আমি সেই চারুলতা পর্বঃ১৩

0
1899

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Ahmed_Priya
#পর্বঃ১৩
_______________________

ঢাকায় ফিরতে ফিরতে সকাল আটটা বেজে গেছে শিহাবের। সারারাত জার্নি করার কারণে প্রচন্ডরকম ক্লান্ত লাগছে তার। ফ্যানের সুইচটা দিতেই সেটা শব্দ করতে করতে ঘুরতে শুরু করলো। এই ফ্যানের আওয়াজে প্রচন্ড অস্বস্তি হয় শিহাবের। সে কোনোমতে জুতাটা খুলেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। শিহাবের মনে হচ্ছে ও বোধহয় বুড়ো হয়ে যাচ্ছে তাই আর আজকাল এত জার্নি তার সহ্য হয়না। পরিশ্রমও খুব একটা করতে পারেনা। খাটের ঠিক পাশেই রয়েছে আয়না। আধশোয়া অবস্থায় থাকা শিহাবকে সম্পূর্ণই দেখা যাচ্ছে সেখানে। শিহাব একবার ভালো করে নিজের দিকে তাকালো। নাহ, খুব একটা বুড়ো হয়নি। মাথার একটা চুলও পাক ধরেনি। চুল না পাকলে কিসের বুড়ো? শার্টটা খুলে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম ঝাকিয়ে ধরলো শিহাবকে কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। টেলিফোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো তার। অর্ধ ঘুমন্ত অবস্থায় টেলিফোন ধরলো শিহাব। জমিদার গিন্নির টেলিফোন। শাওন নাকি অনেকগুলো ঘুমের ঔষধ খেয়েছে। তাকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। জমিদার গিন্নি দ্রুতই শিহাবকে সেখানে যেতে বললো। শিহাবের হাত থেকে টেলিফোন পড়ে গেলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো শাওনের মায়াবী মুখ। মূহুর্তেই যেনো তার কলিজার হাজার টুকরো হয়ে গেলো। শার্ট গায়ে চাপিয়ে দ্রুত ছুটে গেলো হাসপাতালের দিকে।

চারুকে খুবই সাধারণ একটা বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। দুই ঘর বিশিষ্ট টিনের ঘর। রান্নাঘর, বাতরুম সবই দূরে দূরে। দুজন মহিলা ওকে এখানে এসে বসিয়ে দিয়ে গেছে। এরাই নাকি জামাল হোসেনের প্রতিবেশী। পরিবার বলতে তার তেমন কেউ নেই। সে আর তার বন্ধু সবুজ আলী। সবুজ আলী পাশের বাসাতেই থাকে। দুই বন্ধুর মাঝে সচারাচর এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ির যোগাযোগ আছে। কয়েকজন মহিলা এসে দেখে গেছে চারুকে। গল্পের আসল লেখিকা স্নেহা ইসলাম প্রিয়া(শুভ্রা)। তাদের মুখেই শুনেছে জামাল হোসেনের বয়স পয়ত্রিশ কিন্তু তাকে বয়সের তুলনায় বেশ বৃদ্ধ মনে হয়। কই শিহাবও তো ত্রিশ পার করেছে। তাকে তো বৃদ্ধ মনে হয় না। শিহাব আর জামাল হোসেনকে একসাথে দাঁড় করালে সবাই বলবে শিহাব পঁচিশ আর জামাল হোসেন চল্লিশ। কিন্তু সত্যিকারের তাদের বয়সের পার্থক্য মাত্র পাঁচ বছরের। জামাল হোসেন নামক লোকটির ঘরে আসবাব বলতে শুধু একটা খাট, একটা টেবিল আরেকটা আলমারি এবং দুইটা চেয়ার রয়েছে। কিছুক্ষণের মাঝেই ঘরে ঢুকলো জামাল হোসেন। সবাই বলেছিলো ঘরে প্রবেশ করা মাত্র যেনো চারু তাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। চারু সেসবের ধারের কাছেও গেলোনা। ছোট থেকেই ঘারত্যারামি করে আসছে সে এবারেও ব্যতিক্রম নয় কিন্তু জামাল হোসেনের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলো চারু। চোখ গুলো লাল। পা দুটো কিছুটা দুলছে। কাপা কাপা হাতে সে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চারুর সামনে এসে বসলো। চারু তার কাছ থেকে একটা উৎকট গন্ধ পেলো। ওড়না দিয়ে নাক চেপে ধরলো সে। লোকটা কি মাতাল? সে চারুর কাছে এগোতে চাইলেও চারু পিছনে সরে গেলো। এই লোকটাকে কেনো যেনো প্রচুর ভয় লাগছে তার।
– দেখুন, আমার কাছ থেকে দূরে থাকুন। এই বিয়েতে রাজি ছিলাম না আমি। আপনি আমাকে ছেড়ে দিন আমি চলে যাবো।
জামাল হোসেন কথাবার্তার ধারের কাছেও গেলোনা। সে চারুকে ছোয়ায় ব্যস্ত হয়ে গেলো। চারু প্রানপণ নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে চলেছে। কথা বলতে কিন্তু একজন মাতালের সাথে বোধহয় কথা এগোনো যায়না। মাতাল হওয়া শর্তেও যেনো তার শক্তি বিন্দুমাত্র কমেনি। হাজার চেষ্টা করেও চারু তাকে প্রতিহত করতে পারলো না। বাসর ঘর নাকি প্রতিটি মেয়ের জীবনে স্বপ্নের রাত হয় কিন্তু চারুর জীবনে বোধহয় সবচেয়ে নৃসংস রাত ছিলো তার বাসর রাত। এমন বাসর কি আদেও কোনো মেয়ের কাম্য? চারুর জীবনে কি একটু সুখ নেই?

খাটের এককোনে গুটিসুটি মেরে বসে রয়েছে চারু। কিছুটা দুরেই জামাল হোসেন নামক লোকটি বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। চারুর ইচ্ছে হচ্ছে লোকটিকে খুন করে ফেলতে। আচ্ছা এমন হওয়ার কারণ কি? কি পাপ করেছিলো ও? ওর সাথেই কেনো এমন হলো? কেনো ওর এত আকাঙ্ক্ষিত শাওন ওর হলোনা। একেবারে হাতের কাছে পেয়েও কেনো তাকে পেলোনা? একেই বোধহয় ভাগ্য বলে। জন্ম, মৃত্যু আর বিয়ে এই তিনটা সৃষ্টিকর্তা আগে থেকেই লিখে রেখেছেন তাই শাওন ওর এত কাছাকাছি থাকার শর্তেও শাওন বিয়েটা আটকাতে সক্ষম হয়নি। এ কোন পাপের শাস্তি সে পেলো সে? কেনো সৃষ্টিকর্তা এত বড় শাস্তি দিলো তাকে? নিশ্চয়ই মনোরমাকে খুন করার শাস্তি। হ্যাঁ সেটাই হবে। ওই তো পরোক্ষভাবে খুন করেছিলো মনোরমাকে। যদি সেদিন শিহাবকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যেতো তাহলে আজ এমন হতো না। এর শাস্তিই বোধহয় সৃষ্টিকর্তা তাকে দিচ্ছেন। ওকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন, দেখ, শিহাবকে ছেড়ে তুই কত বড় ভুল করেছিস। শাওনকে তুই এমনিও পাবিনা। শিহাবকে বিয়ে করলে অন্তত ভালো একটা স্বামীও পেতি তোর মাও বেঁচে থাকতো। অপরাধবোধ যেনো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে চারুকে। মনোরমার কথা মনে হতেই শব্দ করে কেদে ওঠে চারু। চারুর কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় জামাল হোসেনের।
– কি হইছে? কানতাছো ক্যান?
চারু উত্তর দেয়না। এই ঘৃণ্য লোকটির সাথে কথা বলতেও তার রূচিতে বাধছে। কাল রাতের কথা মনে পড়তেই ইচ্ছে করছে নিজের শরীর টুকরো টুকরো করে কে*টে নদীতে ভাসিয়ে দিতে, বিশেষ করে এই লোকটি যেখানে যেখানে ছুয়েছে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার চারু চাইলেও এই লোকটিকে বাধা দিতে পারবেনা কারণ ধর্মমতে এখন এই লোকটারই চারুর প্রতি অধিকার সবচেয়ে বেশি।
– কথা কও না ক্যান? শুনো অবাধ্য মাইয়া মানুষ একদম পছন্দ করিনা।
– আপনার মতো জঘন্য, ঘৃণ্য আর মাতাল লোককেও আমি পছন্দ করিনা।
জামাল হোসেন অবাক হয়ে চারুর দিকে তাকালো। সে ভাবেওনি চারু মুখের উপর এভাবে কথা বলতে পারে। যখন দেখতে গিয়েছিলো তখন তো একেবারে চুপ করে ছিলো। চারুকে এমন জোর গলায় কথা বলতে দেখে নিজের গলাটা একটু নরম করলেন জামাল হোসেন,
– তুমি কি আমার উপর কোনো কারণে রাগ কইরা আছো বউ?
– বউ ডাকবেন না আমাকে।
– বউরে বউ ডাকমু না তো কি ডাকমু?
চারু উত্তর দেয়না। চুপচাপ হাটুতে মুখ গুজে বসে রইলো। চারুকে এভাবে বসে থাকতে দেখে জামাল হোসেন একটু এগিয়ে এলো তার দিকে।
– কি হইছে তোমার?
– আমি আমার ভাইয়ের কাছে যাবো। আমাকে তার কাছে দিয়ে আসুন। আমি থাকবো না এখানে।
– ক্যান কি হইছে? থাকবা না ক্যান?
– আমি এই বিয়েতে রাজি ছিলাম না তাই আমি চলে যাবো।
– বিয়া তো আল্লাহর হাতে। আমরা কি করতে পারি কও? তুমি কি কাল রাইতের জন্য আমার উপর রাগ কইরা আছো? রাগ কইরো না, আসলে কাল বিয়া ছিলো বইলা সবুজ জোর কইরা আমারে বেশি খাওয়ায়া দিছে। তাই ওমন আচরণ কইরা ফেলছি। তুমি পছন্দ না করলে আর খামু না।
চারু প্রতিউত্তর দিলো না। লোকটা প্রথম প্রথম শক্ত কণ্ঠে কথা বললেও এখন তার গলা নরম হয়ে আসছে। চারু বুঝতে পারছেনা তার কি করা উচিত। কেউ বকাঝকা করলে তার প্রতিউত্তর দেওয়া যায় কিন্তু শান্ত কণ্ঠে কথা বললে তার উপর রাগ ঝাড়া যায়না।
– আমি আমার ভাইয়ের কাছে যাবো।
– কই তোমার ভাই?
চারু উত্তর দেয়না। এই প্রশ্নের উত্তর সে নিজেও জানেনা।
– কাল তো ঈদ। ঈদটা এই বাসায় কাটাও তারপর তোমার বাপের বাসায় বেড়াইতে নিয়া যামু। যতই হোক বিয়ার পর প্রথম ঈদ বইলা কথা। জামাইয়ের বাড়িতেই থাকা উচিত।
চারু উত্তর দেয়না। তার খুব করে জানতে ইচ্ছে করছে শাওন এখন কেমন আছে। কে জানে আর কখনো দেখা হবে কি না ভালোবাসার চাদরে ঢেকে রাখা মানুষটির সাথে।

★★★

জমিদার গিন্নি বিলাপ করে কেদে চলেছে। তারমতে, কাঠের টুকরা শাওনের মাথায় পড়ায় তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে আর সে এতগুলো ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিয়েছে তবে জমিদার গিন্নি বোকা হলেও চারুর বিয়ের আসরে শাওনের অজ্ঞান হওয়া তারপর বাসায় এসে ঘুমের ঔষধ খাওয়া এই দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে কারোরই কোনো সমস্যা হচ্ছেনা। শিহাব এককোনে বিরস মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ডক্টরটি শিহাবের ছোটবেলার বন্ধু তাই শাওনের ব্যাপারে কথা বলতে সে সরাসরি শিহাবকেই তার চেম্বারে ডেকে নিলো।
– শাওন ঠিক আছে তো নাহিদ?
– এখন বিপদমুক্ত। পেট থেকে আমরা ঔষধ ওয়াশ করে দিয়েছি তবে,,
– তবে?
– তবে আমার মনে হয় শাওন কোনোকিছু নিয়ে খুব গভীর শকে আছে। ও কাউকে চিনতে পারছেনা। এমনভাবে চললে ও খুব শীঘ্রই মানষিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে। এখন হয়তো দুই তিনজনকে চিনবে কিন্তু সঠিক চিকিৎসা না হলে সবাইকেই ভুলে যাবে।
শাওনের এমন শকের কারণ শিহাব বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে কিন্তু এই কথাটা ও ওর পরিবারকে এখনই জানাতে ইচ্ছুক না।
– আমার একটা সাহায্য করবি নাহিদ।
– কি সাহায্য?
– বাসার সবার সামনে বলবি ভারি কিছুর আঘাত লাগায় মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে।
– কিন্তু কেনো? শাওনের মাথার চোট এতটাও গভীর নয় এমনকি অজ্ঞান হওয়ার মতো গভীরও নয়। একটাও সেলাই লাগেনি শুধু একটু কেটে গেছে।
– প্রশ্ন করিস না। পরে তোকে সব বুঝিয়ে বলবো। তুই শুধু বাসায় সবার সামনে এই কথাটা বলবি।
শিহাবের কথা মেনে নাহিদ সবাইকে এই কথাটাই বললো। জমিদার গিন্নির বিলাপ আরো বেড়ে গেলো। এত আদরের ছেলে তার, এভাবে সবাইকে ভুলে গেলো? শিহাব কিছু বলছেনা। এক কোনায় দাঁড়িয়ে চোখমুখ শক্ত করে বসে রইলো সে। খুব শীঘ্রই গ্রামে ফিরতে হবে। শাওনের এই অবস্থার জন্য শুধুমাত্র চারুলতা দায়ী। এর জবাবদিহি চারুকে করতেই হবে। কিসের অপরাধে ও শিহাবের কলিজার টুকরো টাকে এভাবে কষ্ট দিলো? কেনো ছাড়লো ওকে?

★★★

পেরিয়ে গেছে দুইদিন। বিয়ের পর এমনিও মেয়ের বাড়ি আসতে হয় তার উপর চারুর জেদে একপ্রকার বাধ্য হয়েই এখানে এসেছে জামাল হোসেন। গ্রামে ঢুকেই সে প্রথম খোজ নিয়েছে হামিদ এসেছে কি না। নাহ, হামিদ আসেনি। চারুর জীবন এভাবে শেষ হয়ে গেলো অথচ হামিদ একবারো এলোনা। মা তো ওকে দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলো তারপরও কেনো এলোনা সে? শাওনের খবরও জানতে ইচ্ছে করছে খুব কিন্তু জামাল হোসেনের সামনে কোনোভাবেই সেই খবর নেওয়া গেলোনা। ইনিয়েবিনিয়ে অনেককেই চারু জিজ্ঞেস করলো, সবার একই উত্তর। সেদিন হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকে শাওন আর কখনো এই গ্রামে আসেনি। বাকিরা সবাই চলে এলেও শাওন আসেনি। বাড়িতে ঢুকতেই অনেক আয়োজন দেখা করলো। অবশ্য শেফালী কোনোটাই করছেনা। টুনির মা, রুবেলের মা, শাপলার মা সবাই মিলেই এইসব করছে। গ্রামে বোধহয় এই এক সুবিধা। কারোর বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হলে প্রতিবেশীরাও বেশ সাহায্য করে। নাজিমুদ্দিন শুধু বাজার করেই সেরেছে। চারুকে দেখে প্রতিবেশীরা একে একে চারুকে জড়িয়ে ধরলো। অবস্থা জিজ্ঞেস করলো। চারু হাসিমুখেই সবার সাথে কথা বললো। ফিরে গেলো নিজের সেই চিরচেনা ঘরে। জামাল হোসেনও পিছুপিছু ভিতরে প্রবেশ করলো।
– এইডা তোমার ঘর?
– হুম।
জামাল হোসেনকে সেখানে রেখে চারু সবার সাথে হাত মিলিয়ে কিছু কাজ করলো। সবাইকে খাবার দাবার দিলো নিজের হাতেই। চারু নিজের কষ্ট কাউকে দেখাতে চাইছেনা। বিশেষ করে শেফালীকে তো একদমই না। চারুর এই হাসিখুশি চেহারা দেখে যেনো গা জ্বলে যাচ্ছে শেফালীর। চারু তাকে জ্বালানোর জন্য ইচ্ছে করে আরো সুখী হওয়ার অভিনয় করলো। বিকেলের দিকে ঘর খালি হলো। মানুষজন কমে এসেছে। নাজিমুদ্দিনও কাজে চলে গিয়েছে। বাসায় শুধু শেফালী, চারু আর জামাল হোসেন আর জামাল হোসেন এখন বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। কিছু মানুষ আছে যাদের ঘুমালে খুবই স্নিগ্ধ, সুন্দর ও পবিত্র লাগে কিন্তু জামাল হোসেন এর ধারের কাছেও যায়না। লোকটা কেমন যেনো হা করে ঘুমায়। অসহ্য লাগে চারুর কাছে।

– বিয়া দিয়াও শান্তি নাই। দুইদিন হইতে না হইতেই জামাই নিয়া হাজির। এতদিন হইয়া গেলো এহোনো কোনোদিন জামাই নিয়া বেড়াইতে যাই নাই আর উনি দুই দিনেই জামাই লইয়া হাজির।
বাড়ি খালি আছে বিধায় শেফালী চারুকে কথাটা শোনাতে ভুল করলো না। হামিদ চলে যাওয়ায় মুখের উপর কথা বলার অভ্যাসটা চারুর গেছে কিন্তু তাকে এবার জবাব দিতে দেখে চমকালো শেফালী।
– আমি তো আর আপন চাচাকে বিয়ে করিনি যে বাসায় যেতে ভয় পাবো। এত জঘন্য রূচি আমার না।
– কি কইলি তুই?
– যা আপনি শুনলেন? নাকি কালা হয়ে গেছেন? গায়ের রঙের মতো মনটাও কুৎসিত।
– তোর সাহস তো কম না মা**। তুই আমার মুখের উপর কথা কস।
– আপনার সাথে কথা বলতে সাহসের কি প্রয়োজন। নারীদের ক্ষেত্রে যদি কাপুরুষ শব্দটা প্রযোজ্য হয় তাহলে আপনি সেই কাতারে পড়বেন। আপনার সাথে কথা বললেও আমার বিবেকে নাড়া দেয়। আমার মন নিজেকে বলে, চারুলতা তুই এত জঘন্য এক মহিলার সাথে কিভাবে কথা বলিস।
শেফালী রাগে চারুর চুলের মুঠি ধরতে আসলো কিন্তু চারু সেই সুযোগ না দিয়ে শেফালীর হাত ধরে ফেললো। নিজেই শেফালীর চুলের মুঠি ধরে আছড়ে ফেললো মেঝেতে। এতদিনে তার প্রচন্ড শান্তি হচ্ছে। শেফালীও অবাক হয়ে চারুকে লক্ষ্য করলো।
– এতদিন থাকার জায়গা ছিলো না তাই বাধ্য হয়েই সব সহ্য করে গেছি কিন্তু আজ আমার একটা আশ্রয় আছে। স্বামী হিসেবে বেশ ভালো একজন মানুষকে পেয়েছি তাই আমার উপর অত্যাচার করবে সেটা ভুলে যাও। টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলবো। ভুলে যেওনা আমার ভাইয়ের কথা। একই রক্ত বইছে আমাদের শরীরে। এখন থেকে সবকিছুর সমান সমান হিসেব হবে।
চারু বেড়িয়ে গেলো বাড়ি থেকে। শেফালীকে জ্বালানোর জন্যই বলেছে জামাল হোসেন ভালো লোক। সত্য বলতে জামাল হোসেনের মধ্যে কোনো ভালো গুণ এখনো অবধি দেখেনি সে। এখন যেই ভালোবাসা আছে সেটাও নিশ্চয়ই নতুন বলে। কিছুদিন পর চাহিদা মিটে গেলে আর ভালোবাসা থাকবেনা। আজ চারদিন পরে সে তার অতি প্রিয় সেই নদীর পাড়ে আসলো। এখানেই হামিদের সাথে ওর শেষবারের মতো দেখা হয়েছিলো।
– বিয়ের পর প্রকৃতির সৌন্দর্য আরো বেশি মনে হয় তাই না?
হঠাৎই কারোর গলার স্বরে চমকে উঠলো চারু। নিজেকে ধাতস্থ করে পেছনোর দিকে তাকানোর পরেই দেখা গেলো শিহাবকে। চারুর মন হঠাৎই খুশি হয়ে গেলো। শিহাব নিশ্চয়ই জানে শাওন কোথায়।

শিহাব অবাক হয়ে চারুকে দেখছে। সালোয়ার কামিজ বাদ দিয়ে মেয়েটা শাড়ি পড়েছে। অনেক বড় বড় মনে হচ্ছে। দুচোখে কাজল, নাকে নাকফুল আর হাতে চুড়ি। সৌন্দর্যের দেবী যেনো চারুর উপর ভর করেছে। গল্পের আসল লেখিকা স্নেহা ইসলাম প্রিয়া(শুভ্রা)। এখন এই চারুলতাকে একদম শিহাবের স্বর্ণলতার মতো লাগছে কিন্তু এই স্বর্ণলতা আজ তার মন কাড়ছেনা। তার জন্য মনে জায়গা নিয়েছে একরাশ ঘৃণা। তারজন্যই শাওনের আজ এ অবস্থা।
– কেমন আছো চারুলতা? অবশ্য বেশ ভালো থাকার কথা। নতুন বিয়ে করেছো।
চারু হতভম্ব হয়ে গেলো। শিহাব ঠিক কি বলতে চাইছে তা বোধগম্য হলোনা তার।
– মানে?
– মানে? মানে কিছুই না। ভালো আছো কি না সেটাই জিজ্ঞেস করলাম। তো তোমার স্বামীর টাকা-পয়সা নিশ্চয়ই খুব বেশি। অন্তত শাওনের চেয়ে নিশ্চয়ই বেশি নইলে তো আর তুমি তাকে বিয়ে করতেনা।
– আমি বুঝতে পারছিনা আপনি কি বলতে চাইছেন।
– বুঝবে কিভাবে? বাচ্চা তো তুমি তাই বোঝো না। ওপস সরি। কিছুদিন পর বাচ্চার মা হবে তোমাকে তো এখন আর বাচ্চা বলা যায়না।
– এসব আপনি কি বলছেন?
– বাদ দাও সেসব। তোমার স্বামী নিশ্চয়ই খুব সুদর্শন। এতটাই সুদর্শন যে শাওনের মুখের এত মায়া ভুলে তুমি তাকে আপন করে নিলে।
– আপনি ভুল করছেন। আমি তো,, আমার কথা বাদ দিন। শাওন ভাই কেমন আছে?
– কেনো? জানতে চাও সে বেঁচে আছে কি না? নাকি বেচে থাকলে মারার ব্যাবস্থা করবে?
– এইসব আপনি কি বলছেন? আমি কেনো তাকে মারবো?
– মারবেনা তবে বাঁচার কোনো উপায়ও রাখো নি। আজ তুমি প্রমান করে দিলে চারুলতা মেয়ে মানেই স্বার্থপর। যেই ছেলেটা এত বছর যাবত তোমাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে গেলো তাকে কি দিলে তুমি তাকে? নতুন জীবনে পা দেওয়ার আগে একবারও শাওনের কথাটা মাথায় আসেনি তোমার? আমার ভাইকে আমি কতটা ভালোবাসি সে ধারণাও তোমার নেই আর আমার সেই ভাই কি না আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলো তোমার জন্য। একটুও মায়া হয়নি আমার ভাইটার জন্য? আমার ভাই যেখানে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছিলো সেখানে তুমি তোমার নতুন জীবন সাজাতে ব্যস্ত ছিলে। কিভাবে এমনটা করতে পারলে চারুলতা? এতটাই পাষাণ তুমি? যদি ওকে ভালোই বাসবেনা তাহলে কেনো স্বপ্ন দেখিয়েছিলে আমার নিষ্পাপ ভাইটাকে?
চারু স্তব্ধ হয়ে গেলো। ওর বিশ্বাস হচ্ছেনা শিহাব এই কথাগুলো বলছে। কোনোকিছু না শুনেই এভাবে বলছে সে।
– কি হলো চুপ করে গেলো কেনো? মনের মাঝে অপরাধবোধ কাজ করেনা? কিভাবে পারলে এমনটা করতে? আমার কি ইচ্ছে করছে জানো? তোমাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। যে আমার ভাইয়ের এই অবস্থার জন্য দায়ী তাকে বাঁচিয়ে রাখতেও আমার কষ্ট হচ্ছে কিন্তু আফসোস তোমাকে আমি খুন করতে পারবো না। ঠকবাজ তুমি হতে পারো আমি নই। আমার ভাইটা কি অবস্থায় আছে ধারণা করতে আরো? একসাথে চল্লিশটা ঘুমের ঔষধ সে খেয়েছিলো কিন্তু দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যাওয়ায় সে বেঁচে গেলো। কি হবে এই বেচে থাকা দিয়ে? আমার চঞ্চল ভাইটা নিমিষে শান্ত হয়ে গেছে। যে ভাইকে দেখলে ও বায়না করতে করতে পাগল হয়ে যেতো সে ভাইকে আজ ও চিনছেনা। শুধুমাত্র একটা কথাই সে বলে, আমাকে আটকে রেখো না। আমার চারুর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আমাকে যেতে দাও। কতটা ভালাবাসলে একটা মানুষ এভাবে মানষিক ভারসাম্যহীন হয়ে যেতে পারে সেই ধারণা রাখো? অভিশাপ দিচ্ছি তোমাকে চারুলতা। তুমি কখনো সুখী হতে পারবেনা। আমার ভাইকে কাদিয়ে সুখী হতে পারবেনা তুমি। তোমার সুখ সহ্য হবেনা। শাওনের প্রতিফোটা চোখের জলের হিসেব তোমাকে দিতেই হবে।
চারু মুচকি হেসে উঠলো। শিহাবের মুখমন্ডল কেমন যেনো লাল হয়ে গেছে।
– আমি সুখে ছিলাম কোনদিন যে আমার সুখ সহ্য হবেনা? মনে আছে আমার জন্মদিনের দিন আপনি আমাকে বলেছিলেন আমার জীবন সুন্দর হোক কিন্তু বিশ্বাস করুন, পনেরো বছর আমার জীবনে অভিসাপ রূপে এসেছে। সেদিন থেকে আজ অবধি আমার জীবনে কখনো সুখ আসেনি। আপনি না আমাকে ভালোবাসতেন? শুনেছি, ভালোবাসার মানুষটির কষ্ট নাকি অপর মানুষটিও অনুভব করে? আপনি তো আমাকে বুঝলেনই না। এ কেমন ভালোবাসা? আমার বিয়ে যার সাথে হয়েছে সে না ধনী আর না সে সুদর্শন। তার বয়স ৩৫ কিন্তু দেখতে মনে হয় বয়স চল্লিশের উপর। হ্যাঁ এমনই এক লোকের সাথে বিয়ে হয়েছে আমার। কি মনে হয় আপনার, আমি শখ করে তাকে বিয়ে করেছি? আমি তো কতবার শাওন ভাইকে ডেকেছিলাম তার ইয়েত্তা নেই কিন্তু সে তো আসলো না। ভালো তো আমি তাকেই বেসেছিলাম। নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে ছেড়ে কে একজন মাতালকে বিয়ে করতে চায়? তার জীবনে আমার প্রয়োজনই শুধু তার শারীরিক চাহিদা মেটানো। কোনো ভালোবাসা নেই তার আমার প্রতি। কি মনে হয় আপনার খুব সুখে আছি আমি? আপনাকে একদিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম না আপনি নিজের আপন ভাতিজিকে বিয়ে করতে পারবেন কি না। কেনো করেছি জানেন? কারণ আমার বাবা বিয়ে করেছিলেন তার আপন ভাতিজিকে। সেই ঘরে আমি ঠিক কতটা সুখী ছিলাম সেটা ধারণা করতে পারেন? আমার আবার সুখ।
শিহাব স্তব্ধ হয়ে গেলো চারুর কথা শুনে। এইটা কি বললো চারুলতা? এইটা কি আদেও সম্ভব? মেয়েটা কি সত্যিই এতটা কষ্টে আছে আর শিহাব কি না বিনাদোষে এই বাচ্চা মেয়েটার উপর এতগুলো অপবাদ দিলো? নিজের ভিতরে পুষে রাখা এতদিনের রাগ গুলো যেনো নিমিষেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। শিহাব চারুকে কিছু বলতেই যাবে তার আগে চারুর ডাগর ডাগর আঁখির অশ্রুজল তার কপোল বেড়ে গড়িয়ে পড়লো। চারু দৌড়ে গেলো বাড়ির দিকে। শিহাবকে সে তার চোখের জল দেখাতে চায়না। কেনো দেখাবে? শিহাব কে তার? ও একবারও চারুর কষ্টগুলো দেখার চেষ্টা করলো না? চারুকে চিৎকার করে থামতে বললো শিহাব। কিন্তু চারু থামলো না। শিহাবও কিছুটা পেছন পেছন গেলো কিন্তু কিছুদূর যেতেই সে থেমে গেলো। এভাবে একটা মেয়ের পেছনে দৌড়াতে দেখলে মানুষ কি ভাববে?
নিজের ভিতরে খুব করে অভিমান খুজে পেলো চারু। অভিমান হচ্ছে হামিদের উপরেও। আর কখনো হামিদকে খুজতে ফিরে আসবেনা ও। হামিদ নিজের কথা রাখেনি। ও ফিরে আসেনি। আসলে নিশ্চয়ই এতদিনে ফিরে আসতো। না আর কখনো সে হামিদের জন্য অপেক্ষা করবেনা। হামিদ কেনো চলে গেলো এভাবে? একবারও কি মনে পড়েনা চারুর কথা?
চারু দৌড়ে গিয়ে নিজের খাটের উপর শুয়ে কান্না করতে শুরু করলো। জামাল হোসেন আগেই সেখানে ছিলো। চারুকে কান্না করতে দেখে ভ্রু কুচকালো সে।
– কি হইলো? কানতাছো ক্যান? কেউ কিছু কইছে? তোমার আম্মায় কিছু কইছে?
চারু উত্তর দেয়না। এই লোকটাকে অসহ্য লাগে তার। কিচ্ছু ভালো লাগেনা। মরে যেতে ইচ্ছে করে শুধু।
– কি হইছে বউ? আমারে কও। কেউ কি তোমারে কিছু কইছে? আহো আমরা আইজই চইলা যামু। যেইখানে আমার বউরে কান্না করতে হয় আমি ওইহানে থাকমু না।
জামাল হোসেন বাচ্চাদের মতো করে চারুর কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। চারু সিদ্ধান্ত নিলো জামাল হোসেনের সাথেই দূরে চলে যাবে সে। আর আসবেনা এখানে। হামিদের জন্যেও না আর শিহাবের জন্যও না। সুযোগ হলে একবার শাওনকে দেখবে শুধু। তাও দূর থেকে। জামাল হোসেন হয়তো একটু হলেও ভালোবাসে তাকে। তার সাথেই নাহয় নিজেকে মানিয়ে নেবো। এমনিতেও তো তার জীবনের কোনো উদ্দেশ্য নেই কিন্তু চারু জানলোও না জামাল হোসেনের যেটুকু ভালোবাসা ও দেখছে সবটাই অভিনয় এমনকি জামাল হোসেনের প্রথমপক্ষের একজন বউও রয়েছে। সেই তার জীবনের একমাত্র নারী নয়। এত বড় সত্য জানার পর কেমন অবস্থা হবে চারুর?

বিঃদ্রঃ নিজের বন্ধুদের পেইজ লাইক দিতে ইনভাইট করুন। যেহেতু পেইজে একজন একজন করে ইনভাইট করতে হয় না তাই এটা আপনাদের জন্য বেশ সহজ এবং আমিও লেখার উৎসাহ পাবো। ধন্যবাদ, হ্যাপি রিডিং।

#স্নেহা_ইসলাম_প্রিয়া

(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

To Be Continued….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here