচী ?

—মাইয়্যা মানুষ যেইদিন জন্মায় থেইকা যেইদিন মরে , এর মধ্যের একটা দিনও নিরাপদ নয় ৷ বাইরে শকুন ,ঘরে শকুন … সবার নজর খালি মাইয়্যা মানুষের শইল্যে ৷ সেই শইল্যে যহন যোয়ার আসে তহন আলোর দিকে ছুইট্টা আসা পোকার মত কিলবিলায়ে পুরুষ মানুষ আসে তার দিকে ৷ ছোক ছোক করে কখন …. শোন রূপা , সব কথা তরে কইতে পারুম না আমি ৷ খালি এইটা জাইনা রাখ আমি তর শত্তুর না ! ভাত রাইখা গেলাম , খাইস ৷ বড়ভাবীরে খাওয়ামু ৷ খাইয়া লইস , অন্নের উপর রাগ করন ভালা না …

রূপা আলেয়া চাচীর সব কথা বোঝে না ৷ তারপরও যতটুকু বোঝে ওর মনে হয় হয়তো চাচী ঠিক কথায় বলেছে ৷ এইতো দুদিন আগেও দুপুরে চাচীর চোখে ফাঁকি দিয়ে দোকানে হজমি কিনতে গিয়েছিল যখন , দোকানদার চাচা তার হাত টেনে ধরেছিল ! এত ঘিনঘিন করে উঠেছিল সে সময় তার শরীরটা ! লজ্জায় ঘৃনায় হজমির দাম দোকানদারের মুখে ছুড়ে দিয়ে দৌড়ে এসেছিল সে ৷ সব না বুঝলেও কিছু তো সে বোঝে ! হঠাৎ করেই একদম পরিচিত মানষগুলো তার দিকে অপরিচিতের মত করে তাকায় ৷ সেই লোভী চোখগুলোর কথা সে কাউকেই বলতে পারে না ৷ এমন কী বড় চাচার বাড়ির কাজের ছেলে রতন তাকে দেখলেই নোংরা একটা হাসি দেয় ! একা পেলেই পথ আটকে দাঁড়ায় ৷ ধমক দিলেও সেই নোংরা হাসি … রূপার গা ঘিনঘিন করে উঠে !

চাচী একেবারেও ভুল বলেনি ৷ এই প্রথমবার রূপার মনে হয় চাচী মানুষটা খুব খারাপ না … ভাতের প্লেট কাছে টেনে নেয় রূপা ৷ দূর থেকে বড় জা’কে খাওয়াতে খাওয়াতে সে দৃশ্য দেখেন আলেয়া বেগম ৷ একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ভাবেন , এবার তারও খেতে হবে … সকাল থেকে তিনিও খাননি ..

*********

জহুরা আর লাকী খুবই অবাক হয়ে দেখলো একটা মেয়ে নিপাকে সাজিয়ে দিচ্ছে ৷ একটু আগেই তারা জেনেছে এই মেয়েটা নিপার সতীন ৷ সতীন কেন সতীনের সাথে এমন হেসে কথা বলবে ! সতীনের উপর বিয়ে হয়েছে শোনার পর থেকেই তারা দুজনই মন খারাপ করে ছিল ৷ এখন এই পরিস্থিতি দেখে মন খারাপ করবে না অবাক হবে এটাই বড় প্রশ্ন !

নিপাকে দেখে মনে হচ্ছে ভাবলেশহীন একটা প্রাণী ৷ যার দেহে হৃদপিণ্ড হয়তো ধ্বক ধ্বক করছে কিন্তু তারপরও দেহ নিঃসার …. চোখে অশ্রু নেই কিন্তু দিপ্তীও নেই ৷

সুমাইয়া মেয়েটাকে ভালো লাগছে তার , আর কাউকেই ভালো লাগছে না ৷ স্বামী মানুষটাকে সবচেয়ে অসহ্য লাগছে ৷ সুমাইয়া তার সাথে এমন ভাবে মিশছে মনে হচ্ছে যেন রূপা ! এতটুকু সময়েই বেশ বোঝা যাচ্ছে মেয়েটার মনটা সরল ৷

সুমাইয়া বকবক করলেও নিপা ছিল নিশ্চুপ শ্রোতা ৷ খাবারের ব্যাচ বসা শুরু হয়েছে শুনে সবাই যখন ঘর খালি করে চলে গেল , তখন নিপা প্রথম কথাটা বললো ! সুমাইয়ার হাত ধরে বললো

—বুবু , আল্লাহর কসম আমি জানতাম না তার আগের বউ আছে ! জানলে আমি জান দিতাম তবু কবুল কইতাম !

—আরে পাগল করে কী ! আমি জানি রে বইন … কাউরে চেনা বাকী নাই আমার ৷

—আজ তো আমার বাপের বাড়ির লোকেরা আমারে নিয়া যাইবো ৷ আমি আর ফেরত আসুম না বুবু … কারো সংসার ভাইঙা নিজের সংসার আমি সাজাইতে পারুম না …

—হা হা হা!সংসার …. তা তুমি না আইতে চাইলেই যে সেইখানে তারা তোমারে রাখবে তার নিশ্চয়তা কী বইন ! যাও , ঘুইরা আসো ! তারা রাখতে রাজী হইলে অবশ্যই থাকবা …

—অবশ্যই তারা সব জানলে পরে রাজী হইবো ৷ আমার আব্বা আমারে খুব ভালোবাসে ৷ সে ও আমার মতই কিছুই জানতো , জানলে আমারে এই ঘরে সে কুনোদিনও পাঠাইতো না !

—আচ্ছা ঠিক আছে ৷ এইবার মুখ বন্ধ লিপিস্টিক লাগামু ৷ এরপর কাজল দিমু , চোখ পিটপিট করবা না একদম কয়া দিলাম ..,

নিপা মুচকি হাসে সুমাইয়ার কথা শুনে ৷

সুমাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে “পাগল মেয়েটা এখনও বোঝেনি , বিয়ের পর বাপ মা সবার আগে পর হয়ে যায় ৷ মেয়ে মানুষ বাপের কাঁধের বোঝা ৷ একবার ঝেড়ে ফেলার পর সেই বোঝা আর কেউ কাঁধে নিতে চায় না ! ”

চলবে—

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here