আমি কাউকে বলিনি সে নাম তামান্না জেনিফার পর্ব ১৫

আমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ১৫
__________________________

তিনটে মাস কিভাবে কিভাবে যেন চলেই গেল ৷ সেই যে ঘুরানি ফিরানিতে বাবার বাড়ি গিয়েছিল নিপা , সেখান থেকে সে বাড়ির সাথে সম্পর্ক শেষ করেই এসেছে এ বাড়িতে ৷ এখন মাঝে মাঝে ঐদিনের কথাগুলো খুব মনে পড়ে ৷ প্রতিবার নিজেকে নিজেই বোঝায় ৷ গত তিনমাসে নিপা ভুলে যেতে চেয়েছে তার বাবার বাড়ির স্মৃতি , বাবার স্মৃতি কিন্তু ঘুরে ফিরে ঐ স্মৃতিগুলোই যেন নানান রঙে সামনে আসে প্রতিনিয়ত ৷

এ বাড়িতে যে নিপা খুব সুখে আছে তা নয় ৷ স্বামী মানুষটা বিয়ের পর সপ্তাহ খানেক বেশ ভালোমানুষী দেখিয়েছে ৷ তারপর থেকেই আসল রূপে ফিরতে শুরু করেছে ৷ গভীর রাতে বাড়ি ফিরে কোনদিন তার কোনদিন সুমাইয়ার সামনে নিজের পুরুষত্ব জাহির করে ৷ সুমাইয়া ভেবেছিল তার হয়ত মুক্তি মিলবে , কিন্তু মুক্তি তারও মেলেনি ৷ সব কিছুর সাথে লড়াই করলেও স্বামীর সাথে লড়াইটা সুমাইয়ারও করা হয়ে উঠে না ৷ নিপা শুনেছিল স্বামীর ভাগ কাউকে দেওয়া যায় না , সেই কষ্ট অবর্ননীয় ৷ কিন্তু যেদিন ইরফান নিপার ঘরে থাকে সেদিন স্বস্তিতে ঘুমায় সুমাইয়া আর সুমাইয়ার ঘরে থাকলে স্বস্তিতে ঘুমায় নিপা ৷

নিপার শাশুড়ির মেজাজ সবসময় কড়া , বাড়ির চাকর বাকরদের সারাক্ষন ধমকের উপর রাখা তার একমাত্র কাজ ৷ তবে সুমাইয়ার সামনে একটু যেন চুপই হয়ে যান তিনি ৷ সুমাইয়ার সাথে না পারলেও নিপার উপর ছড়ি ঠিকমতই ঘুরান ৷ এ বাড়িতে আসার পর তার দুই বার মাসিক হলো, দুইবারই কিভাবে যেন টের পেলেন তিনি ! দুইবারই প্রচণ্ড রাগ হলেন , চিৎকার করলেন … তার একটাই কথা এখনও বাচ্চা পেটে আসছে না কেন ! আবার দিন ঘনিয়ে আসছে ,সে কথা মনে পড়লেই নিপার বুক ধ্বক ধ্বক করে ৷ আবারও সেই অশান্তি ! এ বাড়িতে যেন তাকে আনা হয়েছে শুধুমাত্র সন্তান জন্ম দেবার জন্য ! নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে ওর , কিন্তু পালিয়ে যাবারও জায়গা নেই ৷ একটা যাও জায়গা ছিল , নিজেই সেখানে যাবার পথ বন্ধ করে দিয়ে এসেছে সে !

এরা যা করছে , সহ্য করতে কষ্ট হয় কিন্তু তার বাবা যা করেছে তা বুকে একসাথে লক্ষ ছুড়ি বেঁধার মত কষ্ট ! পর যখন আঘাত দেয় সে আঘাত তবুও সহ্য হয় , আপনের দেওয়া আঘাত সহ্যসীমার বাইরে … সে আঘাতে হৃদয়টা এমনভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় যে তা আর জোড়া লাগে না …

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিপা আবার কাজে মন দেয় ৷ দীর্ঘশ্বাসটাই এখনও নিপার আপন আছে , এটা এখনও তাকে ছেড়ে যায়নি …

********

রতনের বড্ড বাড় বেড়েছে ৷ এত বড় সাহস ওর হয় কী করে ! দুপুরবেলা বাড়ির পেছনের আমগাছে টাঙানো দোলনায় বসে ছিল রূপা ৷ এমন সময় রতন এসে ওর হাত চেপে ধরে বলে “তোমারে আমি ভালোবাসি ৷ তোমারে আমি বিয়া করমু ৷ বিয়ার পর তোমারে এমন সোহাগ করমু যে দুনিয়াদারী ভুইলা যাবা তুমি …” কথাগুলো বলে অশ্লীল ভঙ্গিতে হাসে ৷ রতনের সাহস দেখে রাগে গা কাপছিল রূপার ৷ এক ধাক্কা দিয়ে রতনকে ফেলে দিয়ে বাড়ির ভেতর দৌড়ে ঢুকতে ঢুকতে সে শুনতে পায় পেছন থেকে রতন খ্যাক খ্যাক করে হাসছে আর বলছে “মাইয়্যা মানষের এত দেমাগ ভালা না ! একবার খালি সুযোগ পাই , দেমাগ এমনে ছুটামু যে এই রতইন্যা ছাড়া গতি থাকবো না ! চাচা চাচী লইয়া আমার পায়ে ধইরা বইসা থাকবা শুইনা রাখো ! ”

বেশ কিছুদিন থেকেই নানা ভাবে রূপাকে উত্যক্ত করছে সে ৷ কিন্তু গত কয়েকদিন হলো সেটা চরম মাত্রায় বেড়েছে ৷ রূপার তো মনে হয় রতন সারাক্ষন তার পেছন পেছনই থাকে , যখন তাকে একা পায় শুরু করে বিরক্ত করা … অসহ্য লাগে , নিজের উপরও রাগ হয় ! একবার ভাবে চাচীকে সব বলবে , আবার ভাবে চাচী জানতে পারলে তাকে ঘরে বন্দী করে ফেলবে ….

উঠানে একটা বড় লিচু গাছ ৷ গত বছর লিচু গাছের গোড়াটা শান বাঁধানো হয়েছে ৷ দুপুরবেলা এই শানের উপর শুয়ে থাকতে খুব ভালো লাগে রূপার ৷ আজ এখানে বসেই হাফাচ্ছে সে ! মাথার ভেতর শুধু একটাই চিন্তা কী করলে এই আজাব থেকে মুক্তি মিলবে !

নয়ন অনেকক্ষন থেকেই দেখছিল রূপা গাছতলে বসে হাফাচ্ছে ৷ একটু আগে দৌড়ে এসে এখানে বসেছে ! ও কী কোন কিছুতে ভয় পেয়েছে ?

দুদিন হলো বাড়ি এসেছে নয়ন ৷ এবার এসেছে অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে ৷ কলেজে দুই রাজনৈতিক দলের ছেলেপেলেদের মারামারিতে একজন খুন হয়েছে ৷ কলেজ তাই বন্ধ অনির্দিষ্টকালের জন্য !

বাড়িতে থাকতে বেশি একটা ভালো লাগে না নয়নের ৷ গ্রাম কেমন যেন বদ্ধ লাগে তার , শহরই বরং খোলামেলা ৷ বাড়িতে থাকলে মায়ের বাড়তি আদর … সেই আদরেও অভক্তি তার ! বরং মায়ের উপর তার অনেক রাগও জমানো ৷ আগে যখন সবাই একসাথে থাকতো তখন খুব ভালো লাগতো ওর ৷ বড়চাচী পাগল হলেও সবসময়ই নয়নকে আলাদা ভালোবেসেছে ৷ কার অবশ্য কারণও আছে ৷ যে বয়সে ছেলেরা বল নিয়ে বাইরে খেলা শুরু করে সেই বয়সে নয়ন বড়চাচীর জানালার পাশে বসা শুরু করেছিল ৷ চাচীর সাথেই ছিল তার যত খেলা ৷ ও জানালার নিচে বসে আস্তে করে বলতো “টুকি” … সাথে সাথেই চাচী জানালায় এসে বলতো “ঝা…” এই এক খেলাই চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা ৷ দুজনের একজনও ক্লান্ত হত না ৷

আশেপাশের মানুষগুলো এই দৃশ্য বেশিদিন সহ্য হলো না ৷ একটা পাগলকে সবাই ঘৃনা করবে , ভয় পাবে এটাই যেন সত্য ! কেউ তাকে ভালোবাসবে কেন ? আশেপাশের মানুষগুলো আলেয়া বেগমের কানে কুমন্ত্রনা দেওয়া শুরু করেছিল ৷ পাগলের খপ্পরে পড়ে তার ছেলের কী কী ক্ষতি হতে পারে তা শুনতে শুনতে একসময় বিদ্রোহ করে বসলেন ৷ স্বামীকে রাজী করালেন সংসার ভাগ করতে ৷ নয়ন খুব কেঁদেছিল , কিন্তু তার কান্না সেদিন কেউ দেখেনি ৷ মায়ের উপর রাগ করে বড় চাচা বললেন “আলাদা সংসার পাতো ” …. সেই থেকেই নয়নের মন উঠে গেল গ্রামের উপর থেকে ৷

রূপা এখন কাঁদছে ! সমস্যা তো কিছু একটা হয়েছেই ৷ নয়নের খুব ইচ্ছে করছে মেয়েটার পাশে গিয়ে বসতে ৷ কিন্তু সব ইচ্ছের দাম দিতে হয় না ৷ নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় নয়ন ৷ কাঁদুক রূপা , শান্ত হোক ৷ তারপর না হয় জানা যাবে …

চলবে—

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here