আমি সেই চারুলতা পর্বঃ১২

0
1393

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Ahmed_Priya
#পর্বঃ১২
_______________________

সময় ছুটে চলে আপন গতিতে। তাকে থামানোর সাধ্য কার? তেমনি হামিদ চলে গেছে প্রায় দুই মাস হতে চললো কিন্তু এখনও অবধি ফিরে আসেনি সে। চারু প্রতিদিন অপেক্ষা করে আজ বোধহয় হামিদ ফিরে আসবে কিন্তু না হামিদ আসে না কিন্তু আশা ছাড়েনা চারু নিজেও। সে বিশ্বাস করে একদিন হামিদ ফিরে আসবেই। একেকটা নতুন দিন তার জন্য বাঁচার নতুন আশা। দিন ফুরিয়ে যাওয়ার আগে ফিকে হয়ে আসে তার বাঁচার আশাও। চারু জানতো হামিদ চলে যাওয়ার পর তার জীবন খুবই যন্ত্রণাদায়ক হবে তাই হয়তো এত অত্যাচারের পরেও সে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। কারোর কাছে কষ্ট মুখ ফুটে বলতে পারেনা। কাউকে বলতেও পারেনা নাজিমুদ্দিন আর শেফালীর আগের সম্পর্কের কথা। তাদের যদি গ্রাম থেকে বের করে দেয় তাহলে চারুর কি হবে? সে কিভাবে বেঁচে থাকবে? একটা একা মেয়ে কিভাবে বেঁচে থাকে? হামিদ থাকলে যেইটা হওয়া খুবই সহজ ছিলো হামিদ চলে যাওয়ায় সেটা হয়েছে কঠিন থেকে কঠিনতম। চারুর বিয়ের তোড়জোড় করছে নাজিমুদ্দিন আর শেফালী। চারু বুঝতে পারে কিন্তু তার বলার কিছুই নেই। তার জীবনে বোধহয় এভাবেই ধ্বংস হওয়া লেখা আছে। বিকেল বেলায় নদীর পাড়ে এসে বসে থাকে চারু। এই সময়টুকু তার নিজস্ব। সন্ধ্যা নামার কিছুক্ষণ আগে কেউই এখানে আসেনা তাই শাওনও এসে চারুকে প্রতিদিনই সঙ্গ দেয়। এভাবে প্রতিদিন দেখা করলে কারোর না কারোর নজরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তাই শাওন কোথাও থেকে অনেক গুলো বাচ্চা জোগাড় করেছে। কেউ এলেই যেনো তারা জানায় আর ওরা সতর্ক হয়ে যেতে পারে। বেশিরভাগ সময়েই তাদের মধ্যে কোনো কথা হয়না। চারু একদৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। শাওন কথা এগোতে চাইলেও চারু হু হা ছাড়া কিছুই করেনা। বাধ্য হয়েই শাওনও চুপ করে নদী দেখতে থাকে। এই কয়েকদিনেই চারু যেনো নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে। তার ধারণা চারু হামিদের জন্য কষ্ট পায় কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারেও শাওন চারুর দুঃখ গুলো বুঝতে পারেনা।
– তোর চোখমুখ এমন শুকায়া যাইতাছে ক্যান চারু? ঠিক মতো খাস না?
চারু নিরুত্তর। আসলেই সে দুদিন যাবত কিছু খায় না। কাজে কোনো ভুল করলেই শেফালী তাকে না খায়িয়ে রাখে তাতে সায় দেয় নাজিমুদ্দিন নিজেও। চারুর মাঝেমধ্যে চিৎকার করে নাজিমুদ্দিনকে বলতে ইচ্ছে করে, “বাবা তুমি এমন করো কেনো আমার সাথে? আমার কষ্ট কি তোমার চোখে পড়েনা? না পড়লে কেনো পড়েনা? আমি তো তোমারই মেয়ে। তোমারই অংশ। তাও কেনো আমার কষ্ট তুমি দেখতে পাও না?” হাতে পুড়ে যাওয়ার দাগ। শেফালী উনুন থেকে কাঠ উঠিয়ে সেটা দিয়ে ছেকা দিয়েছিলো চারুর হাতে। আবার সে হাত দিয়েও সব কাজ একা হাতে করিয়েছে এমনকি ১০৫° জ্বর নিয়েও সমস্ত কাজ একা হাতে করতে হয়েছে চারুকে। স্বাভাবিক অবস্থায় হয়তো এত জ্বরে অনেকে দাঁড়িয়ে থাকতে অবধি পারেনা।
– কি রে কথা কস না ক্যান? চোখের নীচে কালি পড়ছে ক্যান? ঠিকঠাক ঘুমাস না? চোখ এমন গর্তে ঢুইকা গেছে ক্যান?
– কেনো আমাকে সুন্দর লাগেনা? সুন্দর না লাগলে আমাকে ভালোবাসবেনা নাকি?
– পাগল হইছস? কি বলস এইগুলা?
– ঠিকই বলেছো। পাগলই বোধহয় আমি হয়ে যাচ্ছি শাওন ভাই। বাবা মনে হয়না বেশিদিন আমাকে রাখবে। খুব শীঘ্রই বিয়ে দিয়ে দিবে। সেখানে গিয়ে যদি একটু শান্তি পাই।
– মজা নেস আমার সাথে? আমি কসম কইরা কইলাম তোর বিয়া অন্য কারোর লগে হইলে আমি বিষ খামু। তুই শুধু আমার।
– তোমার মা তো মানে না শাওন ভাই।
– তোরে নিয়া আমি দূরে চইলা যামু। ভাইজান সব ব্যবস্থা কইরা দিবো।
– আমি কিভাবে যাবো? আমি যদি চলে যাই তাহলে আমার ভাই আমাকে নিতে আসলে তো আমাকে পাবেনা।
– তুই এহোনো বিশ্বাস করস হামিদ ফিরা আইবো? সাত দিনের কথা বইলা গেছে। দুই মাস শেষ হইতে চললো।
– মানুষ তো দশ বছর পরেও ফিরে আসে তাহলে আমার ভাই কেনো আসবেনা?
– পাগলের মতো কথা কইস না। দুই কুলই হারাবি শেষে। হামিদ আর ফিরবোনা।
– যদি ফিরে।
– আর যদি ফিরার আগেই তোর বিয়া দিয়া দেয়?
– বিয়ে ঠিক করে ফেললে নাহয় তোমার সাথে চলে যাবো। কিন্তু আবার আমি ফিরে আসবো। আমার ভাই আমাকে খুজতে আসবে। আমি জানি।
শাওন আর কথা এগোনোর জন্য কথা পায়না। কি বোঝাবে চারুকে? চারুর আচরণ মাঝেমাঝে বাচ্চাদের মতো হয়ে যায় আর সেই বাচ্চা চারুকে কিছুই বোঝানো যায় না। সে বুঝতে চায়না। বোঝানোর সাধ্য অন্তত শাওনের নেই। সন্ধ্যা হওয়ার আগ মূহুর্তে বাসায় ফিরে এলো চারু। তাকে দেখেই আবার শেফালী চিৎকার চেচামেচি শুরু করলো। চারুর এই বিকেলে বের হওয়া সে খুবই অপছন্দ করে। এর জন্য কম গালমন্দ খেতে হয়না চারুকে। চারুর আর এখন এসব গায়ে লাগেনা। শেফালীও চারুর উপর মনমতো অত্যাচার করতে পেরে খুব খুশি। হামিদ থাকাকালীন যেসব চারুকে দিয়ে করানোর চিন্তাও করতে পারতোনা এখন অনায়াসে চারুকে দিয়ে সেসব কাজও করায়।
আবারও কাটে এক বিষাদময় রাত। চারুর বেঁচে থাকার জন্য শুরু হয় নতুন এক উদ্দীপনা এক নতুন দিন। দিন শেষ হওয়ার সাথে সাথে আবারও ফিকে হয়ে যাবে সে উদ্দীপনা।
– তোরে একটা শাড়ি কিনা দিছিলো না?
– হুম।
– আইজ ওইটা পড়বি। তোরে দেখতে আইবো আর সুন্দর কইরা সাজবি। পছন্দ না হইলে তোর কপালে দুঃখ আছে। আর এমন শুকনা মুখে বইসা থাকবি না। ওদের সামনে বইসা যেনো হাসতে দেখি।
চারু কিছুই বললো না। যেখানে ওর কথার কোনো দামই নেই সেখানে কথা বলা বোকামির কাজ। বিয়েটা হয়তো দিয়েই দিবে। নাজিমুদ্দিন বা শেফালী নিশ্চয়ই যাচাই-বাছাই করবেনা। কারোর ঘাড়ে গছিয়ে দিতে পারলেই তারা বাঁচে। আগে দেখতে হবে বিয়ে কবে ঠিক করে তারপর হিসেব করে তার আগের দিন চলে গেলেই হবে। বিয়ের আগের দিন অবধি সে হামিদের জন্য অপেক্ষা করবে। আচ্ছা শাওন তাকে নিয়ে কোথায় যাবে? ধুর, যাবে কোথাও একটা। এত ভেবে লাভ আছে? শিহাবই নিশ্চয়ই কোনো ব্যবস্থা করবে। শেফালী এসে কিছু চিড়া দিয়ে গেলো। শুকনো চিড়া। চারুর গলা দিয়ে সেটা নামতে চাইলো না। কোনোমতে দুমুঠো খেয়ে বাকিগুলো রেখে দিলো। পেট ভরেনি। ভরার কথাও না। খাওয়া শেষে চারু নিজের কাজ শুরু করলো। কাজ শেষে যথারীতি শেফালীর কথামতো তৈরিও হয়ে নিলো।
চারুকে বাইরের বারান্দায় নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানেই একটা কোনা খুব সুন্দর করে গোছানো। এখানেই চারুকে দেখানোর জান্য পাত্রপক্ষকে রাখা হয়েছে। চারু তাদের সামনে থাকা একটি চেয়ারে বসলো। দুজন মধ্যবয়স্ক লোক। সম্ভবত, পাত্রের বাবা আর কাকা।
– তোমার নাম কি?
– চারুলতা।
– শুনলাম এহোনো নাকি লেখাপড়া করো? কোন ক্লাস?
– দশম শ্রেনিতে উত্তীর্ণ হয়েছি।
– বয়স কত তোমার?
– পনেরো
আরো কিছু প্রশ্নত্তোরের মুখোমুখি হতে হলে চারুকে। শেফালী আর নাজিমুদ্দিন পাশেই বসে ছিলো। তারা নিজেদের মধ্যে কিছু কথা বলছিলো। কথার ধরনেই চারু বুঝলো এরা পাত্রের বাবা কাকা কেউ নয় এরাই স্বয়ং পাত্র এবং পাত্রের বন্ধু। কথায় শুনতে পারলো পাত্রের নাম জামাল হোসেন আর তার সাথের বন্ধুর নাম সবুজ আলী। দুজনের ঠোঁটই পান খাওয়ার ফলে লাল হয়ে আছে। চারুর কেমন গা ঘিনঘিন করে উঠলো। এমন একজন লোকের সাথে কি না চারুর বিয়ে হবে? এই লোকগুলোর দৃষ্টি চারুর ভালো লাগছেনা, মনে হচ্ছে যেনো চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে তাকে। ছিহ! কি অস্বস্তিকর পরিবেশ। চারুকে পছন্দ হয়েছে জামাল হোসেনের। তাদের কথাবার্তায় ঠিক করা হলো শুভ কাজে দেরি করতে নেই তাই আজ রাত ৮ঃ০০ মিনিটে চারুর সাথে জামাল হোসেন নামক মধ্যবয়স্ক লোকটির বিয়ে হবে। চারু অবাক বিষ্ময়ে এই চারজন লোকের দিকে তাকালো। ওর কাছ থেকে কেউ অনুমতি নেওয়ার কথা ভাবলো না এমনকি বিয়ের জন্য সময়ও নিলো না। আজ রাতেই নাকি চারুর বিয়ে। এখন কি হবে? হামিদ এখানে নেই। শিহাব শহরে আর শাওন কিছু জানে না। যেভাবেই হোক, শাওনের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। কিন্তু কিভাবে? কালকে বিয়েটা ঠিক করলেও আজ বোধহয় তারা চলে যেতে পারতো কিন্তু এখন কি হবে? চারুর বিয়ের খবর দ্রুতই পৌঁছে গেলো প্রতিবেশীদের কাছে। জামাল হোসেন বা সবুজ আলী যায়নি। বিয়ে শেষ করে একেবারে চারুকে নিয়ে বাসায় ফিরবে তারা।

বিকেল ৫ টা, গ্রামবাসীরা দলে দলে দেখতে আসছে চারুকে। অনেকে আবার জামাল হোসেনকে দেখে মনেমনে আফসোস করছে। মনোরমা বেঁচে থাকলে কখনোই এর সাথে চারুর বিয়ে হতে দিতো না। অবশ্য গ্রামে এমন বিয়ে অহরহ হয়ে চলেছে। নাজিমুদ্দিন নিজেও তো প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সে মাত্র বিশ বছর বয়সী এক যুবতীকে বিয়ে করেছে।
নিজের ঘরে অনুভূতিহীন পাথরের মতো বসে রয়েছে চারু। আজ শেফালী তাকে ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছেনা। সাথে সবসময়ই কেউ না কেউ বসে আছে৷ চারুকে কেউ বিন্দুমাত্র একা ছাড়ছেনা। অনেকে আবার চারুকে সাজানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে তবে চারু নিশ্চুপ। পুরো গ্রামবাসী তো জেনে গেছে চারুর বিয়ের কথা তবে শাওন কি জানেনা? তার পাশেই একদল তরুনী শাড়ি গয়না গুছিয়ে রাখছে। কিছুক্ষণের মাঝেই তারা চারুকে সাজানো শুরু করবে। এমন সময় ঘরে প্রবেশ করলো টুনির মা। সে সবাইকে বাইরে গিয়ে রান্নার কাজ সামলাতে বলে নিজে চারুর পাশে এসে বসলো।
– কেমন আছস মা? চোখমুখ এমন শুকনা ক্যান?
– আমি ভালো আছি চাচি।
– আমি তো তোর মায়ের মতন। মায়ের কাছে মিথ্যা কস ক্যান? আমি বুঝতাছি বিয়াতে তুই রাজি না। মনোরমা আপা থাকলে তো আর তোর জীবনটা এমন হইতো না। থাক মা, কষ্ট পাইস না। জীবনে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। সহ্য কর, ধৈর্য্য ধর দেখবি ভালা হইবো। জামাই নিয়া মন খারাপ করিস না। জামাই তকদীরে লেখাই থাকে। ওইডা বদলান যায়না। কিন্তু রয়েসয়ে সংসার করবি দেখবি সুখী হবি। দোয়া করি মা, স্বামী সোহাগী হ।
চারু কিছু বললো না। জন্মের পর থেকেই দেখে আসছে এই মহিলা তাকে খুবই স্নেহ করে। তার মাঝেই মায়ের ছায়া দেখতে পারে চারু। সে এতক্ষণ যাবত যা বলে গেলো সবই চারুর ভালোর জন্য। সে উঠে চলে গেলো। পাশে বসে রইলো টুনি। ছোট থেকেই অকারণে মেয়েটা চারুর খুব ভক্ত। বয়স মাত্র সাত বছর। সে কি বুঝতে পারছে চারুর বিয়ে? আচ্ছা বিয়ে মানে কি টুনি বোঝে?
– চারু আপা।
– হুম।
– তোমার বিয়া হইয়া যাইতাছে?
চারু কিছু না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হঠাৎই তার মাথায় আসলো টুনিকে দিয়ে শাওনকে খবর পাঠানো যেতে পারে।
– টুনি আমার একটা কাজ করতে পারবি?
– কি কাম চারু আপা?
– পারবি কি না সেইটা বল।
– তুমি যেইটা কইবা আমি সেইটাই পারমু।
চারুর মুখে একটা স্বস্তির হাসি ফুটে উঠলো। সে খুব দ্রুত একটা কাগজ নিয়ে দুইটা লাইন লিখলো।
– শাওন ভাইকে চিনিস টুনি?
– হ চিনমু না ক্যান? কিন্তু তারে তো দুইদিন ধইরা দেখিনা। পরশু ঈদ তো, তাই তার অনেক কাম এহন।
– শোন, এই কাগজটা রাখ নিয়ে শাওন ভাইয়ের কাছে দিবি। আর কাউকে এই কাগজের কথা বলবি না। শাওন ভাইয়ের সাথে মানুষ থাকলে কিছু একটা বলে তাকে দূরে সরাবি তারপর কাগজটা দিবি। পারবি তো?
– খুব পারমু।
– তাহলে তাড়াতাড়ি যা।
টুনি ছুটে দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেলো। কিছুদূর যেতেই সে তার বন্ধুদের দেখতে পেলো। সবাই একসাথে কানামাছি খেলছে। টুনিকে দেখে তারা টুনিকে ডেকে নিলো। ছোট্ট টুনি খেলার লোভ সামলাতে পারলোনা। কাগজটা কোমড়ে গুজে নিয়ে সবার সাথে কানামাছি খেলায় ব্যস্ত হয়ে গেলো।

সন্ধ্যা সাতটা পাড় হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই, অথচ শাওন এখনো আসেনি। তার তো এতক্ষণে পৌঁছে যাওয়ার কথা। চারু বুঝতে পারছেনা এখনো কেনো শাওন আসছেনা। টুনি ঠিকঠাক মতো শাওনের কাছে কাগজটা পৌঁছাতে পেরেছে তো?
খেলা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই টুনির মনে পড়লো চারু তাকে একটা কাগজ শাওনের কাছে পৌঁছে দিতে বলেছিলো। কাগজটা এখনো তার কমোড়ে গোজা। টুনি খুব জোরে জমিদার বাড়ির দিকে দৌড় লাগালো। শাওনকে দেখা গেলো খুব দ্রুত ছুটে একাজ ওকাজ করছে অপরদিকে চারু যে তার থেকে সারাজীবনের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে সে খেয়াল নেই তার। সৌভাগ্যক্রমে টুনি এসে শাওনকে একাই পেলো।
– কি রে টুনি, এত রাইতে তুই এইহানে? সব ঠিক আছে?
টুনি চারুর দেওয়া কাগজটা শাওনকে দিয়ে দৌড়ে ছুটে পালালো। বাসায় দেরি করে গেলে মা তাকে খুব মারে। শাওন হতভম্ব হয়ে গেলো। এইটা কি হলো? টুনি এভাবে ছুটে পালালো কেনো? সে কাগজটা ফেলে দিতে উদ্বত হলো। কে জানে কিসের কাগজ দিয়ে গেলো টুনি। এখন ওর এইসব হাবিজাবি দেখার মতো সময় নেই। শাওন কাগজটা ফেলে দিয়ে নিজের কাজের কাজের দিকে ফিরে গেলো কিন্তু কি মনে করে আবার পিছনে এসে কাগজটা তুললো সে। কাগজটা ভাজ করা। হাবিজাবি কাগজে ভাজ থাকার কথা না। শাওন কাগজটা খুলতেই দুইলাইন চোখে পড়লো,
” শাওন ভাই আজ রাত আট টায় আমার বিয়ে। তুমি যেভাবে পারো আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও।”
সম্পূর্ণ কাগজে শুধু এই দুই লাইনই লেখা কিন্তু এই দুই লাইন শাওনের অন্তরাত্মা অবধি কাপিয়ে তুলতে যথেষ্ট। শাওন দ্রুত ঘড়ি দেখলো। ৭ঃ৪৪ বাজে। ওর কাছে আর মাত্র ১৬ মিনিট বাকি। শাওন পাগলের মতো হয়ে গেলো। কি করবে কিছুই সে বুঝতে পারছেনা। সে একা এখানে কিছুই করতে পারবেনা। সে দ্রুত ঘরের দিকে ছুটে চললো। টেলিফোনের দিকে এগোতেই দেখলো তার খোলা। টেলিফোনে কোনো সমস্যা হলে তার খুলে রেখে দেয় জমিদার গিন্নি। তার লাগানোর বৃথা চেষ্টা না করে শাওন দ্রুত ছুটে গেলো শিহাবের ঘরের দিকে। কিন্তু সেখানেও কারোর সাথে হাসিমুখে কথা বলছে জমিদার গিন্নি। কাউকে বাসায় ঈদের দাওয়াত দিচ্ছে। শাওন দ্রুত ছুটে মিলির ঘরের দিকে গেলো। সেখানে টেলিফোন থেকে শিহাবের টেলিফোনে ফোন দিলো কিন্তু কেউ ধরলো না। শাওন আরো দুবার চেষ্টা করে তারপর অফিসের টেলিফোনে ফোন করলো। সেখান থেকে জানালো শিহাব কিছু কাজে ঢাকার বাইরে গেছে। ফিরতে ফিরতে সকাল হবে। শাওন আর কিছু ভাবলো না। এখন কিছু ভাবার সময় নেই। খুব দ্রুত ছুটে গেলো চারুর বাড়ির দিকে। শিহাব নিশ্চয়ই এখন ওকে কিছু উপায় বলতে পারতো কিন্তু শাওন এখন সম্পূর্ণ নিরুপায় হয়ে ছুটে চলেছে চারুর বাড়ির দিকে। কে জানে ওখানে গিয়ে কি বলবে শাওন।

চারুকে বসানো হয়েছে জামাল হোসেনের পাশে। কাজিও বিয়ে পড়ানো শুরু করে দিয়েছে। চারু শুধু ভাবছে কি থেকে কি হয়ে গেলো? এইটা কি আসলেই হওয়ার ছিলো? কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করে দিলো। প্রথমে জামাল হোসেনকে কবুল বলতে বলা হলো। সে নিয়ম মেনে পরপর তিনবার কবুল পড়লো। এইবার চারুকে কবুল বলতে বলা হলো। চারু চুপ করে রইলো। আচ্ছা শাওন কেনো এলো না? সে কি জানেনা এখানে কি হবে? চারুর মনে হতে লাগলো এখনই শাওন এসে যাবে আর এই বিয়েটা ভেঙে দেবে। আবার মনে হচ্ছে এখনই হামিদ আসবে আর বলবে এই বিয়ে হবেনা। আবার মনে হচ্ছে শিহাব এসে এখনই শাওনের সাথে ওর বিয়ের প্রস্তাব দেবে কিন্তু এমন কিছুই হলো না। না এলো শাওন, না এলো হামিদ আর না এলো শিহাব। সর্বোচ্চ সময় নেওয়ার পর চারু প্রথমবার বললো কবুল। কাজি আলহামদুলিল্লাহ বলে তাকে আবারও কবুল পড়তে বললো। চারু এখনো একবুক আশা নিয়ে বসে রইলো মনে হচ্ছে এখনই কেউ না কেউ আসবে। এভাবে তার জীবনটা বরবাদ হতে পারেনা। কিন্তু নাহ, কেউ এলো না। বাধ্য হয়েই চারু দ্বিতীয় বার বললো কবুল। এইবার তাকে তৃতীয়বার বলা হলো কবুল বলতে। চারুর বুক ভার হয়ে গেলো। এই এক কবুলে তার জীবন এইবার সম্পূর্ণ বদলে যাবে। শেষবারের মতো একবার দরজার দিকে তাকিয়ে চারু তৃতীয়বারের মতো বললো কবুল।
চারুর তৃতীয় কবুল বলার সাথে সাথে শাওনের আগমন ঘটলো। বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। সবাই মোনাজাত নিচ্ছে। শাওন হতভম্ব হয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে গেলো। হাপাচ্ছে সে। তারই সামনে তার চারু অন্যকারো হয়ে গেলো আর সে কিছুই করতে পারলোনা। বুকটা যেনো ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে তার। মাথাটাও কেমন ঘুরছে। আচ্ছা এইটা কি হলো? শাওন কি মারা যাচ্ছে? শাওন সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো আর তার উপর বেশ বড়সড় একটা কাঠের টুকরো পড়লো। সবাই মনে করলো কাঠের টুকরো পড়ায় শাওন অজ্ঞান হয়ে গেছে। ব্যতিক্রম চারু। সে দেখেছে শাওন আগে অজ্ঞান হয়েছে তারপর কাঠের টুকরো টা তার উপর পড়েছে। চারু দৌড়ে শাওনের কাছে যেতে চাইলো কিন্তু তাকে বাধা দিলো জামাল হোসেন,
– কই যাও তুমি? কাঠের টুকরা পড়ছে তাই অজ্ঞান হইয়া গেছে। সবাই দেখতাছে তারে। তোমার যাইতে হইবো না।
চারুর চোখ থেকে হঠাৎ একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে আর একটু আগে কেনো এলেনা শাওন ভাই? নাকি তুমি আমার ভাগ্যেই ছিলে না তাই বিয়ে শেষ হওয়ার পরেই তুমি আসলে? কেনো আসলে বলো তো শেষ মূহুর্তে? এমনভাবে আসার থেকে তো না আসাই বোধহয় ভালো ছিলো। আমাদের সাথে কেনো এমন ঘটলো বলতে পারো?
শাওনকে কয়েকজন মিলে ধরে জমিদার বাড়ির দিকে নিয়ে গেলো আর চারুকে ভিতরে ঘরের নিয়ে যাওয়া হলো জামাল হোসেন সহ। চারুর পা যেনো চলতে চাইছেনা। শাওনের খবর শোনার জন্য মন তৃষ্ণার্থ হয়ে আছে তার। কোনোমতে গিয়ে খাটের উপর বসলো সে। বিদায়ের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই টুনি তার কাছে ছুটে এলো। চারুর কানে কানে ফিসফিসিয়ে সে বললো,
– চারু আপা জানো কি হইছে? জমিদার বাড়িতে দেখলাম কান্নাকাটি করতাছে সবাই আর শাওন ভাই শুইয়া রইছে। সবাই তারে ধরাধরি কইরা কানতাছে আর গাড়িতে তুলতাছে। অনেককে হাসপাতালের নামও কইতে শুনছি।
টুনি যেভাবে ঝড়ের গতিতে এসেছিলো সেভাবেই চলে গেলো। চারুর বুক কেপে উঠলো। কি হয়েছে শাওনের? তাকে হাসপাতালে কেনো নেওয়া হচ্ছে? হঠাৎই তার কাল শাওনের বলা ওই কথাটি মনে পড়ে গেলো,

“আমি কসম কইরা কইলাম তোর বিয়া অন্য কারোর লগে হইলে আমি বিষ খামু।”

তবে কি সত্যিই শাওন এমন কিছু করে বসলো? করতেও পারে। শাওনকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। তাহলে কি শাওন সত্যিই বিষ খেলো? দুদিন যাবত না খেয়ে আছে চারু তার মধ্যে এতটা চিন্তা নিতে পারলো না সে। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে। জ্ঞান হারানোর আগে অস্পষ্টভাবে বললো, “শাওন ভাই!”

বিঃদ্রঃ ছোট বলে লজ্জা দিবেন না। রাইটিং ব্লকে আছি। আর গল্পের কাহিনি এইবার দ্রুত এগোবে। এখন শুধু আগের ১১ টা পর্বের এত বর্ণনার মূল কারণ জানবেন। রাইটিং ব্লকে আছি বিধায় লেখা কিছুটা খাপছাড়া হয়েছে সেটা এভোয়েড করুন। রিচেক হয়নি। হ্যাপি রিডিং।

#স্নেহা_ইসলাম_প্রিয়া

(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

To Be Continued….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here