আমি সেই চারুলতা পর্ব-৩৯

0
1813

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
#পর্বঃ৩৮(বর্ধিতাংশ)
_______________________

– গ্রামটা কি এহনো আগের মতো আছে নাকি রে চারু? এহনও এমন থাকলে মনে হয় মানায়া নিতে পারমু না। এতদিনে অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটছে।
চারু হামিদের কথার কোনো উত্তর দিলো না। হামিদ অনেকক্ষণ যাবত চেষ্টা করছে চারুর সাথে কথা বলার কিন্তু চারু এমনভাবে ওকে এড়িয়ে চলছে যেনো হামিদ বলে কেউ নেই। খুব বেশি হলে শুধু হু হা করে জবাব দিচ্ছে।
– চারু!
– কি চাই তোমার? বিরক্ত করছো কেনো আমাকে?
– তুই আমার সাথে কথা বলতাছস না ক্যান?
– তুমি আশা রাখো আমি তোমার সাথে কথা বলবো?
– ক্যান বলবি না? আমি কি করছি? আমি যা করছি সব তো তোর জন্যই করছি।
– আমার বিশ্বাস ভেঙেছো তুমি। বিশ্বাস গড়াটা অনেক কঠিন কাজ। অনেকটা সময় লাগে কিন্তু ভেঙে যাওয়াটা কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার।
– আমি তোর ভালো চাই, এইটাই কি আমার দোষ?
– আমার কাছে এত কিছু লুকিয়ে যাওয়া তোমার দোষ। তুমি চাইলে আজ আমার জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো।
– আমি তোর জীবনডা পরিবর্তন করতে চাইছি। সুস্থ পরিবর্তন! তহন রাগের মাথায় তোর সাথে মি’লা এতগুলা খু*ন করছি। কিন্তু রাগ ঠান্ডা হইয়া আসার পর বুঝছি এইটা ঠিক হয় নাই। অবশ্য তাদের খু*ন না করলে হয়তো আমি শান্ত হইতাম না। কিন্তু চারু দেখ, যা হওয়ার হইছে। তুই কি একবার নিজের জীবনটা গুছায়া নিতে পারস না?
– না পারিনা। আমার অপরাধীদের আমি শাস্তি না দিয়ে শান্ত হবোনা। তারা শুধু আমার শান্ত জীবনটা এলোমেলো করে দেয়নি বরং আমার আশেপাশে থাকা সবার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে। তারা আমার মা-কে খু*ন করেছে। শাওন ভাইকে খু*ন করেছে। চারুলতার জীবন্ত হত্যার দায়ও তাদের। শিহাব আজও সঙ্গীহীন তাদেরই জন্য। তারা যদি প্ল্যান মাফিক আমার আর শিহাবের পরিচয় না ঘটাতো তবে আজ সে সুন্দর এক জীবন কাটাতো। নানু বাড়ির কেউ আজও জানেনা মা আর নেই। আদরের মেয়েকে তারা হারিয়েছে ওদেরই কারণে। কে জানে আর কত কত মানুষের দীর্ঘশ্বাস আর কষ্টের কারণ তারা!
– ও বাড়িতে চিঠি পাঠাইছিলাম। উত্তর আসছে কালকে। তোরে জানানো হয় নাই।
– কি উত্তর এসেছে?
– নানাজানের অবস্থা আসলেই ভালা না। মৃ*ত্যুর দুয়ারে মনে হয় পৌছায়া গেছে। মরার আগে একবার মায়েরে দেখতে চায়। ভাবতাছি আর চিঠি লিখমু না। কি উত্তর লিখমু? লেখারও কিছু নাই।
চারু আর উত্তর দিলো না। হামিদ কয়েকবার চেষ্টা করেও চারুকে দিয়ে আর কিছু বলাতে পারলো না। হামিদ জানে চারু তার উপর রেগে নেই তবে বড্ড অভিমান! অভিমান তো কেবল ভালোবাসার মানুষদের সাথেই করা যায়। যার-তার সাথে অভিমান করা যায়না। চারু হামিদকে মন থেকে নিয়ে আসতে চায়নি তবে চারুর মনে পড়লো সেদিন মনোরমার বলা কথাটি। কোনো অবস্থাতেই হামিদকে অবিশ্বাস করতে বারন করেছিলো সে। মনোরমার কথাতেই মূলত চারু হামিদকে নিতে রাজি হয়েছে। সিফাত আর হিমেলও একপ্রকার চারুর অনুমতি ছাড়াই তার সাথে চলে গেছে। সিফাতের সাথে পুতুল আর হামিদের সাথে ফাতেমা আর লতা। সিফাতের ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যাবহার করেই তারা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে।
– আমরা কোথায় যাচ্ছি মা?
পুতুলের ডাকে চারুর ভাবনার ঘোর কাটে। চারু শূন্য দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে পুতুলকে। পৃথিবীতে এই মেয়েটাই সম্ভবত একমাত্র মানুষ যে একমুহূর্তের জন্যেও ধোকা দেয়নি চারুকে। চারুর হঠাৎ আরো একটা কথা মনে পড়লো। মনোরমা বলেছিলো, একটা এতিম মেয়েকে বড় করার দায়িত্ব তার। তবে কি সেই মেয়েটা পুতুল? হতেও পারে। পুতুলের বাবা সাজিদ তো আর নেই। সিফাত রয়েছে সাজিদের পরিচয়ে। আর পুতুলের তো মা থেকেও নেই। যার মা-বাবা কোনোটাই নেই, সে তো এতিমই। তবে কি সেদিন পুতুলের কথাই মনোরমা বলেছিলো?
– ও মা! বলো না আমরা কোথায় যাচ্ছি?
– গ্রামে যাচ্ছি মা।
– গ্রামে কেনো যাচ্ছি?
– ঘুরতে যাচ্ছি।
পুতুল আর কথা বাড়ালো না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো সে।

চারুরা যখন গ্রামে পৌছালো তখন ভরদুপুর। সূর্য মাথার উপরে। হেমন্তকাল সন্নিকটে। ধান পাকতে শুরু করেছে। কৃষকেরা সে ধান কাটার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে। ফসলি ক্ষেতে কাকতাড়ুয়া মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তবে আজকাল কাকেরা খুব বেশি বুদ্ধিমান হয়ে গেছে। তারা আর কাকতাড়ুয়া ভয় পায়না বরং নিজেই কাকতাড়ুয়ার উপর বসে খানিকক্ষণ জিড়িয়ে নেয়। অবশ্য পাখিদের মাঝে কাকই সবচেয়ে বুদ্ধিমান। প্রায় আধঘন্টা পথ পায়ে হেটে তারা বাড়িতে পৌছালো। গ্রামের এই আঁকাবাকা রাস্তায় হঠাৎই সিফাতের গাড়ির টায়ার পাংচার হয়ে যাওয়ায় এই দুরবস্থা! হামিদ হাটতে হাটতে একপ্রকার বিরক্ত হয়ে গেছে। এই গ্রামে আজও কোনো উন্নত প্রযুক্তি দেখা পাওয়া যাচ্ছেনা। গাড়ি তো দূর একটা গরুর গাড়িও পাওয়া যাচ্ছেনা। অথচ আগে এই গ্রামেই হামিদ ঘন্টার পর ঘন্টা দৌড়াদৌড়ি করেও ক্লান্ত হতোনা। শহরের হাওয়া গায়ে লেগে এই অবস্থা।
– চারু!
চারু ডাকটা শুনলেও প্রতিউত্তর করলোনা। হামিদ অবশ্য এতে কিছু মনে করলো না।
– চারু গ্রামে কি এহনো বিদুৎ আসে নাই? গরমে ক্যামনে থাকমু?
– আগে কিভাবে থাকতে?
– আগে তো অভ্যাস হইয়া গেছিলো। ছয় বছর পার হইলো এহনো বিদুৎ আসে নাই?
– জানি না। আসতেও পারে। বাসায় গিয়েই জানা যাবে।
– হাটতে হাটতে তো পা ব্যাথা হইয়া যাইতাছে। বাচ্চা দুইটারও কত কষ্ট হইতাছে দেখ।
– ঢং কমিয়ে করো। বাচ্চারা দুজনেই কোলে আছে। মাত্র আধাঘন্টা হেটেই এই অবস্থা। পেটের ভুড়িও বেড়েছে। হাটাহাটি না করলে যা হয়।
– আমি তো তাও হাটতাছি, হিমেল আর সিফাত ভাইয়েরে দেখ। তারা এহনো কত পিছনে। ফাতেমা গ্রামের মাইয়া বইলা তাল মিলাইতে পারতাছে।
– ভাবির গ্রাম কোথায়?
– জানিনা। শহরে যাওনের পর পরিচয় হইছে আমাদের। তোরে কইছিলাম না?
চারু উত্তর দেয়না। আরো দশ মিনিটের মতো হেটে সকলেই বাড়ি পৌছালো। বাড়ির অবস্থা যাচ্ছেতাই। কে জানে কতদিন যাবত এখানে কেউ প্রবেশ করেনা!

★★★

অভির সামনে পড়ে আছে মিলিকে কিডন্যাপ করতে যাওয়া লোক দুটির লা’শ। এদের উপরই চারুকে নজরে রাখার দায়িত্ব ছিলো। অভি এত কষ্ট করে একেকটা প্ল্যান করে আর এই গর্দভ দুটো সব প্ল্যান ভেস্তে দেয়। অভি রাগ সামলাতে না পেরে গু*লি করে দিয়েছে দুজনকেই।
– স্মৃতি!
– বলো।
– মেক আপ বাদ দিয়ে এদের লা’শ সরাও। আর এদের দুজনের বাড়িতে এক লাখ করে টাকা সহ লা’শটা পাঠিয়ে দাও।
– টাকা কেনো?
– এরা এদের পরিবারের একমাত্র আর্নিং মেম্বার।
– তাতে তোমার কি? লা*শ গুম করে দেবো কেউ খুজেও পাবেনা। শুধু শুধু বাড়িতে লা*শ পাঠিয়ে, টাকা দিয়ে ঝামেলা করার কি মানে?
– আমি ব্যাখা দিতে পছন্দ করিনা স্মৃতি। যতটুকু করতে বলছি ততটুকু করো। ভুলে যেওনা তুমি শুধুই আমার একজন ওয়ার্কার। অন্য পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই। তোমাকে আমি বিশেষ জায়গা দিয়েছি বলে এই না যে তুমি আমার কাজে হস্তক্ষেপ করবে।
– আমি কি সত্যিই বিশেষ নই অভি?
– না। তুমি শুধুমাত্র আমার একজন ভালো বন্ধুতে পরিণত হয়েছো ঠিকই কিন্তু নিজের সীমা অতিক্রমের চেষ্টা করো না।
– বুঝেছি।
স্মৃতি মুখ কালো করে বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে। অভির হঠাৎই কেনো যেনো মনে হলো, এই মেয়েটা সাধারণ নয়। একটু বিশেষত্ব আছে তার মাঝে।

– কোথায় আছো তুমি?
– সেটা জেনে আপনার কি কাজ? কেনো ফোন করেছেন সেইটা বলুন।
– তুমি দিন দিন অভদ্রতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যাচ্ছো। ভুলে যেও না আমি তোমার বাবা।
– আপনি আমার বাবা নন। আপনিও জানেন আর আমিও জানি। তাই আমার কাছে ভদ্রতা আশা করবেন না। আপনিই তো বলেন আমি পৃথিবীর জঘন্যতম মানুষদের মধ্যে একজন তবে আমার কাছে আপনি ভদ্রতা আশা করেন কোন যুক্তিতে?
– বাজে কথা বলোনা। তুমি আমারই ছেলে। আমার রক্ত তোমার শরীরে বইছে।
– আপনার রক্ত আমার শরীরে আছেন মানেই আপনি আমার বাবা হয়ে যাননি। আমার না আছে কোনো বাবা, না আছে মা। আমি শুধুই এক,,
অভির গলা ধরে আসে। প্রচন্ড অভিমান তার ভেতর। ফোন কেটে দিয়ে নিজেকে সামলে নিলো দ্রুত। শপিং মলে ঢুকতেই রাজ্যের মানুষজন চোখে পড়লো তার। মিলির জন্য একটা শাড়ি কেনা প্রয়োজন। মেয়েটা প্রচন্ড রেগে আছে। যতদিন ও আছে ততদিন ওকে কাজে লাগাতে হবে। শাড়ির দোকানে গিয়ে খুব সহজেই শাড়ি পছন্দ করে নিলো অভি। মিলির পছন্দ সম্পর্কে সে অবগত৷ শাড়ি কিনে বাড়ি ফিরে যাবে এমন সময়েই অভি একটা জায়গায় বেশ ছোটখাটো জটলা দেখতে পেলো৷ ভীড় ঠেলে সামনে যেতেই দেখতে পেলো একটা বাচ্চা মেয়ে খেলার ছলে গাছের মগডালে উঠেছিলো কিন্তু এখন সে নামতে পারছেনা। গাছটার ঢালও খুব সরু। বড় কেউ উঠতে গেলেই সেটা ভেঙে যাবে। বাচ্চাটা সমানে কেদে যাচ্ছে নীচে নামার জন্য কিন্তু তার সাহসে কুলাচ্ছে না। অভি একবার নিজের দিকে তাকালো। বয়স এইবার ২৫ হলো তার। দেখতেও হ্যাংলা পাতলা। ওজন মাত্র ৫৯ কেজি। ৫.১১ উচ্চতার এই ছেলের জন্য তার ওজন যথেষ্ট কম। কিন্তু তাও এই ওজন নিয়ে গাছের মগডালে ওঠা সম্ভব না৷ জায়গাটা ঢাকা জেলার হলেও উপজেলার ভেতর পড়েছে। মফস্বল এলাকা। মেয়েটির বাবা-মায়ের কান্না দেখে অভির হঠাৎই বেশ মায়া লাগলো। অভি তখনই একটা নীল রঙের বড় প্লাস্টিক জোগাড় করে কিছু লোক দিয়ে সেটা ধরিয়ে রাখলো আর নিজে সাবধানে উঠে গেলো গাছের বেশ উপরের একটা ডালে।
– এসো আমার কাছে এসো। আমি তোমাকে নীচে নিয়ে যাচ্ছি।
– কে তুমি? আমি যাবোনা তোমার কাছে। আমি পড়ে যাবো।
– পড়বে কেনো? আমি আছি না? হাত দাও নিজের।
– যদি পড়ে যাই?
– পড়বেনা।
– তুমি বাঁচাবে আমাকে?
অভি মাথা নাড়লো। মেয়েটি একটু আস্বস্ত হয়ে অভির দিকে হাত বাড়ালো৷ অভির মগডালে উঠতে হলোনা। নীচে বেছানো প্লাষ্টিকটাও আর কাজে লাগলো না। সে সাবধানে বাচ্চাটাকে নীচে নামিয়ে আনতেই সকলের মাঝে একপ্রকার হুড়োহুড়ি লেগে গেলো। এতক্ষণ কান্নাকাটি করা বাচ্চাটির মা দৌড়ে এসে বাচ্চাটাকে বুকে টেনে নিলো।
– আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেবো। আপনি মানুষ না সাক্ষাৎ ফেরেশতা হয়ে এখানে এসেছিলেন। আল্লাহ আপনার ভালো করুন। দুনিয়ায় এখনো ভালো লোক বেঁচে আছে আপনিই তার উদাহরণ।
অভি বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো। এই প্রথম কেউ তাকে দোয়া করলো। তাকে ফেরেশতার সাথে তুলনা করলো কিন্তু সে পৃথিবীর জঘন্যতম মানুষ। বাবা বলেছিলো, অভিই পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ। শিশুরা জন্ম নেয় পবিত্রতার সাথে কিন্তু অভির জন্মই হয়েছিলো খুনি হিসেবে। সারাজীবন সকলের কাছে জেনে এসেছে সে খারাপ। সে নিজেও জানে সে খারাপ। তবে সে যদি খারাপ হয়েই থাকে তবে এই মেয়েটিকে কেনো বাঁচালো৷ মহিলাটি বারবার অভির প্রশংসা করলে অভি স্পষ্ট বলে দিলো,
– না আমি ভালো মানুষ নই। হতে পারিনা। আমি এই পৃথিবীর জঘন্যতম মানুষ আর আমি সেভাবেই থাকতে চাই।
উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো অভির দিকে।

★★★

চারু আর ফাতেমা মিলে সম্পূর্ণ বাড়ি পরিষ্কার করে ফেলেছে। তবে সমস্যা হয়েছিলো থাকার জায়গা নিয়ে। ঘরে মাত্র দুটো ঘর। একটায় চারু আর সিফাত, অন্যটায় হামিদ আর ফাতেমা। বাচ্চারা নাহয় ওদের সাথেই থাকলো কিন্তু হিমেল কোথায় থাকবে? ধান রাখার জন্য ওদের একটা ঘর ছিলো৷ সেটা কিছুটা দূরে। চারু ওটাকেও কোনোমতে পরিষ্কার করে হামিদের পুরোনো চৌকিটা সেখানে পৌঁছে দিয়েছে। ইতিমধ্যে ওদের গ্রামে আসার কথা সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। সকলেই দেখতে আসছে তাদের৷ সিফাতকে চারুর স্বামী হিসেবে পরিচয় করানো হলো। জামাল হোসেনের মৃ*ত্যুর পর হামিদই বিয়ে দিয়েছে চারুকে৷ মুখে মুখে সিফাতের গুনগান চলছে। অনেকে আবার হিংসেয় মুখ বাকিয়ে বলছে, পোলার এত বড় মাইয়া আছে দেইখাই গ্রামের মাইয়া বিয়া করতে রাজি হইছে। চারু কারোর কোনো কথাই গায়ে মাখলো না। হিমেলকে বলা হয়েছে সাজিদের ভাই। হামিদের বউ দেখে আফসোসের সীমা নেই কারোরই। এমন সুন্দর ছেলের বউ কি না এই কালো মেয়ে। চারুর অনুপুস্থিতিতে দু-একজন তো মুখের উপর বলেও দিলো। স্বাভাবিক ভাবেই এতে হামিদের মন নষ্ট হয়ে গেলো। মুখে কিছু না বলেও ফাতেমার প্রতি রূঢ় ব্যাবহার করা শুরু করলো সে। অবশ্য চারুর সামনে খুব বেশিক্ষণ সেটা স্থায়ী হলো না।

শাপলার মা ভাত দিয়ে গেছে আজ। এতদিন পর গ্রামে ফিরে আসায় কেউই আর রান্না করতে দেয়নি। টুনির মা তো আগেই বলে রেখেছে রাতে সে সবাইকে রান্না করে খাওয়াবে। দু-একজন পুরোনো বন্ধুর দৌলতে হামিদ জানতে পেরেছে গত বছরই গ্রামে বিদুৎ এসেছে। অবশ্য বিদ্যুৎ শুধু দিনেই থাকে। রাত হলে তার আর কোনো খবর পাওয়া যায়না। ঝড় বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। আল্লাহর নাম নিয়ে সেই যে যায়, দু-তিন দিনে আর আসার নাম নেয় না। তাও হামিদ ঠিক করেছে কালই বিদ্যুতের লাইন টেনে আনবে। হামিদ অবাক হয়ে লক্ষ্য করে গ্রামে আজও পাঁচ টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়ে এই প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত যাওয়া যায় আর গ্রামের মানুষ আজও কিপটেমি করে হেটেই মাইলের পর মাইল পার করে। হামিদের আসার কথা শুনে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলো বিন্দিয়া।
ছুটে এসেছিলো সে৷ পুতুল আর লতা বাদে সকলেই এ-কাজ ওকাজ করছিলো। বিন্দিয়া যখন আসে হামিদ আর চারু তখন রান্নাঘর পরিষ্কারে ব্যস্ত ছিলো। হামিদকে দেখেই তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। কোনো এক অজানা কারণে চারু সহজেই সেটা বুঝতে পেলো। বিন্দিয়ার বয়স এখন চারুর প্রায় সমান। এখনো বিয়ে করেনি সে। গ্রামে এই বয়সে বিয়ে করেনি মানে অনেক কিছু। সে সম্ভবত অপেক্ষা করছিলো হামিদের জন্য। কিন্তু হামিদ কখনোই তাকে কোনো কথা দেয়নি। হামিদের জন্য তার অপেক্ষাটা কতটা যুক্তিযুক্ত ছিলো? সম্ভবত একেবারেই না। চারুর সাথে কথা বলে বিন্দিয়া এগিয়ে গেলো হামিদের দিকে।
– কেমন আছেন হামিদ ভাই? আমারে চিনতে পারছেন?
হামিদ ভ্রুকুচকে মনে করার চেষ্টা করছে বিন্দিয়াকে সে ঠিক কোথায় দেখছে। হঠাৎই তার মনে এলো বিন্দিয়াই চারুর সম্পর্কে হামিদকে বলেছিলো।
– হ্যাঁ হ্যাঁ চিনতে পারছি। আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
– আমিও ভালো আছি।
বিন্দিয়া ভেবেছিলো হামিদ কথা এগোবে কিন্তু কথা না এগিয়ে হামিদ চুলোয় মাটির প্রলেপ দেওয়ার কাজ শুরু করে দিলো। গ্যাস আসেনি এখনো গ্রামে। এই অজপারা গায়ে গ্যাস আসার কথাও না। মাটির উনুন দিয়েই কাজ চালাতে হবে। বিন্দিয়ার যেনো এই মাটি মাখা হাতেই হামিদকে ভালো লাগছে। অবশেষে তার এত বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটলো। হামিদ কি জানে, ও এতো বছর যাবত শুধুই তার জন্য অপেক্ষা করেছে। হঠাৎই একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজে হামিদ দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো রান্নাঘর থেকে। বিন্দিয়াও আর পিছু পিছু বের হলো। চারু অবশ্য কিছুই বললোনা। মেয়ের প্রতি হামিদের ভালোবাসা দেখলে এমনিই সরে যাবে বিন্দিয়া। তবে বান্ধবীর জন্য বেশ খারাপ লাগছে তার। হামিদ গিয়ে দেখলো ফাতেমা লতাকে বারবার শান্ত করার চেষ্টা করলেও লতা শান্ত হচ্ছেনা। হামিদকে দেখে আবারও ঠোঁট ফুলিয়ে কেদে উঠলো সে। বাবার কাছে কত অভিমান তার। কোলে আসার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো লতা,
– আমার হাতে তো কাদা মাখা। তোমার শরীরেও লাইগ্যা যাইবো মা। তুমি মায়ের কাছে থাকো!
লতা মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। সে মায়ের কাছে থাকবেনা। হামিদের ঠোঁটে সুক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে এলো। মেয়েটা তার প্রচন্ড আহ্লাদী হয়েছে। বাবা ছাড়া কিছুই বোঝেনা। মায়ের বিরুদ্ধে কত নালিশ তার বাবার কাছে। হামিদ হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিলো লতাকে।
– এই বাচ্চাটা কার হামিদ ভাই? একেবারে চারুর মতো দেহা যায়। এইটাই কি চারুর মাইয়া?
– না, ও লতা। আমার আদরের একমাত্র মাইয়া। দেখতে একদম চারুর মতো। তাই না কও?
বিন্দিয়া বেশ জোরে একটা ধাক্কা খেলো।
– ও আপনার মাইয়া?
– হুম। ওইযে তোমার ভাবি।
ফাতেমা মুচকি হাসলো। বিন্দিয়ার মাথায় বাজ পড়লেও হয়তো সে এতটা চমকাতো না। গ্রামের সবাই বলাবলি করছিলো কালো বউ, কিন্তু বিন্দিয়া হামিদের আসার খবরে এতটাই খুশি ছিলো যে কার বউ সেটা জানার প্রয়োজন বোধ সে করেনি। কান্না আটকাতে না পেরে দৌড়ে উঠোন থেকে বেড়িয়ে গেলো সে। ফাতেমা অবাক হয়ে বললো,
– ওর আবার কি হইলো?

★★★

বসন্তের মাঝামাঝি সময়ে শিহাব আর সুহাসিনীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। কাছের আত্মীয় স্বজনরা সবাই জেনে গেছে। বাড়ির সকলেই বেশ খুশি। সুহাসিনীও প্রচন্ড খুশি তবে খুশি হতে পারেনা শিহাব। একেধারে অনেককিছু মাথায় ঘুরতে থাকে তার। সবচেয়ে বেশি মাথায় যন্ত্রণা দিচ্ছে চারুলতা আর অভি। তার জীবনে চারুলতার জায়গা সে অন্যকাউকে দেওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারেনা। মাথায় প্রচুর চাপ পড়ছে তার উপর অভি। মিলি যে কতটা কষ্ট পেয়ে শিহাবকে সব বলেছে তা সে অনুমান করতে পারে কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়। মিলি কেনো অভির সাথে শিহাবের দেখা করালো না? কি এমন হয়ে যেতো ওর সাথে দেখা করালে? মিলি কি কিছু লুকাচ্ছে?
– শিহাব!
সুহাসিনীর ডাকে পেছনে ফিরে তাকায় সে। সুহাসিনী শাড়ি পড়েছে। অতিরিক্ত রকমের সুন্দর হলে কাউকে যেমন লাগে, সুহাসিনীকেও তেমনই সুন্দর বলা চলে। এক দেখায় চোখে পড়ার মতো মেয়ে সে। তবে স্বর্ণলতা শিহাবের মনে যে দাগ কেটেছে, সুহাসিনীর সৌন্দর্য সে দাগ মুছতে ব্যর্থ। হবে নাই বা কেনো, শিহাব তো শুধু চারুলতার রূপটাকে ভালোবাসেনি। তার প্রতিবাদী মনোভাব, বাচ্চামো, নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা, রাগ, জেদ, ভালোবাসা, সরলতা সবকিছুতেই মুগ্ধ হয়েছে। ভালোবেসেছে। এত সহজে কি পাঁচটা বছরের মায়া কাটানো যায়?
– শিহাব শুনছেন?
– হ্যাঁ শুনছি, বলো।
– আমাদের বিয়ে কিন্তু বসন্তে ঠিক করা হয়েছে। জানেন তো?
– হুম জানি।
শিহাব মুচকি হাসে। ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসে একবুক দীর্ঘশ্বাস। আবারও এক বসন্ত! শিহাব নিজ মনে নিজেকেই বললো নিজের ভিতরের কথাগুলো,
বসন্ত আমাদের জীবনে চমৎকার ভূমিকা পালন করছে তাই না স্বর্ণলতা? সেদিন এক বিবর্ণ বসন্তে তুমি অন্য কারোর হয়েছিলে, আজ আরেক বিবর্ণ বসন্তে আমি অন্যকারো হওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম।
আমার কাছে বসন্ত মানেই বিচ্ছেদ।
বিচ্ছেদ মানেই তুমি।
তুমি মানেই আমার ভালোবাসা।

_______________________

To Be Continued…
®শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here